প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ও অস্তিত্বের সংকট

          ‘গোটা মানুষের মানে চাই’ ঘোষণা করে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও মানুষের সমগ্র অর্থ খুঁজেছেন, খুঁজেছেন কোথায় তার অবস্থান। আধুনিক সভ্যতার দান অস্তিত্বের সংকটকে তিনি তাঁর গল্পের উপজীব্য বিষয় করেছেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রিয় বিষয় নরনারীর প্রেম সম্বন্ধে তিনি উচ্চকন্ঠ নন, এমনকি মানবতাকেও পরাজিত করেছেন তাঁর গল্পে। এইসব বৈশিষ্ঠ্যের নিরীখে প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গল্পের পাতা ওল্টানো যাক।

          প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচিত প্রথম গল্প ‘শুধু কেরানি’ প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায় চৈত্র, ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। গল্পটি প্রকাশিত হবার পরেই কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩১ বৈশাখ সংখ‍্যায় সম্পাদকীয় মন্তব‍্যে গল্পটি প্রসঙ্গে মূল‍্যায়ন করা হয় –
“একটি কেরানি যুবক ও তাহার স্ত্রীকে ল‌ইয়া এই গল্প। এই দুইটি মানুষের প্রেম ও স্পৃহার মধ‍্যে কোন‌ও আবিলতা নাই।”
সময়টা ১৯২৪, একজন সামান‍্য বেতনের কেরানির জীবন কাহিনি উঠে এসেছে গল্পে, সংসারে অভাব, তবু হেঁটে অফিস যায়, আর সেই পয়সা বাঁচিয়ে স্ত্রীর জন‍্য গোড়ের মালা কিনে আনে, খোঁপায় জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে – “বল দেখি কেমন গন্ধ ?” – ভালোবাসার প্রকাশে কোনো আভিজাত‍্য নেই, আড়ম্বর নেই, কিন্তু আন্তরিকতা ভরপুর। এরপর স্ত্রীর অসুখ করে, ডাক্তারের কথায় সূতিকারোগ, দরিদ্রতার ভয়াবহতায় চিকিৎসার অভাবে মারা যায় স্ত্রী সেই অনাড়ম্বর ভাবেই। মারা যাবার আগেও তাদের প্রেমের ঘনঘটা প্রকাশ পায় না কিংবা হতাশার বাহুল‍্য‌ও নয়। কেবল স্ত্রী বলে ফেলে – “আমি মরতে চাইনি – ভগবানের কাছে রাতদিন কেঁদে জীবনভিক্ষা চেয়েছি, কিন্তু…”
আর তারপর গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘোষণা – “সব ফুরিয়ে গেল।
তখন কালবৈশাখীর উন্মত্ত মসীবরণ আকাশে নীড়ভাঙার মহোৎসব লেগেছে।”
– দরিদ্র দম্পতির সুখের দাম্পত‍্য জীবনের ইতি টেনেছেন কালবৈশাখীর আকাশে নীড়ভাঙার মধ‍্য দিয়ে। আর গল্পের শুরু হয়েছিল – চঞ্চল পাখিদের খড়কুটো, ছেঁড়া পালক, শুকনো ডাল ইত‍্যাদি দিয়ে ঘর বাঁধার গল্পে।
দরিদ্রক্লিষ্ট মানুষের জীবনও পাখির বাসার মতোই পলকা, সেখানে গভীর অনাড়ম্বর হৃদয়াবেগের সুতো দিয়ে ঘর বাঁধা হলেও দরিদ্র অভাব ইত‍্যাদি কালবৈশাখীর উন্মত্ততায় সব ফুরিয়ে যায়, সে ঘর টেকে না। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে ভালোবাসার গভীরতা নয় টাকা পয়সাই নির্মম বাস্তব। সেই নির্মম বাস্তবতার ছবি প্রেমেন্দ্র মিত্র তুলে ধরেছেন সহছ সাদামাটা ভাষায় কিন্তু তার অর্থ অনেক গভীরে প্রোথিত। অর্থাভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা করতে না পারায় স্বামীর মনের নিদারুণ রক্তক্ষরণ স্ত্রী স্মিত করুণ হাসিতে প্রকাশ করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র – “একটা হাসি আছে – কান্নার চেয়েও নিদারুণ, কান্নার চেয়ে যেন বেশি হৃৎপিন্ড নেংড়ানো।”

         ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের মধ‍্য দিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র সমস্ত পাঠককেই নিয়ে এনেছেন গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসাবে, মোহাবিস্টের মতো তাঁকে অনুসরণ করিয়ে শেষ মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে নির্মম জগতের সামনে উপস্থিত করেছেন। কর্মব‍্যস্ততার দৈনন্দিনতা থেকে প্রত‍্যেক মানুষ‌ই ছুটি পেতে চায়, অবসর চায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র‌ও সেই নিভৃত অবসরে মুক্তির খোঁজ দেবেন বলে অনুসরণ করতে বলেন পাঠককে। তখন তেলেনাপোতা হয়ে যায় পাঠকের স্বপ্নপ্রতিম জায়গা, প্রেমের পাদপীঠ, জীবনানন্দের দারুচিনিদ্বীপ। সেইখানে পৌঁছে পাঠক শুধু নিজেকে দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকে মুক্তি দেয় না, ভিন্নপ্রবাহের স্বাদ নিতে চায়, মেয়ের জন‍্য নিরঞ্জনের প্রতীক্ষারতা মায়ের কোটরাগত চোখে প্রশান্তি এনে দিতে ইচ্ছে হয়। দরিদ্র, অভাবী সাধারণ যামিনী যার মুখের শান্ত করুণ গাম্ভীর্য দেখে মনে হবে জীবনের সুদীর্ঘ নির্মম পথ সে পার হয়ে এসেছে, কিন্তু অভাবী জীবন ক্ষীণ শরীরে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে উত্তীর্ণ হ‌ওয়া তার যেন স্থগিত হয়ে আছে – এমন যামিনীর চোখে কৃতজ্ঞ দেখতে চাওয়ার প্রবল তাড়নায় নিজে নিরঞ্জনের জায়গা নিতে চাইবে এবং সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তেলেনাপোতা ত‍্যাগ করে আবার শহরের কর্মব‍্যস্ততা, গাড়ির ধোঁয়া, আলো, ম‍্যালেরিয়া, দৈনন্দিনতায় তেলেনাপোতা ঝাপসা স্মৃতি হতে হতে মলিন হয়ে যাবে। আসলে এই তেলেনাপোতা ইতিবাচক আদর্শবাদী জীবনের প্রার্থিত গন্তব‍্য, সেখানে নিভৃতক্ষণে মানুষ মেতে চায় কিন্তু সেখানে থাকতে পারে না। এই থাকতে না পারাটাই আধুনিক সভ‍্যতায় মধ‍্যবিত্ত জীবনের দুর্লঙ্ঘনীয় ভবিতব‍্য, আর তার জেরেই প্রার্থিত গন্তব‍্য হয়ে যায় দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনামাত্র।

         ‘মহানগর’ গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্র মহানগরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছেন গ্রাম থেকে আসা সরল ছোট রতনের চোখে। গল্পের শুরুতে পাঠককেও নিজের সহযাত্রী করে নেন – “আমার সঙ্গে চলো মহানগরে”, আর তারপর পেঁয়াজের খোসার মতো সাধারণভাবে উন্মোচন করে মহানগরের গভীরে প্রোথিত হয়ে থাকা গল্পের। রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত এই মহানগর নির্মল ঔদাসীন‍্যে, কঠিন ধাতু আর ইটের ফ্রেমে লক্ষ জীবনের সুতো দিয়ে বুনে চলে বিশাল এক সূচিছিদ্র। এই মহানগরের বিশাল অরণ‍্যে কত মানুষ আসে কত কিছুর খোঁজে। ছোট রতন‌ও আসে বাবার শাসানি চোখ রাঙানি সব সহ‍্য করে তার হারিয়ে যাওয়া দিদির খোঁজে। কেবল ‘উল্টোডিঙি’ নামটাকে মাত্র সম্বল করে। খুঁজেও পায় দিদিকে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে  পারে না, মহানগরের মহানাগরিক দৃঢ় বন্ধনের কাছে পরাজয় ঘটে সরলমতি রতনের ভালোবাসার। তবু তার জেহাদ – “বড় হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব দিদি! কারুর কথা শুনবো না” – এই শপথটুকুই কেবল সত‍্য গ্রামীণ স্নিগ্ধতার, সরল হৃদয়াবেগের। কিন্তু গল্পকার জানেন, রতনের দিদি চপলাও বোঝে আর পাঠক‌ও বুঝে যায় এই শপথ রক্ষা পাবে না, বাস্তবের জটিলতায় দিদির স্মৃতি ফিকে হবে, সমাজ গ্রাস করবে রতনকে আর দিদি হারিয়ে যাবে মহানগরের বিশাল বিস্ময়কর অরণ‍্যে।

         সংস্কার ও মানবতার দ্বন্দ্বে ‘সাগর সংগম’ গল্পের উপজীব‍্য বিষয়। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের কূল বিধবা দাক্ষায়ণীর নি:সঙ্গ জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয় ছিল আচার ধর্ম কেন্দ্রিক কঠোর নিয়মনিষ্ঠা। এহেন দাক্ষায়নীর গঙ্গাযাত্রা পথে সঙ্গী হয় পতিতা মেয়ে বাতাসী। তারপর পরিবেশ ও জন্মগত সংস্কারের আবরণ খসে সুপ্ত মাতৃত্ববোধ প্রকাশ পায়। গঞ্জের চালাঘরে মেয়েটিকে কোলের কাছে শুইয়ে মাতৃত্বের ওম অনুভব করে। কিন্তু গল্পের শেষে বাতাসি মারা যায়। হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছে বাতাসীর পরিচয় হয় দাক্ষায়ণীর মেয়ে। জীর্ণ সংস্কার হেরে যায় মানবতা সর্বোপরি মাতৃত্বের কাছে। নিরন্তর গোটা মানুষের মিনে খুঁজে যাওয়া প্রেমেন্দ্র মিত্রের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি দাক্ষায়নী।

