অচলায়তন –

দ্বন্দ্ব নাটকের প্রাণ, আর রবীন্দ্রনাটকে সেই দ্বন্দ্ব বন্ধন আর মুক্তিকে কেন্দ্র করে, যন্ত্র সভ‍্যতার করাল গ্রাস থেকে প্রাণের মুক্তি ঘোষণা করেছেন ‘মুক্তধারা’ নাটকে, আবার অন্ধ সংস্কার পেরিয়ে প্রেমের, মনুষ‍্যত্বের জয়ের বার্তা দিয়েছেন ‘বিসর্জন’ নাটকে। আর প্রাণহীন নিয়মের বন্ধনকে ছিন্ন করার প্রয়াস দেখিয়েছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে। কিন্তু নিয়মের দাসত্বকে মুক্তির কথা বলতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। কেন ?

অচলায়তন তত্ত্বনাটক, রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নাটকের মূল বিষয় মৌলিক দ্বন্দ্ব, আর সেই দ্বন্দ্ব হল জড়ধর্মের সঙ্গে প্রাণধর্মের। জড়ধর্মের প্রাধান‍্য যত‌ই প্রবল হোক না কেন প্রাণধর্মের কাছে তার পরাজয় নিশ্চিত – এই তত্ত্বকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নানাভাবে উপস্থাপিত করেছেন। প্রমথনাথ বিশীর মতে, তিনটি ভাবে উপস্থাপন করেছেন –
১) মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক
২) মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক
৩) মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক
‘অচলায়তন’ নাটকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রাধান‍্য পেয়েছে, দ্বন্দ্বের মধ‍্য দিয়ে সেই সম্পর্ক স্পষ্টতা লাভ করেছে। মানুষের তৈরি বহুদিনের অর্জিত অন্ধ ও বিকৃত সংস্কার এবং অনুশাসনগুলি সমাজকে কীভাবে নাগপাশের সহস্র বন্ধনে বেঁধে রেখেছে তার স্বরূপ প্রকাশ করে সেখান থেকে মুক্তির কথা বলেছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে।
তাহলে এই নাটকে অচলায়তনের শরিক কারা ? কেবল‌ই কি মহাপঞ্চকের অনুগামীরাই ? না, মূলত মহাপঞ্চকের নিয়মের বেড়াজালকে প্রাধান‍্য দেওয়া হলেও রবীন্দ্রনাথ তিনটি অচলায়তনের কথা বলেছেন –
i) মহাপঞ্চকের অনুগামীদের অচলায়তন
ii) শোনপাংশুদের অচলায়তন
iii) দর্ভকদলের অচলায়তন
এই তিনদলের স্বরূপ স্বতন্ত্র তাই এদের সাধনার পথ‌ও ভিন্ন পথ এবং মুক্তির ঠিকানাও।
● মহাপঞ্চকের অচলায়তনের সাধনা জ্ঞানমার্গে
● শোনপাংশুদের অচলায়তনে সাধনা কর্মমার্গে
● দর্ভকদলের অচলায়তনের সাধনা ভক্তিমার্গে
নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে এরা নিজস্ব পথে কেবল সাধনাই করে বেড়িয়েছে কখন‌ও একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেনি। নিজের পথটাকেই তারা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছে। অথচ এরা তিন দল‌ই গুরুর সন্ধান করেছে। মহাপঞ্চকের অনুগামীরা জ্ঞানমার্গের সাধনায় মন্ত্রকে মননের চেয়ে, পুঁথিকে গুরুর চেয়ে এবং আচারকে মানুষের চেয়ে বড় মনে করেছে। আর তাদের নিয়মের প্রাচীরে আহত হয়েছে সুভদ্র, পঞ্চকেরা। অপরদিকে, শোনপাংশুর দল কাজকে প্রাধান‍্য দিয়েছে কিন্তু কেন কাজ করে তারা জানে না। তারা কাজ করাকেই স্বাধীনতা মনে করে, কেবল শরীরে খেটে যাওয়া। এক‌ইভাবে দর্ভকদের পথ ভক্তির পথ – অন্ধভক্তি, তার স্বরূপ‌ও তারা জানতে আগ্রহী নয়।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ কেবল আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, মননহীনতার বিরুদ্ধে তার অভিযান, মননের স্বাধীনতার তিনি প্রয়াসী যার একমাত্র উপায় জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের একত্র সমন্বয়।
‘অচলায়তন’ নাটকের গোড়া থেকে গুরুর আবির্ভাবের উৎকন্ঠা আছে, অথচ সেই গুরু কে কেউ চেনে না, চেনে কেবল শঙ্খবাদক ও মালী। এর কারণ কী ?
– কেননা, তারা পুরানো লোক, সত‍্যিই কি তাই ?
– আসলে তারাই কেবল সুর ও সৌন্দর্যের সাধনা করেছিল। অন‍্যরা শুষ্ক জ্ঞান ও আচারের মধ‍্যে বদ্ধ ছিল। তাই মালী ও শঙ্খবাদক‌ই কেবল চিনতে পারল সেই গুরুকে যার মুক্ত জীবনের প্রতিষ্ঠার্থে আবির্ভাব।

