নবান্ন’ – বিশ্লেষণী আলোচনা

– সোমা রানা, বি এ ( বাংলা ) , সূবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়

 

‘নবান্ন’ বিজন ভট্টাচার্যের এক কালজয়ী রচনা |
বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯১৫ সালে বাংলাদেশের খনিত্থানপুর গ্রামে ৷ পিতা ক্ষীরোদ বিহারী ভট্টাচার্য পেশায় ছিলেন শিক্ষক | ফলে পিতার জীবনযাত্রা, সাহিত্য-প্রীতি, শেক্সপীয়র চর্চার প্রভাব সব কিছুই পেয়েছিল ছোটো বিজন | তিনি বাবার সাথে বহু জায়গায় ভ্রমন করেছিলেন তার ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, তাদের জীবন-যাপন ও আঞ্চলিক ভাষার প্রতি তার আগ্রহ জন্ম ছিল ছেলেবেলা থেকেই ৷ যার পরিচয় আমরা পাই নবান্ন নাটকের পরতে পরতে ৷ নাটকটিতে শোষিত কৃষক ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন বঞ্চনা ও শোষনের চিত্র নিখুঁদ ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি৷

নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে অরনি পত্রিকায় ৷ এবং পরে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে ৷ এটি একটি গননাটক | গননাটকের প্রথম সূচনা করেন রম্যাঁ রল্যাঁ ৷ গননাটক হচ্ছে সেই নাটক যে দেশ কালের সীমানা ডিঙিয়ে মানুষের মনে চিরকাল গাঁথা থাকে ৷ একটি গোটা সমাজের প্রতিনিধি করে সেই নাটক |

নবান্নের পটভূমিতে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ , জাপানী আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, নিম্নবঙ্গের ফসল নষ্ট, সাধারন মানুষের সীমাহীন দুদর্শা , প্রতিকারহীন মন্বন্তর- সর্বস্ব হারিয়ে গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে ক্ষুধা মেটাতে লঙ্গরখানার লাইনে এসে দাঁড়িছে ৷ ওদিকে লোভী জোতদার মুজুতদার ও সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসক খাদ্য গুদামজাত করেছে এদিকে অস্থিচর্মসায় ক্ষুধার্ত নারী- পুরুষের নগ্নমূর্তির ছবি ও সেবাশ্রমের আড়ালে নারীদেহ নিয়ে ব্যবসার রমরমা সবই উঠে এসেছে বিজন ভট্টাচার্যের হাত বেয়ে নবান্নতে ৷

নবান্ন নাটকটিতে চারটি অঙ্ক আছে ৷ যার প্রথম এবং দ্বিতীয় অঙ্কে ৫টি তৃতীয় অঙ্কে ২টি এবং চতুর্থ অঙ্কে ৩টি | মোট ১৫টি দৃশ্য আছে ৷ নাট্যকার গ্রাম ও শহর জীবনের শঙ্কা ও সঙ্কটের ছবি তুলে একটি ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে ৷

নাটকের প্রথম অঙ্ক শুরু হয়েছে রাতের অন্ধকারে মালভূমির মত উঁচু জায়গায় কতগুলি ছায়ামূর্তির আনাগোনা দিয়ে ৷
নাটকের ঘটনাস্থল আমিনপুর গ্রাম | সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাটি সামলিয়ে গ্রামবাংলার নিম্নবৃত্ত মানুষ যখন একটু শান্তির শ্বাস নিয়েছে ঠিক তখনই নেমে এসেছে প্রকৃতির দূর্যোগ বন্যা | এই বন্যার দাপটে গৃহস্থের মাথার চাল পড়ে যায় ৷ আমিনপুরের পায়ের নীচে শক্ত মাটিটা যায় সরে ৷ তবুও এই দূদর্শার দিনে প্রধান সমাদ্দারের পরিবার মাটি কামড়ে আমিনপুরে পড়ে ছিল ৷

কিন্তু যখন গ্রামের টাকাওয়ালা জমিদার ধূর্ত হারু দত্ত ও তার লোকজন এসে এই অসহায় পরিবারের উপর অত্যাচার চালায় তাদের শেষ সম্বল সেই জমিটুকু কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ৷ তখন তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে কুঞ্জ |
হারুর লোকজন প্রধান, কুঞ্জ ও তার পরিবারের উপর লাঠি চালায় ৷ সমস্ত ঘটনা দেখে ভয়ে আতঙ্কে প্রান হারায় মাখন ৷ মাখন কুঞ্জ ও রাধার একমাত্র সন্তান ৷ কেউই বাঁচাতে পারে না মাখনকে |
তখন সমাদ্দার পরিবার তাদের একমাত্র বংশধরকে হারিয়ে হাহাকার করে ওঠে ৷
‘ ভয়বিহ্বল বিনোদিনীর চোখ মুখ ভেঙে নেমে আসে একটা বিপৎপাতের কালো ছায়া ৷ ‘
এই ইঙ্গিতময় বিনোদিনীর বর্ণনায় ফুটে ওঠে সমাদ্দার পরিবারের গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হওয়ার ভাবনা |

দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায় গোটা সমাদ্দার পরিবার অসহায়তার সমুদ্র সাঁতরে এসে ওঠে শহরের এক পার্কে | এখানকার অসংখ্য ভিখিরির ভিড়ে জায়গা করে নেয় তারা৷ আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেয় ৷
তবে এখানেই এই পরিবারটি দু- টুকরো হয়ে যায় | বাজারের যে দিকে খোলা – খিচুড়ি দেওয়া হবে সেদিকে যায় কুঞ্জ আর রাধিকা ৷ অপরদিকে বৃদ্ধ প্রধান সমাদ্দার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভিখিরিদের পিছু পিছু চলে যায় অন্যদিকে ৷ এছাডা বিনোদিনী পড়ে থাকে পেছনে ৷

অতঃপর বিনোদিনী গিয়ে পড়ল টাউটের পাল্লায় ৷ দু মুঠো খাবার পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সে গিয়ে উঠল কালীধন গুপ্তের সেবাশ্রমে |

কালীধন ধাড়া একজন চালের চোরাকারবারী | সর্বগ্রাসী বিশ্বযুদ্ধে তার অবদান ৷ অল্প পয়সায় চাল কিনে তা গুপ্তপথে বেশি পয়সায় বিক্রি করে সে ৷ চাল জোগান দেয় গ্রামের হারু দত্ত ৷
এই ভাবেই কৃত্রিম উপায়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় | কেবলমাত্র সস্তা হয়ে যায় মানুষের জীবন ৷ গরীব দুঃস্থ বাবার অবিবাহিত মেয়ে কিংবা অভাবগ্রস্থ স্বামীর অল্পবয়সী বৌ অতি সস্তায় চলে আসে কালীধনের সেবাশ্রমে ৷

এখানেই বিনোদিনীর সাথে দেখা হয় নিরঞ্জনের ৷ নিরঞ্জন বিনোদিনীর স্বামী এবং প্রধান সমাদ্দারের ছোটো ভাইয়ের ছেলে ৷ সে বাড়ি ছেড়ে এসেছিল কাজের সন্ধানে ৷ কাজ করত কালীধনের চালের গুদামে ৷ ঘটনাচক্রে তারা মিলিত হয় ৷
এবং অবশেষে ঠিক করে থানাতে গিয়ে সমস্ত ঘটনা তারা জানাবে ৷ থানায় গিয়ে তারা পেশ করে কালীধনের সমস্ত অবৈধ কান্ডকারখানা ৷ সক্ষীও জুটে যায় ৷

দারগা কালীধন ও হারু দত্তকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় জেলে ৷

নিরঞ্জন বিনোদিনী তারপরে চলে আসে তাদের গ্রামে, আমিনপুরে ৷ বন্যা এবং দূর্যোগ তখন কেটে গেছে ৷ গ্রামে ফিরে তারা তাদের ভাঙ্গা ঘর জুড়ে দেয় ৷ চাষীদের সাথে মিলেমিশে মাঠে চাষ করে ৷ ফসল কেটে ধান গোলায় তোলে ৷

অপরদিকে কুঞ্জ,রাধিকা পার্ক থেকে পথে ঘুরতে ঘুরতে লোকের বাড়ির ফ্যান ভিক্ষে করতে থাকে ৷ এখানে চোখে পড়ে তৎকালীন সমাজের দূর্ভিক্ষের ভয়াভয় রূপ ৷

তৃতীয় অঙ্ক সংক্ষিপ্ত ৷ দুটি দৃশ্য | একটি লঙ্গরখানার , অপর চিকিৎসা কেন্দ্রের ৷ প্রথমটিতে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল ৷ এর মধ্যে উপস্থিত কুঞ্জ, রাধিকা এবং অন্যান্য গ্রামের মানুষ | এদের কথাবার্তায় উঠে আসে গ্রামের ফসলের প্রাচুর্যের নানা গল্পকথা ৷ একজন ভিখারী তাদের গ্রামে ফিরে যেতে বলে ৷ কুঞ্জ-রাধিকা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সংকল্প নেয় ৷ আর দ্বিতীয় দৃশ্যে চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রধানকে দেখা যায | এখানে চিকিৎসার নামে প্রহসন চলে ৷ ‘ ভুলে যাও তোমার ব্যাথার কথা ‘ ৷

চতুর্থ অঙ্কে তিনটি দৃশ্য প্রথমটি বেশ বড় ৷ ঘটনাস্থল আমিনপুর গ্রাম | শহর থেকে ঘরে ফিরে আসা মানুষরা নিজ নিজ বাডিতে উপস্থিত ৷
নিরঞ্জনের উদ্যোগে তারা দয়ালের বাড়িতে সভা করেছে, আগামী দিনের সম্ভাব্য সংকট নিয়ে ৷
সকলেই সুখী ভবিষৎ গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ৷ এর পর মিলনের সুখময় পরিবেশ- ভাইয়ে ভাইয়ে পুনর্মিলনের আবেগের দৃশ্য দেখা যায় ৷ দেখা যায় নবান্ন উৎসব | এখানে সমাদ্দার পরিবার বার বার মনে করে প্রধানের কথা ৷
শেষ দৃশ্যে নবান্ন উৎসব চলছে ৷ চলছে। কৃষক রমনীর নাচ-গান, মোরগ লড়াই এবং বা গোরুর দৌড – জয় হল ফেকু মিঞার মোরগ এবং রহমৎ উল্লার গোরু |
এর পর হঠাৎ প্রধানের আবির্ভাব ৷
সবাই আনন্দে বিভোর এখানেই নাটক শেষ ৷

সূত্র – ১. গননাট্য আন্দোলন – বিজন ভট্টাচার্য ( নবান্ন)