সময়ের সিড়ি বেয়ে রবীন্দ্রনাথের নাট্যচর্চার প্রাসঙ্গিকতা
কলমে : বন্দনা সাহা
রবীন্দ্রনাথ এমনই একজন চর্চিত ব্যক্তিত্ব যাকে নিয়ে ভূমিকা করে নতুন কিছু বলার নেই। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় যিনি সযত্নে সাজিয়ে তুলেছেন সাহিত্য সাধনার মন কুসুমের বাগিচা। শুধু এটুকুই বলার বাঙালির দিনযাপনের প্রতিটি গানের সুরে তিনি বেজে ওঠেন হৃদয়ের একতারাতে। তাঁর সম্পর্কে মনের মধ্যে জমে থাকা প্রত্যেকটি প্রশংসা বা স্তুতিমূলক শব্দ ব্যবহার করলেও বোধহয় তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব নয়। সময়ের খাঁজে খাঁজে, জীবনের বাঁকে বাঁকে, সাফল্যে, ব্যর্থতায় তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের পাথেয়, তাই নতজানু হয়ে বসি তাঁর কাছে। বারেবারে তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য কর্ম।
দু’শো বছরের ব্রিটিশ রাজত্বের অবর্ণনীয় অত্যাচারের অন্ধকারময় দিনগুলি পেরিয়ে মানুষ দেখেছিল দেশভাগের বিভীষিকাময় রক্তঝরা দিনের নৃশংস চিত্র, শুনেছিল অসংখ্য মানুষের বেদনার্ত হৃদয়ের মর্মভেদী কান্না। দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল তা মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার টুকুকেও যেন গলা টিপে হত্যা করেছিল। সময়ের অগ্রগতিতে আমরা আধুনিক হয়েছি, নিজেদের সভ্য সমাজের মানুষ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছি কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মাঝে মাঝে স্মরণ করায় – যে পাশবিক, যে অমানবিকতার বীজ বহুবছর আগে রোপিত হয়েছিল তার চিহ্ন এখনও বহন করে চলেছে সমাজের গুটিকয়েক মানুষ। তাই এই বিপর্যস্ত সময়ে মানুষ আকড়ে ধরে সেই চির উন্নত শির, পথ প্রদর্শক গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে। প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’, ‘অচলায়তন’, ‘ডাকঘর’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘বিসর্জন’-র মতো নাটকগুলি যা এই অস্থির সময়ে সঠিক দিশা দেখাতে পারে।
বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি –
“অনবচ্ছিন্ন সাত মাস আমেরিকার ঐশ্বর্যের দানবপুরীতে ছিলেম। সেখানে ভোগের চেহারা দেখেছি, আনন্দের না। দানব মন্দ অর্থে বলছি নে, ইংরেজিতে বলতে হলে হয়তো বলতেম, টাইটানিক ওয়েলথ্। অর্থাৎ যে ঐশ্বর্যের শক্তি প্রবল, আয়তন বিপুল। … আটলান্টিকের ওপারে ইঁটপাথরের জঙ্গলে বসে আমার মন প্রতিদিনই পীড়িত হয়ে বলেছে, তালের খচরমচরের অন্ত নেই, কিন্তু সুর কোথায়? আরো চাই, আরো চাই, আরো চাই, – এ বাণীতে তো সৃষ্টির সুর লাগে না”১
এই শোষণভিত্তিক যান্ত্রিক জীবনে সুর খুঁজতে তিনি সৃষ্টি করেছেন নন্দিনীর মতো প্রাণময়, সজীব চরিত্রকে, নির্মাণ করেছেন যক্ষপুরীর মতো ধণতান্ত্রিক শুষ্ক সমাজ পরিকাঠামোকে, অঙ্কন করেছেন এই শাসিত সমাজের নাম-গোত্র-ব্যক্তি পরিচয়হীন শোষিত মানুষের প্রতিচ্ছবিকে। পুঁজিবাদী সমাজের প্রতীক রূপে জন্ম দিলেন ‘রক্তকরবী’-র মতো নাটকের। এই নাটকের
“মূল-বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হইয়াছে আধুনিক ইউরোপীয় ধণতন্ত্র ও অর্থগৃধ্যুতা, বিজ্ঞান সাধনা শক্তি বলে প্রকৃতির উপস্থাপনের দম্ভ সত্যবাদী বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা এবং নিয়ম তন্ত্র সর্বস্ব যান্ত্রিক শাসন ও শাসন ব্যবস্থার পটভূমিকায় এই বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবে কি করিয়া মানুষের অন্তর আত্মা আবদ্ধ হয় এবং কি করিয়া প্রাণশক্তি সৌন্দর্য ও প্রেমের শক্তির রূপান্তর ঘটাইয়া উদ্ধার সাধন করে ইহারই কাহিনী এই নাটকের বিষয়বস্তু”২
