‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা
নামকরণ সাহিত্যের দ্বারোদঘাটনের চাবিকাঠি, যার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়। নামকরণ একদিকে যেমন শিল্পের মনোভূমিকে স্পর্শ করে। লেখক তাঁর লেখনীতে কোন অভিপ্রেত বক্তব্য প্রকাশ করতে চান অথবা কোন চরিত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান তার ইঙ্গিত থাকে নামকরণের মধ্যে। তাই যে কোনো সাহিত্যকর্মের নামকরণ বিচার এক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা।
আলোচ্য ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি ১৩২২ সালের বৈশাখ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর জ্যৈষ্ঠ মাসে ১৯১৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শিল্পী রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস রচনার নতুন প্রকরণ ও আধুনিক ব্যক্তিচিন্তার সমর্থন একসঙ্গে দেখা দিল ‘ঘরে বাইরে’র কাহিনি রচনার পরিকল্পনায়। ‘ঘরে বাইরে’ তত্ত্বপ্রধান আবার কাব্যধর্মী। রাজনৈতিক পটভূমিতে প্রেমের বিশ্লেষণ, আবার প্রেমের স্বরূপ সন্নিধানে মনের বিশ্লেষণ – সব মিলে যে অভূতপূর্ব পরিবেশ চিত্রিত হয়েছে তার ভেতর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সুকুমার মনটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর এর ওপর ভিত্তি করেই উপন্যাসটির নামকরণের সার্থকতা বিচার্য।
বঙ্গভঙ্গের উত্তাল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়কে উপন্যাসের বৃহত্তর ক্যানভাস করে নিখিলেশ, সন্দীপ ও বিমলার আত্মকথনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে। অর্থাৎ উপন্যাসে দুটি অভিমুখ আছে –
১) মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবন
২) সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গ
আপাতভাবে এই দুটি অভিমুখই ঘর ও বাহির হিসাবে দ্যোতিত হলেও অভিমুখ দুটির সূক্ষ বিশ্লেষণে ঘর ও বাহির তত্ত্বটি স্পষ্টভাবে প্রকট হয়।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও প্রেমতত্ত্বের মূল ভিত্তি হল শাশ্বত ধর্ম, ব্যক্তিত্বের সার্থক প্রকাশ পূর্ণতার অর্জনে। আর পূর্ণতার ভিত্তিও শাশ্বত মানবতাধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দুটি তত্ত্বের ভিতর দিয়ে এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশিত হওয়ায় কাহিনি বিন্যাসে একটি জৈবিক ঐক্য – গ্রহণ নৈপুণ্যের নিদর্শন হিসাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কাহিনির মধ্যে বাইরের অভিঘাত এসেছে সন্দীপকে অবলম্বন করে এবং উপলক্ষ হয়েছে স্বাদেশিকতার কর্মকান্ড। এই কর্মের আবর্তে বিমলা হয়েছে চঞ্চল ও বিপর্যস্ত। কিন্তু বিপর্যয়ের আগুনে পুড়ে বিমলার প্রেম নিকষিত হেমে পরিণত হয়েছে। তবে মূল তত্ত্বের উপলব্ধি নিখিলেশ ছাড়া কারো জীবনেই দেখানো হয়নি। আবার নিখিলেশকে যদি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের মূল তত্ত্বকে উপলব্ধি করার প্রধান শক্তি রূপে চিহ্নিত করা যায় তবে বিমলাকে বলা যেতে পারে সেই শক্তিরূপের আধার। উপন্যাসে বিমলা নিখিলেশের গভীর প্রেমের মহিমা উপলব্ধি করতে পারেনি। আর সন্দীপের রূপজ মোহ তাকে বিপর্যস্ত করেছিল। বিবাহিত নারীর প্রেমচিত্র রচনায় বাংলা সাহিত্যে ‘ঘরে বাইরে’র অনন্যতা এবং লেখকের বৈপ্লবিক দুঃসাহসিকতা অনস্বীকার্য। দাম্পত্যপ্রেমের সত্যশ্রী যথার্থ ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে –
১) “আমার স্বামীর বড় ইচ্ছা ছিল আমাকে বাইরে বের করবেন। একদিন আমি তাঁকে বললুম, বাইরেতে আমার দরকার কী ?”
