।। অণুবীক্ষণে রবীন্দ্র নাটক : সন্ধানী দৃষ্টিতে বর্তমান সময় ।।
কলমে : মধুরিমা চ্যাটার্জী।
সাউন্ড, লাইট, ক্যামেরা…অ্যাকশন। হঠাৎ করেই এক মানুষের আরেক মানুষ হয়ে ওঠা। সহজ কথায়, যেটা নয় সেটা ফুটিয়ে তোলা। না, সিনেমা বা অভিনয় নিয়ে আমি আজ কোনো কথাই বলবো না। বরং এই পথটা ধরে আরেকটু গোড়ার দিকে এগোব। একটু পরিষ্কার করে বললে দাঁড়ায় , আমার আলোচনার বিষয় নাটক। সেটা বোধহয় আমার লেখার শিরোনামই বলে দিচ্ছে। কাঠের ‘স্টেজ’, দুধারে লাইন করে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘উইংস’, শব্দ ছড়িয়ে দিতে তৎপর ‘মাইক’, পর্দা সরার সাথে সাথে সোনালী আলোর ঝলকানি, একাধিক কুশীলব এবং তাদের অভিনয় প্রতিভা— এই সবকিছুই পর পর থরে থরে মনে পড়ে যাচ্ছে তো ‘নাটক’ এই তিন অক্ষরের শব্দটা শুনলে? যত দিন এগিয়েছে ততই বদলেছে মঞ্চসফল নাটকের সংজ্ঞাটা। যেকোনো কাজেরই আগে থাকে তার সলতে পাকানোর কাজ। আর নাটকের ক্ষেত্রে এই কাজটি মূলত করে থাকেন একজন নাটককার তাঁর রচনা দক্ষতার মধ্য দিয়ে। যেকোনো শিল্পকর্মের সৃষ্টিবীজ লুকানো থাকে সমকালের মধ্যে। বাস্তবকে বাদ দিয়ে সৃষ্টিকর্ম জারি রাখা এককথায় অসম্ভব। কাব্যনির্মাণের যে কৌশলের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাকে একটু সহজ করে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে বলা যায় যে, একজন স্রষ্টা লৌকিক জগত থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন এবং তাতে নিজের মনের ভাব মিশিয়ে যা নির্মাণ করেন তাই হয়ে ওঠে তাঁর ‘সৃষ্টি’ এবং পরবর্তীতে তা সমাদৃত হয় ‘সহৃদয় সামাজিক’-এর কাছে। সুতরাং যেকোনো শিল্পকর্মের নির্মাণে সমকালকে উপেক্ষা করে ঘটমান বর্তমানের বাস্তবতা থেকে একজন স্রষ্টার নিজেকে সরিয়ে রাখা বেশ কঠিন।
কল্পকাহিনির সুবাদে অনেকেই জানেন যে, যদি অতীতে ফিরে যেতে হয় তাহলে প্রয়োজন হয় টাইম মেশিনের। কিন্তু যদি ভবিষ্যতটা জানা যেত তাহলে বোধহয় আরো ভালো হত। আর আমি যদি বলি সেটাও সম্ভব। খুব অবাক লাগছে তো? কথার প্যাঁচে না ফেলে বরং আপনাদের অবাকভাবটা একটু কাটিয়ে দিই। প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শঙ্খচিল’ কবিতায় যা লিখেছেন তা বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। ‘আমাদের দেখা হোক সুস্থ শহরে’ – এ আর্জি এখন প্রতিটা সাধারণ মানুষের। এ তো গেল কবিতার কথা। আর যদি নাটকের কথা ধরি তাহলে বলতে পারি এমনভাবেই রবীন্দ্রনাথেরও একাধিক নাটকে ঠিক এখনকার সময়টাকে সহজাত ভঙ্গিতে ধরা আছে। নাটককার রবীন্দ্রনাথ যেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তাই তো ‘তখনকার’ সময়পর্বে দাঁড়িয়ে শব্দ-বাক্যের তুলিতে ‘এখনকার’ সময়পর্বের একটা ছবি এঁকে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকের ক্যানভাসে।
বহুবছর আগের রচিত নাটকে বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতার ঘন বুনোট জড়ানোর কাজটা কিন্তু খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ মূলত এর জন্য ‘তত্ত্ব’-এর আশ্রয় নিয়েছিলেন। করেছিলেন রূপক-সংকেত ও চিহ্ন-প্রতীকের ব্যবহার। তবে এই তত্ত্বের আড়ালে বরাবরই বিরাজ করেছে সত্য। এই প্রসঙ্গেই স্বল্প কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