রাজা যক্ষপুরীতে বসে বছরের পর বছর ধরে কেবল তাল তাল সোনা সংগ্রহের কাজে নিমগ্ন রেখেছে এই পুরীর সমস্ত শ্রমিকদের এবং নিজে সেই ধন সম্পদ নিবিষ্ট মনে রক্ষা করেছে। বর্তমান বিশ্বে এমনি এক পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো তৈরি হয়েছে যেখানে এক শ্রেণির মানুষ কেবল ধন সম্পদ সংগ্রহ করে চলেছে আর এক শ্রেণির মানুষ সেই সম্পদ সৃষ্টির কাজে নিরন্তর মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। ধনতন্ত্রিক শ্রেণির উচ্চ পর্যায়ের মানুষরা বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে রক্তকরবীর রাজার মতো নিজেদের চারপাশে এমন এক জালের আবরণ তৈরি করেছেন যেখানে সহজ সরল জীবনের সুর হারিয়ে গেছে, প্রানহীন নিস্পন্দন এক রুক্ষ মরুভূমি যেন গ্রাস করে নিচ্ছে। রক্তকরবীতে শ্রমিকদের কোনো ব্যক্তি পরিচয় ছিল না, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল ৬৯ঙ, ৪৭গ ইত্যাদি নামে ঠিক যেমনটা বর্তমান সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের কোনো আলাদা পরিচয় থাকে না, তারা টাকার বিনিময়ে কেবল তাদের শ্রমকে বিক্রি করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে ব্যক্তি সত্তা। তারা যক্ষপুরীর নম্বর চিহ্নিত মানুষের মতো হয়েই সমাজের স্তম্ভ স্বরূপ থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবীতে যেমন নন্দিনীর মধ্য দিয়ে মরা কাঠে প্রাণের সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন বর্তমান সময়ের নিষ্প্রাণ শোষন ভিত্তিক সমাজে সেই প্রাণের আলো ছড়িয়ে দিতে আমরা অপেক্ষা করব নন্দিনীর জন্য, অপেক্ষা করব রঞ্জনের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ যন্ত্র সভ্যতার আরেক প্রতীকী রূপ নির্মাণ করেছেন ‘মুক্তধারা’ নাটকে। বিজ্ঞান নির্ভর যন্ত্রসভ্যতা মানুষের কাজকে সরলীকরণ করার মাধ্যমে সময়ের নিরিখে আরো আধুনিক করে তুলেছে। বিজ্ঞান যতখানি সাফল্যের সঙ্গে গবেষণা লব্ধ যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারে সমাজ তত প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যায়। তবে দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারগত পার্থক্যের ভিত্তিতে সেই আবিষ্কার কখনো আশীর্বাদ আবার কখনো অভিশাপ রূপে ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান ও তার যন্ত্রকে সম্মান জানিয়েছেন কিন্তু বিজ্ঞানের অভিসম্পাত যান্ত্রিকতাকে নিন্দা করেছেন-
“বিজ্ঞান যেখানে সর্বসাধারণের দুঃখ এবং অভাব মোচনের কাজে লাগে, যেখানে তার দান বিশ্বজনের কাছে গিয়া পৌঁছায়, সেইখানেই বিজ্ঞানের মহত্ত্ব পূর্ণ হয়। কিন্তু যেখানে সে বিশেষ ব্যক্তি বা জাতিকে ধনী বা প্রবল করিয়া তুলিবার কাজে বিশেষ করিয়া নিযুক্ত হয়, সেখানেই তার ভয়ংকর পতন।”৩
সেই পতনের চিত্রই তিনি অঙ্কন করেছেন তাঁর ‘মুক্তধারা’ নাটকের মধ্য দিয়ে। উত্তরকুটের রাজা রণজিৎ শিবতরাই-এর প্রজাদের নিজের আয়ত্তে আনতে না পেরে সেই রাজ্যের জল সরবরাহের পথ বন্ধ করে তাদের জলকষ্ট ও চাষের ক্ষতি করে নিজের আজ্ঞার বশবর্তী করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাই যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দিয়ে তিনি বিরাটাকার বাঁধ নির্মাণ করে মুক্ত জলপ্রবাহের গতিরোধ করেন। কিন্তু পরিশেষে দেখা যায় রাজার পালিত পুত্র অভিজিৎ নিজের প্রাণের বিনিময়ে সেই বাঁধ ভেঙে শিবতরাই-এর মানুষদের রুদ্ধ জীবনের গতিকে আবার মুক্ত করে দিয়ে যান। কালিদাস নাগকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
