চাঁদ বণিকের পালা – অন্ধকারের পাঁচালি
‘চাঁদ বণিকের পালা’নাটকটি শম্ভু মিত্রের রচিত সর্বশেষ মৌলিক নাটক। ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮সালে, প্রেক্ষাপট মধ্যযুগের সুপরিচিত মনসামঙ্গলের কাহিনি।অথচ নাটকটি বহুরূপী পত্রিকায় ‘বটুক’ ছদ্মনামে লেখেন তিনটি পর্বে এক বিস্তৃতি সময় জুড়ে ১৯৬৫ – ১৯৬৬ এবং ১৯৭৪ সালে।
এখন প্রশ্ন –
● সুপরিচিত মনসামঙ্গলের আখ্যানকে কেন্দ্র করে রচিত ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের স্বতন্ত্রতা কোথায় ?
● এই দীর্ঘ সময় জুড়ে শম্ভু মিত্র আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে পুরানো মনসামঙ্গলের কাহীন কে আশ্রয় করে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের মধ্য দিয়ে কোন দর্শনকে প্রকাশ করলেন শম্ভু মিত্র ?
মনসামঙ্গলের গল্পটিকে নাট্যকার আদ্যোপান্ত ব্যবহার করেননি এবং কাহিনির সমাপ্তির অংশের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। মনসামঙ্গল কাব্যে ছেদ টানা হয়েছিল মনসার পায়ের অবনত অনুতপ্ত চাঁদের সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বিদ্রোহী চাঁদ মনসাকে পূজো দেওয়ার পর দ্বিধাহীন আনন্দিত চিত্তে গ্রহণ করেছে ছয়পুত্র ও সপ্তডিঙা। এবং পরিশেষে মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দৈবী অনুগ্রহ ও তার মহিমা। কিন্তু শ্রী মিত্র সমকালের প্রেক্ষিতে নাটকের বিনির্মান ঘটিয়েছেন, তাই তাঁকে পরিবর্তন করতে হয়েছে নাটকের শেষাংশের মিলনাত্মক কাহিনি এবং সংযোজিত হয়েছে সর্বাপেক্ষা আলোড়ন জাগানো ঘটনা – বেহুলা ও লখিন্দরের যুগল আত্মহত্যা। এই পরিবর্তনই বুঝিয়ে দেয় নাট্যকার ভিন্ন পথে চলার প্রয়াসী।
কিন্তু এই ভিন্ন পথে চলে শম্ভু মিত্র পাঠককে কোথায় নিয়ে যান ? কোন ছবি উন্মোচন করতে চান দর্শকের সামনে ?
মনসামঙ্গলের সূত্রে জানি যে বাসররাতে লখিন্দরের মৃত্যু হলে বেহুলা স্বর্গে গিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এই ছবিকেই নাট্যকার স্থাপন করেছেন আধুনিক জীবনদৃষ্টিতে। স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য বেহুলাকে কামুক দেবতাদের কাছে নৃত্য পরিবেশন করতে হয়েছিল। জীবনানন্দের ভাষায় যা ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো’ , শম্ভু মিত্রের বেহুলার কাছে – ‘সে বড় অশ্লীল’। পরিস্থিতির চাপে সে নিজেই শিখে নিয়েছিল শরীর দেখানোর কৌশল। এরপর নারীতে কালিমালিপ্ত হয়ে সে বেঁচে থাকতে চায়নি। আবার বেহুলার নারীত্বের বিসর্জনে ফিরে পাওয়া প্রাণ নিয়ে লখিন্দরও বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায়নি। তাই আত্মিক সংকটের থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা এখানে বিকল্প পথ হয়ে এসেছে। মনোবিদ কার্ল মেনিঞ্জারের ভাষায় সেই আত্মসংকট হল – “man against himself”. কিন্তু মনসামঙ্গলের আখ্যানের বিনির্মানে এই আত্মিক সংকটের ছবিই কেন এঁকেছিলেন শম্ভু মিত্র ?
