✒️ ভূমিকা :-
বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ যতই দাম্ভিক পদক্ষেপ রেখেছে, ভূমিকম্প, ঝড় ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে ততবার অসহায়তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প ঝড় ইত্যাদি ছাড়াও মানুষ যে প্রকৃতির কাছে নেহাতই শিশু তা মনে করিয়ে দেবার জন্য প্রকৃতির শেষ মার হল মহামারী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের আকাশ ছোঁয়া উন্নতির পরেও প্রাচীনকাল থেকে আজও পৃথিবীকে শাসন করে চলেছে কলেরা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এইডস, ক্যান্সারের মতো নানা মারণ রোগ। এই তালিকার নবতম সংযোজন বর্তমান বিশ্বের ত্রাস করোনা ভাইরাস কোভিড – ১৯।
✒️ করোনা ভাইরাস কী :-
করোনা ভাইরাস, ভাইরাসের একটি শ্রেণি যা সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের আক্রান্ত করে। করোনা ভাইরাস পরিবারের অনেক সদস্য বা প্রজাতি আছে যাদের মধ্যে কিছু সাধারণ আর কিছু মারাত্মক। মারাত্মক প্রজাতিগুলির মধ্যে অন্যতম হল সার্স এবং কোভিড ১৯।
‘করোনা ভাইরাস’ শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে এসেছে যার অর্থ ‘মুকূট’। কারণ ইলেকট্রিক আণুবীক্ষনিক যন্ত্রে করোনার যে ছবি পাওয়া গেছে তাতে অনেকটা মুকূটের মতো দেখাচ্ছে। তবে, ‘করোনা’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে যার অর্থ মালা বা হার।
করোনা ভাইরাস ১৯৬০এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রমিত ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসাবে দেখা যায়। এছাড়া ভাম, গরু, শূকর ইত্যাদি নানা প্রাণীদেহে নানা প্রজাতির করোনা ভাইরাস নানা সময়ে দেখা গেছে। এইসব প্রাণী থেকে মানুষের দেহে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। তবে যে তিনটি প্রজাতি মানবদেহে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটিয়েছে তা হল – সার্স কোভি, মার্স কোভি বা নোভেল করোনা ভাইরাস ২০১২, আর নোভেল করোনা ভাইরাস ২০১৯/ সার্স কোভি -২, যার প্রচলিত নাম – কোভিড ১৯।
✒️ রোগলক্ষণ ও সংক্রমণ :-
সাধারণত শুষ্ক কাশি, বযমি, গলা বা মাথা ব্যথা, পেটের সমস্যা, জ্বরের মাধ্যমে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের উপসর্গ এবং পরে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা যায়। এটি সাধারণত ফুসফুসকে আক্রমণ করে। আবার অনেকক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ ছাড়াই মানবদেহে করোনা ভাইরাসের পজিটিভ হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
হু’র নির্দেশিকা অনুযায়ী এই ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে অনেকক্ষেত্রে ২৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে দেখা গেছে।
এই কোভিড ১৯ এর উৎসস্থল চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর। গবেষকদের একাংশের দাবি এই উহানের একটি পাইকারি বাজার যেখানে সামুদ্রিক মাছ সহ নানা প্রাণি বিক্রি হয়, এই বাজারের সঙ্গেই সম্পর্ক আছে কোভিড ১৯ এর। বাজারের মুরগি, বাদুড়, খরগোশ নানান সামুদ্রিক মাছ করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে। তবে গবেষকরা বলছেন, চিনের ‘হর্সগু’ নামের একপ্রকার বাদুড়ের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল আছে।
চিন থেকে এই কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে, মানুষই এর বাহক, হাঁচি কাশি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে ভারতবর্ষ বাংলাদেশ সহ ২১৩টির ও বেশি দেশ কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে।
✒️ মহামারী রূপে কোভিড- ১৯ :-
সাধারণত যখন বিশ্বজুড়ে বহুদেশের মানুষ কোনো বিশেষ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন তখন তাকে বিশ্ব মহামারী বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো রোগের প্রবণতা ও বিস্তারের ধারাবাহিকতা বা ক্রমশ ঊদ্ধর্গতি দেখে তাকে বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করে।
ম্যালেরিয়া , ডেঙ্গু, জাপানি এনকেফেলাইটিস, সার্স, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু – ইত্যাদি নানা রোগে আমাদের ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গ আক্রান্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি নানান মহামারীও শতাব্দীর পর শতাব্দী শাসন করেছে বিশ্ববাসীর ওপর।
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায় প্রতি ১০০ বছর পর একটি করে মহামারীর পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে – ১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর পর ২০২০ সালে কোভিড ১৯।
● ১৭২০ সালে এশিয়া, আফ্রিকা, ইতালিতে বুবোনিক প্লেগ সংক্রমণে প্রায় ৫কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। রেকর্ড অনুযায়ী এই প্লেগ ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়াজাত, যা মাছির মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগের প্লতিষেধক টীকা এখনও আবিস্কৃত হয়নি।
● ১৮২০ সালে কলকাতায় প্রথম কলেরা মহামারির আকার নিয়েছিল। তারপর ক্রমে ক্রমে ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন সহ এশিয়া চিন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যার ফলে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়।