“এই যন্ত্র প্রাণকে আঘাত করছে, অতএব প্রাণ দিয়েই সেই যন্ত্রকে অভিজিৎ ভেঙেছে, যন্ত্র দিয়ে নয়।”৪
যন্ত্র সভ্যতা মানুষকে যেমন উন্নত ও আধুনিক করে তুলেছে তেমনই এই যন্ত্র বহুমানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে মানুষ এমন এক পরিস্থির মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছেন যেখানে যন্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের জীবনকে। বর্তমানে বস্তি ভেঙে ফ্ল্যাট, জঙ্গল কেটে হোটেল নির্মাণ আমাদের চিরসবুজের দেশ থেকে আরও কৃত্তিম জীবনের দিকে নিয়ে যাছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষকে ধবংসের মুখে ঠেলে দেয়, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। ‘মুক্তধারা’ নাটকে দেখা যায় গুরুমহাশয় দায়িত্ব সহকারে ছোটো ছোটো বালকদের মধ্যে সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে দিয়েছেন। নাটকে পাই-
‘গুরু : যাতে উত্তরকুটের গৌরবে এরা শিশুকাল থেকে গৌরব বোধ করতে শেখে তার কোন উপলক্ষ্যই বাদ দিতে চাই নে।
রণজিৎ : বিভূতি কি করেছে এরা সবাই জানে ত?
ছেলেরা : জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন।
রণজিৎ : কেন দিয়েছেন?
ছেলেরা : (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্যে।
রণজিৎ : কেন জব্দ করা?
ছেলেরা : ওরা যে খারাপ লোক!’৫
শিশুমন সবথেকে পবিত্র, শুদ্ধ জাগতিক সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্ত। দার্শনিক ভাষায় সাদা কাগজের মতো যেখানে যেমনভাবে আঁচর কাঁটা হবে তেমন করেই সে জীবনের শিক্ষা লাভ করবে। শিক্ষকের কাজ দেশের ভবিষ্যৎ ছাত্রসমাজকে মহৎ আদর্শে গড়ে তোলা কিন্তু সেই শিক্ষক মহাশয় যখন এমন উগ্র জাতীয়তাবাদের শিক্ষা দেন তা ছাত্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই ভয়ংকর। গুরু মহাশয় বলছেন তার ছাত্রদের –
“কী রে, তোরা পড়িস নি- বইয়ে পড়িস নি ওদের ধর্ম খুব খারাপ।’৬
যে শিক্ষা অন্ধ ও সংকীর্ণ মতাদর্শে ছাত্রদের চালিত করে সে শিক্ষা মানবতার প্রতি হুমকির নামান্তর। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন মতের নিরিখে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। আমরা সবাই যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে আমাদের নিজেদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। অন্য ধর্মের প্রতি আমাদের মনকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা আমরা শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছি। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে জাতিগত বিদ্বেষ, হিংসা, বিভেদ সৃষ্টি করবে এবং মানবজাতি সংকটের মুখে পতিত হবে। এই নাটকে ভৈরবের মন্দিরে বাবা ভোলানাথের প্রতিষ্ঠা। উত্তরকূট বা শিবতরাইয়ের লোক জানে দেবাদিদেব মহাদেব অপার কৃপায় তাদের জল দান করেছেন। কিন্তু বুদ্ধির অহংকার ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দর্পে উত্তরকুটের মানুষ ভগবানের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চেয়েছে। নাটকে রয়েছে-
‘দূত : শিবতরাইয়ের প্রজারা এখনো এ খবর জানে না। তারা বিশ্বাস করতেই পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।
