ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম. এ, বি. এড , পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়
বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বাংলা উপন্যাসে সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে কারণ, রাঢ়বঙ্গের বিস্তৃত ভুবনকে তিনি তাঁর উপন্যাসে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলি আঞ্চলিক হয়েও ভারতীয় কথাসাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে।
★ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় –
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির ( অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের) অন্তর্গত বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবার নাম হরিদাস বন্দোপাধ্যায় ও মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক সত্যানুসন্ধানের প্রবণতা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে আশ্বিন মাসে নবমীর দিন পিতৃহারা হন, হিসাব মতো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স তখন আট বছর। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লাভপুরের যাদবলাল এইচ. ই. স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে প্রথম ভর্তি হন পরবর্তীতে সাউথ সাবআর্বান কলেজে ( অধুনা আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে পারেনি ভগ্নস্বাস্থ্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য। রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করার জন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গ্রেফতারও হয়েছিলেন এবং ডিসেম্বর মাসে মুক্তি লাভ করেছিলেন।
★ তারাশঙ্করের রচনার প্রেক্ষাপট ও বিশিষ্টতা –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময় যে সকল ঘটনা ঘটেছিল সেইগুলি হলো-
• অসহযোগ আন্দোলন – ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ
• বিপ্লবী আন্দোলন – ১৯০৫ – ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ
• সাম্যবাদী আন্দোলনের সূচনা – ১৯২৭ – ২৮ খ্রিস্টাব্দ
• আইন অমান্য আন্দোলন – ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ
• বিয়াল্লিশের আন্দোলন – ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ
• ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগ – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ
• পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন – ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ
• পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম – ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ
■ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল –
৹ ক্ষয়িষ্ণ জমিদার পরিবারের সমস্যা ও লাভপুর সন্নিহিত অঞ্চলের সাধারণ জনজীবন।
৹ লোকায়ত ব্রাত সংস্কৃতি তাঁর পছন্দের ছিল বলে বোষ্টুম, ডোম, বাউরী, বীরবংশী, সাঁওতাল, বেদে ইত্যাদি মানুষজন ছিলেন তাঁর রচনার বিচিত্র চরিত্র।
৹ চরিত্রের আধিক্য এবং সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া তারাশঙ্করের লেখনীর অন্যতম বিশিষ্টতা।
৹ তারাশঙ্করের লেখনীতে নায়ক চরিত্র আলাদাভাবে গুরুত্ব পায়না, সময় পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে নায়ক করে তোলে।
৹ তারাশঙ্করের উপন্যাসে নায়ক চরিত্র যেমন আলাদা পরিসর পায়না তেমনি নায়ক বা খলনায়ককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না।
★ তারাশঙ্করের সাহিত্যসম্ভার –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজনশীল প্রতিভার নিদর্শন বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে নেহাৎ কম ছিলনা তাঁর সৃজনশীলতার নিদর্শন, যথা-
১. গল্প- ১৯০টি
২. উপন্যাস – ৬৬-৬৭ টি
৩. নাটক-১৩ – ১৪ টি
৪. আত্মজীবনী – স্মৃতিকথা -১০ টি
৫. প্রবন্ধ সংকলন – ৫/৬ টি
৬. গান- ৫০ টি
৭. ছবি – ৩০ টি
৮. কাঠের ভাস্কর্য – ১০ টি
★ প্রকাশকাল অনুসারে তারাশঙ্করের উপন্যাসের তালিকা –
অরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কালের প্রতিমা’ গ্রন্থে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন যথা-
১/ ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ – ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ১৯৩১, ‘ নীলকন্ঠ’ ১৯৩৩, ‘রাইকমল’ ১৯৩৪ , ‘পাষাণপুরী’ ১৯৩৭, ‘আগুন’ ১৯৩৭ ।
২/ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ – ‘ধাত্রীদেবতা’ ১৯৩৯, ‘কালিন্দী’ ১৯৪০, ‘গণদেবতা’ ১৯৪২, ‘মন্বন্তর’ ১৯৪৪, ‘কবি’ ১৯৪৪, ‘সন্দীপন পাঠশালা’ ১৯৪৬, ‘ঝড় ও ঝড়াপাতা’ ১৯৪৬ ।
৩/ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮- ‘হাসুলীবাঁকের উপকথা’ ১৯৪৭, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ ১৯৫২, ‘আরোগ্য নিকেতন’ ১৯৫৩, ‘রাধা’ ১৯৫৮, ‘ডাকহরকরা’ ১৯৫৮ ।
৪/ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ – ‘মহাশ্বেতা’ ১৯৬০, ‘নিশিপদ্ম’ ১৯৬২, ‘জঙ্গলগড়’ ১৯৬৪, ‘গন্না বেগম’ ১৯৬৫, ‘অরণ্যবন্দী’ ১৯৬৬, ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ ১৯৬৭।
৫/ ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ – ‘মণি বউদি’ ১৯৬৭, ‘স্বর্গমর্ত্য’ ১৯৬৮, ‘সুতপার তপস্যা’ ১৯৭১, ‘নবদিগন্ত’ ১৯৭৩ ।
★ চলচ্চিত্রায়ন –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটোগল্প অবলম্বনে বাংলা ভাষায় একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে পরে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’, অজয় কর পরিচালিত ‘সপ্তপদী’, তপন সিংহ পরিচালিত ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’ এছাড়া ‘গণদেবতা’ উপন্যাস নিয়েও তরুণ মজুমদারের নির্মিত চলচ্চিত্র রয়েছে।
★ পুরস্কার ও সম্মান –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর রচনাশৈলীর জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হতে দেখা যায়। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আরগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ ও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ পান। চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণে যান ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। এরপরের বছর সোভিয়েত ইউনিয়নে গমণ করেন এশিয়ান লেখক সঙ্ঘের কমিটি গঠনের প্রস্তুতিমূলক সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে। তাসখন্দে অনুষ্ঠিত অ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সম্মেলনেও ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পদ্মশ্রী ও ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কার না পেলেও কৃষ্ণ কৃপালনীর উদ্যোগে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শরৎস্মৃতি পুরস্কার ও জগত্তারিনী স্মৃতি পদক পান ।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসটি রচনা করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন।