সত্যবতীর চলার পথে রামকালী ও নবকুমার চরিত্র দুটি কতটা প্রতিবন্ধক ও কতটা সহায়ক

কলমে – শ্রেয়সী মিশ্র, এম এ ( বাংলা ) , মেদিনীপুর কলেজ

আশাপূর্ণা দেবী রচিত নারী জাগরনের, নারীবাদের, নারীমুক্তির, এক অন্যতম সৃষ্টি হল ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ । এই উপন্যাস টি হল ট্রিলজি। যার প্রথম পর্যায় ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, দ্বিতীয় পর্যায় হল ‘সুবর্ণলতা’, তৃতীয় পর্যায় হল ‘বকুলকথা’। উপন্যাসটির কাহিনীতে রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ টির ও অধিক চরিত্র। আছে অসংখ্য ঘটনার আলোড়ন বিলোড়ন।এত চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি চরিত্র হল রামকালী, সত্যবতী ও নবকুমার। উপন্যাসের নামানুসারে এই প্রতিশ্রুতি যেন সত্যবতীর -ই। কোনো বাধা না মানা, কোনো নিয়মের মধ্যে না আটকে থাকা, কোনো কুসংস্কার কে প্রশ্রয় না দেওয়া, নাছোড়বান্দা এক নারী অর্থাৎ সত্যবতীর-ই প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর বহন করে এই উপন্যাস। নিভৃত লোকে বসে যারা রেখে গেছেন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর সেই সমস্ত স্মরণীয়া বরণীয়া দের উদ্দেশে রচিত এই উপন্যাস খানি। বাঙালীর ঘরের কোণায় কোণায় লুকিয়ে থাকা হাজারো নারী কে অন্ধকারের গহ্বর থেকে টেনে আলোর মুখ দেখানোর পথ প্রদর্শক হল সত্যবতী। আজকের দিনে নারীদের শিক্ষা লাভের যে স্বাধীনতা, বাইরে বেরিয়ে কাজ করার যে স্বাধীনতা সবকিছুরই মূলে রয়েছে সত্যবতী। সত্যবতীর মতো নারীরা সকল বাধা কাটিয়ে, সকল বেড়াজাল উবড়ে ফেলে এগিয়ে না আসলে ,না জানি নারীদের অবস্থা আজকের দিনে কতটা শোচনীয়ই না হতো। নারীরা আজ ও হয়তো ঘরের এক কোণায় নিজেকে বুঁদ করে রাখতো। যদিও এটা পুরোপুরি ভাবে বলতে পারি না যে সকল নারীই আজ সমান স্বাধীনতা পেয়েছে । না, সেটা হয় নি আজকের দিনে এসে ও নারীদের পুরোপুরি স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ হয় নি। সেদিনের সত্যবতী কে যেমন খুবই অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছিল, আজকের সমাজে ও এরকম বাল্যবিবাহ বহু পরিমাণে দেখা যায় চোখ খোলা রাখলেই। সেদিনের নারী যতটা বঞ্চিত ছিল হয়তো ততটা বঞ্চিত নই, তবু পুরোপুরি যে স্বাধীন সেটাও বলা যায় না। সকল নারীর হয়ে সত্যবতীই যেন রব তুলেছিল —
নারীকে তার আপন ভাগ্য
জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার?
হে বিধাতা ….!

আশাপূর্ণা দেবী তাঁর এই সত্যবতীর মধ্য দিয়ে সকল নারীকে জাগিয়ে তুলছেন। এগিয়ে যাওয়াই নারীর মূল মন্ত্র হওয়া উচিত। নারী বলে পিছিয়ে থাকা কাম্য নয়। উচিত ও ন্যায়ের সহিত চলা নারীটিকে খারাপ বলে তকমা দেওয়া মানুষগুলোকে সত্যবতীর মতো করেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। সত্যবতী শুধুমাত্র একটি উপন্যাসের চরিত্রই নয় । সমাজের আনাচে কানাচে মুখ গুঁজে লুকিয়ে থাকা হাজারো নারীর ভবিষ্যত হল সত্যবতী।

