একটি কলমের আত্মকথা

কলমে – সোমা রানা, বি. এ. ( বাংলা ) , সূবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়

টাইপ রাইটারের খটাখট শব্দে অনেকক্ষন ধরে আমার কান ঝালাপালা করছে ৷ ওই তো সামনে একটা মেয়ে কম্পিউটারে কিসব লিখছে ৷ তার নাকি আজ ইন্টারভিউ ৷ লেখা -লেখির ইন্টারভিউ | কিন্তু আমাকে সে সকাল থেকে একবারও ছুঁয়ে নি ৷ ফিরেও দেখেনি ৷
আমি টেবিলের উপরে রাখা এক কলমদানিতে বসে বসে হাই তুলছি | আমার সাথে আরো অনেকে আছে ফাউন্টেন , ঝর্না, কুইল , বল, ডট, স্কেচ আরো অনেক জন | তাদের কথা পরে বলছি ৷

মাকড়শা জাল বুনেছে আমার উপর ৷ আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে আসার উপক্রম। ধুলোর আস্তরন আমার সারা গায়ে ৷ ভেবেছিলাম লেখা -লেখিব কম্পিটিশান তো তাই মেয়েটি আমার সদব্যবহার করবে কিন্তু সেটা হল না ৷
প্রতিযোগীতার কর্তৃপক্ষ নাকি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে – হোয়াটস্যোপে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে কোনো প্রকার ডক , PDF কিংবা কলমে লেখা ছবি গ্রাহ্য হবে না ৷
আমার চোখে জল ৷
মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা যেদিন আমার কত কদর ছিল ৷ আমি বুক ফুলিয়ে গর্ব করতাম বড় বড় সাহিত্যিক, উকিল , ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কারোর আমাকে ছাড়া দিন চলে না ৷

কথা যখন উঠেছে তখন একটু আমার জন্ম কথাটাই বলি – নাম আমার কলম | ইংরেজির লোকেরা বলে Pen I
আমার জন্ম কবে থেকে তা আমি নিজেই জানি না ৷ কিন্তু জিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে আমার মানে আমার আদিপুরুষের অস্তিত্ব ছিল | তবে তাদের চেহারাটা ছিল একটু আলাদা ৷
নীলনদের ধারের নল খাগড়া ভোঁতা করে তুলি কিংবা সুঁচালু করে কলম করে আমার দেহ গঠিত হত ৷ কিংবা ফিনিসীয় অধিবাসীরা জঙ্গল থেকে এক টুকরো হাড় কুড়িয়ে এনে, কিংবা সামান্য একটা পাখির পালক দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষকে তৈরি করত ৷ এই ছিল তাদের সাদামাটা জীবন ৷

তারপর দিন গড়াতে লাগলো মানুষ উন্নত হতে লাগলো ৷ মানুষের সাথে সাথে আমারও উন্নতি হতে লাগলো ৷ রূপে পরিবর্তন এল ৷ চেহারা হল ঝলমলে ৷ সময়ের কালস্রোতে আদি মানব থেকে যেমন করে হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে ঠিক সেই ভাবে ৷

একটা সময় ছিল যখন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করলে বয়স্করা আশীর্বাদ করতেন – বেঁচে থাকো বাছা , তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক ৷ কিন্তু আজ ! আমার নটে গাছটা মুড়োলো স্বপ্ন আমার ফুরোলো ৷ হায়-রে কপাল | …

একসময় কবিগুরুর হাতের চামড়ার স্পর্শ পেয়েছিলাম আমি | তিনি আমাকে আঙুলে চেপে কত কিছু লিখেগেছেন ৷ সেগুলি ছাড়া আজ তোমাদের জীবন অচল ৷
তিনি আমাকে আদর করে নাম দিয়েছিলেন ঝর্ণাকলম | আমার মুখ থেকে কালি ঝরে ঝরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তো বলে তিনি হয়তো এমন নামটা দিয়েছিলেন ৷ আপাত দৃষ্টিতে কালি ঝরে পড়তো মনে হলেও আসলে আমার গা-বেয়ে , আমার মুখ দিয়ে ঝরে পড়ত ওনার মহৎ ভাবনা | তা স্বীকার করতে আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না |

