প্রিয় মনীষী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয়


ব্যাক্তিগত চিন্তাভাবনার গন্ডির গহীনে, প্রিয় চিন্তক তথা প্রিয় মনীষী হিসেবে যদি কোনো মানুষকে বিচার করতে হয়, তবে মননে যাঁর নাম সর্বপ্রথম উদ্ভাসিত হবে তিনি হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর কবিতা, তাঁর ছোট গল্প, তাঁর গান সর্বজন বিদিত। বলাইবাহুল্য বর্তমান যুগের সাপেক্ষে এই মানুষটির চৰ্চা তুঙ্গে। সর্বপরি তাঁর রচনা সম্ভার অমূল্য। প্রত্যেকটি রচনার মধ্যে তিনি এমন ভাবে নিজ চিন্তন শক্তিকে প্রয়োগ করেছিলেন, যে কালের সাপেক্ষে, সেই রচনা গুলির জুড়ি মেলা ভার।

তাঁর রচনা সত্যই মৌলিক। জীবনদর্শনের নানা খুঁটি-নাটি বিষয় তিনি শব্দসম্ভারের সহযোগে অতীব মুনশিয়ানার সাথে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর নানা লেখায়। এর পাশাপাশি তাঁর নানা গানে উঠে আসে উদ্দম জীবনবোধের বাণী -“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার।”
এমন অতলস্পর্শী আহ্বান অতীব সহজে সাধারণের মনে উৎসাহ সঞ্চার করতে সক্ষম। সহজ সরল ভাবে বাউলাঙ্গের আধারে রচিত এই গান স্বভাবতই প্রশংসার দাবিদার। নিজ রচনার স্তরকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতেও রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শৈল্পিক প্রেক্ষাপটে নানা রচনাকে রূপ দান করার পাশাপাশি সেই শৈল্পিক সত্তাকে সুচারু ভাবে বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব তিনি নিজ স্কন্ধেই ন্যস্ত করেন । তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্পের ভাষা আন্তরিক, এই শিল্পের ভাষাকে অন্তর দিয়েই একমাত্র উপলব্ধি করা যায়। তাই তিনি এই শিল্পকে যথাযথ ভাবে সাধারণীকরণের প্রচেষ্টা করে যান নিজ জীবৎকালে।

রবীন্দ্রনাথ কিশোরবেলা থেকেই বিভিন্ন পুস্তিকা পাঠ করতেন এবং এই পঠন পাঠনের মাধ্যমেই তাঁর সার্থক বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ রচিত “প্রভাত সঙ্গীত”-এ আমরা তাঁর এই সার্থক বিকাশের অখণ্ড দৃষ্টান্ত পায়। তাঁর রচনার যাত্রাপথ আরম্ভনের ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই “প্রভাত সঙ্গীত”-এ। প্রভাত সঙ্গীত কাব্য সংকলনের অন্তর্গত নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতার কিছু অংশ এই ইতিহাসকে কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা করে —
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখির গান।”
হঠাৎ-ই কবির মনে কবিতার যে ,অবারিত ধারার উন্মেষ ঘটে তারই কথা বলা হয়েছে প্রভাত সঙ্গীতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আত্ম উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবং এই আত্ম উন্মোচনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে তাঁর বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনা।

রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তি হিসেবে বিশ্লেষণ করতে গেলে, সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আলোচনায় আসে তা হলো তাঁর আত্মবিশ্লেষণের জায়গাটি। তিনি নিজের অন্তরের সমস্ত ভাবনাকে বিভিন্ন রচনার মধ্যে স্থান দেন এবং এই ভাবনা গুলি-ই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে আমাদের পথ প্রদর্শক। এই কারণবশত রবীন্দ্রনাথকে ব্যাক্তি হিসেবে এবং লেখক হিসেবে বুঝতে গেলে তাঁর রচনাকে তথা তাঁর রচনার ধারাকে বোঝা আবশ্যক।

