মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক কে – মেঘনাদ না রাবণ ?
সংস্কৃতশাস্ত্র অনুসরণ করে বলা যায় – নায়কের দ্রুত ইতি ঘটে না, আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত নায়ক চরিত্রের বিচরণ থাকবে – সমগ্র রচনায় নায়ক উপস্থিত থেকে অপরাপর চরিত্র ও ঘটনা পরম্পরাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। এবং নায়কের মধ্য দিয়েই লেখক তার জীবন দীক্ষা প্রকাশ করবেন। তবে, এই ধারণার অর্থাৎ নায়ক চরিত্র নির্মাণের বিবর্তন ঘটেছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ রচনা করেছিলেন নবজাগরণের পটভূমিতে, দক্ষিণ ভারতের কম্বনের রামায়ণের প্রভাবে বাল্মীকি রচিত রামায়ণের বিনির্মাণ ঘটিয়েছিলেন। অধুনিক খন্ডিত যুগে ঔপনিবেশিকতার কালে মাইকেল ভিন্ন বীক্ষাকে নির্মাণ করেছিলেন রাবণ-মেঘনাদ চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তবে, কাব্যে নামকরণ ও কাহিনিকে কেন্দ্র করে নায়কত্বের আসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দন্ডায়মান – পিতা – পুত্র; রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ। কিন্তু পিতা ও পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের লেশমাত্র নেই ; তাদের সম্পর্ক আধার ও আধেয়ের সম্পর্ক। জনৈক সমালোচকের কথায় –
“ইন্দ্রজিৎ যদি নায়ক হন তবে রাবণের আশ্রয় তাঁহার পক্ষে অপরিহার্য, আর রাবণ যদি নায়ক হন তবে তাঁহাকেও প্রধান ঐশ্বর্যরূপ ইন্দ্রজিতের গর্বকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই।”
প্রথমে দেখি, মেঘনাদকে নায়ক বলার পক্ষে কী কী যুক্তি থাকতে পারে – ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র মুখ্য ঘটনা মেঘনাদের শৌর্য বীর্য এবং তাঁর পতনকে কেন্দ্র করে চিত্রিত হয়েছে। আলংকারিক সূত্র অনুসারে যে সকল গুণ নায়কের থাকা দরকার, সে সমস্তই মেঘনাদ চরিত্রে বিদ্যমান। সর্বপ্রকার সজাগ অনুভূতি সুষমতা, কর্তব্যের ঔচিত্য, আচরণের সৌষ্ঠব, পবিত্র গার্হস্থ্য জীবনের বিচিত্র আদর্শের সামঞ্জস্য ও সর্বোপরি এক মহান বীরত্ব তাঁকে যে কেবল পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের অধিকারী করেছে তা নয় – মেঘনাদ এই কাব্যে এই লোকোত্তর মহিমায় মহিমান্বিত পুরুষে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তাছাড়া মেঘনাদ মধুসূদনের মানসপুরুষ ; মধুসূদনের অতৃপ্ত ব্যক্তিমানস এই চরিত্রাঙ্কনের সাধনায় তৃপ্তিলাভ করেছে। যে পূর্ণাঙ্গ সাফল্যমন্ডিত গৌরবময় জীবন কবির নিজের ভাগ্যে জোটেনি ইন্দ্রজিতের মধ্যে তাই ই কবি অঙ্কিত করেছেন। ইন্দ্রজিৎ চরিত্র সম্বন্ধে মধুসূদন বলেছেন –
“He (the glorious son of Ravana) was a noble fellow, and but for the scoundrel Bibhisan would have kicked the Monkey army into the sea.”
রাবণের পুত্র মধুসূদনের কাছে কেবল ‘ইন্দ্রজিৎ’ নয়, ‘my favourite Indrajit’ , তাঁর কল্পলোকের বধ কাহিনি রচনার কথা অপরকে জানাবার সময় কবির উৎসাহ, মানসিক উত্তেজনা ও বিরাট আয়োজনের ইঙ্গিত সেই কথাতেই নিঃশেষ হয়ে যায় –
“I am going to celebrate the death of my favourite Indrajit.”
