ছোটগল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়


পরিশালীনমুক্ত রবীন্দ্র উত্তরতার স্বচ্ছন্দ এক কালচিহ্ন – কল্লোলগোষ্ঠী। তাদের প্রথম সমরোত্তর সংশয়, অস্থিরতা, নাগরিক মনোভাব, নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গী, রোমান্টিক বিদ্রোহের আবহের মধ‍্যে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক নতুন এবং স্বতন্ত্র‍্য মাত্রা সংযোজন করেছিলেন ত্রয়ী বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। একজন আমাদের বিজ্ঞানবোধ ও মানবমুক্তির আস্বাদনে আস্বাদ‍্য করে তুললেন তাঁর সৃষ্টি সম্ভারকে অপর একজন তাঁর সযত্নলালিত রাঢ়ের সীমানাকে তাঁর সাহিত‍্যে স্থান দিলেন, আর তৃতীয় ব‍্যক্তিত্ব আমাদের চিরপরিচিত শৈশবকে নতুন করে প্রত‍্যক্ষ করালেন।
পল্লীপ্রকৃতি, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন এই ত্রয়ী বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখনীতে নতুনভাবে ধরা পড়লেও বিভূতিভূষণের রচনায় দ্বন্দ্বহীন স্নিগ্ধ উপস্থিতি যুক্তিবাদকে প্রাধান‍্য দেওয়া অন‍্য দুই বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে।

সাহিত‍্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ‍্যায়ের কথায় –
“ঝড়ের যুগে বিভূতিভূষণের প্রশন্তি ঈর্ষা করবার মতো” (সাহিত‍্য ও সাহিত‍্যিক)

ভারতবর্ষ ও ভারতীয় সাহিত‍্যের যে স্থায়ীরস স্নিগ্ধ গভীর শান্তরস তা বিভূতিভূষণের সাহিত‍্যে স্থায়ী অক্ষরে মুদ্রিত আছে। বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ছোটগল্পের রচনাকাল ১৯২২ – ১৯৫০। এই আঠাশ বছরে বিভূতিভূষণ ২১৮টি ছোটগল্প লিখেছেন। বিভূতিভূষণের গল্পগ্রন্থের সংখ‍্যা – ১৯

১. মেঘমল্লার (১৯৩১)         ২. মৌরীফুল (১৯৩২)
৩. যাত্রাবদল (১৯৩৪)         ৪. জন্ম ও মৃত‍্যু (১৯৩৭)
৫. কিন্নরদল (১৯৩৮)          ৬. বেনীগীর ফুলবাড়ি (১৯৪১)
৭. নবাগত (১৯৪৪)             ৮. তালনবমী (১৯৪৪)
৯. উপলখন্ড (১৯৪৫)         ১০. বিধু মাস্টার (১৯৪৫)
১১. ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫)        ১২. অসাধারণ (১৯৪৬)
১৩. মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭) ১৪. নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব (১৯৪৮)
১৫. জ‍্যোতিরিঙ্গন (১৯৪৯)      ১৬. কুশলপাহাড়ী (১৯৫০)
১৭. রূপহলুদ (১৯৫৭)        ১৮. অনুসন্ধান (১৯৬০)
১৯. ছায়াছবি (১৯৬০)

বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের প্রথম গল্প – ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকায় মাঘ সংখ‍্যায়। গল্পে প্রকাশিত বৈশিষ্ঠ‍্যগুলি সূত্রকারে সাজিয়ে পাই –

