গণনাট‍্য ও নবান্ন নাটক

বিজন ভট্টাচার্য কৃষকদের দুর্দশা পীড়িত জীবন নিয়ে লিখলেন ‘নবান্ন’ নাটক। ‘নবান্ন’ নাটক জনসমক্ষে প্রথম এল ১৯৪৪ এ শ্রীরঙ্গম রঙ্গমঞ্চে। বাংলা নাট‍্যসাহিত‍্যের ইতিহাসে একটা বাঁক বদল ঘটালেন বিজন ভট্টাচার্য। কীভাবে ? বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’ এসব গণনাট‍্যের মধ‍্য   দিয়ে। এখন প্রশ্ন কী এই গণনাট‍্য , যা নাট‍্য ইতিহাসে, নাট‍্য ইতিহাসে শুধু নয় সমাজের ইতিহাসেও বাঁক বদল ঘটাল ?

গণ – নাট‍্য  – নাম থেকেই প্রকাশ পায় অনেক মানুষের উপস্থিতি যে নাটকে অর্থাৎ কোনো একক নায়ক নয় প্রধান চরিত্র হয়ে থাকবে অনেকগুলো চরিত্র এবং তারা কোনো জনতা কোনো জাতির প্রতিনিধিস্বরূপ।

সময়টা খেয়াল করো, ‘নবান্ন’ নাটক লেখা হচ্ছে ১৯৪৪এ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আর তাঁর আঁচে সমস্ত ভারতবাসী বিপর্যস্ত। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, কালোবাজারি, আবার এর পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে ফ‍্যাসিজমের উত্থান আক্রমণ এবং সাম্রাজ‍্যবাদের অগ্রাসন সেসময় মানুষকে আতঙ্কিত নিপীড়িত করে তুলেছিল। তখন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে এবং নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের তাগিদে শিল্পী সাহিত‍্যিকরা একত্রিত হয়ে গঠন করলেন প্রগতি লেখক সংঘ ১৯৩৬ এবং কালক্রমে ১৯৪২ এ ফ‍্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ। ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ ভারতবর্ষের লেখকরাও সেদিন শামিল হলেন। এই ফ‍্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংস্কৃতিক শাখা সংঘটন ছিল গণনাট‍্য সংঘ। পরে ব‍্যাঙ্গালোর, মুম্ব‌ইকে অনুসরণ করে কলকাতায় গণনাট‍্য সংঘপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৩ এর মে মাসে। কিন্তু এই ক্রান্তিকালে গণনাট‍্যের প্রয়োজনীয়তা কোথায় ?

         মানুষের কানে অকালের বার্তা পৌঁছে দিতে এবং এই অকালে মানুষের কর্তব‍্য ও দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করে সচেতন করাতেই গণনাট‍্যের প্রধান ভূমিকা। আর তার জন‍্য প্রয়োজন হল নতুন প্রকাশ রীতির –
~ একজন নায়ককে কেন্দ্র করে নয় একাধিক ব‍্যক্তির জীবন নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে নাট‍্যকাহিনি এবং প্রত‍্যেকের‌ই সমান গুরুত্ব।
~ কাহিনি, অভিনয়, দৃশ‍্যসজ্জা সমস্ত কিছুতে প্রকাশ পেতে থাকল কঠোর বাস্তবতা।
~ নাটক তখন বিনোদনের মাধ‍্যম নয়, রুজি রোজগারের মাধ‍্যম নয়, নাটক তার দর্শকের প্রতি দায়বদ্ধতা হয়ে উঠল সমাজের প্রতিবিম্ব, গণমাধ‍্যম, ক্রান্তিকালের লোকশিক্ষক।
~ সেসময় নাটকগুলির প্রত‍্যেকটি দৃশ‍্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, উন্মোচিত করছে এক একটি কঠিন বাস্তব।
~ ভাবে ভাবনায়, নাট‍্য গঠন নাট‍্য বিষয় ও নাট‍্য প্রয়োজনায় গণনাট‍্য সংঘ বাংলা নাটকের এতদিনের ধারা ঐতিহ‍্যকে ভেঙে দিল। আর তার সার্থক প্রকাশ বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের মধ‍্যে দিয়ে।

