“যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ?” – মৃত্যুকে অতিক্রম করে বাঁচার আনন্দ
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বর্তমান বাংলা কাব্য সাহিত্যে একটি বিতর্কিত নাম, খ্যাতি ও অখ্যাতিতে ভরা হলেও এই নামটি আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রখ্যাত শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন –
শক্তি যেমন কবি, তেমনই মানুষ, তেমনই অগোছালো রহস্যময়। প্রখর ঔজ্জ্বল্য নয়, ঝাপসা ধোঁয়াটে রোমান্সে ভরা তার দৃষ্টি।
(শক্তির কাছাকাছি , সম্পা : সমরসিজ সেনগুপ্ত ও ইনা সেনগুপ্ত)
শক্তির কবি প্রকৃতিতে ধরা পড়েছে প্রেম প্রকৃতি মৃত্যুভাবনা এবং অবশ্যই সমাজ মানুষের প্রসঙ্গ। জীবন সম্পৃক্তিই তাঁর কবিতার মূল সুর বাউল মানুষ যেমন ঘরের সংকীর্ণ বন্ধন ছিঁড়েও তার গানের কলিতে ফুটিয়ে তোলে মাটি মাখা জীবনের গান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তেমনি আপাত ভবঘুরে উদাসী মানসিকতার গভীরে সযত্নে লালন করেন তীব্র এক জীবনপিপাসা। তাঁর কাব্যভাষা ও কাব্যরীতিতে যদিও জীবনানন্দীয় স্পর্শ পাওয়া যায়, বিশেষত প্রথমদিকের কবিতায়, তবু তিনি ওখানেই থেমে থাকেননি।
জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় আত্মহননকারী মানুষটি জীবনে পেয়েছিল সবই, সুখী দাম্পত্য, স্নেহময় বাৎসল্য – এক পূর্ণ সুখী তৃপ্ত জীবনের সম্ভার, তবু সে তৃপ্ত হতে পারেননি। সুখে পরিপূর্ণ এক মুহূর্তে, চন্দ্রালোকিত একরাত্রে তবু সে একা একা দড়ি হাতে গিয়েছিল অশ্বত্থ গাছের নীচে, আর তারপর – “থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে” , মৃত্যুর নির্মমতায় স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ। স্বপ্নপূরণ, আশা ভালোবাসা, সুখী দাম্পত্য, বাৎসল্য কোনো কিছুই তাকে বেঁধে রাখতে পারেনা। একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে শক্তিও জন্মের কারণ খুঁজে পায় না – ফিরে যেতে চায়। প্রশ্ন তোলে –
“এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি?” (জরাসন্ধ)।
শক্তির সংশয় – “তবে হয় তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে” (জরাসন্ধ)। এরপর ‘জন্মদিনের পাশে’ শক্তি ‘শীতের বাগান’ দেখতে পায়। দেখতে পায় – ‘চারা গাছ আছে কাছে, ফুল নেই কোনো’ বলে ওঠে – ‘না থাকুক শোভাময় ফুল, শীতের জাতক আমি, দুহাতে শূন্যতা!’ শীতের জাতক হওয়ার পরও শক্তি যে বসন্ত গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এবং হেমন্তকে পরিপূর্ণভাবে দেখেছে, ভোগ করেছে, তারই মধ্যে হেঁটেছে, আশ্রয় খুঁজেছে, বিশ্রাম নিয়েছে, আবার চলেছে এবং সেসব অভিজ্ঞতা ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়। আলোচ্য ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতাটিতেও এই জীবন পিপাসাই উচ্চারিত হয়েছে।
আলোচ্য কবিতায় কবি পারিবারিক জীবনে তৃপ্ত ও অনুরক্ত ; সন্তানের প্রতি অপত্য মমতায় সে মৃত্যুর অনিবার্য ডাকে সাড়া দিতে চায় না। গৃহশ্রম তৃপ্তি অস্বীকার করে কোনো এক রহস্যময় বোধের তাড়নায় সে আত্মহননের পথ বেছে নেয় না। বরং যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বলে –
“ভাবছি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো”
আসলে যাওয়াটা তো অনিবার্য। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলকেই জগৎ সংসারের মায়া ছেড়ে পরলোকে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাই –
” এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন – ‘যেতে নাহি দিব’
হায় তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যায়।….
(যেতে নাহি দিব)
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রোমান্টিকতার সুরে যে নিস্ফলতার প্রকাশ পেয়েছে তারই বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আলোচ্য কবিতাটি। জীবনের স্বাদ পরিতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষায় তার মুখ গেল ঘুরে – শূন্যতার থেকে পূর্ণতার দিকে, পথ থেকে ঘরের দিকে। অতিরিক্ত সুরাসক্তি, জীবনের শেষ পর্যায়ে মৃত্যু ভয় শক্তির শক্তিকে নিঃশেষিত করে দিচ্ছিল। কবি উপলব্ধি করেছেন যে এতকালের বোহেমিয়ান জীবনে শুধু দুহাতে কালিমালিপ্ত হয়েছেন। তাই কবির খেদোক্তি –
“এত কালো মেখেছি দু’হাতে
এত কাল ধরে।
কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।”
‘কালো’ শব্দের তাৎপর্য নিরূপণে কবি বলেছেন –
"কালো' মানে ঐসব অমর্যাদা, অপমান, নানা গন্ডগোল যেন কালো হয়ে ঘিরে ধরেছিল আমাকে। তাই ঘুরে দাঁড়ানো - কালো ছেড়ে সাদার দিকে তাকাই মানুষের মতো করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।"
(স্বগতোক্তি : যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ? সম্পা: দেবতোষ বসু)
জীবনের এই অবেলায় তাই স্বেচ্ছামৃত্যু তাঁর কাম্য নয়। জীবনের যা কিছু রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সবটা এখনো নিঃশেষে পাওয়া হল না। তাই তাঁর স্পষ্টোক্তি –
“যেতে পারি
যে কোনো দিকেই আমি চলে যাতে পারি
কিন্তু কেন যাবো ?”
