বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ – হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের দলিল
অমিত্রাক্ষর ছন্দ, কৃষ্ণকুমারী নাটক কিংবা মেঘনাদবধ কাব্য – মধুপ্রতিভার উজ্জ্বল অবিস্মরণীয় কীর্তি হলেও তাঁর রচিত প্রহসন দুটির স্থান বাংলা সাহিত্যে সর্বোচ্চ, অনতিক্রম্য এবং বিশেষও। কিন্তু মাইকেল এই প্রহসন রচনার পর লেখার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন। কেন ?
বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রহসন প্রণেতা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এবং কোনো রকম পূর্ব নিদর্শন ছাড়াই রচিত প্রহসন দুটি সার্থক, দোষ ত্রুটি আশ্চর্যভাবে মুক্ত। মধুসূদন সমকালীন সমাজব্যবস্থার নগ্নরূপটা দেখিয়েছিলেন প্রহসনের মাধ্যমে, সেই ভ্রষ্ট সমাজব্যবস্থা সমালোচনা করার জন্য বেছে নিয়েছেন প্রহসনের কাঠামো।
নব্য নবজাগরণের আন্দোলনে আন্দোলিত উনিশ শতকের কলকাতা মূল দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল –
এক, পাশ্চাত্য ভাবধারা অনুসৃত যুবক সম্প্রদায়ের ইয়ংবেঙ্গল
দুই, ইয়ংবেঙ্গলের বিপরীতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। প্রথম সমস্যাটি নিয়ে রচিত ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসন, আর দ্বিতীয়টি নিয়ে আজকের আলোচনা ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসন। এটি ১৮৬০খ্রি: প্রকাশিত হয়, এর নামকরণ করেছিলেন রাজা ঈশ্বরচন্দ্র।
পৌত্তলিকতাবাদে অবিশ্বাস ও সমাজ সংস্কারের আশা বুকে নিয়ে উনিশ শতকীয় শিক্ষিত যুবসম্প্রদায় পাশ্চাত্য অনুকারকের দলের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মদ্যপান আর তার সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছিল সম্ভোগলিপ্সা। বেদান্ত আশ্রয়ী হিন্দু রক্ষণশীল একেশ্বরবাদী সমাজ এই ইয়ংবেঙ্গলের তীব্র বিরোধিতা করলেও সমাজের নিজেদের পদমর্যাদা উচ্চ করতে পরিমিত মদ্যপানের প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আর এই পরিমিত মদ্যপানের স্বচ্ছতার মতো সচ্চরিত রক্ষণশীল হিন্দুদের গোপনে চলে বারাঙ্গনা বিলাস। এই মেকি রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাহ্মণের প্রতিনিধি ভক্তপ্রসাদ। মাইকেল নামকরণেও তীক্ষ্ণ সচেতনার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। নব্যযুবক যেমন নবকুমার, তেমনি ভক্তপ্রসাদের ভক্তির ভাব মাধুর্যের নেপথ্যে কদর্য কার্যকলাপকে প্রকাশ করবেন বলেই এই নামকরণ। চরিত্রের কথায় ও কার্যে অসঙ্গতি প্রকাশই প্রহসনের উদ্দেশ্যে। পরম বৈষ্ণব ভক্তপ্রসাদের ভক্তির আড়ম্বরের পেছনে – নারীলোলুপতা এবং তার উদ্দেশ্যে যথেচ্ছ অর্থব্যয় ও
প্রজাশোষণের মধ্য দিয়ে অর্থসংগ্রহ – দুটি দিকই মধুসূদন প্রকাশ করেছেন।
সন্ধ্যাহ্নিক করা, প্রতি সোমবার হবিষ্যি করা জমিদার ভক্তপ্রসাদ মুসলমানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে অথচ মুসলমান নারীকে ভোগ করতে দ্বিধা নেই। বিড়ালতপস্বী বুড়ো শালিক ভক্তপ্রসাদের নারীলালসার চরম পরিণতি নেমে আসে সুন্দরী ফতেমার সামনে। ফতেমার সৌন্দর্যে কামোন্মাত্ত ভক্তপ্রসাদ হানিফের খাজনা মুকুব করে দেয়। দিনের আলোয় প্রাচীন সংস্কারপন্থী বৈষ্ণব ভক্তপ্রসাদ রাতের অন্ধকারে কামোন্মত্ত যুবক। উনিশ শতকের রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীদের সুনিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনে। এ প্রসঙ্গে সমালোচক শশাঙ্ক মোহন সেন জানাচ্ছেন –