         ‘নবান্ন’ নাটকে চারটি অঙ্কে পনেরোটি দৃশ‍্য, গ্রাম বাংলার কৃষকের ছবি আঁকতে গিয়ে এসেছে আমিনপুর গ্রাম। গ্রামীণ কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেছে প্রধান সমাদ্দার ও তার পরিবার। আগষ্ট আন্দোলনে ব্রিটিশ পুলিশ মিলিটারির অত‍্যাচার, খাদ‍্যাভাব, মৃত‍্যু, বন‍্যা, লাঠিয়ালদের অত‍্যাচার, বাঁচার তাগিদে কলকাতায় ভিড়, পরিচিতি হারিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা – সেই সময়ের সবকিছুর নিঁখুত চিত্র তুলে ধরেছেন বিজন ভট্টাচার্য ‘নবান্ন’ নাটকে। আর যখন প্রধান সমাদ্দার তার পরিবারকে নিয়ে পরিচয় হারিয়ে কলকাতায় আসছে তখন বুঝে যাই ‘নবান্ন’ নাটক প্রধান সমাদ্দারকে নিয়ে নয়, তার পরিবারকে নিয়ে নয়, তাদের গ্রাম আমিনপুরকে নিয়ে নয় – সমগ্র গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজের প্রতিনিধি এরা।
         ‘নবান্ন’ নাটকের প্রেক্ষাপটে আছে – ১৯৪২এর আগষ্ট আন্দোলন, ১৯৪২এর প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং ১৯৪৩ এর মন্বন্তর। তবে ৪২ এর প্রাকৃতিক বিপর্যয়েই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমিনপুর ওরফে মেদিনীপুর। ইতিহাসের তথ‍্য অনুযায়ী – ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসে পড়ে মেদিনীপুর ও ২৪ পরগণা জেলার সমুদ্র উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায়। প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হতে থাকে এবং তার সঙ্গে আসে উত্তাল সামুদ্রিক তরঙ্গের বন‍্যা। সে বন‍্যা মেদিনীপুরের কাঁথি মহাকুমায় সাগরতীরের বাঁধ ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত তার প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা বিস্তার করে। তার কবলে পড়ে মেদিনীপুর জেলার ৩৬০০ বর্গমাইল এলাকার ২৩ লক্ষ অধিবাসী এবং ২৪ পরগণার ৪০০ বর্গমাইল এলাকার ২ লক্ষ অধিবাসী। নোনা জলে বিস্তীর্ণ এলাকায় কার্তিকের ফসল ভরা ধান খেত বরবাদ হয়ে যায়, সঙ্গে দেখা যায় ব‍্যাপক অঞ্চলে পানীয় জলের অভাব, আরম্ভ হয়ে যায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী। এই তুফান ও তার আনুষঙ্গিক কারণে মারা যায় মোট ১৪, ৫০০ মানুষ আর ১, ৯০,০০০ পশু।