উপন্যাসটির আর এক অন্যতম চরিত্র হলেন রামকালী। আদর্শ এক পিতা। সবল মেরুদন্ড যুক্ত একজন ঘরের কর্তা। রামকালীর শিক্ষায় যে সত্যবতী কতটা শিক্ষিত হতে পেরেছে তা আমরা প্রতি পদে পদে প্রমান পাই। উপন্যাসটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে —-
“বুড়ো বয়সের প্রথম সন্তান বলেই বাপের কাছে কিছু প্রশ্রয় আছে সত্যবতীর”।
সত্যবতীর চরিত্র এতোটা উল্লেখযোগ্য হওয়ার পেছনে রামকালীর অবদান অনস্বীকার্য। সত্যবতীর জীবনে তার পিতা, রামকালী প্রতিবন্ধকের থেকে সহায়ক হিসেবেই বেশি গুরুত্ব লাভ করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে পিতার সহায় ছাড়া এক নারীর জীবন এতোটা উজ্জ্বল হতে পারে না। যদিও সত্যবতী নাছোড়বান্দা তবুও সে তার পিতার কাছে বেশিরভাগ সময় বাধ্য হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা যদি ন্যায়সাপেক্ষ হয় তাহলেই। সত্যবতীর মাথায় কখন কী মতলব ঘুরতে থাকে তার হদিস পাওয়া মুশকিল। কারোর কথা মুখ বুজে হজম করে নেওয়ার মেয়ে সত্যবতী নয়। সারাদিনের গুমোটের পর বৃষ্টি আসার আগাম দেখা দেওয়ায় সত্যবতী তাদের ঘরের গরু দুটো অর্থাৎ শ্যামলী ধবলী কে ডাকতে আমবাগানের দিকে যায়, সেই পথ দিয়ে রামকালী ও ঘরে ফেরেন তখন তিনি সত্যর গলার স্বর পান এবং সত্য কে ধরে ও ফেলেন । কিন্তু তাই বলে যে ঘর থেকে বেরিয়েছে বলে বিশাল বকাবকি করবেন এরকম টা নয়। ধীর গলায় কোথায় গিয়েছিলে জানতে চাইলে সত্য ক্ষীন স্বরে উত্তর দেয়। এইজন্যই সবাই সত্য কে বাপ সোহাগী বলে আখ্যা দেয়। সত্যিই সত্য রামকালীর বিশেষ আদরিনী, তাছাড়া পয়মন্ত মেয়ে বলে একটু সমীহ ও করেন । তাই বলে সামনাসামনি যে কোনো আদর আদিখ্যেতার পাট আছে তা কিন্তু নয়। সত্যকে কোনোদিনই রামকালী বেঁধে রাখেন নি বা তার সামনে কোনো বেড়ার জাল ও দিয়ে দেন নি। জটা যখন তার বউ কে মেরে প্রায় মরমর করে দিয়েছিল এবং রামকালীর চিকিৎসায় সুস্থ হয়েও উঠেছিল তখন সেই জটা কে পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য সত্য একটা ছড়া বাঁধে আর শুধু ছড়া বেঁধেই রেখে দেয় নি সকল কে শিখিয়েছে এবং জটা আর তার মা কে দেখে এই ছড়া বলতে বলেছে।তখন ও কিন্তু রামকালী তাঁর মেয়েকে বকাবকি করেন নি বা মেয়ে হয়ে ছড়া লিখছে বলে যে শাস্তি দেবেন তাও করেন নি।’