যোগাযোগ উপন্যাস : স্বতন্ত্রতা ও সীমাবদ্ধতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস সম্পর্কে এ কথা বলা চলে যে উপন্যাসটি একাধারে স্বতন্ত্র ও সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ অন্যান্য উপন্যাসের সঙ্গে যেমন এই উপন্যাসটিকে এক শ্রেণিতে রাখা যায় না তার কাহিনি গুণে, একই সঙ্গে কাহিনি রূপায়ণে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। কীভাবে সেটাই জানব আজকের আলোচনায়।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু আলোচনায় প্রথমেই আসি ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা বিষয়ে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায় –
১) অর্থনৈতিক শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট নির্বাচনে
২) দাম্পত্য কলহের অভিনব চিত্রণে
৩) কুমু চরিত্র রূপায়ণে
স্বতন্ত্রতার এই তিনটি মাত্রা ব্যাখ্যা করার আগে দেখে নিই ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস রচনাকালে রবীন্দ্র মনন কোন ধ্বনিতে অনুরণিত হয়েছিল –
-৹ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস প্রকাশের এগারো বছর পরে, ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ১৯২৭সালে। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন ১৯২৯ সালে।
-৹ আগেই জেনেছি রবীন্দ্রনাথে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতার একটি মাত্রা অর্থনৈতিক শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট। কিন্তু কেন বেছে নিয়েছেন এমন পটভূমি ?
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখতে পাই ১৯২৯-৩০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল। আর তার পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হচ্ছিল ৩-৪বছর আগে থেকেই। ইংল্যন্ডের উপনিবেশ হিসাবে ভারতবর্ষেও সেই অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ সবেগে আছড়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রতিফলনই ধরা পড়েছে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের পটভূমিতে।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতার অপর দুটি মাত্রা দাম্পত্য কলহের অভিনব চিত্রণ এবং কুমুর চরিত্র চিত্রণ একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু এই ভাবনার পেছনে রবীন্দ্রনাথের কোন প্রতিক্রয়াশীল মন কাজ করেছিল ?
‘আঁতের কথা’ লিখতে বসে কলম ধরেছিলেন তিনি ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সময় থেকে। তারপর চরিত্রের জটিল মনস্তত্ত্বের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন নানা প্রেক্ষাপটে, তৃতীয় চরিত্রের আগমনের মধ্য দিয়ে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে কুমু – মধুসূদনের দাম্পত্যের ফাটল হিসাবে তৃতীয় ব্যক্তি শ্যামার উপস্থিতি থাকলেও তা গৌণ, মুখ্য কারণ হল উভয়ের চিন্তাভাবনার পার্থক্য, যা অনেকটাই নিহিত আছে কুমুর চরিত্র চিত্রণে।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশের সময় ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কাহিনি শুরু হচ্ছে এই ভাবে – “আজ ৭ই আষাঢ়, অবিনাশ ঘোষালের জন্মদিন। বয়স হল তার বত্রিশ।”
এই অবিনাশ ঘোষাল আর কেউ নয়, মধুসূদন ও কুমুদিনীর ছেলে। অবিনাশ থেকে শুরু করে পেছনের প্রজন্মের দিকে আলোকপাত করার ভাবনা নিয়ে উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন ‘তিনপুরুষ’। কিন্তু দুই তিন সংখ্যা প্রকাশের পরেই নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘যোগাযোগ’। এর পেছনে রবীন্দ্রভাবনার বীজ নিহিত আছে সেই সময়েই। সালটা আবার লক্ষ করো, ১৯২৭খ্রি:, ১৯২৩খ্রি: থেকে কল্লোল পত্রিকা বাংলা সাহিত্যে একটা আলোড়ন তুলেছে, যার লক্ষ্য রবীন্দ্রবিদ্রোহ, রবীন্দ্র রোমান্টিকতার পরিবর্তে নিরাবরণ বাস্তবতার প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ তারই উত্তর দিলেন কুমুর পরিকল্পনায়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতায়। সে প্রেমকে আশ্রয় করে মুক্তি খোঁজেনি। বিনোদিনী – দামিনী – বিমলা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র করে তৈরি করলেন কুমুদিনীকে।
রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রেক্ষিতেই ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতাগুলো বিশ্লেষণ করা যাক –
৹ অর্থনৈতিক শ্রেণিদ্বন্দ্বের পটভূমি –
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারতন্ত্রের আর্থিক অবনতি হতে শুরু করল এবং পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটতে থাকল। কিন্তু ১৯২৬-২৭ সাল বাঙালির অর্থনৈতিক দূর্দশা চরম হতে শুরু করল, যার আন্তর্জাতিক মন্দা অন্যতম কারণ। তাছাড়া স্বদেশী আন্দোলনের কারণে শিক্ষিত যুবকদের সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা কমতে থাকল, তাতে অনুঘটক হিসাবে যুক্ত হল মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন।
এই প্রেক্ষাপটেই বিপ্রদাসের মতো শিক্ষিত বেকার যুবক এবং ভালো ছাত্র মাস্টার , মোক্তার হয়ে ভদ্রশ্রেণিতে ঠাঁই পাবার বদলে ব্যবসায়ী মধুসূদন ঠাঁই পেল ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের দুই মেরুতে বংশ বিবাদের শরিক হিসাবে।
ছাত্রমহলে সেকেন্ডহ্যান্ড বই বিক্রি করে ব্যবসা শুরু থেকে রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনকে নিয়ে উঠলেন কলকাতায়। এবং জানালেন – “ঘোষাল কোম্পানির আজ দেশে বিদেশে ওদের ব্যবসা বনেদি বিলিতি কোম্পানির গা ঘেঁষে চলে, বিভাগে বিভাগে ইংরেজ ম্যানেজার।” অপরদিকে বিপ্রদাসের বাড়ির পরিচয়ে বলেছেন এক মহলে বিলাতি বৈঠকখানা, সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর আসবাব। বিশেষ ক্রিয়াকর্মে জিলার সাহেব সুবাদের নিমন্ত্রণোপলক্ষে এই ঘরের অবগুন্ঠন মোচন হয়। প্রথম দিকের অধ্যায়ে এই সূক্ষ বৈপরীত্য পাঠকের কাছে সচেতনভাবে মেলে ধরে কুমুদিনী মধুসূদনের বিয়ের প্রস্তুতিতে অভিনিবিষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।বলা যায়, দুই তন্ত্রের রুচি ও জীবনবোধের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে অন্দরে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন, দাম্পত্য ফাটলের দীপ জ্বালানোর সলতে পাকিয়েছেন।
৹ দাম্পত্য ফাটল –
কুমু-মধুসূদনের সংঘাত উপন্যাসের আদ্যন্ত তরঙ্গায়িত। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাসের দাম্পত্য সমস্যার প্রধান কারণ নি:সন্তান দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ। সেদিক থেকে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস স্বতন্ত্র, স্বামী – স্ত্রীর রুচির পার্থক্য দাম্পত্যে ফাটল এনেছে এবং তার সুড়িপথে প্রবেশ করেছে তৃতীয় ব্যক্তি শ্যামা। উপন্যাসের শেষে সন্তান সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েও কুমুর সেই আপ্তবাক্য – ‘এমন কিছু থাকে যা সন্তানের জন্যেও খোয়ানো যায় না’ – এর দ্বারা দাম্পত্য ফাটলকে বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদন-কুমুদিনীর দাম্পত্য সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে দুই ভাবে –
১) কুমুর আধ্যাত্মিক ভাবনা
২) মধুসূদন- নায়ক চরিত্রের খল চরিত্রের ন্যায় উপস্থিতি
কুমুর বাবার বাড়ির পরিবেশ, তার বাবা মার সম্পর্ক, স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর অলৌকিক স্বেচ্ছামরণ, মার সতীত্ব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য সম্পর্কের বিষয়ে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল, আর যার অন্যতম ফসল কুমুর মনে যৌন শিথিলতার ভাবনা। বাবা মুকুন্দলালের নারীদের প্রতি উপেক্ষা, বিপ্রদাসের অবিবাহিত জীবনও কুমুর মনে এই শীতলতাকে আরো তীব্র করে তুলেছিল। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একান্ত বিচ্ছিন্ন নিজস্ব আধ্যাত্মিকবোধ, আচরণের শালীনতা, অনাড়ম্বর আভিজাত্য আর পরিশীলিত রুচিবোধ।
