মেঘনাদ বধ কাব্যের নারী চরিত্র : চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরী
উনিশ শতক নবজাগরণের কাল ; মধ্যযুগীয় ভক্তিবাদকে অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যে যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রকাশ। এই নবজাগরণের চেতনা তখনকার নারীদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল। যে নারী একসময় ছিল পুরুষের ভোগের সামগ্রী, উনিশ শতকের এই রেনেসাঁসের কালেই রামমোহন-বিদ্যাসাগরের হাত ধরে সেই নারীরা নারী জাগরণের বাতাসে আন্দোলিত হল। কেবল অন্দরে নয় সদরেও তার গতিবিধি প্রকাশ পেল, লেখকের কলমে নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানবতাবাদ, মনুষ্যত্ববোধ তথা নতুন চিন্তাধারা প্রকাশ পেতে শুরু করল। এমনই এক সময়ে যুগন্ধর কবি মধুসূদন তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে ‘পুরাণ’ কাহিনির পুনর্বয়নে নারীর চরিত্রগুলিকে নবরূপে সজ্জিত করলেন। কাব্যের কেবল প্রমীলা ও সীতা নয়, সরমা, মন্দোদরী, চিত্রাঙ্গদা – প্রত্যেকেই বহন করে কবির চরিত্র পরিকল্পনায় মৌলিকতা ও নৈপুণ্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। নবজাগরণের কালে নারী চরিত্রগুলি নবজাগরণের প্রতীক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আলোচ্য নারী চরিত্রদ্বয় চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরী – উভয়েই রাবণের মহিষী, বীর পুত্রের জননী এবং পুত্রবিয়োগে কাতর। তা সত্ত্বেও মধুসূদন চরিত্র দুটিকে বিপরীত বিন্দুতে স্থান দিয়েছেন।
■ চিত্রাঙ্গদা চরিত্র –
চিত্রাঙ্গদা মধুসূদনের অভিনব সৃষ্টি, বাল্মীকির রামায়ণে চিত্রাঙ্গদার উল্লেখ নেই, কৃত্তিবাসী রামায়ণে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। মধুসূদনের কাব্যে চিত্রাঙ্গদা আপন স্বাতন্ত্র্যে সুস্পষ্ট এবং তার চরিত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।
কাব্যের প্রারম্ভে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদে লঙ্কাধিপতি রাবণ যখন শোকে মুহ্যমান তখন রাজসভায় চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ। এবং চিত্রাঙ্গদার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে রাজসভাগৃহে তার প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে –
“চমকিলা লঙ্কাপতি কনক আসনে।”
অথচ চিত্রাঙ্গদার মুখে তখনও কোনও কথা শোনা যায় নি। তাঁর নীরব শোকাপ্লুত উপস্থিতিই রাবণ এবং তাঁর রাজসভাকে স্তম্ভিত করার পক্ষে যথেষ্ট।
চিত্রাঙ্গদার শান্ত আবেদন –
“একটি রতন মোরে দিয়েছিল বিধি/কৃপাময়”
এর উত্তরে রাবণ আত্মপক্ষ সমর্থনে গভীর প্রত্যয়ের সুরে আবৃত্তি করেন –
১) “এ বৃথা গঞ্জনা, প্রিয়ে, কেন দেহ মোরে”
২) “এক পুত্র শোকে তুমি আকুলা, ললনে
শত পুত্র শোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবানিশি!”
এবং বীরত্ব ও দেশপ্রেমের আদর্শলোক থেকে দু’চার সান্ত্বনা বাক্য দিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে নীরব করতে চাইলে সে প্রচেষ্টা মর্মান্তিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেছেন –
“সন্তানকে স্বদেশের কল্যাণের জন্য ধর্মযুদ্ধে
নিহত হইতে দেখিলে বীর জননীর প্রাণে সান্ত্বনা আসিতে পারে সত্য, কিন্তু অপরের পাপ-তৃষারূপ অগ্নিতে হৃদয়ের ধনকে আহুতিরূপে অর্পিত হইতে দেখিলে বীর জননীর প্রাণে যে যন্ত্রণা হয়, তাহা কে বুঝিবে ?”
তাই ‘বীরকর্ম্মে হতপুত্র’ – রাবণের এই উক্তির ভন্ডামি চিত্রাঙ্গদার পক্ষে অসহ্য। জ্বালাময় বাক্যস্রোতে তিনি প্রমাণ করতে চান যে লঙ্কার কালসমরের একমাত্র কারণ রাবণের পাপবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তাঁর জিজ্ঞাসা –
১) “কিসের কারণে,
কোন লোভে, কহ রাজা, এসেছে এ দেশে রাঘব ?”
২) “কে কহ এ কাল অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে?”
আসলে চিত্রাঙ্গদা রাবণের একাধিক মহিষীর একজন এবং চিত্রাঙ্গদার যে ছবি চিত্রিত হয়েছে তাতে তিনি বিগতযৌবনা নয়, ফলে রাবণের সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধানও অল্প নয়। অসমবয়সী যুবতী চিত্রাঙ্গদা রাবণের সঙ্গ পাননি এবং তাঁর অতৃপ্ত আবেগানুভূতি তৃপ্ত করতে চেয়েছেন একটি মাত্র সন্তানকে অবলম্বন করে। তাঁর নারীত্ব ধূলায় অবলুন্ঠিত হলেও মাতৃত্ব চরিতার্থ হয়েছে বীরবাহুকে কেন্দ্র করে। তাই আজ যখন তাঁর বিক্ষুব্ধ জীবনের সেই অবলম্বন করে। তাঁর নারীত্ব ধূলায় অবলুন্ঠিত হলেও মাতৃত্ব চরিতার্থ হয়েছে বীরবাহুকে কেন্দ্র করে। তাই আজ যখন তাঁর জীবনের সেই অবলম্বনটুকু খসে যায় তখন বাঁধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় পুত্রশোকের মধ্য দিয়ে সেই চিরসঞ্চিত ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ চিত্রাঙ্গদা স্বল্পপরিসরে অঙ্কিত হলেও তার মধ্য দিয়ে নবযুগের নারীত্ব বিদ্রোহিনী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্দর থেকে সদরে তাঁর অনায়াস প্রবেশ, সহজ যুক্তির ভিত্তিতে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা, বুদ্ধির আধারে জীবনকে দেখার মানসিকতা – চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি আপন বৈশিষ্ঠ্যে সমুজ্জ্বল। রাবণ যখন তাঁর পরাজয় সম্পর্কে সচেতন, এবং এর জন্য বিধি অদৃষ্টকে দোষ দিচ্ছেন তখন চিত্রাঙ্গদার সহজ সচেতন প্রতিবাদ –
“হায়, নাথ, নিজ কর্ম্মফলে,
মজালে রাক্ষসকূল, মজিলা আপনি।”
তেজস্বিতা আছে বলে যে নারী চরিত্রের কোমলতার সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়েছে তা নয়, আছে শোকের পর্যাপ্ত দীনতা, নারীহৃদয়ের অসীম আকুলতা, স্বামীর প্রতি আনুগত্য অথচ অন্যায় অধর্মের প্রতিবাদেও কোনো দূর্বলতা প্রশ্রয় পায়নি। কুসুমকোমল নারী সত্তার মধ্যে নিহিত আছে বজ্র কঠোরতা। এই আপাত বিরোধী বিচিত্র শক্তি ও প্রবণতার সমাবেশে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি হয়ে উঠেছে অনুপম, অনন্য এবং অনবদ্য।
■ মন্দোদরী চরিত্র –
লঙ্কার অন্ত:পুরে অপর যে নারী চরিত্রটি একেবারে চিত্রাঙ্গদার পাশাপাশি পাওয়া যায়, তিনি – মন্দোদরী। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সূচনায় চিত্রাঙ্গদা যেমন নবযুগের নবজাগ্রত নারীত্বসহ বিদ্রোহিনী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে উল্কার মতো আলোকচ্ছটায় পাঠককে ঝলসিত করে, কাব্যের প্রায় সমাপ্তিতে মন্দোদরী তেমনি ধ্রুবতারকার মতো পাঠকহৃদয়কে তার স্নিগ্ধ অনির্বাণ জ্যোতিতে মুগ্ধ করে।
মন্দোদরী লঙ্কাধিপতি রাবণের প্রধানা মহিষী, বীর পুত্র মেঘনাদের জননী এবং বীরাঙ্গনা প্রমীলা তার পুত্রবধূ। এক সম্পূর্ণ জীবনের আধার মন্দোদরী –