সতীনকাঁটা’ শব্দটা যখন সত্য বলেছিল তখনই দেখেছি রামকালী কে বিচলিত হতে , সত্য যে উচিত কথা মুখের ওপর বলেছে তার জন্য নয়। তিনি ভাবলেন যে সত্যর মনে এত হিংসার ভাব এল কী করে? সতীন কে বোন ভেবে ও তো সংসার করা যায়। কিন্তু সত্যর যুক্তির কাছে শেষমেশ তিনি চুপ করে যান। কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি সত্যকে দমিয়ে রাখেন না। সত্য যখন নেড়ুর মক‍্শ করা দেখতে গিয়ে তালপাতায় হাত দিয়েছিল তখন নেড়ু সত্য কে ভয় দেখালে সত্য ও জবাব দিতে ছাড়ে না।এই ঘটনা যখন সত্যর মা, ভুবনেশ্বরী দেবী তাঁর স্বামী অর্থাৎ রামকালী কে বলেন তখন রামকালীর মধ্যে কোনো আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি। পরিবর্তে রামকালী তাঁর মেয়ের হাতে দোয়াত কলম ও খসখসে বালির কাগজ তুলে দেন এবং লিখতে বলেন। তিনি সত্য কে জিজ্ঞেস ও করেন তুমি কি লেখাপড়া করতে চাও? , এরপর থেকে প্রতিদিন দুপুর বেলা তিনি সত্যকে পড়াতে বসান। সেই সময়ে যখন মেয়ে দের ঘর থেকে বের হওয়া টাই দায় ছিল ঠিক সেই সময়ে এক পিতা যে কিনা মেয়ের হাতে দোয়াত – কাগজ তুলে দিচ্ছেন। রামকালী কতটা সহায়ক সত্যর চলার পথে তার জন্য এর থেকে বড় প্রমান আর কী ই বা হতে পারে? তিনি মেয়ের সকল দুঃসাহসের পরিচয় পেয়েছেন, সে দুঃসাহস পরিপাক ও করেছেন,কারন তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম ও করেছেন। সত্যর কাছে দুচোখের বিষ ছিল পরের ঘর যাওয়া নিয়ে খোঁটা। তাকে দু ঘা দিলেও সে মেনে নেবে তবে পরের ঘর নামক বিভীষিকা টিকে সে মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু সেই সত্যবতীই পিতার সম্মানের কথা ভেবে যখন বলে ‘আমাকে পাঠিয়ে দাও , ভেবে নিও আমি মরে গেছি’। এবং আরও সকল কথা শুনে রামকালী ভাবেন এইটুকু মেয়ে এত কথা ভাবেই বা কী করে? সত্যবতীর মুখে মেয়েমানুষ তুচ্ছ শুনে রামকালী অবাক হন এবং সত্য কে জিজ্ঞেস করেন তুমি তো এরকম কথা বল না? এই একটা ভুল অর্থাৎ সত্যর বিয়ে হয়ে যাওয়া এত কম বয়সে যা সত্যর জীবন কে আলাদা দিকে টেনেছে। সকল পরিস্থিতিতেই রামকালী সত্যর মনের অবস্থা বুঝেছেন, বুঝেছেন তার সকল কথার অর্থ। কখনোই দমিয়ে রাখেন নি তিনি। লোকে সত্য কে নিয়ে যত নালিশ করলেও তিনি কখনোই কান দেন নি কারন সত্যর ওপর ভরসা ও বিশ্বাস ছিল রামকালীর।একজন আদর্শ ও শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে তিনি বুঝেছেন নারীর শিক্ষালাভ ও নারীর এগিয়ে যাওয়া কতটা প্রয়োজন। তিনি না ভাবলেও সত্য তাঁকে ভাবতে বাধ্য করেছে। কখনোই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কড়া নিয়মকানুন চাপিয়ে দেননি তিনি। বরং সর্বক্ষেত্রেই সহায়ক হয়ে সত্যর জীবনপ্রভা কে আরও উজ্জ্বল করেছেন।

