সাজাহান নাটক –
ঐতিহাসিক ট্রাজেডি
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তীদের থেকে সরে এসে নতুন ধারা প্রবর্তন করেন, পাশ্চাত্য নাটক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে রোমান্সচর্চার পাশাপাশি বাস্তবতার দ্বারা সম্পৃক্ত করে স্বতন্ত্রতা দান করেছেন এবং বাংলা নাটকে এনেছেন নতুন তাৎপর্য।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে সর্বজনবিদিত হল নূরজাহান এবং সাজাহান। মোগল যুগকে অবলম্বন করে দ্বিজেন্দ্রলাল মোট পাঁচটি নাটক লিখেছিলেন – প্রতাপসিংহ, দূর্গাদাস, মেবারপতন, নূরজাহান এবং সাজাহান। এদের মধ্যে প্রথম তিনটিতে রাজপুত ইতিহাসে আদর্শবাদের প্রাধান্য এবং পরের দুটিতে মোগল পরিবারের জটিলতাকে রূপ দিয়েছেন। এবং পারিবারিক জটিলতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক নাটক ট্রাজেডির গভীরে প্রবেশ করেছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল ‘সাজাহান’ নাটকের কাহিনি আরম্ভ করেছেন ১৬৫৮ খ্রি: এর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে যে সমস্ত ঘটনা ও যুদ্ধবিগ্রহ ঘটেছে তার জীবন্ত চিত্র নাটকে পাওয়া যায়। এমনকি নাটকের শেষ দৃশ্যে সাজাহান যে ঔরঙ্গজেবকে ক্ষমা করেছেন – এ ঘটনাও অনৈতিহাসিক নয়। তবে, মহামায়া ও পিয়ারা কল্পিত চরিত্র হলেও ইতিহাস বিরোধী নয়, কেননা মহামায়া চরিত্রে রাজপুত রমণীসুলভ ব্যক্তিত্ব এবং পিয়ারা চরিত্রের উপস্থিতিতে সুজার নৃত্যগীতপ্রিয়তা প্রকাশ পেয়েছে।
এবার আসি, ‘সাজাহান’ নাটকে ট্রাজেডি চেতনা প্রসঙ্গে। মূলত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সাজাহান নাটকে শেক্সপীয়রীয় ট্রাজেডি অনুসরণ করেছেন। পঞ্চাঙ্ক বিভাজনে এবং চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব রূপায়ণে ট্রাজেডি সৃষ্টি করেছেন। এখন প্রশ্ন হল কোন চরিত্রকে কেন্দ্র করে ট্রাজেডি ঘনীভূত হয়েছে ‘সাজাহান’ নাটকে ? এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীলেখক নবকৃষ্ণ ঘোষ জানাচ্ছেন – ‘দারার মৃত্যুই সাজাহান নাটকের চরম ট্রাজেডি’। কেননা দারাই সিংহাসন ও জীবন দুইই হারালেন। তাঁর ভাগ্যবিপর্যয়েই নাটকের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ‘সাজাহান’ নাটকে দারার মৃত্যু হয়েছে চতুর্থ অঙ্কের শেষ দৃশ্যে, এবং তারপরেও ৬টি দৃশ্য সম্বলিত একটি অঙ্ক আছে যেখানে দারার মৃত্যুতে সাজাহানের চিত্তবিকার দেখানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের সঙ্গে ; সেখানেও মেঘনাদের মৃত্যুর পরেও কাহিনি এগিয়েছে এবং পরিশেষে রাবণের বিলাপে ট্রাজিক রসকে ঘনীভূত করেছে। সাজাহানের চিত্তবিকার, রাবণের বিলাপ শেক্সপীয়রের কিং লিয়ারের অর্ধোন্মাদ অবস্থার প্রভাবপুষ্ট।
এছাড়া, ‘সাজাহান’ নাটকের প্রথমদিকে যে সকল কার্যকলাপ, পুত্রদের প্রতি আচরণ, সিদ্ধান্তসহ অন্তর্জীবনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পরিণাম শেষ দৃশ্যে সুস্পষ্ট হয়েছে। তাই বলা যায় ‘সাজাহান’ নাটকের ট্রাজেডি সাজাহানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। পক্ষান্তরে দারার পরিণাম প্যাথেটিক। আবার, সুকুমার সেন জাহানারা চরিত্রের মধ্যে এবং অজিত ঘোষ ঔরঙ্গজেব চরিত্রের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ করে ট্রাজেডির কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসাবে মত পোষণ করলেও সাজাহান এর অসহায়চিত্তের বেদনাময় অভিব্যক্তি অধিক পরিস্ফুট হয়েছে। সন্তানদের প্রতি অপরিমেয় স্নেহ, প্রশ্রয় এবং ভুল সিদ্ধান্তই লিয়ারের মতো সাজাহানকে ট্রাজেডি করে তুলেছে।
দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক ট্রাজেডি নাটকগুলিতে যে বিষয়টি অন্যান্য নাটকদের থেকে স্বতন্ত্র করে তা হল জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের স্ফূরণ। ইতিহাসের তথ্য অনুসরণ করে ঐতিহাসিক পটভূমিতে দ্বিজেন্দ্রলাল ‘সাজাহান’ নাটকে দেশপ্রেম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত সূক্ষ নাটকীয় কৌশলে। নাটকের তৃতীয় অঙ্কে চারণ বালকদের গাওয়া ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ গানটি দেশপ্রেমের ইঙ্গিত বহন করে।
বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে হিন্দু মুসলমানের মৈত্রী ভাবনা যেমন রাজপুত – মোগল যৌথ কার্যকলাপে সূচিত হয়েছে তেমনি ‘সাজাহান’ নাটক জুড়ে নানা সংলাপেও প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, নাট্যকার ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে মুসলমান শক্তিকে এবং রাজপুত শক্তির মধ্য দিয়ে ভারতবাসীকে প্রকাশ করেছেন। নাটকে দিলদার বলছেন – “হিন্দুরা মুসলমানের অধীনে এক রকম সুখে আছে বলতে হবে”, কিংবা যশোবন্ত সিংহের আক্ষেপ – “হিন্দুর সাম্রাজ্য কবির স্বপ্ন। হিন্দুর প্রাণ বড়ই শুষ্ক, বড়ই হিম হয়ে গিয়েছে। আর পরস্পর জোড়া লাগে না।” – এ উচ্চারণ আসলে পরাধীন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ পদাশ্রিত মানুষগুলোর প্রতি। এ প্রসঙ্গে তোমরা লক্ষ্য করো ‘ধর্ম’ শব্দটি ধর্ম্ম রূপে ব্যবহৃত , এই ধর্ম্ম হিন্দু বা মুসলমান ধর্ম নয়, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল এখানে ধর্ম্ম অর্থে ক্ষাত্রধর্ম্ম বা মানবধর্ম্মকে বুঝিয়েছেন। দারার সংলাপে তার পরিচয় পাই – “আমি জানি পৃথিবীতে ধর্ম্ম এখন স্বার্থসিদ্ধি, নীতি শাঠ্য পূজা খোসামোদ কর্তব্য জোচ্চরি।” কিংবা পরাধীন ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে ‘সাজাহান’ নাটকে এমন সংলাপও এনেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল –
১. এ রাজ্যের প্রজার কাছে প্রাণের চেয়ে মান বড়।
২. একটা কামানের চেয়েও একটা রাজপুত ভয়ঙ্কর।
এখানে রাজপুত অর্থে ভারতবাসীকে বুঝিয়েছেন নাট্যকার।
আসলে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর স্বাদেশিক চিন্তার সুর সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে সার্বজনীন দয়া, মৈত্রী ও শুভেচ্ছার পরিমন্ডলে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বাদেশিক ভাবনা সংরক্ষণ ও সংগঠন চেতনার মিশ্রণে সম্পৃক্ত। জাতিকে মহাজাতিতে পরিণত করার সাধনাই দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশপ্রেম সাধনার শ্রেষ্ঠ রচনা, আর এখানেই তিনি অনন্য।
ঋণ স্বীকার : দ্বিজেন্দ্রলাল – কবি ও নাট্যকার – রথীন্দ্রনাথ রায়