পাহাড়-জঙ্গল-গাছ-গাছলি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরম আত্মীয়। প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছায়াতলে তাঁর পরম শান্তি। হেমন্তের অরণ্যে পোষ্টম্যান হয়ে ঘুরে বেড়ানোই তাঁর নেশা। প্রকৃতির হাতছানিতে, প্রকৃতির টানেপ্রয়োজনে অপ্রয়োজনেশক্তি সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন ঝাড়গ্রাম, ডুয়ার্স, কানহা, চাইবাসা প্রভৃতি স্থানে। আকাশে মেঘের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন –
“জানলায় ভাসে মালতী ফোটানো বেলা
নীল মেঘ বনে কালো মেঘ তাড়া করে।”
(ব্যবধান)
জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। সেই মধুর জীবনের প্রত্যেকটি পরতে যেন মৃত্যুর হাতছানি। জীবন মৃত্যুর সেই সহাবস্থানের কথাই বলেছেন আলোচ্য ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ?’ কবিতায় –
“এখানে খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়।”
তবুও মৃত্যুকে, মৃত্যুর দেবতাকে ফিরিয়ে দিতে শক্তি লিখেছেন –
“বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালি ঘাস
দুয়ার চেপে ধরে।”
(অবনী বাড়ি আছো ? )
জীবনের পাড়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছেন, ভয় পেয়েছেন আবার মৃত্যুকে ভালোবেসে জীবনকেও উপভোগ করতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন অন্যত্র –
“আগুন অসহ্য হয় নদীর ধারে
এবং মড়া চাইতে পারে এক কৃষিজল
মৃত্যু তখন হয় না সফল, হয় না সফল।”
(মৃত্যু)
এখানে ‘এক কৃষি জল’ কবির জীবন পিপাসা। আবার ‘তুমি একা থেকো’ কবিতায় লেখেন –
“কোলের কাঙাল আমি, পিপাসার্ত আমি”
তাই চন্দনচিতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যাত হয়। শিশুকে আদর করা শুধু নয় চুম্বনের উষ্ণতায় ভরিয়ে দেওয়া আর ভরে যাওয়ার আনন্দে কবি ফিরতে চান ধুলো কালি ভরা সংসারে, সুখ দুঃখ তাড়িত জীবনে। আর প্রকৃতির নিয়মে যাবার সময় হলে তবেই তিনি পৃথিবী ছাড়তে রাজি তবে একা নয়। তিনি বলেছেন –
"আমার ভালোবাসার জন যারা তাদেরকেও আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। একটু স্বার্থপরের মতোই কথাটা শোনায়, উপায় নেই।"
(স্বগতোক্তি : যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো
সম্পা : দেবতোষ বসু)
তাই তাঁর স্পষ্টোক্তি –
“একাকী যাবো না অসময়ে।”
এরই সমান্তরাল আকুতি ব্যক্ত হয়েছে অন্যত্র –
“বাঁচতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই
শুধু বাঁচা, অহরহ মৃত্যুর ওলটপালটের
মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই, শুধু বাঁচতে চাই।”
(শুধু বাঁচতে চাই)
বাঁচতে চাওয়া, অসময়ে যেতে না চাওয়ার মধ্যে আছে কবির সদর্থক জীবনবোধ। তিনি সর্বগ্রাসী মৃত্যুর কাছে যেতে চান না; ফিরতে চান সংসারে, ভালোবাসার কাছে। তাই ঘুরে দাঁড়ানো, মৃত্যুর দিকে পিছন ফেরা আর জীবনের মুখোমুখি হওয়া।
রবীন্দ্রনাথ যেমন মৃত্যুকে ‘শ্যামসমান’ জেনেও বারবার জীবনের সংলগ্ন হতে চেয়েছেন; সুকান্ত যেমন মৃত্যুর অনিবার্যতা স্বীকার করেও পরবর্তী শিশুও প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবীকে ‘সুস্থ ও বাসযোগ্য’ করে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেন। কবি শক্তিও তেমন মৃত্যুকে অনিবার্য হিসাবে স্বীকার করেও সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে জীবনতৃষ্ণাকে প্রকাশ করেছেন। ফিরে যেতে চেয়েছেন আঘাত ব্যাঘাত শোক দুঃখ সত্ত্বেও যেখানে আছে নীড়ের উষ্ণতা, সন্তানের মুখে চুমো খাওয়ার অনাবিল আনন্দ। যেমন ভেবেছিলেন জীবনানন্দ –
“ভালোবাসা আর ভালোবাসার সন্তান
আর সেই নীড়
এই স্বাদ গভীর – গভীর।”
(পাখিরা)