বিভুতি : দেবতা তাদের জল দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে বাঁধবার শক্তি’৭
সেই অহংকারের বশবর্তী হয়ে যন্ত্ররাজ বিভূতি তার শক্তি প্রদর্শনে নির্মাণ করেছে বিশালাকার বাঁধ আর আর নির্মাণ কাজের জন্য জোরপূর্বক তুলে আনা হয়েছে প্রজাদের যারা তাদের জীবনের বিনিময়ে জীবননাশের যন্ত্র বানিয়ে গেছে। বাঁধ নির্মাণের আনন্দে ভৈরবের পূজার আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু যখন দেবতাকেও তারা ভাগাভাগি করে কেবল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তখন সে পুজো আর শ্রদ্ধা ভক্তির নিবেদন থাকে না। আসলে উত্তরকূটবাসীর পুজো আর ভৈরবের পুজো হয়নি হয়েছে বিভূতির পুজো। আমাদের সমাজেও কি দেবতা কেন্দ্রিক বিভাজন চোখে পড়ে না? কোন বিশেষ দেবতার উপর কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষেরই অধিকার আছে বলে প্রচার করা হয় না? কোন কার্যসিদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষের প্রাণকে তুচ্ছ করে, মনুষ্যত্ব বোধকে হত্যা করতে দেখা যায় না? আমাদের চারপাশে একটু চোখ মেলে দেখলে এই সব কিছুই চোখে পড়ে। যে যন্ত্রসভ্যতায় আমরা নিজেদের আধুনিক ভাবতে শিখছি সেই যন্ত্রসভ্যতায় “পীড়িত হইতেছে মানুষের অন্তরাত্মা, তাহার মনুষ্যত্ব। কুমার অভিজিৎ মানুষের সেই নিপীড়িত অন্তরাত্মার প্রতীক।”৮
যন্ত্র একসময় যন্ত্রণায় পরিণত হয়ে যাবে না তো? তখন হয়তো আবারও কোনো অভিজিতের উত্থানের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে।
বেশিরভাগ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলে। সময় ও সমাজের বিধি নিষেধের ঘেরা টোপে বদ্ধ ঘরে চুপটি করে বসে থাকে নিশ্চিন্ত মনে। আর এই একই স্রোতে বইতে বইতে কয়েকজন ব্যতিক্রমি মানুষ স্রোতের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ায়। যেন মরা কাঠে ফুল ফোটে। ‘অচলায়তন’ নাটকে পঞ্চক ও দাদাঠাকুর সেই ফুল। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথা, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধকারের অজ্ঞানতায় ডুবে ছিল অচলায়তনের শিক্ষানিকেতন। শাস্ত্রের বিধান, নিয়ম নীতি, বিধি নিষেধের বাড়বাড়ন্তে তারা নিজেদের জীবনকে কোষে বেঁধে রেখেছিল। মন্ত্রপূত এই অচলায়তনের চারিদিকের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখা হত যাতে বাইরের এক বিন্দু আলো, প্রাণের হাওয়া ভিতরে ঢুকতে না পারে। নাটকে পাই –
‘সুভদ্র : আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক : পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র : সে আমি বলতে পারব না। ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে!
পঞ্চক : তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল্।
সুভদ্র : আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের –
পঞ্চক : উত্তর দিকের?
সুভদ্র : হ্যাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে –
পঞ্চক : জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র : বাইরেটা দেখে ফেলেছি।
…
দ্বিতীয় বালক : আমাদের আয়তনের উত্তর দিকেটা যে একজটা দেবীর।
তৃতীয় বালক : সেদিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তা হলে যে সে –
পঞ্চক : তা হলে কী?
তৃতীয় বালক : সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক : কী ভয়ানক, শুনিই না।
তৃতীয় বালক : জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
সুভদ্র : পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে?