প্রকৃতিচেতনা –
“বিশ্বস্রষ্টার মধ‍্যে যোগসূত্রের আবিষ্কার” রবীন্দ্রসাহিত‍্যের অন‍্যতম বৈশিষ্ঠ‍্য বলে বিভুতিভূষণের মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রোত্তর কথাশিল্পীদের মধ‍্যে বিভূতিভূষণ‌ই সম্ভবত এই ধারাটি সার্থকভাবে অনুসরণ করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির মধ‍্যে যে বিপুল রহস‍্যের সন্ধান পেয়েছেন সে সন্ধান বিভূতিভূষণের প্রকৃতিবোধের মধ‍্যে অন‍্যতম উৎস। তবে, কেবলমাত্র প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তিনি কখন‌ও গল্প লেখেননি – প্রকৃতি যখন‌ই আবির্ভূত হয়েছে তখন‌ই তার সঙ্গে এসে দেখা দিয়েছে মানুষ এবং মানুষের উপাস‍্য দেবতা।
     একদিকে ওয়র্ডস‌ওয়ার্থের কাব‍্যে প্রকৃতির অন্তর্লীন সত্তার গভীরতম উপশব্ধির প্রকাশ, আবার হার্ডসনের মতো প্রকৃতিপ্রেমিকরা মূলত ‘Naturalist’ কিন্তু বিভূতিভূষণের লেখনীতে এই দুয়ের সার্থক সমন্বয় পাই। একদিকে প্রকৃতির রূপময়ী কান্তি আর তার‌ই অন্তরালে অন‍্যদিকে পেয়েছি নিগূঢ় প্রাণসত্তাকে। প্রকৃতি নিয়ে তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য হল – কুশল পাহাড়ী, কৃপালিনী কলোনি, কনে দেখা প্রভৃতি।

মানবচেতনা –
বিভূতিভূষণ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন,
“এই প্রকৃতির সঙ্গে, পাখির গানের সঙ্গে মানুষের সুখ দুঃখের যোগ আছে বলেই এত ভালো লাগে”
প্রকৃতির অনুষঙ্গে মানবচেতনা, মানবীয় রূপ ধরা পড়েছে তাঁর ছোটগল্পগুলোতে। বলা যেতে পারে, তাঁর ছোটগল্পের ভূমন্ডলে প্রায় তিনভাগ মানুষ এবং এক ভাগ অপরাপর। এই সাধারণ মানুষের তুচ্ছ ঘটনা তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।
‘কিন্নর দল’ গল্পের গ্রামের মানুষ ঈর্ষাকাতর, বিবাদপ্রিয় ; এই প্রতিবেশের বদল ঘটাচ্ছেন শ্রীপতির ব‌উ, গ্রামের অন্ধকার জীবনের মধ‍্যে আলোর প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সাধারণ প্রাত‍্যহিক জীবনের মধ‍্যেও যে মাধুর্যময় মুহূর্ত আছে তা এখানে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন।
শুধু তুচ্ছ ঘটনা নয়, বিভূতিভূষণের গল্পে সাধারণ মানুষ তাদের তুচ্ছ আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উপস্থিত। ‘পুঁইমাচা’ গল্পের ক্ষেন্তির জীবনের অন‍্যতম আকাঙ্ক্ষা কুঁচো চিঙড়ি দিয়ে রান্না করা পুঁইশাকের চচ্চড়ি।
সাধারণ মানুষের ছোটোখাটো সুখ দুঃখ বা আনন্দ বেদনার প্রতি গভীর সহানুভূতি থাকার জন‍্য তাদের চরিত্রে ত্রুটি বিচ‍্যুতি বা অপরাধগুলো হয়ত বিভূতিভূষণের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত। মানুষ সম্পর্কে এই অপরিসীম উদারতার জন‍্য তাঁর রচনায় তথাকথিত ভিলেন নেই। তাই তিনি অনায়াসে ‘বিপদ’ গল্পের হাজুর পতিতাবৃত্তি মেনে নিতে পারেন, তিরস্কার করবে ঠিক করেও তিনি তার জীবিকাগ্রহণকে সমর্থন করে নেন –
“যে কখনো ভোগ করে নাই, তাহাকে ত‍্যাগ করো যে বলে, সে পরমহিতৈষী সাধু হতে পারে, কিন্তু সে জ্ঞানী নয়”
শরৎ প্রেমেন্দ্রর সাহিত‍্যে রূপোপজীবিনীর বিচিত্র রূপায়ণ আমরা পেয়েছি, পেয়েছি সহানুভূতি, জ্বালা, সমাজজিজ্ঞাসা ; কিন্তু এমন সহজভাবে হাজুর অপরাধের এমন সত‍্য সমর্থন বাংলা সাহিত‍্যে আগে দেখা যায়নি।