টমাস কার্লাইল জানাচ্ছেন, যে যুগ প্রতীককে মর্যাদা এবং উচ্চমূল্য দেয় সেই যুগই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কী এই ‘প্রতীক’? ইতিহাসকে প্রশ্ন করলে জানা যায়, এই ‘প্রতীক’ কথাটার উৎপত্তি মূলত গ্রীক শব্দ ‘সিমবোলান’ থেকে। প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি থেকে প্রতীকের উৎপত্তি হয়েছে এবং পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিস্তৃতি লাভ করেছে ইহুদীদের হাত ধরে। আমরা একথা জানি যে, ভাষা আবিষ্কারের ফলেই মানুষ তার মনের ভাবকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করার অবকাশ পেল। এই ভাষা মূলত এবং প্রধানত চিহ্ন এবং প্রতীক। এরই সাহায্যে মানুষ আপন কামনা-বাসনা, ভাব-কল্পনা ও আবেগ প্রকাশ করে থাকে। তাই চিন্তার চিহ্ন বা প্রতীক ব্যতিরেকে ভাষার নিজস্ব কোনো মূল্যই নেই।
অন্যদিকে ল্যাংগার (Langer) তাঁর ‘ফিলোজফি ইন আ নিউ কিই ইন আ নিউ কিই ইন আ নিউ কিই’ (Philosophy in a new key) গ্রন্থে দুইপ্রকার চিহ্নের কথা বলেছেন-
১/প্রাকৃতিক চিহ্ন
২/কৃত্রিম বা মনুষ্যসৃষ্ট চিহ্ন
চিহ্ন কোনো একটি নির্দিষ্ট ‘কিছু’র দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়। অন্যদিকে প্রতীকের মধ্যে থাকে আলো-আঁধারী ভাব। প্রতীক গোপনীয়তা এবং প্রকাশের সমন্বয়। বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলতে কিছু উদাহরণের আশ্রয় নেওয়া যাক। রাজমুকুট বা রাজদন্ড রাজার চিহ্ন কিন্তু দুটোই আবার রাজশক্তি এবং মর্যাদার প্রতীক। অন্যদিকে নারীর সিঁথির সিঁদুর যেমন বিবাহের চিহ্ন তেমনই আবার সতীত্ব, পবিত্রতা, নারীত্বের মহিমার প্রতীক। সুতরাং এটা বোঝা যাচ্ছে যে, প্রতীক এবং চিহ্ন এক নয়। উভয়ের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য।
চিহ্ন-প্রতীকের পাশাপাশি রূপক ও সাংকেতিক নাটক নিয়েও দু-চার কথা বলা প্রয়োজন।
রূপক ও সাংকেতিক মূলত দুটি ভিন্ন মাত্রার নাটক। কারণ সাংকেতিকের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সিম্বলিজম’ (Symbolism) আর রূপকের ‘অ্যালিগরী'(Allegory)। রূপকে যথেষ্ট সরলতার সঙ্গে বলা হয় নীতিগর্ভ কাহিনি। কাহিনির ওপর অংশে একটা অর্থ থাকে, কিন্তু সেই কাহিনির ভেতরে অর্থাৎ মর্মাংশে আর একটি অর্থ সমান্তরাল রেখায় বিধৃত থাকে।
রূপকে তাই ওপরের অর্থটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আভ্যন্তরিক অর্থ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এর মধ্যে একটি নীতি প্রচারের বিষয়ও থাকে।