পঞ্চক : শোন্ বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে। কিন্তু যাই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে’৯
যে ছাত্ররা নির্ভীক চিত্তে কঠিন পথে এগিয়ে যাবে দেশের সেই ভবিষ্যত সামান্য জানলা খোলা নিয়ে ট্রমায় আচ্ছন্ন। অন্ধ বিশ্বাস তাদের মনোবল ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে বিংশ শতকে লিখিত এই নাটক বর্তমান সময়েও একই ভাবে প্রযোজ্য। এই অংশ আমাদের সমাজের অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, পুঁথিগত বিদ্যার দমবন্ধ করা পরিবেশকে স্মরণ করায়। এই ধরণের মানুষেরা নিজেদের শাস্ত্রের মোড়কে আবৃত রাখতে পেরে গর্ববোধ করে ও আরও নিষ্ঠার সঙ্গে শাস্ত্র মেনে চলার অঙ্গীকার করে। এই নিয়ম নিষ্ঠা, আচার আচরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
“অনেক সময় ধর্ম সাধনায় দেখা যায়, কঠিনতাই প্রবল হইয়া ওঠে-… সে আপনার সীমার অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে বসে থাকে সে অন্যকে আঘাত করে তার মধ্যে কোন প্রকার নড়াচড়া নেই এইটা নিয়ে এসে গৌরব বোধ করে নিজের স্থানটি ছেড়ে চলে না বলে কেবল সে একটা দিক দিয়ে সমস্ত জগৎ কে দেখে এবং যারা অন্যদিকে আছে তারা কিছুই দেখছে না এবং সমস্তই ভুল দেখছে বলে কল্পনা করে”১০
আর অচলায়তনে এই কাঠিন্যই ছাত্রদের কোমল মনকে পদদলিত করে নিষ্প্রাণ করে তোলে। শাস্ত্রের পুঁথিগত বিদ্যা ও নিয়মের কাঁটায় যখন জীবন ক্ষত বিক্ষত, অন্ধ বিশ্বাসের জমাট বাঁধা মেঘে ঘনিয়ে আসে ঝড়, প্রায়শ্চিত্তের হাজার রকম বীভৎস রূপ মনের ভিতর ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে তখন দাদাঠাকুর অর্থাৎ গুরু আসেন এক পশলা বৃষ্টির পর হিমেল বাতাসের মতো। হাজারো বছরের জীর্ণ শুষ্ক শাস্ত্রের কাঁটা উপরে রোপন করেন বাহারি গোলাপ। মুক্তি পায় শেকল বাঁধা মন, খাঁচার পাখি দূর আকাশের নীলিমায় ডানা মেলে। নাটকের শেষে গুরু বলেছেন – “এতদিন ঘর বন্ধ করে ও মনে করেছিল চাকাটা খুব চলছে কিন্তু চাকাটা কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরছিল তা সে দেখতেও পায়নি। এখন আলোতে তার দৃষ্টি খুলে গেছে।১১
যে দমবন্ধ অন্ধকারময় পরিবেশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষেরা তৈরি করেছিল দাদাঠাকুর সেই অন্ধ বিশ্বাস, আনুগত্য, নিয়মের বেড়াজাল ভেদ করে জীবনের আলো নিয়ে এসেছেন। তাই আমাদের অপেক্ষা থাকবে সেই দাদাঠাকুর বা গুরু বা গোঁসাইঠাকুরের জন্য, নতুন কোনো কুসংস্কারমুক্ত ভোরের নরম আলোর প্রতীক্ষায়।
‘ডাকঘর’-এর অমল যেমন মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল রাজার চিঠির জন্য এবং তা সত্যি হয়েছিল। হয়তো অমলের মতো বিশ্বাসের দৃঢ়তায় সেই অপেক্ষার অবসান ঘটবে। বর্তমান সমাজে ‘ডাকঘর’ নাটকের কবিরাজ চরিত্রের মতো মানুষের কোনো অভাব নেই যারা বলে-
“হঠাৎ আজ একটা কেমন হাওয়া দিয়েছে, আমি দেখে এলাম তোমাদের সদর দরজার ভেতর দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইছে। ওটা একেবারেই ভালো নয়। ও দরজাটা বেশ ভালো করে তালাচাবি বন্ধ করে দাও।… ওই যে জানালা দিয়ে সূর্যাস্তের আভাটা আসছে ওটাও বন্ধ করে দাও”১২