কিন্তু নায়কত্বের বিচারে বলা যায়, মেঘনাদবধ কাব্যের শ্রেষ্ঠ চরিত্র মেঘনাদ হলেও রাবণই তার মূল আশ্রয়। নয় সর্গে বিস্তৃত কাব্যের মাত্র তিনটি সর্গে মেঘনাদ স্থান পেয়েছে। অল্প কাল পরিসরে তার উপস্থিতি বর্ণময় হলেও সমগ্র কাব্য কাহিনি অন্যান্য চরিত্র তার দ্বারা পুষ্ট লাভ করতে পারেনি।
উপরোক্ত আলোচনার অনুসরণে দেখা যায়, মেঘনাদ মধুসূদনের আদর্শ হতে পারে কিন্তু কবির প্রকৃত স্বরূপ মেঘনাদ নয় রাবণ। রাবণের পৌরুষ ও শক্তি লীলা, রাবণের অনন্ত সম্ভাবনাময় জীবন এবং নিয়তির নির্যাতনে এই শক্তি সম্ভাবনার শোচনীয় পরিণামের মধ্যে কবি যেন আপন জীবনের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলেন। আত্মসচেতন কবি নিজের অনন্ত সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন, বন্ধুদের কাছে কি হবেন, কি করবেন তার আভাস দিয়েছিলেন কিন্তু বহিঃশত্রুর নিষ্ঠুর প্রতিকূলতায় তাঁকে ব্যর্থতার অভিশাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে। কবির আশাভঙ্গের ট্রাজেডি যেন রাবণ তার বক্ষে ধারণ করেছেন। তাই কবির দৃষ্টিতে রাবণ –
“was a grand fellow”, এবং “the idea of Ravana elevates and kindness my imagination.” – এখানেই দেখা যায় মেঘনাদ বধ কাব্যের রাবণ হল পরিকল্পনার মূল উৎস।
মেঘনাদ বধ কাব্যে প্রথম থেকে শেষ সর্গ পর্যন্ত রাবণের সর্বব্যাপী হাহাকার – এ দিক থেকে বলা যায় রাবণ এই কাব্যের মূল লক্ষ্য ছিল বলেই কাব্যটি এত বিস্তৃতি লাভ করেছে। মেঘনাদের মৃত্যুর পরও আরো তিনটি সর্গ রচিত হয়েছে, উনিশ শতকের রোমান্টিক কবি এখানে রাবণের ভাগ্যের চূড়ান্ত পরাজয়কে নিকটতর করেছে।
ট্রাজেডির নায়ক সেই চরিত্রকে বোঝানো হয় যার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে, ভালো মন্দ মিশ্রিত হবে এবং যার doing ans suffering তার পরিণতিকে ত্বরান্বিত করবে। বস্তুত এ কাব্যে রাবণই তার কৃতকার্যের জন্য দায়ী, সীতাকে হরণ করে সে জগতের বৃহত্তর নীতিবোধকে বিচলিত করেছে ফলে তার ওপর শাস্তির খড়্গাহাত পড়েছে। কিন্তু রাবণ, বীরবাহু, কুম্ভকর্ণ, মেঘনাদ – এদের মৃত্যুর জন্য অদৃষ্ট নিয়তিকেই দায়ী করেছেন। অথচ শেক্সপীয়রীয় ট্রাজেডির মতো তার পতনের কারণ তার চরিত্রের মধ্যে নিহিত আছে –
“…হায়, নাথ, নিজ কর্মফলে
মজালে রাক্ষসকূল, মজিলা আপনি।”
বস্তুত কাব্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাবণ যে জ্বালা অনুভব করেছে তা পরাজয় বা অনুশোচনার জ্বালা নয়, তা আত্মীয় বিয়োগের জ্বালা। ভক্ত, ভৃত্য, পতিকূল গরবিনী গৃহবধূ, ভক্তিমান ও বীর্যবান আদর্শ পুত্র এবং সমদুঃখভাগিনী আদর্শ স্ত্রী – এরা সকলেই রাবণের জীবনে মুকুটের রশ্মিছটা আর পুত্র মেঘনাদ সেই মুকুটের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তাই মেঘনাদের মৃত্যুর পরও কিছু বাকি থেকে যায়, বাকি থেকে যায় রাবণের বিলাপপূর্ণ স্বগতোক্তি –
“ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে –
সঁপি রাজ্যভার, পুত্র, তোমায়, করিব
মহাযাত্রা…”
যে কাব্যের শুরু শোকার্ত রাবণের হাহাকারে, সেই কাব্যের শেষও তার বিলাপে। তাই নির্দোষ অতিমানবতুল্য মেঘনাদ নয়, দোষগুণে পরিপূর্ণ মানুষ রাবণই কবির প্রধান লক্ষ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাবণ চরিত্র যদি তার মানস চরিত্র তবে তার চরিত্রের প্রতি তিনি উদাসীন কেন ? কাব্যের পদে পদে দেখা যায়, রাম-সীতার লোকশ্রুত মহিমায় কবি অভিভূত এবং রাবণের দুশ্চরিত্রতার ধারণাও তাঁর মনে বদ্ধমূল। রাবণ যে সীতাকে হরণ করলেন তারপর তাকে কেবল অশোকবনে রেখেই দিলেন, না তাকে বলপূর্বক সম্ভোগ করলেন না আধুনিক অর্থে ভালোবাসলেন। অথচ এই সীতাহরণই তার লঙ্কারাজ্য ধ্বংসের এবং প্রিয় বিচ্ছেদের মূল। এ থেকে মনে হয় যেন রামের