অপরদিকে, মধুসূদন উঠতি ব্যবসায়ী, বিত্তের অহংকারে বংশগত বিবাদকে যেমন জিইয়ে রেখেছিল তেমনি স্থূল রুচির অধিকারী হয়ে উঠেছিল। আর নায়কের চরিত্রে খলনায়কের উপস্থিতির জন্য রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনকে দিয়েছিলে দোর্দন্ডপ্রতাপ। কুমুর থেকে নীলা আংটির অধিগ্রহণ, বিপ্রদাসের চিঠিকে গোপন রাখা, হাবুলের প্রতি দুর্ব্যবহারে সে হয়ে উঠল লোভী বণিক ও স্থূল স্বামী। মধুসূদনের বয়সাধিক্য কুমুর কাছে বাধার কারণ ছিল না, কুমু নিজেকে সেই ‘মহারাজার’ কাজে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করবে বলেই স্বামীর গৃহে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু মধুসূদনের ‘মহারাজা’ খেতাবের সঙ্গে কুমুর ভাবনার ‘যোগাযোগ’ হয়নি, যে ভাবনা সে এনেছিল পিতৃকূল থেকে, যে ভাবনা সে পেয়েছিল দাদা বিপ্রদাসের সহচর্যে। ভীষ্মের মতো, তাপসের মতো কিংবা মোতির মা’র কথায় গোরাচাঁদের মতো দাদা বিপ্রদাসের একেবারে বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান মধুসূদনের। তার প্রভূত্বব্যঞ্জক কর্কশ ব্যবহারই শুধু নয় , ভোরের শুকতারার মতো মনে হওয়া কুমুকে সেই অধিকার করতে চেয়েছিল সর্বোপরি হারিয়ে না ফেলার ভয়ে ভীত হয়েছিল। তাই কুমুর মান ভাঙাতে কুমুর সান্নিধ্য পেতে তৎপর মধুসূদনের –
১) “এইখানেই আমি বসে রইলুম, যদি আমাকে ডাকো তবেই যাবো, বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করতে রাজি আছি”
কিংবা ২) “বড় বউ আমার ওপর রাগ কোরো না” এবং অবশেষে
৩) “আমি তোমার অযোগ্য, কিন্তু আমাকে কি দয়া করবে না ?”
– এই ধরণের স্থূল মানভঞ্জনের প্রয়াস, আংটি উপহার দেওয়া কিংবা দাদার চিঠির খবর দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্ত্রীর মনের নাগাল পাবার চেষ্টা কুমুর মনের আক্ষেপকে আরো ঘনীভূত করেছে, সেই আক্ষেপের কারণই হল মধুসূদনের বয়সাধিক্য তার মর্যাদা, সংযম, দৃঢ়তা ভুলেছে। পুরাণ ঘেঁষা, পুঁথিপাড়া শান্ত, শুভ্র, সুগভীর শিবের যে ছবি মনে নিয়ে উমার মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিল কুমু প্রথমেই সেখানে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। আর কুমুকে না পাবার ব্যর্থতা কুমুর প্রতি ভালোবাসার প্রতাপশালী মধুসূদন ঘনিষ্ঠ হয়েছে শ্যামার, তার বিকৃত কামকে ব্যবহার করেছে।
অর্থাৎ কুমুর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাই তাদের দাম্পত্য জীবনে যোগাযোগে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুমুদিনীর চরিত্রের মুক্তি প্রেম নয় তার স্বাধীনচিত্ততা – এই ভাবনাই রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কাহিনি গ্রন্থনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। রঘুবংশ, নলদময়ন্তীর উপাখ্যান, কুমারসম্ভব, শকুন্তলার কাহিনি কুমুর মনে সতীত্বের আদর্শলোক তৈরি করেছিল –
“তিনি ভালোই হন, মন্দই হন, তিনি আমার পরম পতি। সতীধর্মের এই লক্ষণ”
এই ভাবনা নিয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে কুমুর ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকবোধ হয়ে গেল মীরাবাঈয়ের আদর্শে, সংসারবিমুখ, আপন অস্তিত্বসচেতনায় সমুজ্জ্বল। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জেরেই সেই যেমন স্বামীকে সরিয়ে রেখেছে, দাম্পত্যকে মানতে চায়নি, সংসারকেও অস্বীকার করেছে। আর এখানেই নিহিত আছে এই উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা।
এবার আসি ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। কুমুর চরিত্রের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা অনেকটাই এসেছিল দাদা বিপ্রদাসের চিন্তাভাবনা মারফত। যে দাদা সতীত্বের নাম করে মেয়েদের ওপর হওয়া অসম্মান নিয়ে বিক্ষোভ উগড়েছে গোটা একটা অধ্যায় জুড়ে। কুমুর সূত্রে সমস্ত নারী জাতির অসহায়তা তার ভাবনার অন্যতম বিষয়, আর সেই ভাবনার লালন তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। অথচ সেই বিপ্রদাসই সন্তানসম্ভবা বোনকে অপমানের মধ্যেও স্বামীগৃহে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয় –
“তোকে নিষেধ করতে পারি এমন অধিকার আর আমার নেই। তোর সন্তানকে তার নিজের ঘরছাড়া করব কোন স্পর্ধায়?”