“দেশীয় হিন্দুয়ানির ভন্ডামিকে সকলভাবে প্রকাশ করেছেন মধুসূদন। এই ভন্ড চরিত্র হল জমিদার ভক্তপ্রসাদ। তার নারীলোলুপতাকে কেন্দ্র করে একদিকে হিউমার অন্যদিকে স্যাটায়ারের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।”
এই হিউমার ও স্যাটায়ারের যুগ্ম প্রকাশের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ সার্থক প্রহসন হয়ে উঠেছে। মাত্র একদিনের ঘটনায় জীবনের খন্ডাংশকে প্রকাশ করেই সামগ্রিক অন্ত:সারশূন্যতাকে উপস্থাপিত করেছেন। স্বল্প কথায় সংহতি পরিসরে সামগ্রিক সমস্যাকে প্রকাশ করেছেন, অথচ তার মধ্যে কোনো বিষয়ক বর্ণনা করতে বাকি রাখেনি, কোনো দিক অসম্পূর্ণ থাকেনি, অতিরিক্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি। অথচ এই প্রকার সার্থক অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর রাখার পরেও মধুসূদন এই প্রহসন রচনায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন কারণ – প্রহসনের মধ্য দিয়ে মেকি সমাজের যে দিকটা তিনি তুলে ধরেছেন তাতে সমকালীন সমাজ তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। প্রহসনের অভিনয় বন্ধ করতে বাধ্য করা হয় এবং নাট্যকারের কপালেও জোটে সমুচিত নিন্দা ও তিরস্কার। ভক্তপ্রসাদের এই ধরণের চরিত্রাঙ্কন গোঁড়া ব্রাহ্মণ ও সমাজপতিদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। পন্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন এর তীব্র নিন্দা করে জানান –
“গোঁড়া হিন্দুরা অপরাপর অপকর্মে রত হইলেও জাতিভ্রশংকর যবনী সংযোগ কখনোই এরূপ ব্যগ্র হয় না।”
অর্থাৎ মুসলমান রমণীর প্রতি ভক্তপ্রসাদের আসক্তিকে তিনি অস্বাভাবিক বলে মনে করেছেন। তবে, এই রকম মানুষ প্রকৃতই ছিল, এখনও আছে। যোগীন্দ্রনাথ বসু মধুসূদনের জীবনচরিতে জানিয়েছেন –
“মধুসূদনের সময়ে এই শ্রেণীর কতকগুলি লোকের কলিকাতার ও তাহার নিকটবর্তী পল্লীসমাজে বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। বাহিরে মালাজপ, কিন্তু গোপনে পরস্বাপহরণ, সামাজিক প্রতিপত্তির জন্য দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা কিন্তু গোপনে বারাঙ্গনা প্রতিপালন তাঁহাদিগের অনেকের নিত্যব্রত ছিল।”
তা সত্ত্বেও বলা চলে রামগতি ন্যায়রত্ন প্রহসনটির সুবিচার করতে পারেননি। নাট্যকার ভক্তপ্রসাদের মাধ্যমে সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজকে ব্যঙ্গ করেননি, ভন্ডধর্মধ্বজাধারীদের মুখোশ খুলেছেন। আর তার বিপরীতে প্রহসনে এনেছেন পঞ্চানন বাচস্পতির মতো সনাতন শান্ত ব্রাহ্মণকে যার হস্তক্ষেপেই ফতেমা মুক্ত পায় এবং ভক্তপ্রসাদের চৈতন্যোদয় হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রী দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ১৩৫১ সনের আষাঢ় মাসে ‘প্রবাসী’তে ‘মধুসূদন ও ফরাসী সাহিত্য’ সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধে জানান যে, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটি ফরাসি নাট্যকার মলিয়েঁর ‘তারতুফ’ নাটকের প্রভাবে লিখিত, যদিও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।
Abul Hossain