মহাকালচেতনা –
জীবনবোধের তাৎপর্যমন্ডিত অর্থগভীরতার পাশে আর এক জায়গায় জীবন যেখানে কায়াহীন, অর্থহীন, উদ্দেশ‍্যহীন অনির্দিষ্টতায় হয়ে আছে সেই অনির্দিষ্টতাকে নিয়ে বিভূতিভূষণ ‘ভুন্ডুলমামার বাড়ি’র মত সার্থক গল্প রচনা করেছেন। এই অনির্দিষ্টতা শুধু এককালের নয়, কাল থেকে কালান্তরে বিসর্পিত – ভুন্ডুলমামার বাড়ির মতোই তা অসমাপ্ত –
“জীবনের পিছন ফিরে চেয়ে দেখলে যতদূর দৃষ্টি চলে ততকাল ধরে যেন অনন্তকাল, অনন্তযুগ ধরে ভন্ডুলমামার বাড়ির ইট একখানির পর আর একখানি উঠেছে – এই অনাদ‍্যন্ত মহাকাল বেয়ে কতশত জন্মমৃত‍্যু, সৃষ্টি ও পরিবর্তনের ইতিহাসের মধ‍্য দিয়ে ভন্ডুল মামার বাড়ি হয়ে চলেছে – ওর‌ও বুঝি আদিও নেই, অনন্ত নেই।”
চিঠিতে লিখেছেন তিনি, তাঁর উপন‍্যাসের মূল সুর – “Vastness of Space and passing time”. শুধু উপন‍্যাসে নয় বিভূতিভূষণের সাহিত‍্যের একটা বড় উপলব্ধি এই চলমান মহাকালের স্বরূপ উপলব্ধি। তাই বিভূতিভূষণের সাহিত‍্যে শুধু good art এর স্নিগ্ধতা নয়, great art এর গভীর প্রশস্তি আছে যা পাঠককে শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর বিশ্বাসে উত্তীর্ণ ও বিশ্বস্ত করে তোলে।
‘বড়দিদিমা’ গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় কুঁচ কাঁটার জঙ্গলের ভিড়ে ভাঙা পোড়া বাড়ির মাঝখানে এ এক মহাকালের মিউজিয়ম, যেমন বিষণ্ণ, তেমনি বিস্ময়কর।

পটভূমির বিস্তৃতি –
         কেবল মহাকাল নয়, বিভূতিভূষণের সাহিত‍্যে স্থান পেয়েছে বিস্তৃত পটভূমি। তাঁর ছোটগল্পের ইতিহাস ও ভূগোল যথাক্রমে বর্তমান ও গ্রাম বাংলা নিয়ে হলেও তার সীমা দূর কালে ও দেশে বিসর্পিত। তাঁর ছোটগল্পের ইতিহাস যেমন ও ভুগোল যথাক্রমে বর্তমান গ্রাম বাংলা নিয়ে হলেও তার সীমা দূর কালে ও দেশে বিসর্পিত। তাঁর ছোটগল্পের ইতিহাস যেমন ‘মেঘমল্লার, ‘প্রত্নতত্ত্ব‘, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি গল্পে অতীত বৌদ্ধযুগে ব‍্যাপ্ত, ভৌগলিক সীমাও তেমনি ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’, ‘অভিমানী’, ‘টান’,
প্রভৃতি গল্পে সুদূর উত্তর ভারত, কাবুল এমনকি আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ছোটগল্পের অধিবাসী – আদিবাসী থেকে ঈশ্বর।