আর ‘অচলায়তন’ নাটকের সর্বশক্তির উৎস গুরু, এই গুরু আসলে কে ? নাটকে গুরুর তিনটি রূপ –
অচলায়তনে তিনি গুরু,
শোনপাংশুদের কাছে দাদাঠাকুর,
আর দর্ভকদের কাছে গোঁসাই। কবি জানিয়েছেন দাদাঠাকুর, গোঁসাই আর গুরু – এই তিন মূর্তিতে মিলেই গুরুর সম্পূর্ণ রূপ। অর্থাৎ জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি যোগের সম্মিলিত শক্তির উৎস এই গুরু। তার যোদ্ধাবেশের উল্লেখ আছে। প্রমথনাথ বিশীর মতে, এই গুরুকে ভগবৎপ্রেরিত দূত বলে মনে করতে হবে। তিনি স্নেহ‌ও করেন আবার শাসন‌ও। মহাপঞ্চককে স্নেহ করেন বলেই শাসন করেন এবং ক্ষমা করেন।

কিন্তু শোণপাংশুদের কাছে থেকেও তারা গুরুর প্রশ্রয় পাননি কেন ? এর উত্তরে সমালোচক অজিত ঘোষ জানাচ্ছেন,।গুরুর পথ নিরপেক্ষ তাই গুরুর খুব কাছাকাছি থেকেও গুরুকে শোণপাংশুরা পুরোপুরি পাননি।আবার এর কারণ হিসাবে এটা মনে করাও অসঙ্গত নয় যে তাদের কর্মোদ‍্যমকে তিনি সংযত করতে চেয়েছিলেন।

আর দর্ভকরা ? আপাতভাবে মনে হয় যে গুরুর দরদ দর্ভকদের প্রতি গভীর নয়, কেননা তাদের প্রতি আলাদা কোনো নির্দেশ নেই। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, এই দর্ভকদের ভক্তিপথ উপেক্ষা করতে না পেরে গুরু তাদের মাঝে নেমে এসেছেন, নাটকের শেষাংশে সকলকে নিয়ে তিনি দর্ভকদের ভক্তির অর্ঘ‍্য গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ অচলায়তন এবং শোনপাংশু অপেক্ষা দর্ভকদের স্থান খানিক উচ্চ বলা যেতে পারে গুরুর কাছে, কারণ তাদের কাছে ভক্তিমার্গ আছে, মনন দ্বারা চালিত তারা। তবে, সেখানেও সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ধরা দেননি কারণ জ্ঞান যোগেই ভক্তি সমৃদ্ধ হয়।