এরা জ্ঞানের আলোকে রুদ্ধ করে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে যেতে চায় ডুবিয়ে দিতে চায়। বাইরের জগতের জানা অজানা গ্রহণ করতে ভয় পায় পরিচিত ঘেরাটোপে ঘুরে মরে। কুয়োর ব্যাঙ যেমন সমুদ্রকে ভয় পায় তেমনই অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এরা কেবল নিয়মের ছকে বাঁধা জীবনেই চলতে চায়। প্রাচীন মুনি ঋষিদের শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যায় ধর্মগত বিভ্রান্তিতে ভারতবর্ষ যেন এক অচলায়তনে পরিণত হয়েছে। সেই প্রাচীর ভাঙতে তাই রাজকবিরাজের মতো মানুষের দরকার যে বয়ে আনবে নতুন বার্তা, যে অমলের স্বপ্ন পূরণের মতো আমাদের সমাজেরও সব অন্ধকার দূর করে আলো নিয়ে আসবে, পরিবর্তনের ডাক দেবে –
“একি! চারিদিকে সমস্তই যে বন্ধ! খুলে দাও খুলে দাও, যতো দ্বার জানলা আছে সব খুলে দাও”১৩
ধর্ম’ শব্দটির অর্থ হল ‘যা ধারণ করে। ধৃ ধাতু + মন প্রত্যয় = ধর্ম। ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। যা ধারণ করে মানুষ সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পবিত্র জীবনযাপন করতে পারে তাকেই বলে ধর্ম। কিন্তু সেই ধর্মের অপব্যাখ্যা নষ্ট করেছে ধর্মের মূল সত্যকে। সাম্প্রতিক ধর্ম কেন্দ্রিক ঘৃণ্য রাজনীতি সমাজনীতি মানুষের মধ্যে বিভেদ বিভাজনের মাধ্যমে ধর্মের ভিতরকার পবিত্রতাকে কলুষিত করে চলেছে। যে ধর্ম মনুষ্যত্ববোধ উন্মেষ ঘটায়, যা হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম মমত্ববোধের জাগরণ ঘটায় সেই ধর্মের নামে প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে দেখা যায়- “ধর্মের অর্থহীন অন্ধসংস্কার ও চিরাচরিত যুক্তিহীন প্রথার সঙ্গে নিত্য সত্য মানব ধর্ম বা হৃদয়ধর্ম; মিথ্যা ধর্মবোধের সঙ্গে উদার মনুষ্যত্বের; মানুষের রচিত আচার বিধির সঙ্গে হৃদয়ের পরম সত্য প্রেমের; হিংসার সঙ্গে অহিংসার”১৪ দ্বন্দ্ব।
ধর্মের নামে নিরীহ পশুহত্যার মতো নৃশংস ঘটনাকে পুন্য পবিত্র চোখে দেখে ধর্মের সমর্থকেরা। রাজকীয় স্বার্থ সিদ্ধির কারণে বলি হতে হয় সাধারণ মানুষকে। যে ধর্ম রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে, পাশবিক হত্যায় উল্লাস অনুভব করে সে ধর্ম কখনোই জীবনের উন্নতি সাধন করতে পারে না। এই নাটকে সেই পশু হত্যায় উন্মত্ততা লক্ষ করা যায়। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমানিক্য মাতৃ পূজায় অহেতুক অবলা পশু হত্যায় কাতর হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পশু বলির নিষ্ঠুর নৃশংসতার স্বরূপ উন্মোচন করেছিল ভিখারিনী অপর্ণা। রাজা গোবিন্দমানিক্যের জ্ঞান চক্ষু উন্মিলীত হয় এবং তিনি জানান- “মন্দিরেতে জীববলি এ বৎসর হতে হইলো নিষেধ…বালিকার মূর্তি ধরে স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন জীব রক্ত সহে না তাহার”১৫
রাজা উপলব্ধি করেছিলেন নীচ স্বার্থ, ক্ষমতার দম্ভ, অন্ধ অজ্ঞানতা পশু বলির মতো বৃদ্ধ প্রথাকে কেবল স্ফীত করে তুলছে। কিন্তু ধর্মের ধ্বজাধারী রঘুপতি তার ব্যক্তি স্বার্থ, আত্মাভিমান, ব্রাহ্মণের গর্ব ও ক্ষমতার দম্ভে প্রবল বিরোধিতা করে ব্রহ্মশাপ দিয়েছেন- “অবিশ্বাসী, সত্যই কি হয়েছে ধারণা কলিযুগে ব্রহ্মতেজ গেছে-তাই কি এত দুঃসাহস? যায় নাই, সে দীপ্ত অনল জ্বলিছে অন্তরে, সে তোমার সিংহাসনের নিশ্চয়ই লাগিবে। নতুবা এ মনানলে পুড়াইব সব শাস্ত্র, সব ব্রহ্মগর্ব”১৬ গোবিন্দমানিক্যের শত বিরোধিতা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সত্বেও আজও মানুষের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হয়নি, আদিম পাশবিকতায় তারা রক্ত দর্শনে আনন্দ লাভ করে। সম্প্রতি বাংলা ধারাবাহিক ‘গৌরী এলো’-তে মা কালীর কাছে পশু বলির বিরোধিতা করতে দেখা গেছে স্বয়ং মাতৃরূপী মনুষ্য গৌরীকে। পশু বলির মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটে চলেছে কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে। পশুবলি নিয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। সে বিষয়ে সঠিক কোনটি তা আলোচনা সাপেক্ষ কিন্তু মানবতার দিক থেকে এ অহেতুক রক্তপাত কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়।