অতীতচারিতা –
      অতীতচারিতা রোমান্টিসিজমের এক অন‍্যতম উপাদান। কিন্তু বিভূতিভূষণের রোমান্টিকতা কেবল বিশুদ্ধ সৌন্দর্য এবং অতীন্দ্রিয় প্রেমের প্রতি আকর্ষণের জন‍্য‌ই নয়। কখনো নিছক ইতিহাস প্রীতিতে আবিষ্ট হয় আবার কখনো বা প্রাচীন হিন্দু বৌদ্ধযুগের কোনো বিশেষ কাহিনীর সাহায‍্য নিয়ে নিজস্ব জীবনদর্শন উপস্থাপিত করার জন‍্য তিনি অতীত ভারতবর্ষ পর্যটন করেছেন। তাঁর এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য হল – ‘মেঘমল্লার’, ‘নাস্তিক’, ‘স্বপ্ন বাসুদেব’, ‘শেষলেখা’ প্রভৃতি।
     হিন্দু বৌদ্ধযুগের পটভূমিকায় রচিত এই জাতীয় ছোটগল্পগুলিতে বিভূতিভূষণ বস্তুনিষ্ট ঐতিহাসিক তথ‍্য বা ঐতিহাসিক চরিত্র সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি আসলে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করে সেই পটভূমিতে চিরন্তন মানবলীলাকে চিত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তাই মেঘমল্লার যেমন একদিকে প্রদ‍্যুম্নের আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে বন্দিনী দেবী সরস্বতীকে উদ্ধারের কাহিনি অপরদিকে তেমনি তা সুনন্দ এবং প্রদ‍্যুম্নের প্রেমজীবনের ব‍্যর্থতার কাহিনি। মানবজীবনের চিরন্তন অনুভূতিশীল বিশেষ করে প্রেম এই ধরণের ছোটগল্পগুলিতে মুখ‍্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ইতিহাস এখানে এই সার্বজনীন অনুভূতি সৃষ্টির উপাদানমাত্র।

আধ‍্যাত্মিকতা –
          সাধারণত মানবজগৎ এবং প্রকৃতিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ উদাসীনতা আমাদের দেশের আধ‍্যাত্মিকতার অন‍্যতম লক্ষণ বলে ধরা হয়। কিন্তু বিভূতিভূষণের আরাধ‍্য ঈশ্বর তাঁর চারপাশের অতিপরিচিত মানবজগৎ এবং প্রকৃতিজগতের মধ‍্যে বিরাজমান। সেই মহাশিল্পীর বিরাট লীলাকে উপলব্ধি করাই তাঁর মতে প্রকৃত অধ‍্যাত্ম সাধনা। তাঁর জীবনে ও সাহিত‍্যে প্রকৃতিকে আশ্রয় করে এই অধ‍্যাত্মচেতনার ক্রম অভিব‍্যক্তির স্পষ্ট পরিচয় আছে।
       সমাজ এবং সংসারের দায়িত্ব অস্বীকার করে অধ‍্যাত্মসাধনার যে ঝোঁক তার প্রতি বিদ্রুপ করেছেন ‘মহাপুরুষ হরিদাস’ গল্পে। আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি করে হরিদাস প্রথমে চাকরি এবং সংসারের ক্ষুদ্র বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলেন কিন্তু দারিদ্র‍্য, অভাব, অনটন পত্তনদার এবং সাংসারিক কর্তব‍্য তাকে পুনরায় নতমস্তকে জীবিকা স্থলে ফিরতে বাধ‍্য করল।
     ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পে সাধু লেখককে বলেছেন –
“মানুষ মুক্ত আছেই কেবল সে সম্বন্ধে নিজে সচেতন নয় সে।…সাংসারিক কর্তব‍্যের সন্ধানে সে নিজেকে স্বেচ্ছায় বেঁধে রেখেছে। কিন্তু এই বন্ধনটুকু তার জীবন সাধনার সার্থকতার পক্ষে অত‍্যন্ত প্রয়োজনীয়। কেননা, এই সমস্ত ছোটোখাটো অসংখ‍্য বন্ধনেই মহানন্দময় মুক্তির আস্বাদ এনে দেয়।”
আসলে বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করতেন যে আধ‍্যাত্মিক জীবন, মহাজীবন, ও প্রকৃতিজীবন – এই ত্রিবিধ জীবনের সমন্বয়ের ফলেই জীবনের সমগ্রতা রূপ রস সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