সাংকেতিক রচনায় কোনো নীতি প্রচারের বালাই থাকে না, যে সত্য অশরীরী এবং ইন্দ্রিয়াতীত , যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, যা শুধু ব্যঞ্জনায় আভাসিত অপার্থিব কিন্তু অনুভবগম্য, সেই সত্যকে বোঝাবার চেষ্টা করে থাকেন লেখক। যাকে রূপে ধরা যাচ্ছে না সেই অরূপকে শিল্পী মূর্ত করার চেষ্টা করেন সংকেতের সাহায্যে। এখানে বাচ্যার্থ প্রধান নয়, ব্যঙ্গ্যার্থই প্রধান। স্রষ্টার মনে যে ভাবজগতের উদয় হয়- পরিচিত রূপের মাধ্যমে অনেক সময় তার বর্ণনা করা চলে না, অথচ মনের তীব্র আকুলতাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না, তাকে প্রকাশ করতেই হয়। সংকেতের সাহায্যেই তা ব্যক্ত হয়।
নাটক , নাটকে ব্যবহৃত চিহ্ন-প্রতীক এবং নাটকের দুই রকমফের রূপক এবং সাংকেতিক নাটক নিয়ে অল্প কথায় কিছু তথ্য দিয়ে রূপরেখাটি ফুটিয়ে তুললাম। আলোচনাক্রমে আমরা দ্বিতীয় অংশের একেবারে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। এই অংশে রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু নাটকের সেই সেই জায়গাগুলো ছুঁয়ে যাব যেখানে বর্তমান সময় প্রাসঙ্গিকতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে।
সময়টা ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ(১৩১৫ বঙ্গাব্দ), যাত্রার ভঙ্গিতে রচিত হল “শারদোৎসব“; রবীন্দ্রনাথের প্রথম ঋতু উৎসবের নাটক। মঞ্চ রূপায়ণে কিছু অসুবিধা, “শারদোৎসব” সংশোধিত হয়ে হল “ঋণশোধ”। প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরি হলে মানবহৃদয় কীভাবে সংকীর্ণতা মুক্ত ও উদার হয় তাই দেখানো হয়েছে এই নাটকে।
যদি নাটকটির দ্বন্দ্বের অনুসন্ধান করি তাহলে প্রথম দৃশ্যেই যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল – সংকীর্ণ নীরস জীবনের সঙ্গে উন্মুক্ত প্রাণের তথা আনন্দবোধের দ্বন্দ্ব। নাটকে বালকের দল প্রকৃতির সঙ্গে মিলে গেছে ছুটির আনন্দ উপভোগ করতে –
“কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই।”
মূলত মানুষের সঙ্গে , প্রকৃতির সঙ্গে তখন তাদের মিলে যাবার আকাঙ্ক্ষা –
“রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু
চরাব আজ সাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু
চাঁপার বনে লুটি।”
এখনকার অর্থাৎ বর্তমান যে যুগচেতনা তা হল স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। আর এই স্বাতন্ত্র্যের বোধ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন তার ভোগচেতনাই বড় হয়ে ওঠে। ‘কী দিতে পারি’ এই বোধ লুপ্ত হয়ে যায় ‘কী আদায় করতে পারি’ এই বোধের গাঢ়ত্বে এবং প্রকটতায়। “শারদোৎসব”-এর এই বিশ্বচেতনার সঙ্গে স্বার্থচেতনার দ্বন্দ্বটাই প্রতিফলিত হয়েছে “ঋণশোধ”-এ। বক্তব্যে স্পষ্টতা আনতে রাজা বিজয়াদিত্য এবং মন্ত্রী সুভূতির রাজনীতি বোধের মধ্যে প্রতিফলিত আলোচ্য দ্বন্দ্বের পরিচায়ক এমন একখন্ড সংলাপ উদ্ধৃত হল-
“মন্ত্রী: রাজ্য রাখতে গেলে রাজ্য বাড়াতে হবে…কেবলই জয় করতে হবে, কেননা প্রতাপ জিনিসটা যেখানে থামে সেইখানে নিবে যায়।”
“বিজয়াদিত্য: রাজ্যের লোভ মিটবে বলেই আমি রাজত্ব করি, বাড়বে বলে নয়। রাজা হয়েছি বলেই দেখতে পেয়েছি রাজ্যটা কিছুই নয়।”