আসলে শম্ভু মিত্র বেহুলা – লখিন্দরের আত্মহননের সমকালীন যুগযন্ত্রণার বিষময় ফল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আগেই বলেছি ১৯৬৫ সালে এ নাটকের রচনা শুরু হলেও শেষ হয় প্রায় ১১ বছর পর। এই সময়ের ব্যবধানে সদ্য ক্ষমতার হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীনতায় ভারতবর্ষ বিশৃঙ্ঘল। আর পশ্চিমবাংলায় তখন চলছিল নকশাল আন্দোলন, যার বিস্তার ১৯৬৭ – ১৯৭২খ্রি:। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে ন্যায় ও ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চারু মজুমদার কানু সান্যালের নেতৃত্বে সেদিনে যুবসমাজ নির্দ্বিধায় আত্মবলিদানে এগিয়ে এসেছিল। শাসকদলের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা আর নকশালদের দমনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছিল সামাজিক ব্যাভিচার, নৈতিক অশুচিতা, যৌনলিপ্সা ও সন্ত্রাস। শম্ভু মিত্র সমাজের এই সংঘাত সংকটময় কুৎসিত রূপটিকেই অন্ধকারের তাৎপর্য হিসাবে নাটকে ব্যবহার করেছেন। এই যুগক্রান্তিকালের ফসল অস্তিত্বের সংকট, জীবনানন্দের ভাষায় যা বোধ, কিংবা মুদ্রাদোষ। এই বোধের তাড়নাতেই চাঁদ সদাগর মদ্যপানে নিজের সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত করে আর লখিন্দর বেছে নেয় আত্মহনন। এ আত্মহনন আসলে পলায়নপরতা নয়, এ আসলে প্রতিবাদ, দেশ কাল সমাজের নৈতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা সৃষ্ট অন্ধকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রত্যাখ্যান। নাটকে চম্পকনগরীর নাবিকেরা বলে – “আমাদের তরে ভাই চাকুরির গদি নাই।”
লখিন্দর বলে – “মানুষ কি শুধু কতগুল্যা প্রতিক্রিয়া ? শুধু প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি ?”
কিংবা – “রক্ত দেও, মুখ বুজে কাজ কর্যে যাও, কথা কয়ো নাকো।”
– এইসব কথার অনুষঙ্গে পুরাণকল্পনার ব্যপ্তি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে যায় সমকালীন রাজনৈতিক ভাবনা প্রতিষ্ঠায়। তাহলে কি সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থার বিপরীতে আদর্শবাদী বিদ্রোহের মাহাত্ম্যকীর্তন ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের উদ্দেশ্য ?
একদিকে বল্লভাচার্য ও বেণীমাধবের দল বিপরীতে ভৈরব করালীদের দল – উভয়েই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ক্ষমতায়ন প্রভৃতির দিক থেকে চম্পকনাগরীকে বিশ্লেষণ করতে চায় কিন্তু তার উন্নতির কথা ভাবে না, তাকে রক্ষা করতে চায় না। এই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট নাগরিকদের পারস্পরিক দলাদলি, স্বার্থপরতা এক অন্ধকার আবর্তকে ঘনিয়ে তুলছে। আর মনসামঙ্গল কাব্যের আত্মপ্রতিষ্ঠা পরায়ণ মনসাদেবী সেই অন্ধকারের অজ্ঞানতার প্রতীক। এই অন্ধকারময় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ সৎ মানুষের লড়াই – চাঁদ সদাগরের লড়াই। চাঁদ সদাগর তাই বলেছে – “শুধু বেঁচে থাকা বল্যে কোনো কথা নাইরে জীবনে” – সে বুঝেছিল আলোর তীব্রতা অন্ধকারের চেয়ে অনেক বেশি ; তাই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যেও পাড়ি দেবার কথা বলে, পাড়ি দেয়। যতদিন বাঁচবে প্রেতের মতো হলেও সে পাড়ি দেবে। এই ‘পাড়ি’ র মধ্যেই নিহিত আছে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের মূলসূত্র আর শম্ভু মিত্রের জীবন দর্শন।
এ পাড়ি চাঁদের একার পাড়ি নয়, চাঁদের অনুভবে সে একক ব্যক্তিত্বও নয়। সমগ্র চম্পক নগরী পাড়ি দেবে শিবের সন্ধানে। পাড়ি না দিয়ে উপায় নেই। যতদিন সভ্যতা বাঁচবে সত্যের কথা শিবের কথা সুন্দরের কথা তাকে ভাবতেই হবে। এটাই সত্যিকারের পূজা- অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করে সুউদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচা।
জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন –
“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-
এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ
এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল
প্রায় ততদূর ভালো মানবসমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব আজ নয় ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।”
এভাবেই পাড়ি দেওয়া অনবরত সত্যের সন্ধানের চলার মধ্য দিয়ে চাঁদ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। নাটকের শেষে অন্ধকার মঞ্চে চাঁদে ‘পাড়ি দেও পাড়ি দেও’ – এই আলোকিত ছবিটাই চাঁদের সর্বশেষ বাস্তব, এখানেই চাঁদের বৈপ্লবিক অভিযান সার্থকতা পায়, আর শম্ভু মিত্রের ভাবনা পায় স্বতন্ত্র্যতা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – চাঁদ বণিকের পালা : আধুনিক উপাখ্যান – সম্পাদনা : অপূর্ব রায়