বাতাসে লাশের গন্ধ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত‍্যুর নগ্ন নৃত‍্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে –
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিল,
জীর্ণ জীবনের পুঁজে যারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, – একি তবে নষ্ট জন্ম ?
এ কি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরানো শকুন।

বাতাসে লাশের গন্ধ –
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ –
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না –
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে
আমি ঘুমোতে পারিনা, আমি ঘুমোতে পারিনা –

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল‍্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

■ প্রাসঙ্গিক তথ‍্য –
● ১৯৭৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অরণি গোষ্ঠী আয়োজিত টাঙ্গাইলের দুদিনব‍্যাপী সাহিত‍্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতাটি পাঠ করে ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শামসুর রহমান, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা সহ শতাধিক কবি লেখক এবং বিশিষ্টজনেরা।
রুদ্র মুহম্মদের নির্ভীক লেখনী, দৃঢ় কন্ঠস্বর আর সাহসি বিষয়বস্তুর আকর্ষণে যেমন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল উপস্থিত শ্রোতারা তেমনি আলোড়িত হয়েছিল সরকারের গোয়েন্দারাও।

● ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতাটি রুদ্র মুহম্মদের প্রথম কব‍্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ কাব‍্যগ্রন্থের অন্তর্গত, প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, প্রকাশক অপর এক প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা।

● কাব‍্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন –

“থামাও থামাও এই মর্মঘাতি করুণ বিনাশ
এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত‍্যার প্লাবন

সিরাজ শিকদার
শেখ মুজিবর রহমান
আবু তাহের

তিনজনের মৃত‍্যুর অস্বাভাবিকতাই উৎসর্গপত্রের সূত্র। মাত্র ২১বছর বয়সে স্বাধীনতার পর দেশের অরাজকতা দেখে দেশাত্ববোধের উদ্দীপনা থেকে প্রতিবাদ করেছেন কবিতা জুড়ে।