● এরপর ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণ যার পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে বর্তমানের কোভিড ১৯। সেইসময় মানুষজন H1N1 ফ্লু ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, ভাইরাসটি ক্রমাগত জিনের পরিবর্তন করতে পারত ফলে তার প্রভাব পড়েছিল মারাত্মক। প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। মূলত ১৯১৮ সালে স্পেন এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল তাই এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু । স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে।
এই স্প্যানিশ ফ্লুর অপর এক প্রজাতি ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু নামে আতঙ্কের কারণ হয়েছিল।
● আর ২০২০ সালে কোভিড ১৯ এ এখনো পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ। মৃতের সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। তবে সুস্থ হয়েছেন ৩৯ লক্ষের ও বেশি মানুষ।
✒️ প্রতিকারের উপায় :-
কোভিড ১৯ করোনাভাইরাসের এই প্রজাতিটিও অহরহ জিনের পরিবর্তন ঘটতে পারে যার ফল মারাত্মক, একদিকে মানুষের সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি গবেষকরা এর প্রতিষেধক প্রস্তুতিতে নাস্তানুবাদ হচ্ছেন। তাই এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় হল সচেতনভাবে ‘হু’র নির্দেশিকা মেনে চলা। হুর নির্দেশনামা অনুযায়ী –
●যেহেতু মানুষই নোভেল করোনা ভাইরাসের বাহক তাই রোগ প্রতিরোধে মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা social distance মেনে চলাই প্রথম এবং প্রধান প্রতিরোধের উপায়। এর জন্যই বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন সময়ে লকডাউন চলছে।
● নোভেল করোনা মানুষের নাক ও মুখের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসে সংক্রমণ করে। তাই ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে নাক মুখ ঢাকার ব্যবস্থা করতে হবে রুমাল বা মাস্ক ব্যবহার করে।
● ভাইরাস যে কোনো জায়গায় থাকতে পারে এবং তা মানবদেহে সংস্পর্শে এসে সক্রিয় হয়ে যায়। তাই হু বারবার হাত ধোবার নির্দেশ দিয়েছেন। বারবার হাতে হাত ঘষে ধুলে ভাইরাসের প্রোটিন আবরণ ছিন্ন হয়ে ভাইরাসটি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই বারবার হাত ধোয়া ভীষণ জরুরি।
● যে কোনো ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে ভাইরাসের ক্ষমতা অনুয়ায়ী আমাদের শরীর তার অ্যান্টিবডি কিছু সময়ের মধ্যে তৈরি করে নিতে পারে। বিভিন্ন ভাইরাসের ক্ষেত্রে সময়টা তার ক্ষমতা অনুযায়ী কম বেশি হয়। কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে সময়টা ১৪ থেকে ২৪ দিন। তাই এই সময়ে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়াতে হবে।
● ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়ার জন্য আমাদের মনও সুস্থ থাকতে হবে। দুশ্চিন্তা, হতাশা থেকে মনকে দূরে রাখতে হবে। নানা সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
● এছাড়া করোনা ভাইরাস যেহেতু প্রাণীদেহ থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ছে তাই সেক্ষেত্রে বাইরের পশুপাখি পশুর বাজার এসব এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়।
এছাড়া মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নানাসময় বাইরে বেরোতে হলে মাস্ক পড়া ও হাত ধোয়ার মতো সতর্কীকরণের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের পোশাক ধুয়ে ফেলা সাবান শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করার মতো কিছু নিয়ম অবলম্বন করতে হবে।
অর্থাৎ যে কোনো প্রকারে যে কোনো রকমের বর্হিসংস্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর সেটাই হবে মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধের লড়াইয়ের একমাত্র হাতিয়ার।
✒️ উপসংহার :-
উন্নয়নের নামে যথেচ্ছাচার সচেতনতার অভাব যখনই প্রবল হয়েছে ঠিক তখনই প্রকৃতি চোখ রাঙিয়ে তার উপযুক্ত শাস্তির বিধান করেছে। মারণ ভাইরাসের কারণ মানুষের বিপুল হারে মর্মান্তিক মৃত্যু, অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয় যে , যে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে একশ্রেণির মানুষ বছর বছর পরিবেশ দিবস পালন করেছেন, মহা সমরোহে চলছে অরণ্য সপ্তাহ উৎসব, মানুষকে সচেতন করার হাজার এক প্রয়াস – এইসব তুচ্ছ করে প্রকৃতি নিজেই নিজেকে দিয়েছে লকডাউনের মধ্যে।
বিভিন্ন মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে দূষণের মাত্রা অনেক নেমে গেছে, গরমের প্রভাব কমেছে, ওজোন স্তরের গহ্বর পূর্ণ হয়েছে, প্রকৃতিও অনেক সবুজ হয়েছে। এমনকি বিপুল পরিমাণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নগরায়ণের প্রভাবে মানুষ যেভাবে প্রকৃতির অন্যান্য সন্তান পশুপাখিদের কোণঠাসা করে দিয়েছিল, বিশ্বব্যাপী লকডাউনের জেরে তারাও স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছে। বনাঞ্চল থেকে প্রকাশ্য সড়কে তাদের বিচরণ লক্ষ্য করা গেছে, কোথাও ময়ূর কোথাও উটপাখি কোথাও হরিণ বা অন্যান্য পশু। এসব কিছুর মধ্যে কি মনে হয় না যে নোভেল করোনা ভাইরাস আসলে অ্যাভেঞ্জার সিরিজের থ্যানোস, যে এই বিপুল জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসেছে কিংবা কলিযুগের অবতার কল্কি যার পাপের ঘড়া পূর্ণ হতে আগমন ঘটেছে ?
Khub bhalo
Khub bhalo