ধর্মের মূল কাজ হওয়া উচিত শান্তির বাণী প্রচার, সকলের মাঝে শুদ্ধতা পবিত্রতা ছড়িয়ে দেওয়া, প্রেম সাগরে এক তরীতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দেখা যায় ধর্মের কারণেই এত ভেদাভেদ, এত রক্তপাত, এত শ্রেণি বৈষম্য। ধর্ম যদি সমস্ত মানুষকে একই বিনি সুতোর মালায় গাঁথতে না পারে তাহলে সে ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভালো। অথচ বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। অস্পৃশ্যতা এক সামাজিক ব্যাধি আর এই ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজের বহু মানুষ বিশেষত উচ্চ অভিজাত মানুষ যারা নিজেদের সমাজের দণ্ড মুন্ডের মাথা বলে মনে করে। শ্রেণি বৈষম্য বা অস্পৃশ্যতার কারণে বলি হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চণ্ডালিকা’ নাটকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে এক সুন্দর বার্তা দিয়েছেন। চন্ডাল কন্যা প্রকৃতি কুয়োর ধারে গরু চড়াতে গেলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুক তার কাছে তৃষ্ণার জল চায় প্রকৃতি নিজের সামাজিক পরিচয় দিলেও মহৎ উদারতায় বলেন-
“শ্রাবণের কালো মেঘকে চন্ডাল নাম দিলেই বা কী, তাতে তার জাত বদলায় না, তার জলের ঘোচে না গুন। তিনি বললেন নিন্দে করো না নিজেকে। আত্মনিন্দা পাপ, আত্মহত্যার চেয়ে বেশি”১৭
জন্ম থেকেই প্রকৃতি নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সে জানে সে সমাজের আর পাঁচ জন মানুষের কাছে অস্পৃশ্য। সে নিজের মতো করে জীবনধারণ করে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী, কখনো কারো অনিষ্ট করে না অথচ সমাজ তাকে ব্রাত্য করেছে। সমাজে থেকেও সে অনেকদূরর মানুষ। কিন্তু ক্লান্ত ক্লিষ্ট বৌদ্ধ পথিক তাঁকে জানিয়ে যায় জীবনের সারসত্য –
“যে মানুষ আমি, তুমিও সেই মানুষ, সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে তৃপ্ত করে তৃষিতকে”১৮
বৌদ্ধ ভিক্ষুকের এই বাক্য বদলে দেয় প্রকৃতির সমগ্র জীবন দর্শনকে। সে নতুন করে ভাবতে শেখে, সমাজের নির্মিত বেড়াজাল ভেদ করে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। তার মা তাকে বারবার জন্ম পরিচয় সম্পর্কে বোঝাতে চাইলেও সে বলে–
“মিথ্যে নিন্দে রটাসনে নিজের, পাপ সে পাপ! রাজার বংশে কত দাসী জন্মায় ঘরে ঘরে, আমি দাসী নই। ব্রাহ্মণের ঘরে কত চন্ডাল জন্মায় দেশে দেশে, আমি নই চন্ডাল”১৯
একজন ব্রাত্য মানুষ খুঁজে পাচ্ছে নিজের মানব পরিচয়, মনুষ্যত্ব বোধই একমাত্র মানুষের প্রথম ও প্রধান পরিচয় বৃদ্ধ ভিক্ষুক তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কত সহজভাবে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে অস্পৃশ্যতা অনেকখানি হয়তো দূর হয়েছে যে প্রবল প্রকট রূপে শ্রেণি বৈষম্য ছিল আধুনিকতার কালে তা খানিকটা পরিশীলিত হয়েছে কিন্তু মুছে যায়নি। আজও খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে এমন বহু ঘটনা চোখে পড়ে যা পূর্বের সময়কালকে স্মরণ করায়। গ্রামে গঞ্জে এখনও অস্পৃশ্যতা নিয়ে ঘটে যায় পাশবিক ঘটনা। এই ভয়াবহ অস্থির সময়ে তাই বারেবারে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। এই