কুমুর চরিত্রেও এই ধরণের বিভ্রান্তি লক্ষণীয়। দাদার শিক্ষায় প্রতিপালিত হয়েও কুমু সংসার করতে গেল পুঁথিপড়া পৌরাণিক সতীত্বের ভাবনায়, অসংযমী প্রতাপশালী মধুসূদনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে প্রথম থেকেই মীরার আদর্শ অনুসরণ করল, অবশেষে সন্তানসম্ভবা হয়ে সে হয়ে উঠল বিদ্রোহিনী। তত্ত্বকথায়, মাতৃত্বের আবরণে আত্মসমর্পণ হয়ে উঠল গৌরবের, নারীর স্বাধিকারে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি।
“একদিন ওদের ছেলেকে আমি ওদের হাতে দিয়ে দেব। এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্য খোওয়ানো যায় না।”
প্রথম বাক্যটি যে কথার কথা তা উপন্যাসে বিপ্রদাসও বুঝেছিল, পরের বাক্যটি যাকে ঘিরে কুমু চরিত্রের স্বতন্ত্রতা, তার ট্রাজিক আর্তনাদ তাও আসলে ফাঁপা হয়ে যায় চরিত্রগুলির নির্মাণে, গঠনের জটিল ও অসংলগ্ন উপাদানে। ক্ষেত্র গুপ্তের কথায় ওই আপ্তবাক্যটি আসলে – “ডুবে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তের বুদ্বুদ”।
অর্থাৎ ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের প্রধান ত্রুটি চরিত্রের কল্পনাগত দৈন্য, যেটা ছিল উপন্যাসের প্রধান আশ্রয়। মধুসূদনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতয় ঘটেনি। উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন যে দোর্দন্ড প্রতাপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, যার জেরে বংশগত বিবাদকে জিইয়ে রেখেছিল সেই নিপুণ ব্যবসায়ী হয়েও স্ত্রীর মানভঞ্জনে এবং মনোরঞ্জনে যে সব স্থূল পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তাতে তার চরিত্রটি কেবল বণিকতন্ত্রের টাইট চরিত্র হয়ে থেকে গেছে। এককভাবে বা পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অর্থাৎ ধনতন্ত্রের বা বণিকতন্ত্রের প্রতিভূ মধুসূদনের সঙ্গে ব্যক্তি মধুসূদনের, তার জীবনের, কার্যকলাপের দাম্পত্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়নি। কুমুর প্রতিবন্ধকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা অনুযায়ী মধুসূদন কখনো প্রতাপশালী কখনো আপসমুখী ও স্তিমিত হয়ে গেছে। যদিও ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের শেষে মধুসূদনের পরিসর সম্পূর্ণ ভাবা গেলেও কুমুর পরিণতি সংশয়ের মুখে পড়ে যায়। ফলে, ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতাই উপন্যাসের সীমাবদ্ধতার কারণ হয়ে উঠেছে।
★ কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
১) বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস – ক্ষেত্র গুপ্ত
২) বাংলা উপন্যাসের কালান্তর – সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়