অপর চরিত্র নবকুমার,যিনি সত্যবতীর স্বামী। পিতার আদর্শে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সত্য এখন আসে স্বামীর কাছে। নবকুমার সত্যবতীর জীবনে তার পিতার মতো সহায়ক হয়তো হয়ে উঠতে পারেন নি, তবে সত্যর কাছে প্রতিবন্ধক হয়ে ও থাকতে পারে নি। কিন্তু সত্যবতীর ভবিষ্যত স্বপ্নের প্রতিবন্ধক হয়েছেন নবকুমার। রামকালীর মতো সবল মেরুদন্ড যুক্ত মানুষ নবকুমার মোটেও নয়। বিয়ের পর থেকে তার স্ত্রী অর্থাৎ সত্যবতীর মুখটি ও সে ভালো করে দেখে নি, যা দেখেছে তাঁর ছায়া। যদি কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে ও ভয় পায় নবকুমার নবকুমার চরিত্র টির কোনো গাম্ভীর্যতা কোনো আদর্শতা ই খুঁজে পাওয়া যায় না। যার নিজের ই শক্ত করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই সে কী করে ওপরের সহায়ক হয়? নবকুমার এর মা এবং সত্যবতীর মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে দেখে সে নির্বোধের মতো ছুটে পালায়। সংসারের ঝামেলার ভয়ে সে বন্ধুর বাড়িতে থাকার কথা বলে। যদি ও নবকুমার একটু হলেও সত্যবতীর সহায়ক হতে পারত কিন্তু তার মায়ের ভয়ে সে চেষ্টা টুকুও করে না।যখন নবকুমারের জ্বর হয় তখন সত্যবতী কলকাতা থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করায় এতে ও সত্যবতী কে শুনতে হয় হাজার কথা। এইভাবে চলতে চলতে নবকুমার ও সত্যবতীকে ভালোবাসতে শুরু করে। রামকালীর ইচ্ছেমতো তার জামাই পড়াশোনা যানা, সংস্কৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, ইংরেজি শিক্ষায় উদ্যোগী তবে ন্যায়ের পথে থেকে যে ন্যায়ের বিচার করবে এমনটা নয় নবকুমার। তবে স্বামীত্ব ও পৌরষের ধিক্কারে নবকুমারের মধ্যে ও পরিবর্তন আসে। নবকুমার নিজে না চাইলেও তার মায়ের ভয়ে সে চাইছিল সত্যকে দাবিয়ে রাখতে। কিন্তু সত্য কে আটকায় এরকম মানুষ কেউই নেই। নবকুমার ইংরেজি জানা শিক্ষিত এক যুবক তাই সত্যবতী চেয়েছিল নবকুমার কলকাতায়‌ গিয়ে চাকরি করুক । এবং তারা ঘর ভাড়া করে কলকাতায় থাকবে। কিন্তু নবকুমার কে ও রাজি করাতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি সত্যকে। শেষমেশ তারা ভবতোষ মাস্টার এর ঠিক করে দেওয়া একটা ঘরে গিয়ে ওঠে। নবকুমার চাকরি করে একটা অফিসে। তার দুই ছেলে কে নিয়ে ভালোই কাটতে থাকে। নবকুমার অফিসের নানান গল্প ও এসে স্ত্রী‌ কে শোনায়। নবকুমার যে প্রতিবন্ধক সত্যবতীর চলার পথে তা বলতে গেলে বলতে হয় সমাজ ও তার মায়ের ভয়ে। সে সকল কিছুর শুরুতে না করলেও সত্যবতী তাকে মানিয়েই ছেড়েছে। সত্যর ইংরেজি শেখার বিষয়ে ও নবকুমার মতপ্রকাশ না করলেও শেষে সত্য শিখেই ছেড়েছে। কিন্তু উপন্যাসের শেষে এসে নবকুমার প্রতিবন্ধক হয়েই দাঁড়ায়। কারন সত্যর হাজার স্বপ্ন দিয়ে গড়া আদরের মেয়ে সুবর্ণলতা কে দুদিনের জন্য ঘর নিয়ে যায় ঠাকুমার আদর ও স্নেহে থাকার জন্য। কিন্তু ঘরে গিয়ে নবকুমারের মা অর্থাৎ সুবর্ণলতার ঠাকুমা সুবর্ণলতার বিবাহ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন এবং বিবাহ দিয়েও দেন। নবকুমার কোনো রকমের ন্যায় বিচার করে না। সত্য তখন কলকাতায়। এইভাবে সত্যর জীবনের প্রথম থেকে নবকুমার সহায়ক ও প্রতিবন্ধক হয়ে আসলেও ,, শেষে পুরোপুরি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সত্যর হাতে তৈরি একটি নবপ্রস্ফুটিত ফুল কে ছিঁড়ে ফেলে দেয় , সত্যর অনুমতি ছাড়াই। আটকে যায় তার জীবনের গতি। এভাবেই চাপা পড়ে যায় সত্যবতীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

‌ *_______*

 

তথ্য সংগ্রহকারী বইয়ের তালিকা :-
১) প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী