তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও নাগিনী
– রহস্যময় জৈব প্রবৃত্তির স্বরূপ উন্মোচন
উনিশ শতকের শিল্প সাহিত্য মানবমহিমার যে মূল্যবোধকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল বিশ শতকের নানা রাজনৈতিক ঘটনা, মূল্যবোধজনিত পরিবর্তন, ফ্রয়েড – ইয়ং এর মনোবিশ্লেষণ, সমাজবাস্তবতা, সাম্যবাদী চেতনা প্রভৃতির প্রতিঘাতে তিরিশের শতকে বাংলা কথাসাহিত্যের পালাবদল ঘটল। দেশ কাল ও তত্ত্বের এই প্রেক্ষিতে জীবন রসের শিল্পীরূপে বাংলা কথাসাহিত্যের আসরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব। তিনি অনেকাংশে কল্লোলকেন্দ্রিক চেতনাকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্যমুখীনতাকে অস্বীকার না করে নিজস্ব দৈশিক সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক পারিপার্শ্বিককেও তার রূপান্তরের কাহিনিকে উপন্যাসে ও ছোটগল্পে রূপায়িত করেছেন।
আলোচ্য 'নারী ও নাগিনী' গল্পটির প্রথম প্রকাশ শারদীয় দেশ পত্রিকায়, ১৩৪০ বঙ্গাব্দে। রাঢ় বাংলার ব্রাত্যসমাজের মানবজীবনের আদিম কামনা-বাসনার বাস্তব রূপকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের এই রহস্যময় জৈব প্রবৃত্তি তাঁর বিভিন্ন গল্পের মুখ্য বিষয় - 'তারিণী মাঝি', 'কালাপাহাড়', 'অগ্রদানী', 'নারী ও নাগিনী', তবে পটভূমি ভিন্ন।
‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে ব্রাত্য সমাজভূক্ত খোঁড়া শেখের প্রবৃত্তি তাড়িত তীব্র যৌনসক্তিজনিত আচার আচরণ এবং তার ভয়ঙ্কর পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। মনুষ্য ও মনুষ্যেতর প্রাণীর আত্মিক মেলবন্ধন নিয়ে লেখা এক গল্প। গল্পে খোঁড়া শেখ “সাপের ওঝা। শুধু ওঝা নয়, সাপ লইয়া খেলাও সে করে।” একটা ছোট উদয়নাগকে কেন্দ্র করে খোঁড়ার দাম্পত্য জীবনে রীতিমতো রহস্যময়তার সৃষ্টি। সে সাপিনীর নাকে মিনি পরায়, শিরে সিঁদুর লাগিয়ে তাকে নিকে করে আদর করে, জোবেদার সতীন বলে পরিচয় করিয়ে দেয়, চুম্বন করে। নাগিনীকে কেন্দ্র করে মানবীর বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বলে খোঁড়া শুধু সকৌতুকে হাসে। নাগিনীর আসঙ্গলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য তাকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে এলেও কোনো এক দূর্বোধ্য মায়ায় সে খোঁড়ার বাড়িতে ফিরে আসে। তাকে দেখে জোবেদা ঘুঁটে ছুঁড়ে মারলে রাতের অন্ধকারে জোবেদাকে সে দংশন করে। আর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অসামান্য শিল্পকৌশলে গল্পটির সমাপ্তি টানেন খোঁড়ার কথায় –
“শুধু তোর দোষ কি, মেয়ে জাতের স্বভাবই ঐ। জোবেদাও তোকে দেখতে পারত না।”
বিশ্বসৃষ্টির আদিম জীবন স্পন্দন এক নতুন সুরে ধ্বনিত হয়েছে। গল্পটির মূল আবেদন জৈবিক, প্রবৃত্তিগত জীবন রহস্যকে আদিমতায় অবনত করে মানুষ ও পশুর প্রভেদের মূল্যায়ণ করেছেন। অরণ্য প্রকৃতির রহস্য ও প্রকৃতিগত সত্যকে বিস্ময় ও অর্ধপরিচয়ের রহস্যে আবৃত করে তারাশঙ্কর এই কাহিনিকে রূপ দিয়েছেন। জৈবিক জীবনের ক্ষেত্রে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক রূপটি জোবেদা এবং উদয়নাগের মধ্যে এক অনুপম শিল্পশ্রী লাভ করেছে। নারীর প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বভাব উদয়নাগের মতোই সর্পিল, ক্রূর। নিকৃষ্ট নীচুতলার প্রাণী উদয়নাগের সঙ্গে মানুষকে এক করে দেখার ফলে জোবেদার সঙ্গে তার আত্মঅধিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবাস্তবের সীমা নির্দেশ করে না। বাসনা বন্ধনে বন্দি এই নাগিনী জোবেদার মতোই ঈর্ষাদগ্ধ হয়ে একদিন তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দংশন করে তার প্রাণান্ত ঘটায়। গল্পটির এই পরিণাম চিন্তা মানুষের আদিমতম বৃত্তিতে ভীষণ। জীবজগতে সমগ্র স্ত্রী জাতির প্রকৃতিগত প্রবণতা তারতম্যহীন। এদিক থেকে ইতর প্রাণীর সঙ্গে প্রভেদ নেই তার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পটির সঙ্গে বালজাকের ‘A passion In the Desert’s তুলনীয় যেখানে মরুভূমিতে নির্বাসিত এক সৈনিকের সঙ্গে এক বাঘিনীর অস্বাভাবিক হৃদয় বন্ধন চিত্রিত হয়েছিল।
‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে জোবেদা ও নাগিনীর সম্পর্ক আবার প্রভুত্ব – অধীনস্থ বা উচ্চবর্গ – নিম্নবর্গ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে আলোচ্য। গল্পে খোঁড়া শেখ ও জোবেদা নিম্নবর্গীয় মুসলিম ঘরের প্রতিনিধি। এঁদের মধ্যে নাগিনী উদয়নাগের প্রবেশ এবং নাগিনী ও জোবেদা সতীন সম্পর্কে আবর্তিত হয়। নাগিনী ও জোবেদার মধ্যে ক্ষমতা অধীনতার সম্পর্ক বিদ্যমান, ‘জোর যার মুলুক তার’ – এই প্রবাদই এখানে আবর্তিত হয়েছে, তাই জোবেদা দাম্পত্য সম্পর্কের জোরে নাগিনীকে তাড়িয়ে দিলে আপন ক্ষমতায় বলীয়ান নাগিনীর ক্ষমতার বহি:প্রকাশে অধীনস্থ জোবেদা বেঁচে থাকতে পারল না। জোবেদার মৃত্যুর পর তাদের ভিটেতে উদয়নাগ সংসার পেতেছে –
“রাঙা রঙের সাপ ফণা দুলাইয়া খেলা করিতেছে।”
ক্ষমতায়নের প্রেক্ষাপটে জোবেদা নাগিনীর কাছে পরাজিত।
আদিম মহাকাব্যের পরিচয় নির্দেশ করা হয়েছিল, ‘শূর যুগের প্রতিনিধি শূর কাব্য’ হিসাবে। শূরযুগ আসলে মানুষের ইতিহাসের সেই আদিমতম সময়, যখন আপন স্বাধীন শক্তির সামর্থ্য সদ্য সচেতন মানুষ প্রথম সংঘবদ্ধ হয়েছিল। সে জীবনের সহজ চরিত্র গড়ে উঠেছিল ‘আদিমতা’ ও ‘উদাত্ততার’ সমবায়ে। আদিমতা জৈব প্রবৃত্তি সাধিত : কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মৎসর্যতার নির্বার স্বাধীন প্রবণতায় প্রখর। আর ‘উদাত্ততার’ আভিধানিক অর্থ ‘বিপুল চিত্ততা’, মানুষের চিত্তচেতনার নির্বার নির্বোধ অভিপ্রকাশ। কোথাও কোনো আবরণ নেই তার, মথিত নগ্ন জীবনের মাটির গন্ধ জড়ানো চক্রাবর্তিত, পাথর জমানো রূপ। এ প্রসঙ্গে ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে নাগিনীর চরিত্র স্মরণীয়। নারী স্বাভাবিকতা নাগিনীর অন্তর্লগ্ন হয়ে ফেরে আদিম জীবনের অকুঞ্চিত তরঙ্গ। ঈর্ষা – হিংসা – আক্রোশের পৃষ্ঠলগ্ন ভালোবাসার শরীরভেদী নির্যাস। তাই বলা যেতে পারে, মহাকাব্য চরিত্র রূপায়নের এক দুর্মর স্বাক্ষর ‘নারী ও নাগিনী’।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যশৈলী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দেখা যায় চরিত্রের রূপবর্ণনায় ভাষার বিশেষত্ব এবং বক্তব্যের গভীরতা প্রকাশ পায়। ‘নারী ও নাগিনী’ তে নাগিনীর রূপ বর্ণনা –
