আম্ফান নিয়ে মাধ্যমিক বাংলা প্রতিবেদন
■ প্রতিবেদন – ১
★ আম্ফানে বিপর্যস্ত বাংলা ★
অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের পর এবার ২০মে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে নেমে এসেছে আম্ফানের তান্ডব। তারপর কেটে গেছে চারটে দিন। কোথাও গাছ পড়ে ভেঙে গিয়েছে টালির চাল, কোথাও উড়ে গিয়েছে টিন। সাগরদ্বীপের মণিরুদ্দি শেখ থেকে আমতার বাপ্পা মন্ডলের এখন একটাই আশ্রয় খোলা আকাশ। সাগরদ্বীপ, বকখালি দীঘা সহ দুই মেদিনীপুর ও দুই ২৪ পরগণা জেলা প্রায় জলের তলায়। প্রভাব পড়েছে হাওড়া, হুগলির কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। প্রশাসন সূত্রের খবর, সাগরদ্বীপ, সাহেবখালি, কচুবেড়িয়া সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ মাটির বাড়িই সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। বিঘের পর বিঘে চাষের জমিও নোনা জলের তলায়। কোটি কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি তো হয়েছেই, তার সঙ্গে নোনা জল ঢুকে যাওয়ায় আবার কবে ফের চাষ করতে পারবে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে স্থানীয় চাষীরা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে উচ্ছে, বেগুন, পটল, ট্যমেটো, অথচ ত্রাণের খাবার, জল না পৌঁছানোর ফলে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন গ্রামবাসী। উপকূলবর্তী এলাকা থেকে একটু উপরের দিকে হাওড়া হুগলির অবস্থাও প্রায় এক। পরবর্তী তিনদিনের জমা জল সরতে শুরু করলেও পানীয় জলের সুরাহা হয়নি।
আম্ফানের হানায় আরামবাগে প্রায় ৫০টি ঘরের চাল উড়ে গেছে, হাওড়ার আমতা-বাগনানেও গৃহহীন হয়েছে স্থানীয় মানুষ। স্থানীয় গ্রামবাসী লালু মন্ডলের কথায়, “লকডাউনে চায়ের দোকান বন্ধ, ঝড়ে বাড়ির টিন উড়ে গেল। ছেলেপুলে নিয়ে থাকবো কোথায় ? খাবো কী ?” একই প্রশ্ন ঘুরছে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে। দ্বারকেশ্বর নদীর ধারে পার্বতীচক গ্রামের হরু শেখের খেদ, এক বিঘে জমি ভাগে নিয়ে তরমুজ চাষ করেছিলাম। সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ত্রাণই ভরসা। কিন্তু কেউ খোঁজ নিল না এখনও।” ঘরবাড়ি, চাষযোগ্য জমির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গবাদি পশু, হাঁস, মুরগি এর সংখ্যাটাও কম নয়। ৫ লক্ষেরও বেশি গাছ ভেঙেছে এই কালবৈশাখিতে।
তিলোত্তমা কলকাতাসহ সম্পূর্ণ দক্ষিণবঙ্গ ডুবে গেছে অন্ধকারে। বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির সূত্রের খবর, বিদ্যুতের খুঁটি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কর্মীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না, লকডাউনে শ্রমিকরাও কম আসছে, ফলে সময় লাগছে মেরামতিতে। এই দুই দিনে ১০০টির মতো খুঁটি মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে।
লকডাউনের কারণে সবাই যখন ভরসা খুঁজছে ত্রাণের বিলিব্যবস্থায়, তখন সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকাবাসীর মুখে অন্য সুর। তারা না খেয়ে থাকতে পারবে , অন্ধকারেও দিন কাটাতে পারবে কিন্তু বছরের পর বছর অনিশ্চয়তা আর কতদিন ? তাই তাদের দাবি, ত্রাণের চাল ডাল নয়, ত্রিপল নয়, স্থায়ী বাঁধ।