হাতে মৃত্যুতেই তার মোক্ষ। পৌনঃপুনিক দীর্ঘশ্বাস এবং অশ্রুমোচনের ফাঁকে তিনি আস্ফালন করেন বটে, কিন্তু মুখ দিয়ে প্রকৃত শক্তি মত্ততার প্রকাশ দেখা যায় না। আবার প্রতিপক্ষের দূর্বলতা নিয়েও মাইকেল সরব হননি – শূর্পনখার প্রতি লক্ষণের আচরণ যে অপৌরুষের, বলীবধ যে ধিক্কারযোগ্য, রামচন্দ্র যে কূটনীতিজ্ঞ হয়েই রাবণকে হারাতে পারলেন, ‘ভিখারী রাঘবের’ বিরুদ্ধে এতগুলি অস্ত্র পেয়েও মাইকেল ব্যবহার করেননি; এমনকি মেঘনাদের হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুর অন্যায়টাকেও অনায়াসে আমাদের মন থেকে মুছে দিলেন স্বর্গের সমস্ত দেবতাদের রামানুরাগ প্রকাশ করে। মিল্টন সম্বন্ধে একটা কথা আছে যে মনে মনে তিনি শয়তানেরই সপক্ষ ছিলেন, অনুমিত হয় সেজন্যই মাইকেল বুঝি স্থির করেছিলেন যে রাবণের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ তাঁর কর্তব্য। এ থেকে বলা যায়, সজ্ঞানে রাবণ ও ইন্দ্রজিতের মধ্যে নায়কোচিত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, নির্জ্ঞানে রামই তাঁর সমগ্র কল্পনাকে অধিকার করে তাঁর কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করেছে। তবে এটাও উল্লেখ্য, রামচরিত্রের মধ্যে বীরত্ব, অন্যান্য চরিত্রকে সম্পৃক্ত করার ক্ষমতাও পরিস্ফুট হয়নি।
আসলে এই নায়ক দ্বন্দ্বের স্বরূপ নিহিত আছে মধুসূদনের কবি প্রকৃতির দ্বন্দ্বের মধ্যে। মধুসূদনের আদর্শ ক্লাসিক কাব্যের ছিল বলে মেঘনাদ তাঁর কাব্যের আদি প্রেরণা স্বরূপ। আবার, দেশজ সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে তিনি এড়াতে পারেননি তাই রামের প্রতি কোনোরকম বিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা প্রকাশ তাঁর পক্ষে সহজ সম্ভব হয়নি। আবার যুগের প্রেরণা অজ্ঞাতেই তাঁর মনে গভীরতর সংস্কারের আকাশে প্রবেশ করেছিল। উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির সংকটময় মুহূর্তে বহিরাগত আর্যসংস্কৃতির ধারক রাম-লক্ষণের দূর্বলতা, কূটনীতির বিপরীতে ভারতের নিজস্ব অনার্য সংস্কৃতির ধারক রাবণকে দাঁড় করিয়ে রাবণের ব্যর্থতা বিচার করেছেন। তাই সীতাহরণ যে রাবণের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল তা রাবণ অস্বীকার করেননি ঠিকই কিন্তু তিনি সীতাহরণ করেছিলেন নিজের উপভোগের জন্য নয়, সূর্পনখার দুঃখে দুঃখী হয়ে –
“হায় সূর্পনখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী
কাল পঞ্চবটী বনে কালকূট ভরা
এ ভূজগে ?”
এবং রাবণ সমস্ত কাব্য জুড়ে শুধু একটি প্রশ্নে জর্জরিত –
“কি পাপে লিখিলা
এ পীড়া দারুণ বিধি রাবণের ভালে?”
মধুসূদনের মতে, সীতাহরণের সঙ্গে রাবণের সর্বনাশের কোনো যোগাযোগ নেই, বাল্মীকির রামায়ণের বিরুদ্ধাচারণ মাত্র। আর রাবণের দীপ্ত পৌরুষের পতনের কারণ যদি নিয়তি হয়ে থাকে তবে নিয়তির বিধান নিষ্ঠুর হলেও কাব্যে তা যথাযথ প্রতিপাদন করতেন। আসলে, ব্যর্থতাবোধ জাত আর্তনাদ নিয়তি চেতনার দ্বারা উদ্ভুত হয়নি, উদ্ভুত হয়েছে বাঙালির জীবনের ব্যর্থতা থেকে। জাতির জীবনসত্য ব্যক্তিজীবনের রসে জর্জরিত হয়ে কাব্যটির মর্মে নিহিত আছে। পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল বুর্জোয়া জীবনবেদ পরাধীন, অর্থনীতিতে অনগ্রসর, তখনও যন্ত্রশিল্পে প্রবেশাধিকারবিহীন বাঙালির জীবনে সত্য হয়ে উঠতে পারেনি। আদর্শে আর বাস্তবে, কল্পনায় আর কৃতিতে এই বিরোধই শুধু নয়, শেষ পর্যন্ত আদর্শের সম্পূর্ণ পরাজয় এবং বাঙালির কেরাণীত্ববরণ, তার সকল আশার ভষ্মীভবনই রাবণের জীবনে রূপায়িত। তাই উনিশ শতকে লেখা ‘মেঘনাদবধকাব্যে’র নায়ক রাবণ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
১) মধুসূদনের কবি আত্মা ও কাব্য শিল্প – ক্ষেত্রগুপ্ত
২) সাহিত্যচর্চা – বুদ্ধদেব বসু