প্রসঙ্গত “জীবনস্মৃতি” এবং “ছেলেবেলা” রচনার ক্ষেত্রে লেখক যে একেবারে সঠিক দিনপঞ্জী অনুযায়ী সমস্ত তথ্য দিয়েছিলেন তা নয় বরং নিজ ব্যাক্তিমানসের স্মৃতিপটে তাঁর যে সব স্মৃতি ভেসে উঠেছিল, সেইসব স্মৃতি গুলিকেই তিনি এই পুস্তিকা গুলির অন্তর্ভুক্ত করেন। তথাপি এর ভিত্তিতে আমরা বলতেই পারি লেখক নিতান্ত গতানুগতিক ভাবে যে নিজ লেখা সম্পন্ন করতেন তা নয়। তাঁর লেখায় রয়ে যেত মৌলিকতার ছোঁয়া। যে ছোঁয়া রচনা গুলিকে করে তুলতো পরম তৃপ্তিদায়ক। সেই সময়ে কাল্পনিক পুষ্প মুকুল সহযোগে সাজিয়ে তোলা রচনা গুলি আজও রয়ে গেছে। বই বাজারের কোণায় কোণায় রবীন্দ্রনাথের রচনা উপলব্ধ। তবুও এই মানুষটিকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের বেগ পেতে হয়। খুঁটিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে এই বেগ পাওয়ার কারণ আসলে যথার্থ পঠনের অভাব। আমরা কিছু কিছু জনশ্রুতির সাথে কিছু কিছু লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, এই প্রচেষ্টাকে কখনোই অমূলক বলা যায়না তবে এরই সাথে আর একটু জোর দিয়ে যদি আমরা রবীন্দ্রনাথ কে বোঝার চেষ্টা করি তবে সাধারণ স্তরে খুব সহজেই কবিগুরুর নাগাল পাওয়া সম্ভব।

বিশেষ চিন্তক তথা বিদ্যান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সর্বজন মাঝে খ্যাত। মনীষী হিসাবে যদি রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখা করতে হয় তবে,আমরা তাঁর ভাবনা জগতের নানা দিককে আলোচনা করলেই এর সুরাহা করতে পারবো। শিক্ষা, মানবতাবাদ, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতির উন্নয়নে উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জমিদারি কাজের সূত্রে শিলাইদহে থাকাকালীন তিনি প্রজা উন্নয়নেও ব্রতী হন। এর দৃষ্টান্ত আমরা “ছিন্নপত্রাবলি”-তে সংকলিত নানা পত্রের মধ্যে পায়।

শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামত ছিল ভিন্ন প্রকারের তিনি চেয়েছিলেন মানুষের আত্মপ্রকাশের ইচ্ছেকে রূপ প্রদান করতে। তিনি বলেছিলেন, নীলাকাশের উদয়াস্তের প্রাঙ্গনে সুকুমার বালক বালিকার অব্যক্ত বেদনার , প্রকাশ ঘটানোর কথা। গৌণ আইন কানুনের জঞ্জালের বাইরে প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রে শিশুদের উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এবং এই চাওয়াকেই কলেবর প্রদানের জন্য ১৯০১ সালে তিনি ৫ জন ছাত্রকে নিয়ে শুরু করেন ব্রহ্মচর্য-আশ্রম। গুরুদেবের মতে শিক্ষা হলো এমন একটি জিনিস যা ব্যক্তিকে যথাযথ ভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এরই সাথে তাঁর শিক্ষাদর্শে অন্তর্ভুক্ত হয় পল্লীপুনর্গঠনের প্রয়াস। ১৯০৬ সালে গুরুদেব তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ আরো দুইজন কে আমেরিকা পাঠান কৃষিবিজ্ঞান, গো-পালন, ডেয়ারি শিল্প সংক্রান্ত পাঠের উদ্দেশ্যে। ১৯১২ সালে তিনি সুরুলের কুঠি বাড়ি ক্রয় করেন। এবং এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত কৃষি উন্নয়ন কেন্দ্র পরবর্তীকালে শ্রীনিকেতন নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন অর্জন করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত গুরুদেবের শিক্ষা সংক্রান্ত ভাবনার প্রতিরূপক হিসেবে বিশ্বভারতী দন্ডায়মান।

রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তার জগতে এ ছাড়াও অন্যান্য নানা বিষয় কার্যকর হয়। বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ছন্দরীতির বদল করতেও কবিগুরুর বিশেষ ভূমিকা বর্তমান। মানসী পর্যায়ে লেখক কলাবৃত্ত রীতির প্রচলন করেন। মুক্তদল এবং রুদ্ধদলের মাত্রার নবমূল্যায়ন করেন তিনি নানা কবিতা মাধ্যমে। এছাড়া মানসী পর্যায়েই কবির কবিসত্তার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। “কড়ি ও কোমল” পর্যায় পর্যন্ত লেখকের যে সব, লেখা প্রকাশ লাভ করে সেই সব লেখার উর্ধে উঠে মানসী পর্যায়ে লেখক সম্পূর্ণ লেখকসত্তার অধিকারী হন। সাহিত্য জগতের বাইরে রাজনৈতিক স্তরের নানা কাজেও রবীন্দ্রনাথ অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে নিজ মন দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। নাইট উপাধি ত্যাগ করেন পাঞ্জাবের জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের জন্য। এছাড়াও নানা ভাবে তাঁর প্রতিবাদের সুর প্রতিধ্বনিত হয়।

প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তাঁর এক মোক্ষম অস্ত্র হলো সাহিত্য। সাহিত্যের তরণীকে অবলম্বন করে লেখক নিজের মত ব্যক্ত করেন নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে। সাহিত্য জগতে ভাববাদী লেখকগণের তালিকার মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সৌন্দর্যবোধ, ভাববাহুল্যতা সর্বদায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। সাহিত্যের রসকে কিভাবে উপলব্ধি করতে হয় এ বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেন। বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থের “বাজে কথা” প্রবন্ধে লেখক অরসিককে রসপ্রদানের ক্ষেত্রে বিরূপ মন্তব্য করে বলেন , সাহিত্যের রস রসিকের জন্যই বরাদ্দ থাকা কাম্য। অরসিককে রসপ্রদান কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় কারণ প্রয়োজনবাদিরা কখনো অপ্রয়োজনের আনন্দ উপভোগ করতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথ এই ভাবেই সাহিত্যের মাধ্যমে নানাধরণের বিষয় ফুটিয়ে তোলেন এর পাশাপাশি সুক্ষ থেকে সুক্ষতম বিষয় হয়ে ওঠে তাঁর রচনার উপজিব্য ।

সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ হিসাবে কবিগুরু সমাজের নানা অসংতির মোকাবিলাও করেন। সমাজের নিয়মকে লঙ্ঘন করে প্রথম দিকে চোখের বালির বিনোদিনী এবং বিহারীর বিধবা বিবাহ না দিতে পারলেও। পরবর্তী কালে চতুরঙ্গের বিধবা রমণী দামিনী ও শ্রীবিলাসের বিবাহ তিনি দেন নির্দ্বিধায়। “ত্যাগ” গল্পে স্ত্রী কুসুমের জন্য সমাজের মানা উপেক্ষা করে হেমন্তের গৃহত্যাগ, লেখকেরই কলম নিঃসৃত। সমাজের অন্তঃসারশূন্য নিয়মকে গ্রাহ্য না করে হেমন্তের এই ইতিবাচক ত্যাগ, আধুনিক মনস্ক ভাবনার বার্তায় বহন করে। সমাজ সমাজসংস্কারক, শিক্ষাগুরু, সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক সবরকম নামে নামাঙ্কিত করলেও যেন কবিগুরুকে ছোট করা হয়। তৎকালীন যুগের সাপেক্ষে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা মানব জীবনে, মানব সমাজে, এবং সাহিত্য জগতে যে পরিবর্তন আনে তা সত্যি অনস্বীকার্য।।