         ‘নবান্ন’ নাটকের প্রথম দৃশ‍্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ পরিবেশ, বাঁশের গাঁট ফাটা শব্দের প্রতীকে গুলির আওয়াজ প্রকাশ করে সংগ্রামী জনতার ওপর সাম্রাজ‍্যবাদীদের নির্মম অত‍্যাচার। দ্বিতীয় দৃশ‍্যে মন্বন্তরের ছবি – ছন্নছাড়া গৃহস্থলি, দারিদ্র‍্যের বীভৎস রূপ। ভয়াবহ সাইক্লোন ও বন‍্যার ছবিতে ৩য় দৃশ‍্য পরিপূর্ণ। এরপর নাট‍্যকাহিনি তৎকালীন পরিস্থিতি অনুসারে এগিয়ে পড়েছে নিরন্ন অসহায় জনসমুদ্রের বুকে কলকাতায়।
‘যুগান্তর’ পত্রিকা ১৯৪৪ খ্রি: ২৭শে অক্টোবর লিখছে –
আগষ্ট আন্দোলন বন‍্যা, দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় এই নাটকের গল্পাংশ রচিত এবং যাহারা একেবারে নীচের তুলনায় বাঙ্গালার সেই দুঃস্থ কৃষকজীবন ইহার মধ‍্যে প্রতিফলিত। ইহা সত‍্য সত‍্য‌ই গণজীবনের প্রতিচ্ছবি।”
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল গ্রামীণ কৃষকদের দুর্দশার ছবি নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে তো অনেক আগেই লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। দীনবন্ধুর মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক সেসময়ে জনসমাজে
যথেষ্ট সাড়াও ফেলেছিল। স্বরপুর গ্রামের গোলক বসুর পরিবার – তোরাপ, আদুরি, ক্ষেত্রমণি সকলে একক নায়ক চরিত্র থেকে বেরিয়ে সেসময়কার কৃষকদের দুর্দশার প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ১৮৬০ এর লেখা নীলদর্পণ-এর প্রায় ৮৪ বছর পর নবান্ন সেই কৃষকদের দূর্দশা নিয়েই তো লিখেছে। তবে, ‘নবান্ন’ নাটকে অভিনবত্ব কোথায় ? আদৌ কি বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন বাঁক বদলের দাবি রাখে ?

       সেইসময় ‘শনিবারের চিঠি’ ব‍্যঙ্গ করে লিখেছিল – “ইহা নীলদর্পণ হয় নাই, হ‌ইয়াছে লালদর্পণ।” এই প্রসঙ্গে ‘নীলদর্পণ’ ও ত‍ৎকালীন নাটকগুলির বিশ্লেষণ করা যাক। জোর করে নীলের চাষ তার আদায় এবং অত‍্যাচারের পটভূমিকায় জন্ম নিয়েছিল ‘নীলদর্পণ’ নাটকে। বিলাতের মুখরক্ষা ও শাসকের হৃদয় পরিবর্তন এটাই ছিল উদ্দেশ‍্য। বাগানবাড়ির নাট‍্যশালা ভেঙে সর্বসাধারণের জন‍্য জন্ম নিল ন‍্যাশানাল থিয়েটার। রাজনীতির নাটকে এক প্রত‍্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করল বাংলাদেশ। কিন্তু দীনবন্ধু বুঝতে পারছেন না কোনটা সঠিক পথ, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শকে অনুসরণ করেননি তিনি। কৃষিজীবী ‘তোরাপ’ প্রতিবাদী চরিত্র কিন্তু শ্রেণি চ‍রিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। তোরাপ থেকে গিয়েছিল বিচ্ছিন্ন চরিত্রের মধ‍্যে একক বীরত্ব। দীনবন্ধু ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকরদের অত‍্যাচার লিখলেন অভিজ্ঞতা দিয়ে কৃষকদের দুর্দশা লিখলেন সহানুভূতি দিয়ে কিন্তু সেসময়ে যে এত বড় কৃষক আন্দোলন ঘটে যাচ্ছে তার বিবরণ কিংবা সেই আন্দোলনের সূত্রপাতের পূর্বাভাস পর্যন্ত নাটকে নেই।