“সেই লাল রঙের মধ্যে ফণার ঘন কালো চক্র চিহ্ন অপূর্ব শোভায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। প্রজাপতির রাঙা পাখার মধ্যে কালো বর্ণ রেখার মতোই সে মনোরম।”
নাগিনীর এই রূপের পাশাপাশি তরুণী জোবেদার সৌন্দর্য ও যৌবন তরঙ্গকে তুলনা করা হয়েছে। আর সেই সতীনের মাঝে খোঁড়া, তার পা দুটিই শুধু খোঁড়া নয়, যৌবনের কদাচারের ফলে কুৎসিত ব্যধিতে তার নাকটাও বসে গেছে। নাকের জায়গায় বীভৎস একটা গহ্বর, তার উপর বসন্তের দাগ তার মুখটাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। লেখক এখানে রূপের বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন। ভয়ঙ্কতার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে খোঁড়ার মতো প্রাণধর্মে চঞ্চল, প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষের মধ্যে তার আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক।
মানবসমাজে সর্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সাপ মূলত ভয় হিংসা মৃত্যুর প্রতীক। তবুও হৃদয় দৌর্বল্যের পারস্পরিক সম্পর্ক যেন বীভৎসতাকে অতিক্রম করে মানবীয় সংবেদনার সুরে উন্নীত হয়েছে। মানুষের সৌন্দর্য চেতনায় মৃত্যুর বীভৎসতা হয়েছে ‘শ্যাম সমান’। রূপমুগ্ধ মানুষ তাই সাপের রূপমাধুরী ও সম্মোহিনী শক্তিকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে বীভৎস দর্শন খোঁড়া শেখের নাগিনীর প্রতি মানবীয় জীবন রহস্যের জটিলতাকে উন্মুক্ত করতে সক্রিয় হয়েছে। গল্পে নাগিনীকে খোঁড়া শেখ সিঁদুর পরিয়েছে, সিঁদুর এখানে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর বন্দিত্বের শৃঙ্খল। সিঁদুর পরার ফলে নাগিনীর উত্তরণ ঘটেছে মানবীয় ক্রুর হিংসার সতীন স্বভাবে। ফলে গল্পটি কেবল ধাতুপ্রকৃতির রহস্য অনুসন্ধান নয়, তার থেকে মানবধর্মের উত্তরণের দিশার প্রকাশ ঘটেছে। মানবীয় জীবন স্বভাবে ‘নারী ও নাগিনী’ সতীন সম্পর্ক প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে জয় – পরাজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে তা শুধু বিস্ময়কর নয়, অভিনব।
গ্রামবাংলার আঞ্চলিক জীবনযাত্রার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা শরৎচন্দ্রের রচনায় বিশেষ করে 'মহেশ', 'অভাগীর স্বর্গ' এর মতো ছোটগল্পে গ্রামীণ সমাজের দীন দরিদ্র অবহেলিত মানুষের আকাঙ্ক্ষার রসোজ্জ্বল মূর্তি পাওয়া যায়। কিন্তু তারাশঙ্কর সেই শ্রেণির মানুষের আদিম অমার্জিত জীবনযাত্রা এবং সংলাপকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন, যেভাবে তাদের আদিম প্রবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন পূর্বে কিংবা পরে বাংলা সাহিত্যে তা তুলনা রহিত। শরৎসাহিত্যে জীবনের কুৎসিত দিকটির প্রকাশ নেই, তিনি মানব জীবনের শাশ্বত অনুভূতিগুলিকে - প্রেম বাৎসল্য ইত্যাদি সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। অপরদিকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে মধুরের সঙ্গে ভয়ঙ্করের, সুন্দরের সঙ্গে অসুন্দরের মিলন ঘটিয়েছেন।
তাই জগদীশ ভট্টাচার্য্য বলেছেন –
“শরৎচন্দ্রের জীবনে রাধিকা মূর্তিরই আরাধনা, তারাশঙ্করের আরাধ্য জীবনের বিভীষণা নায়িকা কালিকামূর্তি।”