[ বিমলার আত্মকথা ]
২) “আমি চাই বাইরের মধ্যে তুমি আমাকে পাও, আমি তোমাকে পাই। এইখানে আমাদের দেনাপাওনা বাকি আছে।”
[ নিখিলেশের আত্মকথা ]
এইভাবে ঘরের বাইরের সত্যের মধ্যে, ব্যাপকের মধ্যে উভয়ের পরিচয়কে পাকা করে ভালোবাসার সার্থকতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাই রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যরূপে চিহ্নিত। তিনি দাম্পত্যপ্রেম সম্পর্কে একটি বিশেষ তত্ত্বকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। আসলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা ‘পতিগত সংস্কার’ তৈরি হয়ে ওঠে তাই দাম্পত্য প্রেম ব্যক্তি অনুভবজাত নয়, তা হয়ে যায় সামাজিক হৃদয়বৃত্তি। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
“স্ত্রী পুরুষের প্রেম বলে যে একটা স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি আছে তাকে অতিক্রম করে দাম্পত্য প্রেম নামক এক সামাজিক হৃদয়বৃত্তিকে সাধনার দ্বারা গড়ে তোলবার বিশেষ চেষ্টা আমাদের দেশে আছে।”
ঘরের গন্ডিতে যে প্রেম থাকে তা কেবল জীবনরক্ষার তাগিদে উন্মুখ, প্রেমের অতীন্দ্রিয় অসীমের উপলব্ধি সাধারণত সেখানে সম্ভব হয় না। ঘরের প্রেমকে তাই বাইরের পটভূমিকায় দাঁড় করালেই তার যাচাই নিখুঁত হয় এবং সে যাচাইয়ে প্রেম যদি নিখুঁত হয় এবং সে যাচাইয়ে প্রেম যদি অপরাজিত থাকে তবে তা সত্যকারের প্রেম নামের উপযুক্ত। প্রসঙ্গত ‘রাজা’ নাটকে রাণীর সঙ্গে পুনর্মিলনের দিনে রাজা রাণীকে আহ্বান জানিয়ে বলছেন –
“আজ এই অন্ধকারে ঘরের দ্বার একেবারে খুলে দিলুম। তখনকার লীলা শেষ হল। এসো আবার আমার সঙ্গে এসো, বাইরে চলে এসো আলোয়।”
একইভাবে উপন্যাসে দাম্পত্য প্রেমের ঘর বাহির তত্ত্ব ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়ে উপন্যাসটির নামকরণকে সার্থক করে তুলেছে।
বিমলাকে অবলম্বন করে নিখিলেশের মনের বাস্তব ও কল্পনা, ঘর ও বাহির, সীমা ও অসীমের যে দ্বন্দ্ব উপন্যাসে তার সম্পূরক পাত্র – পাত্রী হল মেজো জা ও চন্দ্রনাথ মাস্টার। মেজো জা ঘরের প্রতীক, আর চন্দ্রনাথবাবু বাইরের; একজনের ঘরের প্রতি আকর্ষণ, আরেকজনের বাইরের প্রতি , তিনি সংসার বিরাগী। উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, দাঙ্গার খবর এলে চন্দ্রনাথবাবু নিখিলকে কর্তব্যের মুখে যাবার উপদেশ দিলেন এবং মোজোরাণী আকুল হয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে তৎপর হলেন। উপন্যাসের যেখানেই দুটি চরিত্রের উপস্থিতি সেখানেই তারা পরোক্ষে প্রত্যক্ষে নিখিলেশের মনে সীমা অসীমের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছে।
‘ঘরে বাইরে’ নামকরণটির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট কালচেতনা রয়েছে যাকে তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত করাই শিল্পসম্মত বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন। সত্যসন্ধ পুরুষ নিখিলেশ স্ত্রীর ব্যক্তিসত্তাকে বিকশিত করার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছে বৃহত্তর কর্মের পটভূমিতে। এই তত্ত্বই উপন্যাসে বিধৃত, নামকরণও তত্ত্বানুযায়ী। কাহিনির মধ্যে এই সমস্ত তত্ত্বের উপস্থিতির জন্য অনেক ক্ষেত্রে সমালোচকদের কাছে উপন্যাসটিকে রূপক বলে মনে হয়েছে।