         ‘সংসার সীমান্তে’ গল্পটি এমন দুই নারী পুরুষের গল্প যারা প্রকৃত অর্থে সংসার সীমানার বাইরে বসবাসকারী অতি নগণ‍্য মানুষ – অঘোর দাস, একজন চোর, আর রজনী – বিগতযৌবনা রূপহীনা পতিতা। এই নরনারীর মধ‍্যেও যে মধুর প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক হতে পারে তা তথাকথিত ভদ্র সম্প্রদায়ের ভাবনার বাইরে। সন্দেহ নেই বাংলা সাহিত‍্যে এমন প্রেম বিরল, আর প্রেমেন্দ্র মিত্র বসলেন সেই রূপকথার গল্প লিখতে।
গল্পে পলাতক আসামী অঘোর বর্ষাক্লান্ত গভীর রাতে চুরি করতে গিয়ে পালিয়ে বাঁচতে আশ্রয় নেয় রজনীর ঘরে। আবার ভোরে সকলের অলক্ষে পালিয়ে গিয়েও দুপুরে ফের এসেছে। কলঙ্কিত ইতিহাসে রূপকথার গল্প বুনেছে সেবা, মনকষাকষি, শাসন কিংবা ‘আজ একটু অম্বল রাঁধতে পারিস’ এর মতো আব্দারে। এরপর সেই রূপকথার গল্প ঘর বাঁধার প্রস্তুতি নিয়েছে, আর ঠিক তখন‌ই তা ভেঙে আছড়ে পড়েছে বাস্তবের মাটিতে। রজনীর ধার শোধার জন‍্য প্রয়োজনীয় কুড়ি টাকা জোগাড়ের শেষ চুরি করতে গিয়ে অঘোরের পাঁচ বছরের জেল আর রজনীর ডিবার নিবো নিবো আলো হাতে প্রতীক্ষা – নির্মম বাস্তবের শাশ্বত ছবি, এ ছবি স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা – এর মধ‍্য দিয়েই চলে সংসারের সীমান্তে থাকা মধ‍্যবিত্ত মানুষের জীবন।

          নিম্নমধ‍্যবিত্ত প্রেমেন্দ্র মিত্রের অভিজ্ঞতার পরিসীমা নয়, তার গভীরে প্রবেশের ক্ষমতাও প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিল। তাই সহজ, সরল অনাবিল ভাবে প্রকাশ করেছেন মধ‍্যবিত্ত জীবনের দুর্জ্ঞেয় রহস‍্য, না জানতে চাওয়া সেসব গল্পগুলির সামনে পাঠককে কান ধরে এসে বসিয়ে দিয়েছেন। ‘গোটা মানুষের মানে’ দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সূক্ষ আভিজাত‍্যহীন হৃদয়াবেগ ও নির্মম বাস্তবতার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছেন, কখনো কষ্ট করে বাঁচানো টাকায় ফুলের মালা কিনে খোঁপায় বেঁধে কখনো যামিনীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখিয়ে, দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতির মধ‍্য দিয়ে চারপাশের বিরুদ্ধে প্রবল জেহাদ ঘোষণা করে, জীর্ণ সংস্কার ভেঙে মাতৃত্বের জয়যাত্রায় কিংবা সংসারের প্রান্তে থাকা উপেক্ষিত মানুষের ঘর বাঁধা স্বপ্ন দেখিয়ে ক্রমে রূপকথার গল্প বুনে পাঠককে মোহাবিষ্ট করেছেন, তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আর তারপরেই খুলে দিয়েছেন নির্মম বাস্তবের দরজা, তাও নি:শব্দে।

        শিল্প সাহিত‍্য বা যে কোনো সৃষ্টিকেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করলে তার শিল্পগুণ থাকে না। খানিকটা সংশয়, খানিকটা কৌতূহল আর খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে পড়তে হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প। পঞ্চাশ বা ষাট দশকে বাংলা ছোটগল্পের অন‍্যতম বৈশিষ্ঠ‍্য গল্পের শেষে চমকের বদলে অনিশ্চয়তা। বলাবাহুল‍্য এই রীতির‌ই প্রবর্তক প্রেমেন্দ্র মিত্র। নিজের ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর মন্তব‍্য –
শুরুও সত‍্যি বলতে গেলে কোনো গল্পের‌ই নেই, শেষ‌ও না।” এই অস্তিত্বের সংকট ভাষা ও ভাবের মাধ‍্যমে পরিস্ফুট হয়ে তাঁর গল্পকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে।

তথ‍্যসূত্র : প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প – সম্পাদনা : সৌরীন ভট্টাচার্য