চতুরঙ্গ উপন্যাস – নতুন পর্যায়ের সূচনা
‘চোখের বালি’ থেকে ‘গোরা’ – রবীন্দ্র উপন্যাসের একটি পর্যায়। ‘গোরা’ প্রকাশের ছয় বছর পরে ‘চতুরঙ্গ’ থেকে রবীন্দ্র উপন্যাসের নতুন পর্যায়ের সূচনা হয়েছে। তাই আঙ্গিকগত দিক থেকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের একটা আলাদা স্থান আছেই।
এতদিন রবীন্দ্রনাথ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনিকে বিশ্লেষণ করতেন, নিজের জবানিতে কাহিনি বুনতেন, কিন্তু চতুরঙ্গে সেই প্রচলিত ফ্রেমের বদল ঘটল। উপন্যাসের একটি চরিত্রের চোখ দিয়ে কাহিনি বুনন ও বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ইন্দিরা’ তে এই রীতির ছাপ থাকলেও তা রবীন্দ্রনাথ তা অতিক্রম করে আরও দূরে।
কথনরীতির পাশাপাশি ভাষারীতির ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ধারা থেকে অন্যত্র সরে গেছেন। পূর্ববর্তী গোরা থেকে স্বতন্ত্র; সবুজ পত্রের যুগে বিবরণ বর্ণনা থেকে সংলাপ সবটাই সাধুরীতির প্রয়োগ। তার সঙ্গে একদিকে অলঙ্কারের ব্যবহারের প্রাচুর্য অন্যদিকে বক্র রমণীয়তা – সব নিয়ে এক নব্যভাষা ভঙ্গি দেখা যায়। অর্থাৎ চতুরঙ্গ উপন্যাস সাধু ভাষায় লেখা কিন্তু তার মেজাজ চলিত ভাষার।
এবার আসি ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় একইসময়ে লিখছেন ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস। তার আগে শেষ উপন্যাস লিখেছেন গোরা ছয় বছর আগে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উঠে আসছে ‘ঘরে বাইরে’ তে। আর তার পাশাপাশি ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের কাহিনি সমাজচেতনা এবং চরিত্রের আত্মবিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। শচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাস এই তিনটি চরিত্র নিয়ে মূলত আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসটি। কেন্দ্রিয় চরিত্র শচীশ যেন গোরার সহোদর, গোরার মতো উজ্জ্বল চেহারা তার। অথচ গোরার হিন্দুত্ব ছিল স্বাজাত্যবোধ, দেশের মানুষের মধ্যে তার আত্ম অনুসন্ধান। কিন্তু শচীশ চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগ ক্রমশই ম্রিয়মান হয়ে আসছে। আর তার পাশে শ্রীবিলাস – সুখ শোক মিশ্র জীবনের প্রতি তার আসক্তি।
সমাজ চেতনার অপর একটি দিক প্রতিফলিত হয়েছে দামিনীর মধ্যে – বিধবা বিবাহ। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের শুরুতে ননীবালার বিধবা বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল তা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ননীবালার আত্মহত্যায়। কিন্তু বিধবা দামিনী শ্রীবিলাসকে বিয়ে করেছে অথচ সে ভালোবেসেছে শচীশকে, বিয়ের পর শ্রীবিলাসকে ভালোবেসে ফেলছে কিন্তু শচীশের প্রতি ভালোবাসাও তার অবিচল। আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে সীমা – অসীমের মিলনের সূত্রপাত করছেন রবীন্দ্রনাথ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। শচীশের সঙ্গে দামিনীর প্রেম অসীমাভিসারী এবং শ্রীবিলাসের সঙ্গে তার প্রেম তা নীড়াভিমুখী। প্রেমের এই দুই দিক পরবর্তীকালে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে দেখা যাবে। আর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস আসলে সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাহিনির এক আধুনিক কনসেপ্ট। অন্যজনের প্রতি ভালোবাসায় আসক্ত দামিনীকে শ্রীবিলাস সপ্রণয়ে গ্রহণ করেছে, পুরুষের অভিমান ও অহংকার বিসর্জন দিয়েছে – এখানে শ্রীবিলাসের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখরের।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শচীশ, দামিনী, শ্রীবিলাস হলেও অপ্রধান চরিত্র জগমোহন ও লীলানন্দর গুরুত্বও অনেকটাই। বলা যেতে পারে, অপ্রধান চরিত্র দুটি প্রধান চরিত্রকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে।
