চর্যা পদকর্তার পরিচয়


৹ তিব্বতি ইতিহাসে চৌরাশি সিদ্ধার নাম সুপ্রসিদ্ধ।
৹ মিথিলার জ‍্যোতিরিশ্বর ঠাকুর তাঁর ‘বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থে ৭৬জন সিদ্ধাচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন।
৹ রাহুল সাংকৃত‍্যায়ন ‘দোহাকোষ’ গ্রন্থের ভূমিকায় যে সকল সিদ্ধাচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন সেখানে তাড়ক ও ঢেন্ঢন পাদের উল্লেখ নেই। চাটিল পাদ আছেন ‘চাট পা’ নামে।
এবার আসি, আবিষ্কৃত চর্যাপদে প্রাপ্ত ২৩জন কবি প্রসঙ্গে –

লুই পাদ –
৹ চর্যাপদের প্রথম কবি – লুই পাদ।
৹ টীকাকার মুনিদত্ত তাকে বলেছেন – আদি সিদ্ধাচার্য।
৹ তিব্বতি তালিকাতে তাঁর নাম প্রথম।
৹ তারানাথের বিবৃতি মতে, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। (আদি সিদ্ধাচার্য – রাহুলভদ্র , তার শিষ‍্য নার্গাজুন, তার শিষ‍্য শবরীপাদ, তার শিষ‍্য লুই পাদ)
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, লুই পাদ বাঙালী
৹ রাহুল সংকৃত‍্যায়নের মতে, লুই পা ছিলেন রাজা ধর্মপালের সচিব ও লেখক।
(“লুই পা রাজা ধর্মপালকে কায়স্থ থে” – ভূমিকা দোহাকোষ)
৹ অর্থাৎ লুই পার জীবনকাল অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে।
৹ লুই পার শিষ‍্য উড়িষ‍্যার রাজা দারিক এবং তার মন্ত্রী ঢেঁকি। দারিক পাদ চর্যায় উল্লেখিত তার গানে লুইপাদের উল্লেখ করেছেন।
৹ তাঞ্জুর তালিকায় উল্লেখিত লুই পাদের সমস্ত গান‌ই বৌদ্ধ দর্শন সংক্রান্ত। দোহাকোষ ও গীতিকা ছাড়া তিনি ‘শ্রীভগবদভিসময়’, ‘অভিসময়বিভঙ্গ’, ‘বুদ্ধোদয়’, ‘বজ্রসত্ত্বসাধন’ রচনা করেন। এর মধ‍্যে প্রথম দুটি গ্রন্থ সেসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল।
৹ টীকায় আচার্য মুনিদত্ত লুইপাদকে ‘জ্ঞানানন্দ সুন্দর’ আখ‍্যা দিয়েছেন।

শবরী পাদ –
লুই পাদের গুরু মহাসিদ্ধ শবরী। ইনি রসসিদ্ধ নার্গাজুনের শিষ‍্য ছিলেন।
৹ তারানাথের বিবরণ অনুযায়ী, নার্গাজুন তাকে শ্রীপর্বতে যাবার নির্দেশ দেন যেখানে তিনি শবরসুলভ জীবনযাপন করেন এবং শবরীশ্বর বা সিদ্ধ শবরী নামে পরিচিত।
৹ তন্ত্রমতে শবর বা সবর অর্থ বজ্রধর
৹ তাঞ্জুর তালিকামতে শবরীপাদ বজ্রযোগিনী সাধন সংক্রান্ত কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