         এই আবেদন নিবেদন এর রাজনীতিকে সম্বল করে ‘নীলদর্পণ’কে অনুসরণ করে জন্ম নিল ‘জমিদার দর্পণ’, ‘চা-কর দর্পণ’ এর মতো নাটকগুলি। পরবর্তীকালে ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’, ‘কারাগার’ , ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ ইত‍্যাদি নাটকে ব্রিটিশ শাসনের বর্বরোচিত দিকটা দেখানো হল সাঙ্কেতিকতার আশ্রয়ে। আসলে উনিশ শতেকের প্রতিবাদী নাট‍্যকারদের নাটকে যে রাজনৈতিক পটভূমি বাঙালি প্রত‍্যক্ষ করেছিল তার উৎস ছিল স্বদেশ প্রেম ও মানবপ্রেম। তাই অত‍্যাচারের বিবলণ সহানুভূতিতে প্রকাশ পেয়েছে, সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ শক্তির মন্ত্রে তাদের উজ্জীবিত করতে পারেনি। শুধু পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়, মানুষের বেঁচে ওঠা ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ শক্তির জয় ঘোষণা করা হল ‘নবান্ন’ নাটকে আর তার দায়িত্ব তুলে নিল নির্যাতিত কৃষকরাই। বিজন ভট্টাচার্য বলছেন –
“বাস্তববাদী হলেও আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। উজ্জ্বল এক ভবিষ‍্যৎ জীবনের স্বপ্ন। শ্রেণীহীন সমাজব‍্যবস্থার সেই স্বপ্ন ‘নবান্ন’ নাটক।”
জাতির যন্ত্রণা থেকে জাতির গৌরবের উন্মেষ ‘নবান্ন’ নাটক। নবান্ন নাটক সম্পর্কে অরণি পত্রিকা লিখেছে –
“খোলা মনে, শিথিল দেহে নাটক দেখতে গিয়ে ফিরে আসতে হবে প্রতিজ্ঞা কঠোর মন নিয়ে দৃঢ় মুষ্টিতে। বলিষ্ঠ এই প্রাণশক্তির উদ্বোধন ‘নবান্ন’ র প্রাণবস্তু। বাঙ্গালার গণজীবনের এই প্রাণস্পন্দন কোথাও দেখিনি, নীলদর্পণেও না।”

        মার্কসীয় চেতনায় বিশ্বাসী গণনাট‍্য সংঘের উদ্দেশ‍্যেই ছিল সমাজের সঠিক ছবিদেখিয়ে সাধারণ মানুষকে নিজের কর্তব‍্য সম্পর্কে সচেতন করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা, মুক্তির স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেবার জন‍্য সংগ্রাম করা। এখানেই আলাদা হয়ে যায় ‘নীলদর্পণ’ নাটক থেকে ‘নবান্ন’ নাটক। ‘নবান্ন’র অভিনবত্ব এইখানে। কিন্তু ‘নবান্ন’ নাটক গণনাট‍্যহিসাবে কতটা সার্থক ?

       কমিউনিস্টদের একাংশের দাবি ছিল ‘নবান্ন’ নাটকে জনগণের সংগ্রাম সেভাবে স্থান পায়নি, প্রাধান‍্য পেয়েছে হতাশা। এই দাবিতে কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা ‘নবান্ন’ নাটক বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন। এদের মতে ‘নবান্ন’ নাটকে রাজনৈতিক মতাদর্শগত দূর্বলতা ছিল।
অপর একাংশ ‘নবান্ন’ নাটকের ত্রুটি দেখিয়েছিলেন যা ১৩৫১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ‍্যায় ‘পরিচয়’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল – এই নাটকের শেষাংশ পূর্ববর্তী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন, ফলে নাটকটি স্বাভাবিক পরিণতি পায়নি।
– কিন্তু শেষ দৃশ‍্যটি বাদ দিলে যা থাকে তাকে নাটক বলা যায় না।
দুই পক্ষের মত মেনে নিয়েও বলা চলে ‘নবান্ন’ নাটকে এত দূর্বলতা সত্ত্বেও ‘নবান্ন’ নামে একটা যুগ চিহ্নিত হয়েছে। ‘নবান্ন’ নাটকের গুণ সম্পর্কে চিত্তরঞ্জন ঘোষ জানাচ্ছেন –
“পেশাদারী মঞ্চে যখন জীবনবিচ‍্যুত নাটকের একচ্ছত্র একঘেয়েমি তখন ‘নবান্ন’ গিয়েছিল জনজীবনের কাছে, তাদের সুখ দুঃখকে বোঝার চেষ্টা করেছিল।”
– এই জনজীবনের ঘনিষ্ঠতাই ‘নবান্ন’র প্রধান সম্পত্তি আর মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে তার জন‍্য সংগ্রাম করা ‘নবান্ন’র সম্পদ।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
নবান্ন নাটক – সম্পা: শমীক ভট্টাচার্য