আমাকে খাতায় আঁচড় কেটে তিনি সৃষ্টি করেছেন কত কালজয়ী রচনা | শুধু রচনা সৃষ্টি করেন নি সৃষ্টি করেছেন ছবিও |
লেখার সময় আমাকে নিয়ে তিনি যখন হিজিবিজি কাটাকুটি খেলা খেলতেন তখন আমার গায়ের কালো রক্ত পাতায় এলোথেলো হয়ে ছবি মনে হত তখন থেকেই তিনি চিত্রশিল্পী৷

এবার বলি অতীতের সেই রোমানসাম্রাজের কথা ৷ রোমানসাম্রাজে আমার কতই না খ্যাতি ছিল ৷ তখন আমার রূপ ছিল ব্রোঞ্জের ৷ নাম ছিল ব্রোঞ্জের শলাকা | কেউ কেউ আমাকে আবার স্টাইলাস বলেও ডাকতেন ৷ জুলিয়াস সিজার আমাকে দিয়েই কাসকাকে হত্যা করেছিলেন ৷আমাকে দিয়েই খুন হয়েছিল ৷ সেটা আমার মোটেই ভালো লাগে নি ৷

আমি তো নরম হৃদয়ে বস্তু ৷ আমার কাজ খাতায় আঁচড় কাটা ৷ আঁচড় কেটে সমাজের পরিবর্তন করা, দেশের উন্নতি করা, দশের ভালো করা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়া, কুসংস্কার দূর করা, প্রেমিকের মনের কথা বলা ৷
কিন্তু সম্রাট জুলিয়াস আমাকে আমার প্রকৃত কাজ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন আমাকে বানিয়ে ছিলেন খুনি ৷

আমি নরম হৃদযের হলেও দূর্বল নই আমি হচ্ছি তালোয়ারের চেয়ে শক্তিশালী, বজ্রের চেয়েও কঠিন ৷ শুধু জানতে হবে আমার এই অমূল্য শক্তির সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবহার |
আমি রাজা-মন্ত্রীর সিংহাসন টলাতে পারি ৷ খানা-খওর রাস্তায় মাটি ভরাট করাতে পারি ৷ স্কুল খুলতে পারি ৷
তাছাড়া তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো, আমি কিভাবে বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রোধ আর রামমোহনের হাত ধরে সতীদাহ প্রথা রোধ করার সেই কথাটা | আর কত কি বলব ! –
নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করতে লজ্জা লাগে ৷

একসময় আমি গ্রামে-গঞ্জে বাঁশের কঞ্চি কেটেও তৈরি হয়েছি ৷ ছেলে মেয়েদের ভালোবাসো পেয়েছি ৷ আমাকে ঘিরে তাদের কত আনন্দ ছিল ৷ তারপর সেই ছোটো ছোটো শিশুদের বয়স বাড়লো আমিও হারতে লাগলাম ৷

আমার সঙ্গীরা – দোয়াত-কালি – কলম, খাগের কলম, পাখির পালক যার ইংরেজি নাম কুইল তারা সবাই মরে ভূত হয়ে গেছে ৷ এখন তাদের দেখতে পাওয়া যায় ছবিতে, মিউজিয়ামে কিংবা শখের কলম সংগ্রহীর দেরাজে ৷

তারপর একদিন লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যানর জন্ম দিলেন আমার নতুন অবতারকে ৷ নাম হল ফাউন্টেন পেন ৷ তবে শৈশবে ( প্রথম দিকে )এই নামটা আমার ছিল না, ছিল রিজার্ভার পেন ৷ আমার এই রূপ শরৎচন্দ্র, শৈলজানন্দ সহ অন্যান্য লেখকদের নেশাগ্রস্থ করেছিল ৷ আমাকে সংগ্রহ করার নেশা |