অতিপ্রাকৃত –
       বিভূতিভূষণের গল্পে অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে নিয়ে লেখা অনেকগুলি গল্প আছে। অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিভূতিভূষণের কাছে শুধু কৌতূহলদ্দীপক ব‍্যাপক নয়, পরলৌকিক অদৃশ‍্য জগতের ইঙ্গিতবহ। ‘কবিরাজের বিপদ’ গল্পের কবিরাজ কবিরাজী করতে গিয়ে জানতে পেরেছে, মরা মানেই বৃহত্তর জীবনের মধ‍্যে প্রবেশ করা। পরলৌকিক ও বৃহত্তর জীবন বিশ্বাসের মত‌ই প্রবল তার অলৌকিকতার ওপর বিশ্বাস। লেখকের কাছে অবশ‍্য অলৌকিক বলে স্বতন্ত্র কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব নেই – তা প্রাকৃত বুদ্ধির অতীত বলেই অতিপ্রাকৃত। অতিপ্রাকৃতের প্রতি স্বাভাবিক বিশ্বাসে এবং অতিপ্রাকৃত কাহিনি রচনার নিপুণতায় এই বিভাগে একাধিক সার্থক গল্প রচিত হয়েছে যেমন – অভিশপ্ত, তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প ইত‍্যাদি।

        বিভূতিভূষণের গল্পের অন‍্যতম দিক তিনি উপলব্ধি ও অনুভূতির দিকটিকে প্রকরণের মাধ‍্যমে তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন –
“হয়ত গল্পটা কিছুই নয় – মানুষের ব‍্যাথাহত আত্মার আহুতি – সেটাই আসল জিনিস।”
অর্থাৎ তাঁর গল্প মানে ঘটনার বিন‍্যাস নয়, কাহিনির জটিলতা নয়, চরিত্রচিত্রণ নয়, গল্প হল অনুভূতি ও উপলব্ধির ভাষ‍্যরূপ।

        তাঁর লেখার মধ‍্যে আশ্চর্য ধরণের সরলতা আছে। অত‍্যন্ত জটিল এবং গভীর বিষয়বস্তুকে তিনি সহজ ও সরল ভাষায় প্রকাশ করতে সমর্থ ছিলেন। ফলে অনেক গভীর রচনাই পাঠকের কাছে হালকা বলে প্রতিভাত হয়।

ড. ভূদেব চৌধুরি তাই সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন –
“কি প্রকরণে কি বিষয় বিন‍্যাসে সব দিকেই তাঁর রচনা অপ্রত‍্যাশিতভাবে সরল যার ফলে সৃষ্টির মধ‍্যে জীবনের ভারটুকু আর কিছুতেই অনুভব করা যায় না”

বিভূতিভূষণের গল্পে ভাষার সারল‍্য তাঁর জীবনকে সহজ সরল দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা থেকে এসেছে।

     বিভূতিভূষণের গল্পগুলির মধ‍্যে কথকতার ভঙ্গী লক্ষ‍্য করা যায়। তাঁর জীবনী থেকে জানা যায় – “শৈশবে বিভূতিভূষণের সাহিত‍্যবুদ্ধির উন্মেষ পিতার কথকতা শুনে।”
সমস্ত ধরণের শ্রোতার মনকে আকৃষ্ট করার জন‍্য‌ই কথক ঠাকুর সমস্ত জটিল দুরূহ ভাষা ছন্দ অলঙ্কার এড়িয়ে চলতেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করার জন‍্য বিভূতিভূষণের রচনা এতটা মনোমুগ্ধকার।

    সাধারণত ছোটোগল্পের মধ‍্যে যে দৃঢ় সংহতি থাকে, আরম্ভের মধ‍্যে আকস্মিকতা থাকে এবং সমাপ্তিতে চমক থাকে তা তাঁর ছোটগল্পে নেই। একধরণের উদাসীনতা এবং নিরাসক্তবোধ তাঁর ছোটগল্পকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্বভাবত বিভূতিভূষণের ভিন্ন জীবনদর্শনের কারণে।

     কল্লোলের সমকালে হয়েও বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ভিন্ন পথের পথিক। তাঁর রচনায় পাশ্চাত‍্য ভাবধারা, নেতিবাদী সাহিত‍্য সাধনা অনুপস্থিত। চারপাশের সাধারণ তুচ্ছ জগৎ থেকে অসাধারণ মাধুর্যমন্ডিত দিকটিকে অপরিসীম নিষ্ঠায় তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর ছোটগল্পে। পশ্চিমী আধুনিকতার বিপরীতে জীবনবীক্ষা প্রকাশ করেছেন। তিনি চেনাজগৎ, বাস্তবতা, দেশজ ধারা, ঐতিহ‍্যের উৎসভূমি থেকে আধুনিকতা নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তৎকালীন সাহিত‍্যে প্রতিফলিত উগ্র আধুনিকতা সম্পর্কে নলিনীগুপ্তকে লিখেছেন –
“আমরা যে অর্থে সাহিত‍্যের আধুনিকতা আনতে চাচ্ছি সেটা প্রকৃত পক্ষে আমাদের নয়, ইউরোপের।”

         কল্লোলীয়দের লেখায় যে প্রেমচেতনা প্রকাশ পেয়েছে তা অনেকটা যৌনচেতনার নামান্তর ; তাদের প্রেমচেতনা মূলত ফ্রয়েডীয় ও লরেন্সীয় তত্ত্বের পরিচয়বাহী। এ সম্পর্কে বিভূতিভূষণ তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন –
“বাংলার সমস‍্যা যৌন সমস‍্যা নয়, বাংলার সমস‍্যা রোগ, দারিদ্র‍্য, মুর্খতা – এই সব। সৌখিন যৌন সমস‍্যা হয়ত শহরে আছে – সে খুব বড় সমস‍্যা নয়।”

কল্লোল লেখকদের অভিজ্ঞতা সংকীর্ণ নগরজীবনের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ ; বিভূতিভূষণ নাগরিক জীবনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছেন, তার পরিবর্তে গ্রাম জীবনের প্রাচুর্যতা দেখিয়েছেন। অভিজ্ঞতাবহুল গ্রামের লাবণ‍্যময়তা, প্রতিদিনের দারিদ্র‍্যপীড়িত জীবন, সাধারণ মানুষের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ পেয়েছে এবং এর মধ‍্য দিয়ে তিনি রোমান্সের অবতরণ করেছেন। তিনি ছিলেন অরণ‍্যপাগল। ডায়েরিতে লিখেছেন –
“এই অরণ‍্য‌ই ভারতের আসল রূপ, সভ‍্যতার জন্ম হয়েছে এই অরণ‍্য শান্তির মধ‍্যে, বেদ আরণ‍্যক উপনিষদ জন্ম নিয়েচে এখানে – সমাহিত স্তব্ধতায় – নগরীর কোলাহলের মধ‍্যে নয়”।

        সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সাহিত‍্য শেষ পর্যন্ত পথিককে নিয়ে যায় প্রাত‍্যহিকতায় খন্ডিত এই জীবন থেকে এক মহাজীবনের আশ্বাসে, প্রশান্তিতে, প্রসন্নতায়, আত্মার নির্ভীকতায়। অপুর মতো তার‌ও মনে হয়,
“সে জীবনের অধিকার হ‌ইতে তাহাকে কাহার‌ও বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই, সে দীন নয়, তুচ্ছ নয় – এটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভ‌ও নয়।”

– – – – – –