জ্যাঠামশাই – উজ্জ্বল স্থির চরিত্র। বিজ্ঞানবুদ্ধি, মননচর্চা, নাস্তিক্যধর্ম অনুশীলন, তারুণ্য ইত্যাদি জগমোহন চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য। সবুজপত্রের মানসিকতার মধ্যেও মননচর্চাই প্রধান। জ্যাঠামশাই জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে মন্তব্য করেছেন –
“তখন বেন্থাম, মিল ও কোঁতের আধিপত্য। তাঁহাদেরই যুক্তি লইয়া আমাদের যুবকরা তখন তর্ক করিতেছিলেন। কিন্তু ইহাকে আমরা শুধু মানসিক বিদ্রোহের উত্তেজনা রূপেই ব্যবহার করিয়াছি। নাস্তিকতা আমাদের একটা নেশা”
– নেশার বশেই নাস্তিকতার চর্চা করার জন্য জগমোহনের মতো সম্ভাবনাময় চরিত্রের কোনো পরিণতি পাওয়া যায় না। আর এই জগমোহনের স্বাধীনচিত্ততার প্রভাব পড়েছিল শচীশের মধ্যে। পীড়িতের প্রতি করুণা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, সেবাধর্ম – প্রভৃতি জ্যাঠামশায়ের শিক্ষা দ্বারা শচীশ ও শ্রীবিলাস উভয়েই লালিত ছিল। কিন্তু জ্যাঠামশাই থেকে লীলানন্দ স্বামীর শিষ্যত্ব, আত্মবিভোর হয়ে কীর্তন গান, গুরুর পা টেপা – শচীশের এই চিত্তবদলের বিবর্তন রবীন্দ্রনাথ দেখাননি। শুধু দু’বার শচীশ নিজেকে বালক মূর্তিতে কল্পনা করেছে মাত্র। আসলে শচীশ একজন শিষ্য, আগে জ্যাঠামশায়ের শিষ্য, নিসংশয়ে সেখানে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে, তাঁর আদর্শে নিজেকে গড়ে। পরে লীলানন্দ স্বামীর পথ অনুসরণ করেছে। শচীশের পরিবর্তন ঘটেছিল দামিনীর সংস্পর্শে, অনুভব করেছিল দামিনীর প্রতি আকর্ষণ কিন্তু দামিনীর গুরু হতে সে রাজি হতে পারল না। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলা যায় জ্যাঠামশায় ও লীলানন্দ স্বামী দ্বারা শচীশ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। আর জ্যাঠামশায় লীলানন্দ স্বামী , শচীশ এবং দামিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে শ্রীবিলাস। আর দামিনীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের
“বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধনমাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ” – এই সুরই ধ্বনিত হয়েছে।
চতুরঙ্গ উপন্যাসের কাহিনি অতি সংক্ষিপ্ত এবং তার মধ্যে নাটকীয়তা বর্তমান। আর নাটকীয়তা আবর্তিত হয়েছে চরিত্রগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। শচীশ – প্রথম জীবনে জ্যাঠামশায়ের চ্যালা, নাস্তিক, পরবর্তীকালে লীলানন্দের শিষ্য হয়ে রসের সাধনায় মেতে উঠেছে এবং উপন্যাসের শেষে বলেছে –
“একদিন বুদ্ধির ওপর ভর করিলাম, দেখিলাম সেখানে জীবনের সব ভার সয়না, আর একদিন রসের উপর ভর করিলাম দেখিলাম সেখানে তলা বলিয়া জিনিসটাই নাই।”
আবার প্রেমের ক্ষেত্রে দামিনীকে স্বীকার করবে কিনা সে নিয়েও দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। দামিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে শচীশ ও শ্রীবিলাসকে কেন্দ্র করে। শচীশকে সে বলছে – “তুমি আমাকে এমন কিছু মন্ত্র দাও যা এ সমস্তের চেয়ে অনেক উপরের জিনিস – যাহাতে আমি বাঁচিয়া যাইতে পারি।” শচীশের প্রতি তার আকর্ষণ এবং শচীশকে মুক্তি দেবার আকাঙ্ক্ষার দামিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে শ্রীবিলাস তার আশ্রয় হয়েছে। শ্রীবিলাস চরিত্রে দ্বন্দ্ব আবর্তিত হয়েছে প্রেম ও প্রেমের অপ্রকাশ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে।
পরিশেষে ক্ষেত্র গুপ্তকে অনুসরণ করে বলা যায়, আকাশের মুক্তি এবং শোকসুখমিশ্র মাটির অমৃতকে রবীন্দ্রনাথ একটি মানবিক কাহিনিতে অভিনব আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। এর সঙ্গে এটাও বলা চলে ‘চতুরঙ্গ’ তথাকথিত উপন্যাস নয়, ছোটগল্পের আঙ্গিকে উপন্যাসে আত্মসাতের ফল।