বধূ : নাগরিক জীবনে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াস
সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আধুনিক বাংলা কবিতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মুখোশ নয়, মুখই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। জন সংলগ্নতা ও গণমুক্তির রাজনৈতিক চেতনা তাঁর কবিমানসের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। দেশ – কাল – ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের মর্মবস্তু ছিল দেশাত্মবোধ ও মানবতা। বৃহত্তর মানব সমাজের দিকে তিনি হৃদয়কে মেলে ধরতে চান। ফলে রোমান্টিকতার চর্চা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। রোমান্টিক বদলে প্রখর বাস্তবকে রূপ দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর কলম বলে উঠেছে –
“ছেঁড়া জুতোটায় ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে
বেঁধে নিই মন কাব্যের প্রতিপক্ষে;
সেই কথাটাই বাধে না নিজের বলতে –
শুনবে সে কথা হাজার জনকে বলতে।”
রাজনীতিকে কাব্যের আবেগে রূপান্তরিত করে পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করাই তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। আলোচ্য ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতাটি নিতান্ত সাধারণ গৃহবধূর কথকতা, সেখানেও রোমান্টিকতার ছায়া পড়েনি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটিতে বিশ শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ দশকের নাগরিক জীবনের মানসিকতা প্রতিফলিত, সেখানে আত্মনাশের পরিবর্তে অস্তিত্বরক্ষার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশিত। কবি কবিতার সূচনাতেই একদিকে যেমন রবীন্দ্র পঙক্তির অংশ ব্যবহার করে কবিতার বিষয় সূত্রটিকে ধরিয়ে দিয়েছেন পাঠককে, তেমনি সচেতনভাবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতার পরিবেশটিকে ধরেছেন অব্যর্থভাবে। এখানে কবি “পুরানো সুর ফেরিওয়ালার ডাকে” – এই উচ্চারণে যুগগত ক্রান্তিকালটিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। নগরের যান্ত্রিকতা, প্রাণহীন, মমত্বহীন জীবন প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা উভয় কবিতারই বধূর মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছে। হার্দ্যতা, ভালোবাসা, মমতা এখানে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। কেবল ‘তেজারতির মতন কিছু পুঁজি’ সঙ্গে থাকলেই এই হৃদয়হীন নগরটিতে টিকে থাকা সম্ভব।
কবি যেন ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিতে চান, অসুস্থ যুগের প্রকোপে, নাগরিক জীবনের পঙ্কিলতায় কেমন করে গ্রামের প্রাণময়ী এক সত্তাও হারিয়ে যায় কদর্য অন্ধকারে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বলার ভঙ্গিতে লগ্ন হয়ে থাকে এই নাগরিক অস্তিত্বের অর্থহীন গ্লানির প্রতি সংহত অথচ তীব্র ব্যঙ্গ –
“বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা ; তাই
কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে।”
ফলে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটিকে বলা চলে আধুনিক বিশ্বযুদ্ধোত্তর মুনাফাসন্ধানী মমতাহীন বঙ্গ নগরের অসহায়তা ও সামাজিক সংস্কৃতিক আর্থিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের সাংকেতিক দলিল।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটি স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত সমনামের কবিতাটিকে অনুসরণ করে রচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশৈশব মুক্তিসন্ধানী, যা কিছু খন্ড বা যা কিছু বন্ধন, তাকে অস্বীকার করে মুক্ত আত্মার বিকাশকেই তিনি প্রার্থনা করেছেন – সাধনা করেছেন তাঁর কাব্যে ও সাহিত্যে, তাঁর দর্শন ও জীবনভাবনার প্রতি পদক্ষেপে। পল্লীপ্রকৃতির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে রবীন্দ্র সাহিত্যের পাত্র পাত্রীদের নাগরিক জীবন থেকে মুক্তির জন্য আকুলতা আমরা দেখেছি ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রে। কিংবা দাম্পত্য জীবনের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসে গ্রামের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মুক্ত জীবন কাটানোর জন্য আকুলতা দেখেছি ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী চরিত্রের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতাতেও সেই প্রকৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামের বধূটির আর্তির মধ্য দিয়ে। গ্রাম প্রকৃতির বৈপরীত্যে নাগরিক জীবন তার কাছে যন্ত্রণাময় মনে হয়েছিল। ইটের পর ইট সাজিয়ে যে নগর গড়ে উঠেছে সেখানে দলিত হয়ে গেছে তার প্রাণের সহজ আনন্দ। আশৈশব প্রকৃতিলালিত বধূর প্রাণ নগরের পাঁচিল ঘেরা আয়তনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল শ্বাসরুদ্ধ। এই মমত্বহীন নগরে বধূটির প্রাণের আর্তি কেউ বোঝেনি। তাই দীঘির কালো জলের শীতল স্পর্শে বধূটির যন্ত্রণার অবসান চেয়েছিল –