প্রমথ চৌধুরী, শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী এবং বিশ্বপতি চৌধুরী ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসকে রূপক রচনা বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। সুরেশচন্দ্রের মতে, নিখিলেশ প্রাচীন ভারত, সন্দীপ নব্য ইউরোপ এবং বিমলা ভারতবর্ষ। মানুষের মধ্যে জ্ঞান এবং প্রেম দ্বিবিধ – একটি হচ্ছে ‘অহং’, অপরটি ‘সোহহং’। এর একদিকের প্রেমে সাধনার মূল্য গৌণ, মন্ত্র স্তবটাই মুখ্য, এ প্রেমে আত্মস্বরূপ বিঘ্নিত হয়। এ প্রেমে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, মন সবকিছুই ভস্মীভূত হয়, তবু মুক্তি নেই। অন্যদিকে যে প্রেম সেখানে ধ্যান বড়, স্তব গৌণ; তাই সেখানে বাহিরকে অস্বীকার করেও বাহিরকে পেয়েছে। অহংবোধ ইউরোপের জীবন দর্শন, সে জীবনার্থের প্রতীক সন্দীপ। সে ইউরোপের মতই আত্মসুখ সর্বস্ব, দেশের প্রশ্নেও স্বদেশসর্বস্ব। পক্ষান্তরে, প্রাচীন ভারতের বাণী আত্মসর্বস্বতা কিংবা সংকীর্ণ জাতীয়তা নয় – সে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য ধৈর্য শান্ত ত্যাগধর্মী জীবনদর্শন গড়ে তুলেছে। প্রাচীন ভারতের আদর্শের মতোই শান্ত, ধৈর্য ও বিশ্বমানব কল্যাণমুখী চেতনায় গড়ে উঠেছে নিখিলেশের জীবনবেদ। তার এ আদর্শ বিমলা ও স্বদেশ সাধনা উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে। আর প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ বা নিখিলেশ এবং নব্য ইউরোপীয় জীবনার্থ বা সন্দীপ – উভয়ের টানাপোড়েনে ভারতবর্ষ বিমলা বিভ্রান্ত। প্রাচীন ভারতের ত্যাগধর্মী কর্মযোগ ও নব্য ইউরোপীয় ভোগবাদী কর্মবাদী সংশ্লেষণী যে ভারতবর্ষের জন্য যথার্থ এ রূপকার্থ ‘ঘরে বাইরে’ পরিণতিতে আভাসিত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে, এর প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ একটি পত্রে অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লিখেছিলেন –
“প্রমথ চৌধুরী এই গল্পটি রূপক বলে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু সে বোধ হয় কতকটা লীলাচ্ছলেই করে থাকবেন। এর মধ্যে কোন জ্ঞানকৃত রূপকের চেষ্টা নেই, এ কেবলমাত্রই গল্প। মানুষের অন্তরে সঙ্গে বাইরের এবং একের সাথে অন্যের ঘাত প্রতিঘাতে যে হাসিকান্না উদঘাটিত হয়ে ওঠে এর মধ্যে তারই বর্ণনা হচ্ছে। তার চেয়ে বেশি যদি কিছু থাকে সেটা অবান্তর এবং আকস্মিক।”
রবীন্দ্রনাথ নিছক গল্প লিখলেওলেখনীর মধ্যে নানা মাত্রা থাকে, যা ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ে সামাজিকের চোখে ভিন্নভাবে প্রতিভাত হয়। আর প্রমথ চৌধুরীর রসোপলব্ধির যোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
সবশেষে বলা যায়, ‘ঘরে বাইরে’তে নিখিলেশ – বিমলা সন্দীপ আপন বৈশিষ্ঠ্য প্রকাশের দ্বারা তত্ত্বধর্মী উপন্যাসে রস সঞ্চার করেছে। কাজেই নিছক তত্ত্ব না হয়ে উপন্যাসটি রসময় হয়ে উঠেছে। দ্বৈধ ব্যক্তিত্ব বা split personality এ উপন্যাসের রসসঞ্চার করেছে। এই ব্যক্তিদ্বৈধের সংঘর্ষই ‘ঘরে বাইরে’র সমস্যা। রবীন্দ্রনাথের একটি বক্তব্যে এ জাতীয় মন্তব্য রয়েছে –
“বিমলার struggle নিজেরই শ্রেয়ের সঙ্গে প্রেয়ের – সন্দীপ নিজের মধ্যে নিজেরই হারজিৎ বিচার করছে – নিখিলেশও নিজের feeling-এর সঙ্গে নিজের কর্তব্যের adjustment করচে। এদের আত্মানুভূতি নিজের record নিজে রাখচে।”
কাজেই এ উপন্যাসের তত্ত্ব, চরিত্র, পরিবেশ, মনস্তত্ত্ব – সবকিছুই যে পরিচয় তুলে ধরতে চায় তা হল নিজেকে জানা। এ জানা সম্ভব হবে আপন অন্তরের শ্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বে, ঘরে ও বাইরের পটভূমির বৈপরীত্যে। কাজেই নামকরণ কাব্যধর্মী, তাত্ত্বিক এবং সার্থক।