ভুসুকু পাদ –
৹ ভুসুকু পাদের ব‍্যক্তিত্ব ও প্রাচীনত্ব নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।
৹ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানিয়েছেন সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ‍্যে যত মহাযান বজ্রযানের ভাষ‍্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা তাঞ্জুর তালিকায় স্থান লাভ করেছে। তাঞ্জুর তালিকা ও চর্যাগীতিকোষবৃত্তিতে ভুসুকু পাদের নাম উল্লেখ আছে।
৹ আবার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধগান ও দোহার মুখবন্ধে ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ ও ‘বৌদ্ধিচর্যাবতার’ গ্রন্থের রচয়িতা শান্তিদেবের যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট হয় যে শান্তিদেব ও ভুসুকু এক‌ই ব‍্যক্তি
৹ কিন্তু সুকুমার সেন ভিন্ন মত পোষণ করে জানান – “শান্তিদেব অনেক আগেকার লোক। তিনি মঞ্জুশ্রীর উপাসক। আর ভুসুকু ছিলেন সহজানন্দের সাধক।”
৹ আবার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০নম্বর তালপাতার পুঁথির থেকে শান্তিদেবের যে জীবনচিত্র উদ্ধার করেছেন, সেখানে বলা আছে –
“শান্তিদেব ছিলেন রাজার ছেলে। যৌবরাজ‍্যে অভিষিক্ত হ‌ইবার প্রাক্কালে তাঁহার মাতা তাহাকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ ল‌ইতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়িয়া যাত্রা করিলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ‍্যের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হ‌ইল এবং বার বৎসর মঞ্জুবজ্রের নিকটে থাকিয়া তিনি মঞ্জু-শ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হ‌ইলেন। তৎপরে তিনি রাউত বেশে যাত্রা করিলেন মগধের উদ্দেশ‍্যে। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী, তরবারিধারী অচলকে সৈনাপত‍্যে নিযুক্ত করিলেন। তরবারিকে আশ্রয় করিয়া তাঁহার অদ্ভূত সিদ্ধি প্রকাশ পাইল। তখন তিনি রাজকার্য ত‍্যাগ করিয়া ভিক্ষুবেশে নালন্দায় আসিলেন। এখানেই তিনি ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ ও ‘বোধিচর্যাবতার’ রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় এবং কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে তিনি সমাধি সমাপন্ন থাকিতেন বলিয়া ‘ভু-সু-কু’ নামে খ‍্যাতি লাভ করেন (“ভুঞ্জানোপি প্রভাবশ্বরঃ সুপ্তোহপি কুটিং গতোহপি তদেবেতি ভুসুকু সমাধি সমাপন্নত্বাৎ ভুসুকু নাম খ‍্যাতিং সঙ্ঘেহপি”)
৹ অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শান্তিদেব, অচল সেন, রাউত এবং ভুসুকু এক‌ই ব‍্যক্তি। এবং তিনি সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ‍্যে বর্তমান ছিলেন।
৹ তারানাথ বোধিচর্যাবতারাদি গ্রন্থের লেখককে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে তিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলের লোক। আর চর্যাপদে ভুসুকু নিজেকে বঙ্গালী বলেই পরিচয় দিয়েছেন।

শান্তি পাদ –
৹ ভুসুকু বা শান্তিদেব এবং শান্তিপাদ কিন্তু কখনোই এক‌ই ব‍্যক্তি নন।
৹ চর্যার শান্তিপাদ আসলে রত্নাকর শান্তি, এমন মত উল্লেখ আছে তাঞ্জুর তালিকায়।
৹ তিনি অষ্টম শতাব্দীর মধ‍্যভাগে বর্তমান ছিলেন।
৹ তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য – মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা, কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ‍্যসমাজ নিবন্ধ, বজ্রতারা, মহামায়াসাধন, সহজরতিসংযোগ, সহজযোগক্রম এবং সুখ দুঃখদ্বয় পরিত‍্যাগ দৃষ্টি ইত‍্যাদি।


সরহ পাদ –
৹ পন্ডিত তারানাথের মতে, সরহপাদ‌ই আদি সিদ্ধাচার্য।
৹ সরহপাদের জন্মস্থান উড়িষ‍্যা মতান্তরে, ভাগলপুরের রাজ্ঞী।
৹ তিনি নালন্দায় শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং নালন্দায় তার গুরু ছিল ধর্মকীর্তি হরিভদ্র।
৹ রাহুল সাংকৃত‍্যায়নের মতে, সরহপাদের জীবনকাল অষ্টম শতাব্দী। এবং পরলোক
গমন করেন সম্ভবত ৭৮০খ্রিঃ।
৹ দাক্ষিণাত‍্যে তিনি এক শকারের কন‍্যাকে মুদ্রারূপে গ্রহণ করেন, তখন থেকে তার নাম সরহ (শরহ) পাদ।
৹ রাহুল সাংকৃত‍্যায়ন মনে করেন যে, শরহ পাদের ভিক্ষু নাম রাহুল ভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে তার নাম সরোরুহ বজ্র বা সরহ বজ্র।
৹ সরহপাদ অপভ্রংশ ভাষায় অনেকগুলো দোহা এবং দোহা জাতীয় গীতি রচনা করেন।
৹ পদকর্তা সরহপার রচিত গ্রন্থগুলি হল – বুদ্ধকপাল সাধন, হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকা – পদ্মিনীনাম।