“শরদিন্দু পুত্র; বধূ শারদ-কৌমুদী
তারা কিরীটিনী নিশি সদৃশী আপনি
রাক্ষস কূল ঈশ্বরী! অশ্রুবারি ধারা
শিশির কপোল পর্ণে পড়িয়া শোভিল।”
ধৃতিরূপিনী এই নারী কেবল লঙ্কেশ্বরী নন, লঙ্কার জননী তিনি। তাই বিভীষণ সম্বন্ধে বলেন – “এ কনক লঙ্কা মোর মজালে দুর্ম্মতি”
– ‘মোর’ উচ্চারণে প্রকাশ পায় সমগ্র লঙ্কার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ শুধু কর্তৃত্বের নয়, অপরিসীম মমত্বের।
প্রিয়তম পুত্র মেঘনাদ কাল সমরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, আশঙ্কায় মন্দোদরীর অন্তর উৎকন্ঠিত, নিয়ত পুত্রের কল্যাণ কামনায় শিবের আরাধনায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন। খাঁটি বাঙালি মায়ের মত ব্রত, উপবাস প্রার্থনাদি দ্বারা সেই বিপদ কাটাবার জন্য আত্মনিগ্রহের কঠিন পথ অবলম্বন করেছেন। আবার মেঘনাদের বিদায়কালে বলেছেন –
“যাইবি রে যদি –
রাক্ষসকূল রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
রক্ষণ এ কাল রণে! এই ভিক্ষা করি
তাঁর পদযুগে আমি।” (৫ম সর্গ)
মাতৃচরিত্রের এই সমুন্নতি সাধন মাইকেলের প্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। যুদ্ধযাত্রাকালে প্রমীলাকে নিজের কাছে রেখে দেবার মধ্য দিয়ে যৌথ পরিবারের মাধুর্য, শাশুড়ি বৌমার সম্পর্কের নিবিড়তা প্রকাশ পেয়েছে।
বীরপুত্রের মৃত্যুতে বীর জননীর শোক প্রকাশ পেয়েছে ভিন্নভাবে। মন্দোদরী অন্দরে অধিষ্ঠিত, রাবণ সদর থেকে অন্দরে আসছেন, নীরবতার মধ্য দিয়ে পুত্র বিয়োগের কাতরতা প্রকাশ, স্বামীর পদপ্রান্তে পতিত হয়ে যাবতীয় ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী করছেন। দেবারাধনায়, আশঙ্কাতুর হৃদয় উদ্ঘাটনে অথবা নির্বাক আর্তিতে মন্দোদরী মাতৃত্বের পূর্ণমূর্তি এবং তা রাজকীয় গাম্ভীর্যে উদঘাটিত।
মন্দোদরী ও চিত্রাঙ্গদা উভয়েই পুত্রবিয়োগে কাতর হলেও উভয়ের অবস্থানগত ভিন্নতায় উভয়ের শোকের প্রকাশ ভিন্নরূপ। চিত্রাঙ্গদা খন্ডিত জীবনের প্রতিনিধি, যার জীবনে চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার ব্যবধান দুস্তর, অতৃপ্তিবোধে আক্রান্ত, তাই তাঁর শোক সরব, তিনি শোকে বিদ্রোহিনী, স্বামীর পাপাচরণে বিচলিত, তাঁর কাছে রাবণ অভিযুক্ত। অপরদিকে, মন্দোদরী সম্পূর্ণ জীবনের প্রতিনিধি, স্বামী পুত্র পুত্রবধূ নিয়ছ তৃপ্তিময় জীবন, যার জীবনের আর কিছু চাওয়ার নেই, তাই তাঁর শোক নীরব, স্বামীর কাছে সান্ত্বনাপ্রার্থী, চরম দুঃখ স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াতে তাঁর জীবনের সার্থকতা।
চিত্রাঙ্গদা নবযুগের বিদ্রোহিনী ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্যবাদী নারী অপরদিকে মন্দোদরীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে চিরকালীন মাতৃরূপ কল্যাণবোধে যা প্রকাশিত। মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ উনিশ শতককে উপস্থাপিত করেছেন যেখানে চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরীকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে উনিশ শতকের বিরুদ্ধ অবস্থাকে প্রকট করেছেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
মধুসূদনের কবি আত্মা ও কাব্য শিল্প – ক্ষেত্র গুপ্ত