লকডাউনের অভিজ্ঞতা/ডায়েরী

ভূমিকা –
অন‍্যান‍্য বছরগুলোর মত বিগত ২০২০ র শুরুটাও বড়দিনের উৎসব, নতুন ক্লাস, ব‌ই আর সরস্বতী পূজোর মতো আনন্দের আমেজ নিয়ে শুরু হলেও তাতে বাধ সেধেছিল করোনা ভাইরাস। অতিমারীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা। অতিমারীর আগ্রাসন ঠেকাতে প্রশাসন ঘোষণা করল ‘লকডাউন’। দীর্ঘকালীন লকডাউন প্রথম অভিজ্ঞতা হিসাবে ভালো লাগলেও পরে অনিশ্চয়তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে যায়।

লকডাউন কী ও কেন ?
কোনো জরুরীকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন‍্য অথবা কোনো সংকটের হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন‍্য সাময়িকভাবে কর্মবিরতির গৃহীত কর্মসূচীকে লকডাউন বলা হয়। দেশে বিদেশে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক থেকে সাপ্তাহিক কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিলেও বিশ্বব‍্যাপী এই দীর্ঘকালীন লকডাউনের সিদ্ধান্ত এই প্রথম।

সম্প্রতি বিশ্বে অতিমারী করোনা ভাইরাসের বিশেষ প্রজাতি কোভিড-১৯ ঘরবন্দি করেছে বর্তমান প্রজন্মকে। বিজ্ঞানীদের অনুমান যে এই RNA ভাইরাসটি মানুষের থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে, সুতরাং পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাই হল করোনা ভাইরাসের একমাত্র আপদকালীন প্রতিষেধক। কিন্তু সাতশো কোটির পৃথিবীতে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা যেন সোনার পাথর বাটি। সুতরাং দীর্ঘকালীন লকডাউন‌ই একমাত্র ভরসা বলে মনে করছেন বিজ্ঞানী থেকে প্রশাসনিক মহল। আর তার জেরেই ভারতবর্ষ সহ প্রায় সমগ্র বিশ্বে দফায় দফায় টানা সাত-আটমাস লকডাউন চলেছে।

আমার অভিজ্ঞতা –
আমার জীবনে এত দীর্ঘ ছুটি কখনো পাইনি। স্কুল টিউশন সব বন্ধ ছিল। একি অবস্থা পরিবারের অন‍্য সদস‍্যদের‌ও। তাই প্রথম প্রথম একসঙ্গে সময় কাটানো বিভিন্ন রান্ন বান্নায় মাকে সাহায‍্য ইত‍্যাদি করলেও বাইরের গাছপালা, রাস্তাঘাট দেখতে না পেয়ে অস্থিরতা য় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতাম। তার‌পর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার কাজ করত টিভির খবরে অহরহ দুমদাম সংক্রমণ বৃদ্ধি ও মৃত‍্যুর খবর।

অস্থিরতা কাটাতে কখনো টিভিতে সিনেমা, দাদুর সঙ্গে দাবা, বাবার সঙ্গে বিকেলে বাগানের কাজকর্ম করতাম। আর নিস্তব্ধ দুপুরগুলোতে সঙ্গী হত অপু, ফেলুদা, কাকাবাবু, মিতিনমাসিরা। কিন্তু নিজের এলাকাই কন্টেনমেন্ট জোন হিসাবে যখন চিহ্নিত হল তখন প্রায় সকলের চোখেই আতঙ্কের ছায়া নেমে এল।

অপেক্ষার অবসান –
নানারকম হতাশা, অশান্তির মধ‍্যেও মনে মনে আশা রাখতাম – “একদিন ঝড় থেমে যাবে / পৃথিবী আবার শান্ত হবে।” সেই আশা নিয়েই আগস্ট মাস নাগাদ শুরু হল পুরানো গতিতে ফিরে যাবার প্রয়াস, তবে অবশ‍্য‌ই নতুন ছন্দে- মাস্ক, স‍্যানিটাজার সঙ্গে নিয়ে। কোয়ারেন্টাইন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন থেকে সরে চেনা জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়ে গেল সকলের। আর আমাদের জন‍্য স্কুলের চেনা করিডোর, খোলা মাঠ না হলেও প্রাইভেট টিউশনের পরিচিত পরিবেশটা বরাদ্দ হয়েছিল। তাই আমিও সমস্ত হতাশা সরিয়ে নতুনভাবে পুরোদমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

দীর্ঘকালীন লকডাউনের পরবর্তী প্রভাব
মানুষের দীর্ঘকালীন গৃহবন্দিত্ব পরিবেশের সজীবতা ফিরিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। যানবাহনের ধূলো ধোঁয়ার অনুপস্থিতি দূষণের পারদ‌ও নামিয়ে দিয়েছে বেশ খানিকটা। লকডাউন চলাকালীন‌ই প্রকাশ‍্য রাস্তায় ময়ূর থেকে উটপাখির বিচরণ কিংবা সকালের সূর্যস্নাত পাহাড়ের উঁকি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকের পাতায়।

তবে, দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন দূষণের পারদের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির পারদ‌ও নামিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। করোনা নয়, অনাহারের হাত থেকে বেঁচে থাকাই এখন বড় চ‍্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্মহীন সাধারণ মানুষের কাছে। চাকরি হারিয়ে অনিশ্চিত জীবন থেকে বাঁচতে অনেকেই আত্মহত‍্যার পথে হেঁটেছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের‌ জন্মভূমিতে ফিরে এসে কপালে আর পেটে ভাঁজ পড়েছে। অনিশ্চয়তার মুখে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভবিষ‍্যৎ সব‌ই।
তবু, এই ‘নিউ নর্ম‍্যাল’ জীবনকে গ্রহণ করার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে মানুষের মধ‍্যে।

উপসংহার –
বিগত তিন চারমাসের দীর্ঘস্থায়ী লকডাউন আবারো বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে মানুষ নেহাত‌ই শিশু। কাজেই কোনোকিছুর সমাধান করতে গেলে সমস‍্যার মূলে পৌঁছাতে হবে, প্রকৃতিকে অবমাননা করে বাঁচা সম্ভব নয়। সমস‍্যা, পরিস্থিতিই মানুষকে অভিজ্ঞ করে। দীর্ঘকালীন লকডাউনের অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে সেই শিক্ষক।

মাসিক সাপ্তাহিক লকডাউন, আনলক ১,২,৩ এর মধ‍্য দিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। তবে আমাদের স্কুল খোলার দিন এখন‌ও অনিশ্চিত।