বিভূতিভূষণের আরণ্যক : প্রকৃতির পাঁচালী
রবীন্দ্র-শরৎপর্বের পরে বাংলা উপন্যাসে যে নবপর্যায়ের সূত্রপাত হয় সেখানে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম একত্রে উচ্চারিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আঙ্গিকের দিক থেকে নিঃসন্দেহে আধুনিক, রবীন্দ্র-শরৎ পর্বের উত্তর পর্যায়ের বৈশিষ্ঠ্য তাঁর সব উপন্যাসেই সচেতনভাবে অনুসৃত। কিন্তু আধুনিক পর্বের বিষয়বস্তু বাস্তবতা, যা সেই সময়ের আধুনিকতার মূল লক্ষণ তা কতটা পরিলক্ষিত হয়েছে বিভূতিভূষণের উপন্যাসে ?জৈবতা, যৌনতা, মানসিক বিকার, জটিল অস্তিত্বের সংকট, যুগচৈতন্য, শ্রেণিদ্বন্দ্ব বিভূতিভূষণের কোনো উপন্যাসেই নেই। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে বাস্তবতা এসেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রায় , মানসিকতায়, সেইসব গরীব ঘর গৃহস্থলীর বাস্তব বিবরণে যা অনেকটাই শরৎচন্দ্রীয় গ্রাম্যসমাজকে মনে করায়। তাহলে বিভূতিভূষণ কোন দলের ? পূর্ব পর্বের সমাপ্তিতে নাকি নবপর্যায়ের সূচনায়। সমালোচক ক্ষেত্র গুপ্ত বলছেন, বিভূতিবাবু দুই যুগের সন্ধিকালের ঔপন্যাসিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি বিচার্য।
বিভূতিভূষণ মোট ১৪টি উপন্যাস লিখেছেন, এবং সবগুলিতে জীবনবোধ ও রচনারীতি প্রায় একই। বিষয়বস্তুর সূক্ষবৈচিত্র্যে আলোচ্য ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি – প্রকৃতি ও মানুষ এই পর্যায়ের অন্তর্ভূক্ত। আর আরণ্যক উপন্যাসের ভৌগলিক বিস্তার – কুশী নদী নিকটবর্তী ভাগলপুর অঞ্চলের লবটুলিয়ার জঙ্গল।
‘পথের পাঁচালী’ – ‘অপরাজিত’এর অপুকে পেরিয়ে বিভূতিভূষণ পৌঁছেছিলেন ‘আরণ্যকে’, সত্যের চোখে দেখেছিলেন লবটুলিয়ার জঙ্গল। অপুর প্রকৃতিবোধের সঙ্গে সত্যর প্রকৃতিচেতনার কোনো পার্থক্য নেই। এ যেন আর এক পথের পাঁচালী, যে পথ জনহীন আদিম অরণ্যের মধ্য দিয়ে অরণ্য ধ্বংসী ঘনবসতির দিকে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে।
আরণ্যকের প্রাণ বিশাল গহন অরণ্য। বাংলার প্রাণ, প্রকৃতি নিয়ে , আদিম বনভূমিকে প্রাধান্য দিয়ে এত বড় উপন্যাস আগে লিখিত হয়নি। পাহাড়ি অরণ্য, অরণ্য লালিত নির্জনতা, গাছপালা, শ্বাপদকুন্ডা, ভয়, পরী, দেবতা, রাসবিহারী সিংএর মতো মহাজন, রাজু পাঁড়ের মতো কবিরাজ, যুগলপ্রসাদের মতো প্রকৃতিপ্রেমিক – এই আয়োজন বাংলাসাহিত্যে দেখা যায় না। অর্থাৎ বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে অরণ্যপ্রকৃতি নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাসই হল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’।
এই আরণ্যক নিয়ে বিভূতিভূষণ লিখেছেন নানা কথা তাঁর ডায়েরীতে – “এই জঙ্গলের জীবনে নিয়ে একটা কিছু লিখবো – একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ গতিশীল ব্রাত্যজীবনের ছবি। এই বন, এই নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার – এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যে খুপড়ী বেঁধে থাকা।…এদেশের লোকের দারিদ্র্য, সরলতা – সব।”
লবটুলিয়া-ভীমদাসটোলা-ধরমপুর এইসব অঞ্চল ঘিরে গঙ্গোতা, দোষাদ, সাঁওতাল, ব্রাহ্মণ প্রজাদের বাস। বহুদিন এরা ভাত খায় না, ভাত দের স্বপ্ন, বিলাসিতা। শীতে কারও গায়ে গরমবস্ত্র নেই। মন মন তুষ এদের কম্বলের সুখ দেয়। ঘোলা জল এদের পানীয়। সত্যচরণের জবানিতে, “বাংলাদেশে এমন দরিদ্র নেই”। বাথুয়াশাক, মকাইসেদ্ধ, ঘাটো, এসব খেয়েও জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয় না তারা। বরং মঞ্চি, কুন্তা, রাজু, যুগলরসাদ, ধাওতাল সাহু – প্রত্যেকে জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। তাই সমালোচক রুশতী সেন জানান, “বেঁচে থাকার প্রয়াসে এক বর্ণময় জীবন বানিয়ে তোলার সাধ্য তাদের আছে।” আবার, এই অরণ্যেই দশরথের মতো শিল্পীরা মূল্য পায় না, নাগরিক মনপুষ্ট সত্যচরণের প্রকৃতিলালিতা ভানুমতির প্রতি ‘ভানুমতীকে বিবাহ করিতে পারিতাম’ দূর্বল বিলাসমাত্র হয়ে থেকে যায়। এখানেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ও মানবীয় বাস্তবতার যুথবদ্ধ মিলনে আরণ্যকের সার্থকতা। আর এসেছে অরণ্যলালিত লোককথা; দোবরু পান্নার থেকে জানতে পারি অরণ্যের দেবতা ও রক্ষাকর্তা টাঁড়বারোর কথা। শিকারীদের অন্যায় হাত থেকে তিনি বন ও পশুদের রক্ষা করেন। অথচ এই দেবতাও অসহায় হয়ে পড়ে কলকাতার মানুষদের কাছে। এই সূত্রই আবার মনে করায় সাবলটার্ন তত্ত্বের কথা।
প্রভু ও প্রজার সম্পর্কে প্রজারা নির্যাতিত ও শোষিত। আরণ্যক উপন্যাসে রাসবিহারী, নন্দলাল ওঝাদের অধস্তনের প্রজারা সাবলটার্ন তত্ত্বের আওতাভূক্ত। শোষক জমিদার ও শোষিত দরিদ্র্য প্রজাদের মধ্যে সত্যচরণ শোষণের নির্মম ইতিহাস না বুঝেও অনেকটা বোঝে – তাই মটুকনাথকে টোল খুলে দেয়, কুন্তাকে বিনা সেলামিতে দশবিঘা জমি দেয়। ধাওতাল সাহুকে সমাদর করে।
এই প্রভু – প্রজা সম্পর্কের পাশাপাশি মালিক অধীনের সম্পর্কের ছবি পাই অরণ্যবিধৌত অঞ্চলের সমস্ত মানুষদের মধ্যে, যারা জল খাদ্য অর্থ মহামারী সবকিছুর সংকটে প্রকৃতির অধীনস্থ, প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এখন প্রশ্ন বিভূতিভূষণ কি কেবল অরণ্যবিধৌত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কষ্টজর্জরিত দিনলিপিই লিখেছেন সমস্ত উপন্যাস জুড়ে ? প্রকৃতি ও মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন বর্ণনাই কেবল আরণ্যক উপন্যাসের সম্পদ নাকি এর ভিতরে সঞ্চিত আছে অন্য কোনো সম্পদ ? এর উত্তর খুঁজতে হলে প্রয়োজন ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সামগ্রিক পর্যালোচনা –
‘আরণ্যক’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সত্যচারণ জানাচ্ছে –
● “চিরকাল কলিকাতায় কাটাইয়াছি, এই অরণ্যভূমির নির্জনতা যেন পাথরের মতো বুকে চাপিয়া আছে বলিয়া মনে হয়।”
ওই পরিচ্ছেদেরই মাঝে লিখেছেন –
● “…সেই নীরব নিশীথ রাত্রে জ্যোৎস্নাভরা আকাশতলে দাঁড়াইয়া মনে এক অজানা পরীরাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি – মানুষের কোনো নিয়ম এখানে খাটিবে না। এইসব জনহীন স্থান গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নালোকে পরীদের বিচরণভূমিতে পরিণত হয়, আমি অনধিকার প্রবেশ করিয়া ভাল করি নাই।”
● নবম পরিচ্ছেদে এসে লিখছেন –
“নির্জনতার মোহ, নক্ষত্রভরা উদার আকাশের মোহ আমাকে এমনি পাইয়া বসিয়াছে যে মধ্যে একবার কয়েকদিনের জন্য পাটনায় গিয়া ছটফট করিতে লাগিলাম কবে পিচ ঢালা বাঁধ করা রাস্তার গন্ডি এড়াইয়া চলিয়া যাইব লবটুলিয়া বইহারে।”
● “এই নির্জন শোভাময় বন্য প্রান্তর, অরণ্য, কুন্ডী, শৈলমালা জনপদে পরিণত হইবে, লোকের ভিড়ে ভয় পাইয়া বনলক্ষীরা ঊদ্ধর্শ্বাসে পালাইবেন – মানুষ ঢুকিয়া এই মায়াকাননের মায়াও দূর করিবে, সৌন্দর্যও ঘুচাইয়া দিবে।”
● অবশেষে উপন্যাসের অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে সত্যচরণের জবানীতেই বিভূতিভূষণ বলেছেন –
“লবটুলিয়া গিয়াছে, নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহার গিয়াছে – কিন্তু মহালিঘারূপের পাহাড় রহিল, ভানমতীদের ধানঝাড়ি পাহাড়ের বনভূমি রহিল। এমন সময় আসিবে হয়ত দেখে যখন মানুষ অরণ্য দেখিতে পাইবে না – শুধু চাষের ক্ষেত, পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়বে, তখন আসিবে সেই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশ, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেইসব অনাগত দিনের মানুষদের জন্য এ বন অক্ষুন্ন থাকুক।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিভূতিভূষণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যন্ত্রসভ্যতার থাবা কত ব্যাপক কত ভয়ানক। এখন উদ্ধৃতিগুলি পরপর পড়লে বিবর্তন বুঝতে পারবে। প্রকৃতিপ্রেমিক সত্যচরণ থেকে প্রকৃতি সচেতন সত্যচরণের বিবর্তন। নাগরিক সভ্যতায় পুষ্ট সত্যচরণের নির্জনতা প্রথমের বুকে পাথর চাপা মনে হলেও পরে এই নির্জনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তারপর এর অস্তিত্বে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। প্রকৃতি সচেতনতা বা পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ে বাংলা সাহিত্যে তেমন চর্চা হয়নি, যাকে ইংরাজিতে ইকো ক্রিটিসিজম বলতে পারি।
বিপন্ন পরিবেশ, তাকে রক্ষা করতে হবে, পরিবেশের বিপন্নতায় মানুষের কীভাবে কোন দিকে বিবর্তিত – এসবই ইকো ক্রিটিসিজমের আওতায় পড়ে। বলা যায়, ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ উপন্যাস থেকে সাহিত্য জগতে ইকো ক্রিটিসিজমের যাত্রা শুরু। ইংরাজীতে এ বিষয়ে অনেক উপন্যাস পেলেও বাংলায় নামমাত্র, আরণ্যক, অরণ্যের অধিকার উপন্যাসগুলি এক্ষেত্রে স্মরণীয়। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ এই ইকো ক্রিটিসিজমের বীজ বপন করে গেছেন বিচ্ছিন্নভাবে। প্রকৃতি প্রেমিক সত্যচরণের ওপরই ভার পড়েছে জমিতে গাছপালা সাফ করে প্রজা বসানোর। তিনি তো সেইসময়ে জীবিকার আশ্বাস ছেড়ে অরণ্য ও মানুষগুলোর হয়ে প্রতিবাদ করতে পারতেন। কেন করেননি ? কারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার ঘেরাটোপ। তাই ভূমিকা অংশের শেষ পর্যায়ে অকপট স্বীকারোক্তি – প্রতিবাদ তিনি করেননি সত্য কিন্তু ষাটের শেষ আর সত্তরের শুরুতে বিশ্বের দিকে যে পরিবেশবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তার অন্তত সিকিভাগ শতাব্দী আগে ভূমিষ্ঠ হয়ে ‘আরণ্যক’ তার কথাগুলো শুনিয়ে গেছে। আর রেখে গেছে যুগলপ্রসাদের মতো গাছপাগলের অনুপ্রেরণা। আর এখানেই বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস বিষয়গত উপস্থাপনায় আধুনিকতার গন্ডি পেরিয়ে উত্তর আধুনিকতার পথকে প্রশস্ত করেছে।
তবে, ‘আরণ্যক’ উপন্যাস আলোচনায় সবচেয়ে বড় বিতর্ক হল এটা আদৌ কি উপন্যাস ? এখানে তো মানুষের কথা তেমন নেই, অরণ্য প্রকৃতির বর্ণনায় স্মৃতিকথা বা ভ্রমণকথা। কিংবা সময় তারিখ বিহীন ডায়েরিও বলা যেতে পারে। তবে লেখক তাঁর দিনলিপিতে বলেছেন – “ইহা ভ্রমণ বৃত্তান্ত বা ডায়েরী নহে – উপন্যাস।” হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ (১৩৫৭) সংখ্যায় বলেছেন – “আমাদের উপনিষদকে বলে অরণ্যশাস্ত্র।…আরণ্যক বাংলার উপন্যাস সাহিত্যে এক অভিনব উপনিষদ।”