দারিক পাদ –
লুইপাদের শিষ‍্য ছিলেন দারিক পাদ ; দারিক পাদের গানে ‘লুই পাঅ পসাএ’র স্বীকৃতি আছে।
৹ তারানাথের মতে দারিক পাদ ছিলেন উড়িষ‍্যার রাজা, তিনি সংস্কৃততেও সুপন্ডিত ছিলেন।
৹ তাঞ্জুর তালিকা অনুযায়ী তার লেখা গ্রন্থ দুটি হল – ‘শ্রীকালচক্রতন্ত্ররাজ’ এবং ‘সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি’।

কাহ্ন পাদ –
৹ চর্যাপদের সঙ্কলিত গানের মধ‍্যে কাহ্নপাদের গানের সংখ‍্যা সর্বাধিক।
৹ চর্যাপদে প্রাপ্ত ৫০টি গানের ১৩টি গান‌ই চর্যাকবি কাহ্নপাদের লেখা। তবে, ২৪ সংখ‍্যক চর্যাটি মূল পুঁথিতে লুপ্ত, তাই কাহ্নপাদের মোট ১২টি গান কাহ্ন ভণিতায় আছে।
৹ তাঞ্জুর তালিকা, তিব্বতি ইতিহাসে কৃষ্ণ, কাহ্নপাদ, কৃষ্ণপাদ ইত‍্যাদি নামে একাধিক গ্রন্থতালিকা সন্নিবেশিত হয়েছে যা থেকে অনুমান করা যায় একাধিক কাহ্নপাদ আছে।
চর্যাগীতিতে রচয়িতার যে নাম যে সব চর্যাগানে পাওয়া যায় –
কাহ্নপাদ – ৭, ৯, ৪০, ৪২, ৪৫
কৃষ্ণপাদ – ১২, ১৩, ১৯
কৃষ্ণাচার্যপাদ – ১১, ৩৬
কৃষ্ণব্রজপাদ – ১৮
৹ টীকাকার মুনিদত্ত কৃত নির্মলগিরা টীকায় উল্লেখ অনুযায়ী –
কৃষ্ণচার্যপাদ – ৭, ৯, ১২, ১৮, ৪২
কৃষ্ণাচার্য – ১১, ৩৬, ৪০, ৫৫
কৃষ্ণাচার্যচরণ – ১৩, ১৯
কৃষ্ণপাদ – ১০ (চর্যাগানে কোনো কবির নাম নেই)
৹ আবার, সুকুমার সেন বলেছেন – ‘চর্যাগীতিতে যে গানগুলি আছে তাহা হ‌ইতে অন্ততঃ দুইজন কাহ্নের অনুমান করিতে পারি’।
সুকুমার সেন মনে করেন ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬,৪২ সংখ‍্যক চর্যা জলন্ধরী পাদের শিষ‍্য কাহ্নের রচনা।
৹ এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ‍্যক চর্যাগান অপর এক কাহ্নকবির রচনা।
৹ কাহ্নপাদের পরিচয় পুরাণশ্রুতিতে আচ্ছন্ন। তাঞ্জুর তালিকায় তাকে ভারতবাসী বলা হয়েছে। তিব্বতি ইতিহাস বলে তাঁর জন্ম কর্ণনগর। তবে কাহ্নপাদের চর্যাগানে বাংলা শব্দ সম্ভারের প্রাচুর্য লক্ষণীয়।
৹ কাহ্নপাদ ছিলেন চর্যাপদের কবি সিদ্ধাচার্য বিরূপার শিষ‍্য। নাম কাল বিরূপ।
পুরাণশ্রুতি অনুযায়ী, ভবিষ‍্যৎবাণী হয় তিনি ৪টি মহাপাপ করবেন। ভবিষ‍্যদবাণী সফল হয়। পাপ স্খলনের জন‍্য তিনি জলন্ধরী পাদের শরণাপন্ন হন। এবং জলন্ধরী পাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনা করে পাপমুক্ত হন। বিরূপপাদ ও জলন্ধরী পাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগ তাঞ্জুর তালিকা এবং চর্যাগানে পাওয়া যায়।

বিরুআপাদ –
৹ বিরুআপাদ বজ্রযোগিনীর সাধক ছিলেন। তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ‍্যপানাসক্তি ও শুন্ডিনীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা উল্লেখ আছে।
৹ তিনি ‘গীতিকা’, ‘কর্মচন্ডালিকা’, ‘দোহাকোষগীতি’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
৹ কথিত আছে, জল, অগ্নি, বিষ – কিছুই তাঁর ক্ষতি করতে পারতো না।
৹ কিংবদন্তী অনুযায়ী, রামপালের পট্টহস্তী ‘বানাবদল’ বিরূপের চরণামৃত পান করে যুদ্ধে গমন করে ম্লেচ্ছ সৈন‍্যকে পরাভূত করতে সক্ষম হন।

ডোম্বী পাদ –
৹ চর্যাপদের পদকর্তা ডোম্বীপাদের উল্লেখ আছে তাঞ্জুর তালিকায়, আচার্য ডোম্বীপাদ অথবা মহাচার্য ডোম্বী হেরুক উভয় নামে।
৹ তিব্বত তালিকায় ডোম্বীপাদ সন্ন‍্যাসী এবং মগধের রাজা হিসাবে উল্লেখ আছে।
৹ তারানাথের মতে, ডোম্বী ত্রিপুরার রাজকুমার বিরূপপাদের শিষ‍্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ‍্য।
৹ সুকুমার সেনের মতে, ডোম্বী রাঢ়ের কবি।
৹ ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, ডোম্বী হেরুক অষ্টম শতাব্দীর লোক।

কম্বলাম্বর পাদ –
৹ তাঞ্জুর তালিকায় মহাচার্য কম্বলাম্বর পাদের নাম আছে। তালিকা অনুযায়ী তিনি মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদ, প্রজারক্ষিতের গুরু
৹ চর্যাপদের পদকর্তা কম্বলাম্বর পাদের গ্রন্থ ‘অভিসময়নামপঞ্জিকা’।
৹ অনুমিত হয়, গ্রন্থটি চর্যাপদের পদকর্তা লুইপাদের ‘অভিসময়বিভঙ্গ’ গ্রন্থের পঞ্জিকা।
৹ তারানাথের মতে, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন বজ্রঘন্টের শিষ‍্য। ডোম্বী হেরুক, জলন্ধরী পাদের সঙ্গে কম্বলাম্বর পাদের যোগ ছিল।
৹ পুরাণ শ্রুতি অনুযায়ী কম্বলাম্বর পাদ ছিলেন উড়িষ‍্যাবাসী রাজকুমার। এই সূত্র ধরে তারানাথ মনে করেন কম্বলাম্বর পাদের সঙ্গে দ্বারিক পাদের যোগ ছিল।
৹ চর্যাকবি শ্মশানে গিয়ে সাধনা করে মন্ত্র সিদ্ধ হন। মন্ত্রবতী শ্মশান ডাকিনী তাঁকে বিনাশ করতে উদ‍্যত হয়। তবে ডাকিনী শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। সেই থেকে চর্যাকবি কম্বল নামে প্রসিদ্ধ হন।
৹ কম্বলাম্বর পাদের কিছু সংস্কৃত রচনাংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহ দোহার অদ্বয়বজ্রকৃত টীকায়।