সময়ে যে মানুষগুলো নিজের সামাজিক পরিচিত নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না তাদের বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ডকে সোজা করতে ‘চন্ডালিকা’-র মতো নাটক প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটি বৈশিষ্ট্য স্বরূপ বলা যায় তিনি প্রথমে কোনো সমস্যার কথা বলেছেন তারপর তা থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন বা এমন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন যে আলোর দিশা দেখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে আমাদের যাপনে আমাদের মননে। তিনি চিরকালীন, তাঁর চিন্তা ভাবনা ও সাহিত্যকর্ম কালজয়ী রূপে বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। পুঁজিবাদী সমাজের স্বরূপ থেকে শুরু করে, যন্ত্র সভ্যতার কুফল, অন্ধ কুসংস্কার ও পুঁথিগত বিদ্যার চর্চা, আবার ধর্মকে ব্যবহার করে বিভেদ বিভাজন ও পশুবলির মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, কখনো শ্রেণি বৈষম্য অস্পৃশ্যতা এই সব কিছুই রবীন্দ্রনাথের নাটকে রয়েছে যা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি আমাদের সমাজ। দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ সমাজের মূল সমস্যাকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে কারণে তার আশু সমাধান দিয়ে গেছেন নাটকের মধ্য দিয়ে। পরিশেষে বলা যায় সময়ের সিড়ি বেয়ে যুগ বদলালেও মেরুদণ্ডের ক্ষত এখনও সারেনি। তাই সেই ক্ষত সারাতে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে হবে। সময়ের প্রতি বাঁকে বাঁকে তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র নাট্যচর্চা।
■ তথ্যসূত্র –
১) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ৩১০
২) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ৩২২
৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালান্তর (স্বাধিকারপ্রমত্ত:), ১৩৫৫ পৌষ, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলকাতা, পৃ. ১১৬
৪) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ৩০৭
৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুক্তধারা, ১৪১৭ বৈশাখ, কবিতা পাক্ষিক, কল ০৯, পৃ. ১৬
৬) তদেব, পৃ. ১৬
৭) তদেব, পৃ. ৭
৮) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ৩০০
৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অচলায়তন, ১৪২৭ বৈশাখ, কবিতা পাক্ষিক, কল ০৯, পৃ. ১৩-১৪
১০) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ২৩৬
১১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অচলায়তন, ১৪২৭ বৈশাখ, কবিতা পাক্ষিক, কল ০৯, পৃ. ৭৮
১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডাকঘর, ১৪২৭ বৈশাখ, কবিতা পাক্ষিক, কল ০৯, পৃ. ২১
১৩) তদেব, পৃ. ২৪
১৪) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবিন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, ২য় সং, ১৩৬৬, ওরিয়েন্ট বুক ডিস্টিবিউটরস, কল ১২, পৃ. ১২৮
১৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিসর্জন, ১৩৪১ বৈশাখ, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কল ১৭, পৃ. ২০
১৬) তদেব, পৃ. ৪৬
১৭) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চণ্ডালিকা, ১৩৪৩ ভাদ্র, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলকাতা, পৃ. ৩
১৮) তদেব, পৃ. ৪
১৯) তদেব, পৃ. ১৩-১৪
/ — /