‘অচলায়তন’ নাটক প্রবাসীতে প্রকাশ হলে অধ‍্যাপক ললিত কুমার বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ‘আর্য্যাবর্ত্ত’ (কার্তিক, ১৩১৮) মাসিক পত্রে একটি প্রশস্তি ও সমালোচনা প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পত্রে সমালোচনার উত্তর দেন যা ‘আর্যাবর্ত্ত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ, ১৩১৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। শ্রী বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় সেখানে ‘অচলায়তন’ নাটক প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন রাখেন যে গুরুর উদ্দেশ‍্য কি শুধু ভাঙা ?
এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানান, গুরু ভাঙার কথা নয়, গুরুর আঘাত কেবল নষ্ট করার জন‍্য‌ই নয়, তাকে নতুন করে সৃষ্টি করার  মধ‍্যেই সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথের মতে, ইতিহাসে সর্বত্র‌ই কৃত্রিমতার জাল যখন দৃঢ়তম হয়েছে তখন‌ই গুরু এসে তা ভেঙেছেন, তাঁকে হয়ত আমরা স্বীকার করিনা, বাধা দিই তবু তিনি আসেন। এমনকি তিনি মনে করেন যে ইউরোপে যে যুদ্ধ বেঁধেছে সে ঐ গুরু এসেছেন বলেই। তাকে অনেক দিনের টাকার অহংকারের প্রাচীর ভাঙতে হচ্ছে বলেই তিনি এসেছেন সমারোহ করে।

তা সত্ত্বেও, ‘অচলায়তন’ নাটক সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। তত্ত্বাশ্রয়ী এই নাটকের সকল চরিত্র‌ই যেন আইডিয়ার মুখোশ পাত্র। মানবীয় গুণ চরিত্রগুলির মধ‍্যে ধরা পড়েনি, কেউ প্রাণধর্মের কথা বলেছে কেউ জড়ধর্মের কথা, কিন্তু তাদের চরিত্রের কোনোরকম উত্থান পতন নেই। রবীন্দ্রভাবনার বাহক মাত্র। কেবল মহাপঞ্চক চরিত্রটিতে মানবসুলভ সজীবতা আছে বলে মনে করেছেন ড. বিশী।
এছাড়া অপর যে ত্রুটিটি নজরে পড়ে সেটা হল, রবীন্দ্রনাথ এখানে নতুন সমাজব‍্যবস্থার কথা বলেছেন অথচ সেই সমাজ নারী বর্জিত। নাটকের কোনো চরিত্রের উল্লেখ পাই না।

‘অচলায়তন’ নাটক আলোচনা প্রসঙ্গে আসে অচলায়তনের পরিবেশের কথা। অচলায়তনের দুর্ভেদ‍্য প্রাচীর বেষ্টিত অট্টালিকা নালন্দা, বিক্রমশীলা ইত‍্যাদি বৌদ্ধবিহারগুলিকে মনে করায়, এর অদ্ভূত রীতিনীতি,আচারব‍্যবস্থা, মন্ত্র বেশিরভাগ‌ই মহাযান মতবাদের সঙ্গে সাদৃশ‍্য পাওয়া যায়। সেদিক থেকে গুরু ও বৌদ্ধদের গুরু গৌতম বুদ্ধের সমগোত্রীয় মনে করা যেতে পারে।

তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অচলায়তন’ নাটকে হিন্দু বা বৌদ্ধ কোনো বিশেষ ধর্মের আচার ব‍্যবস্থাকে আঘাত করেননি, তিনি যে কোনো ব‍্যবস্থার অর্থহীন অযৌক্তিক অভ‍্যাস ও বিশ্বাসবশত চলে আসা আচারসর্বস্বতাকে আঘাত করেছেন এবং সমস্ত কিছুকে জ্ঞান কর্ম ভক্তি যোগে গ্রহণের কথাই বলেছেন।