বীণাপাদ –
৹ চর্যাপদের কবি বীণাপাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুকুমার সেন মন্তব‍্য করেছেন –
“টীকাকারের অনুসরণে একটি চর্যা অকারণে বীণাপাদের রচনা বলিয়া স্বীকৃত হ‌ইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন‌ও নাম চর্যাটিতে নাই।”
৹ চর্যাগীতির পদকর্তারা অনেকক্ষেত্রে রূপকের আবরণে আত্মগোপন করেছেন।
আবার কোথাও কোনো ভণিতা না দিয়ে নিজেই গীতি কবিতার নায়ক হিসাবে পদটিতে উপস্থিত হয়েছেন।
যেমন দেখতে পাই কাহ্নপাদের ১০ সংখ‍্যক চর্যা এবং শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ‍্যক চর্যায়। অর্থাৎ বীণাপাদকে অস্বীকার করা যায় না।
৹ তাঞ্জুর তালিকায় বিরূপার বংশধর রূপে বাণীপাদের উল্লেখ আছে।
৹ চর্যাপদের কবি বীণাপাদ গুহ‍্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রমের ওপর গ্রন্থ‌ও লিখেছেন।
৹ তারানাথের মতে, বীণাপাদ অশ্বপাদের শিষ‍্য।
৹ অনুমান করা হয়, চর্যাগীতির পদকর্তা বীণাপাদ অষ্টম শতাব্দীর শেষ সময়ে বর্তমান ছিলেন।

কুক্কুরী পাদ –
৹ তাঞ্জুর তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুরাজ নামে তিনি অভিহিত করেছেন।
৹ তাঁর রচিত একটি গ্রন্থের নাম গুহ‍্যাবধরব‍্যুহ।
৹ চর্যাপদের কবি কুক্কুরীপাদকে টীকাকার মুনিদত্ত ‘স্বানন্দ আসবপান প্রমোদমনা’ এবং প্রজ্ঞাপারমিতার্থমৃত পানপরিতুষ্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।
৹ কুক্কুরীপাদ রচিত ৪৮ সংখ‍্যক চর্যাপদটি লুপ্ত।

আর্যদেব –
৹ তাঞ্জুর তালিকায় চর্যাপদের কবি আর্যদেবকে আচার্য বা মহাচার্য বলা হয়েছে।
৹ আর্যদেব সংস্কৃতে সুপন্ডিত ছিলেন।
৹ চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে এই চর্যাকবি গ্রন্থ রচনা করেন।
৹ ‘চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ’ সংস্কৃত গ্রন্থটিও সহজ সাধনার চিত্তশোধন বিষয়ক মূল‍্যবান গ্রন্থ।
৹ প্রভুভাই প‍্যাটেল মনে করেন আর্যদেব চর্যাপদের কবি রাহুল ভদ্রের শিষ‍্য নার্গাজুন এবং উড়িষ‍্যারাজ ইন্দ্রভূতিপাদের সমসাময়িক।

কঙ্কণ পাদ –
৹ তাঞ্জুর তালিকামতে চর্যাকবি কঙ্কণপাদ অপর চর্যাপদের কবি কম্বলাম্বর পাদের বংশধর।
৹ কঙ্কণপাদের রচিত গ্রন্থের নাম ‘চর্যাদোহাকোষগীতিকা’।
৹ টীকাকার মুনিদত্ত কঙ্কণপাদের সম্পর্কে বলেছেন পরম করুণাসবপানে প্রমুদিত কঙ্কণ ‘সিদ্ধাচার্য’।

চাটিল পা –
৹ চর্যাপদের কবি চাটিল পাদের কথা তাঞ্জুর তালিকাতে নেই।
৹ তারানাথের বর্ণনায় চাটিল পাদের উল্লেখ আছে।
৹ বর্ণরত্নাকর গ্রন্থে চাটিল নাম আছে।
৹ চাটিল পা রচিত ৫ সংখ‍্যক চর্যাগানে চাটিল পাদ নিজেকে অনুত্তর স্বামী বলেছেন।
৹ তবে, এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেন চর্যাগানটি চাটিল পাদের কোনো শিষ‍্যের রচনা।
কারণ যত উচ্চস্তরেই থাকুক না কেন কোনো চর্যাকর্তাই নিজেকে অনুত্তর স্বামী বলে জাহির করবে না।
সুকুমার সেনের এই মতের বিরোধিতা করে একাংশ বলেছেন লুইপাদ, কুক্কুরী পাদ সকলের চর্যাগানেই আত্মাপ্রশংসা আছে। অর্থাৎ ৫ সংখ‍্যক চর্যাগানটি চর্যাপদের কবি চাটিল পাদের‌ই রচিত।

গুন্ডরী পা –
৹ চর্যাপদের কবি গুন্ডরী পাদের নাম তাঞ্জুর তালিকাতে নেই।
৹ Grunwedel যে সিদ্ধাচার্য তালিকা প্রস্তুত করেছেন তাতে চর্যাকবি গুন্ডুরী
পাদের নাম উল্লেখ আছে।
৹ চর্যাগানে গুন্ডরীপাদের রচনায় ‘গুড়রী’ নাম ভণিতায় আছে।

তাড়ক পাদ –
৹ চর্যাপদের কবি তাড়কপাদ নামটি কেবল ৩৭সংখ‍্যক চর্যাগানেই পাওয়া যায়।
৹ টীকাকার তাড়ককে সিদ্ধাচার্য বলেছেন – “সিদ্ধাচার্যো হি তাড়ক”।
৹ তাঞ্জুর তালিকায় মহাপন্ডিত তারশ্রী এবং উপাধ‍্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় চর্যাকবি তাড়ক পাদ এদের কেউ হবেন।

ঢেন্ঢন পাদ –
৹ চর্যাপদের কবি ঢেন্ঢন পাদের নাম তিব্বতি ইতিহাসে নেই
৹ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন তিনি ঢেন্ঢন।
৹ ঢেন্ঢন পাদ রচিত ৩৩ সংখ‍্যক চর্যাপদের প্রভাব কবীরের একটি কবিতায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় পাওয়া যায়।
৹ লক্ষণের অনিল পুরাণে এবং গোর্খবিজয় কাব‍্যে ঢেন্ঢন পাদের কবিতার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।

তান্ত্রী পাদ –
৹ চর্যাপদের ২৫ সংখ‍্যক চর্যা লুপ্ত যা চর্যাপদের কবি তন্ত্রীপাদের রচিত
৹ মুনিদত্তের টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়।
৹ সিদ্ধাচার্য তালিকায় তান্তি নাম আছে, ‘বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে তান্তিপা নাম।
৹ জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন – তন্ত্রী নামটি জাতি বৃত্তির স্মারক। নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতি ধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়। হীন বৃত্তিধানী তন্ত্রী হন বজ্রধর।

জয়নন্দী –
৹ তারানাথের ইতিহাসে চর্যাকবি জয়নন্দীর নাম নেই।
৹ সিদ্ধাচার্য তালিকায় জয়নন্দ নাম আছে।
৹ টীকাকার মুনিদত্ত জয়নন্দীকে পরম করুণা অর্জনের জন‍্য ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন।

ধামপাদ –
৹ চর্যাকবি ধামপাদ চর্যাপদের ওপর এক কবি কাহ্নপাদের শিষ‍্য।
৹ তাঞ্জুর তালিকামতে আচার্য ধামপাদ আচার্য কৃষ্ণের বংশধর।
৹ ‘সুগতদৃষ্টি গীতিকা’, ‘মহাযান নিষ্পন্নক্রম’, ও ‘হুঙ্কারচিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম’ প্রভৃতি গ্রন্থ এই চর্যাকবি ধামপাদ রচনা করেছেন।

মহিন্ডা –
৹ আচার্য মহিন্ডা চর্যাপদের কবি কাহ্নপাদের শিষ‍্য।
৹ চর্যাগানের ভণিতায় ‘মহিন্ডা’ নামটি উল্লেখ আছে।
৹ তবে, মুনিদত্তের টীকায় নাম আছে মহীধরপাদ।
৹ তারানাথের বিবৃতিতে উল্লেখ আছে – মহিল।
৹ তাঞ্জুর তালিকায় তিনি মহিপাদ নামে পরিচিত।
৹ মহিপাদ ‘বায়ুতত্ত্ব ও দোহাগীতিকা গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ভাদে পাদ –
৹ বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে ‘বাইলবাদাই’ নামে কৃষ্ণাচার্যের যে শিষ‍্যনাম পাওয়া যায় ইনি ভদ্রপাদ বলে অনুমান করা হয়।
তাঞ্জুর তালিকায় ভাদে পাদকে বলা হয়েছে ভান্ডারিণ।
৹ ‘সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি’ গ্রন্থের উল্লেখ আছে চর্যাপদের কবি ভাদে পাদ নামে।
৹ টীকায় মুনি দত্ত ভাদে পাদকে ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’ যুক্ত সিদ্ধাচার্য বলেছেন।

– – – – – – –