তবে আমার এই রিজার্ভারের রূপটাও বেশি দিন টিকল না তৈরি হলাম আরো উন্নত ৷ নাম হল বল পেন বা ডট পেন ৷
এটাই আমি |
আর কি বলব আমার বর্তমান অবস্থার কথা !
এখন আমি ইউজ অ্যান্ড থ্রো ৷
আমাকে কিনে আনা হয় তারপর ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলা হয় জানালার ওপারে ৷ এখন জীবন আমার বাসি ফুলের মালা কিংবা অনুষ্ঠানের শেষে মাটিতে পড়ে থাকা বাদ্যযন্ত্রের মতো ৷

মেয়েটা এখনো খট খট করে বর্নযুক্ত বোতামে চাপ দিচ্ছে ৷ আর মাঝে মাঝে সেই চারকোনে বাক্সটার দিকে তাকাচ্ছে তারপর আবার টাইপ করছে ৷

মাঝে মাঝে হিংসে হয় সেই চার কোনে বাক্সটাকে ৷ ইচ্ছে হয় কুপিয়ে কুপিয়ে তার বোতাম, তার পর্দা সব তচনচ করে দেই ৷

আর ওই মেয়েটা শুনেছিলাম সে কিনা ভালো লেখে ৷ …
এক মাস্টারমশাই আমাকে তার বুক পকেটে নিয়ে নিয়ে ঘুরতেন ৷ সেটা অবশ্য নিত্যান্তই ওনার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির খাতিরে ৷ কিনেছিলেন আমাকে এক দোকান থেকে ৷
তারপর একদিন মেয়েটির লেখা পড়ে তার প্রশংসা করে আমাকে উপহার হিসাবে তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে ৷
ভেবেছিলাম এই মেয়েটি আমাকে ভালবাসবে ৷ ভালো- বেসেও ছিল খুব |
তাই তো আমার গায়ে ধুলোর আস্তরন , বুকে জমাট বাঁধা কালো রক্ত ৷ আমার জীবন কী সার্থক হল?
প্রথমে ভাবতে আমি বেশি প্রিয় বলে আমার এমন অবস্থা ৷ কিন্তু সেটা ভুল ৷ আমার সহসঙ্গীদেরও একই অবস্থা ৷ কলমদানির রাজ্যে হতাশা | আর এই হতাশার কারন সেই চৌকো বাক্স ৷…

উঁকি মেরে পর্দাতে তাকাতেই দেখি মেয়েটা আমাকে নিয়েই লিখছে ৷ লিখছে আমার আত্মকথা ৷ আমাকে ছাড়াই লিখছে আমার দুঃখ গাথা |
এই চৌকো বাক্স কেটে নিচ্ছ আমার অতীত – বর্তমান – ভবিষ্যৎ |
কেড়ে নিচ্ছে সুন্দর লিপিশিল্পী বিদ্যা | হারিয়ে যাবে ব্যক্তির হাতের অক্ষরে তার মনেভাব বিশ্লেষণের পদ্ধতি | সবার দিন ফুরালো তাহলে আমারও কি ফুরালো ?
ফেসবুকে টাইপ, হোয়াটস্যাপে টাইপ, ছাপাখানায় টাইপ ৷ এখন আমাকে হাতে নিয়ে লেখালেখির কাজটা প্রয়োজনীয়তা নয়, বিলাসীতা মাত্র ৷

তবুও আমি খুশী ৷ আমি মাস্টারমশাইয়ের
উপহার দেওয়ার যোগ্য হয়েছি ৷ ইন্টারভিউ কম্পিটিশানের বিষয় হয়েছি তাই |
এই লেখার মধ্য দিয়ে এমনি করেই বেঁচে থাকবো আমি | ধন্যবাদ মেয়ে ৷ ধন্যবাদ আমার বাংলা অ্যাকাডেমি |

তথ্যসূএ – ১. ‘ হারিয়ে যাওয়া কালিকলম’ – শ্রীপান্থ