“দীঘির সেই শীতল কালো
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।”
আসলে যান্ত্রিক নগরায়ণের পরিবর্তে প্রকৃতির সহজ প্রাণময় মুক্ত সহচর্য এই বধূটির অধিকতর কাম্য। তাই শহরে বাস করলেও বিভিন্ন অনুষঙ্গে গ্রামজীবন তাকে হাতছানি দেয় বারবার –
“কলসী লয়ে কাঁখে পথ সে বাঁকা –
বামেতে মাঠে শুধু সদাই করে ধূধূ
ডাহিনে বাঁশবনে হেলায়ে শাখা।”
এই একই কথার অনুরণন পাই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতায় –
“কাছেই পথে জলে কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে
হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা
পড়লো মনে, খাসা জীবন সেথা।”
একই বিষয়ে দুজনের দুরকম বর্ণনা – রবীন্দ্রনাথ বাঁকাপথ, ধূ ধূ মাঠ, বাঁশবনের প্রসঙ্গ এনে গ্রামজীবনকে স্পষ্ট করেছেন। সুভাষ শহরজীবনকে ধরেছেন গলির মোড়, ফেরিওয়ালাল ডাক, গ্যাসের আলোর প্রসঙ্গ এনে। সুভাষ তাঁর বধূর গ্রাম জীবনের সুখ স্বপ্নের দিন বোঝাতে লিখেছেন –
“সারা দুপুর দীঘির কালো জলে,
গভীর বন দুয়ারে ফেলে ছায়া।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বধূর গ্রাম জীবনের সুখস্বপ্ন বোঝাতে লিখছেন –
“দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো জ্বলে
দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা।”
লক্ষণীয় রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষ উভয়ের বলার বিষয় এক, কিন্তু শব্দগত পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ ‘দিঘির কালো জলে’ সাঁঝের আলোর প্রসঙ্গ এনেছেন, আর সুভাষ সাঁঝের পরিবর্তে ‘দুপুর’ এর প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন।
নগর জীবন যান্ত্রিক, নির্মম। ইট কাঠ পাথরের রাজধানীতে যুক্ত চাঁদের সাক্ষাৎ মেলে না –
“ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে –
দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন
আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারি
ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে।”
গ্রাম শহরের পার্থক্যে চাঁদ দেখার রোমান্টিকতা আমূল বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথ এই একই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন এইভাবে –
“হেথাও উঠে চাঁদ ছাদের পারে
প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে।”
নিসর্গহীন, সংকীর্ণ গলি জীবনে বসবাস করা বধূ অসহায়তা বোধ করে। প্রিয়তম ছাড়া একলা জীবন তার চরম বিপর্যস্ত মনে হয় –
“সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
লেকের কোলে মরণ যেন ভালো।”
রবীন্দ্রনাথের বধূও নগরজীবনের চরম অবস্থায় পৌঁছে জানায় নিজের মনের কথা –
“দিঘির সেই কালো জল শীতল কালো
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।”
রবীন্দ্রনাথের বধূ দিঘির শীতল জলে প্রাণ জুড়োতে চেয়েছেন, নিজেকে শেষ করতে চেয়েছেন। সুভাষের বধূ অনেক বাস্তবধর্মী, সে জানে শহরে দীঘি নেই, তাই নিজেকে শেষ করতে হলে লোকের জলই একমাত্র ভরসা। এভাবেই পার্থক্য গড়ে যায় উভয় কবিতার মধ্যে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নবর্জন বাস্তবধর্মী বধূ কবিতাটি হয়ে উঠেছে অনেকটাই নীরস। প্রেম ভাবনাকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কোনোদিনই আমল দেননি, ফলে রোমান্টিক আবহ এ কবিতায় তেমনভাবে ধরা পড়েনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ রোমান্টিকতায় ভরপুর, রমণীয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল সমগ্র বিশ্বের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই এক ক্রান্তিকাল। এই দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে মানুষের রোমান্টিক স্বপ্নকল্পনার জগৎ যেন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। গুঁড়িয়ে গেল মূল্যবোধ নষ্ট হল প্রেম প্রীতি ভালোবাসার মূল্য। আধুনিক কবিদের কবিতায় এই স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস বিধৃত। সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ এখন অপচিত। এ যুগের কবিরা 'জন্ম রোমান্টিক' রবীন্দ্রনাথকে প্রায় উচ্চ ঘোষণায় প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেন। এই রবীন্দ্র বিরোধিতা এসেছে ভাবে - ভাষায় - মননে - চিত্রকল্প নির্মাণে ছন্দে উপমায় সর্বত্র। কখনো কখনো আধুনিক কবিরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথকেই ব্যবহার করে। এই ধারায় বিশিষ্ট কবি বিষ্ণু দে। তিনিই স্পষ্টত রবীন্দ্র পঙক্তিকেই ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বধূ' কবিতাটিতেও রবীন্দ্রযুগের থেকে আধুনিক যুগের চূড়ান্ত নাগরিকতার সুবিশাল পার্থক্যটি তুলে ধরা হয়েছে খুব সচেতনভাবেই একটি বিশিষ্ট রবীন্দ্র কবিতার অনুষঙ্গ ব্যবহার করে।