◆ বিকল্প শিরোনাম –
১) করোনার গোদের ওপর বিষফোঁড়া আম্ফান
২) আম্ফানের তান্ডবে অসহায় দক্ষিণবঙ্গ
■ প্রতিবেদন – ২
★ আম্ফানে ব্যাহত বিদ্যুৎ পরিষেবা ★
আম্ফানে শাসিয়ে গেছে প্রায় ১২০ ঘন্টা হতে চলল। এখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত শহরতলি ও জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। আলো জ্বলেনি খোদ রাজধানীতেও। জলের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে আধুনিক সভ্যতা। আর তারই দাবিতে করোনা, লকডাউন, সোস্যাল ডিসট্যান্সের সমস্ত বিধি শিকেয় তুলে বিক্ষোভে ফুঁসছে শহর থেকে শহরতলি। সোমবার সকাল থেকেই কলকাতার যাদবপুর, বাঘাযতীন, টালিগঞ্জ, প্রিন্স আনোয়ার শাহ, গড়িয়া, বেহালা সহ বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা অবরোধ ও থানা ঘেরাও চলে। একই ছবি দেখা যায় জেলার বিভিন্ন এলাকায়। হুগলি ভদ্রেশ্বরে মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ চলে, মেদিনীপুরে খেজুরিতে স্থানীয়রা টানা ৫ ঘন্টা ধরে বিক্ষোভ দেখান। উত্তর ২৪ পরগণায় ও নদীয়াতেও চিত্র অব্যাহত। এখন সকলের প্রশ্ন একটিই, সেনাবাহিনী নামিয়ে গাছ তো কাটা হল। কারেন্ট কখন আসবে ? টানা পাঁচদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে অসুস্থ ব্যক্তিদের। লকডাউনের কারণে চিকিৎসাতে চলছে নানা সমস্যা। তারওপর কারেন্ট না থাকায় তাদের অবস্থা আরও বেহাল। বেহালার কালীচরণ দত্ত রোডের বাসিন্দা সুমন দাস জানাচ্ছেন তার মার কিডনির সমস্যা ও ডায়াবেটিস আছে। গরমের কারণে বারবার জল চাইছেন। আবার লোডশেডিং এর কারণে ফ্রিজে থাকা ইনসুলিনগুলো নষ্ট সয়ে যাচ্ছেন তো। একইভাবে সমস্যায় পড়েছেন খুদেরা। বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ থাকার ফলে ব্যাহত হয়েছে মোবাইল ফোনের পরিষেবাও, ঘাটতি পড়েছে ইন্টারনেটের প্রবাহে। মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া যাচ্ছে না ফলে যোগাযোগ করতে পারছেন না পরিজনদের সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতে পারছে না অনলাইন ক্লাসেও।
তবে, বিদ্যুৎ বিপর্যয় প্রসঙ্গে কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম অবশ্য এর জন্য দোষ দিচ্ছেন সিই এস সি ই দের। যদিও তাদের দাবি, বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। ঝড়ে গাছ পড়ে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তার দ্রুত সামলে ওঠাই একটা চ্যালেঞ্জ।
আম্ফানের ফলে প্রায় পাঁচ লক্ষ গাছ ভেঙেছে, বিদ্যুতের খুঁটি পড়েছে লক্ষাধিক। প্রশাসন সূত্রের খবর অনুযায়ী এই বিপর্যয় মোকাবিলায় কাজ করেছেন প্রায় পনের হাজার বিদ্যুৎ কর্মী। করোনা পরিস্থিতিতে তাদের সহযোগিতা কাম্য। যদিও সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছে পানীয় জল আর বিদ্যুতের আলো কেবল অধরা এক স্বপ্ন।
◆ বিকল্প শিরোনাম –
১) আম্ফানের জেরে অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলা
২) বিফল বিদ্যুৎ পরিষেবা, বিক্ষোভে অব্যাহত
৩) কেটে গেছে ১২০ ঘন্টা, আলো এখন স্বপ্ন
৪) আলো কবে ? ঝড়ের পর ফুঁসছে শহর
■ প্রতিবেদন – ৩
★ আম্ফানে ভাসল বইপাড়া, চোখের জলে বিক্রেতারা ★
আম্ফানের তান্ডবে লন্ডভন্ড গোটা বাংলা, জলের তলায় রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলা। তার প্রভাব পড়েছে মহানগরীতেও। আম্ফানের দাপটে কলকাতার বইপাড়া এখন নদী।
করোনা পরিস্থিতিতে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বইপাড়ার ছোটখাটো বই বিক্রেতারা। তাই দু’মাসের লকডাউন কাটিয়ে ২১শে মে লক্ষীবার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল তারা, সব দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক আগের দিনেই সমস্ত সবুজ স্বপ্নকে ঢেকে দিল কালো কালো দৈত্য। লকডাউন শিথিল হওয়ার আগের দিনেই প্রবল ঝড় বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে গেল বইপ্রেমীদের আশ্রয় বইপাড়াকে।
বুধবার রাতের দূর্যোগ কাটিয়ে পরদিন ভোর হতেই কলেজস্ট্রিট পৌঁছে গিয়েছিলেন ছোট বড় ব্যবসায়ীরা। ততক্ষণে থইথই জলে ভেসে চলেছে কোটি টাকার বই। যাদের গুমটি দোকান তাদের তো ক্ষতি হয়েছেই, যাদের পাকা ঘরের দোকান রেহান মেলেনি তাদেরও। কফি হাউসের নিচে দেব সাহিত্য কুটিরের দোকান, শাটারের নিচ থেকে সব পাকা বাঁধাই করা বই টেনে বের করেছে জলের ঝাপট। একই অবস্থা দে’জ পাবলিশিং, কথা ও কাহিনি, বামা পুস্তকালয়ের মতো বড় বড় দোকানগুলির। দে’জ পাবলিশিং এর কর্ণাধার সুধাংশু দে’র আক্ষেপ – “যা বই বেশিরভাগই রাস্তায়। এখন ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করার নেই।” একই সুর মিত্র ও ঘোষেরও। সংস্থার কর্ণাধার জানাচ্ছেন – “এখন তো হিসাব করা সম্ভব নয়। কোনো বই বাঁচাতে পারব কি না ভাবছি।”
কফি হাউসের আশেপাশে থেকে ইউনিভার্সিটির রাস্তা সোজা কলেজ স্কোয়ারের দিকে রাস্তা সবটাই এখন হাঁটুজল। “থইথই জলে যেন বইগুলোর নিথর দেহ ভাসছে” – কাঁদতে কাঁদতে জানালেন ২১নং স্টলের দোকানদার। ১৪০ নং স্টলের বিক্রতেতার মুখেও হতাশা – “এতদিনের লকডাউনের কারণে সংসার চালানো খুব কষ্টে হয়ে উঠেছিল। তাই দোকান খোলার কথা ভেবেছিলাম। আর এখন তো সেই আশাও নেই। জানিনা সংসার চালার কীভাবে এবার।”
শুধু বই বিক্রেতা নয়, এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে বহু বইপ্রেমী ভাসছে চোখের জলে। সোস্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়ছে তাদের আবেগ, বইবিক্রেতাদের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা। পাবলিশার্স ও বুক সেলার্স গিল্ড এই ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আর্থিক সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। গিল্ডের পক্ষ থেকেও ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে তহবিল খোলা হয়েছে এবং সমস্ত বিশ্ব থেকেই সাহায্যের আর্জি জানানো হয়েছে। গিল্ড কর্তা ত্রিদিব চ্যাটার্জী তাঁর ফেসবুকে পাশে থাকার আর্জি জানিয়ে লিখেছেন – “লকডাউনে ছিলাম অর্ধমৃত, এখন মুমূর্ষু। অনুগ্রহ করে একটু দৃষ্টিপাত করুন সবাই।”