বিজয়াদিত্য প্রকৃত রাজার ন্যায় সকলের মধ্যে নিজের হৃদয়রাজ্যবিস্তার করতে চান। আর মন্ত্রী সুভূতি যে রাজ্যবিস্তারের কথা বলেন তা মানুষে মানুষে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে – স্বার্থবোধের দ্বারা তা খন্ডিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষের মনই সংস্কারের খাঁচায় আটকা পড়েছে। সংস্কার ভালো, কিন্তু কিছু সংস্কার অপদেবতাস্বরূপ মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে তার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়। তাই “ঋণশোধ“(ভূমিকা অংশে)-এ বিজয়াদিত্যের অনুভব :
“আমাদের বংশে যতদিন যত রাজা হয়েছে সকলের বয়স একত্র হয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।”
রাজা হওয়ার এই বয়সের বোঝা কাঁধ থেকে নামাতে হলে সিংহাসনের অহমিকা ত্যাগ করে মিলে যেতে হবে বাইরের সকলের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাই শেখরকে দিয়ে স্মরণ করিয়েছেন,
“সিংহাসন থেকে একবার মাটিতে পা ফেলেন দেখি। ওই মাটির মধ্যে জীবন যৌবনের জাদুমন্ত্র রয়েছে।”
‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’তে রবীন্দ্রনাথ তাঁর “শারদোৎসব”সম্বন্ধে জানাচ্ছেন-
“ওটা হচ্ছে ছুটির নাটক”।
তবে এই ছুটির অর্থ ফাঁকি নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
“কর্ম থেকে মাঝে মাঝে আমরা যে এইরূপ অবসর লই সে কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য নয়—-কর্মের সঙ্গে যোগকে নবীন রাখবার এই উপায়।… মাঝে মাঝে কর্মক্ষেত্র থেকে যদি এইরকম দূরে না যাই তবে কর্মের যথার্থ তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারি নে।”
কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমরা এতটাই কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাই যে জীবনটা শুধুই বয়ে চলে তার ‘নটা-পাঁচটা’র সংকীর্ণ খাতে। বৃহত্তর অর্থে আমরা জীবন উপভোগ করা থেকে থাকি যোজন দূরে। এ তো জীবন ‘যাপন’ নয়, অস্তিস্ত্ব টিকিয়ে রাখার ইঁদুর দৌড়।
আনুমানিক ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ়, রবীন্দ্রনাথ তখন বাস করছেন শিলাইদহে। এইসময় পর্বে যে নাটকটি পূর্ণতা পাচ্ছে তা হল ‘অচলায়তন‘(১৯১২খ্রিঃ)। নিষ্ঠুর প্রথা ও প্রাণের দ্বন্দ্বের শেষে প্রাণের জয় ঘোষিত হয়েছে ‘অচলায়তন’-এ।
এই নাটকের অভিনয় উপযোগী সংক্ষিপ্ত রূপই হল ‘গুরু’র রচনাকাল ১৯১৮খ্রিস্টাব্দ। রবীন্দ্র রচনাবলীর এয়োদশ খন্ডের গ্রন্থপরিচয় অংশ জানাচ্ছে যে, অচলায়তনের ‘কিঞ্চিৎ রূপান্তরিত এবং লঘুতর আকার’ হল ‘গুরু’। এই রূপান্তরে নাটককার অনেক অংশ যেমন বর্জন করেছেন তেমনি কয়েকটি নতুন অংশ সংযোজিতও হয়েছে। তবে শুধু যে অভিনয়ের দিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে তা নয়, ‘তত্ত্ব’-এর দিক দিয়েও ‘গুরু’ সার্থকতর হয়ে উঠেছে।
নাটকটির মূল সংঘাত যেখানে তা হল, হৃদয়কে পাখির ন্যায় আনন্দ উদ্বেল করে রাখতে হবে , না, যন্ত্রের ন্যায় মন্ত্র অভ্যাস করে বাইরের পৃথিবীকে ভুলে থাকতে হবে। পুরাতনের জায়গায় নতুনের উদ্ভাবন করা চাই , না, পুরাতনকে ধরে রাখাতেই জীবনের সার্থকতা। নাটকের অন্যতম মূল চরিত্রদ্বয় পঞ্চক এবং মহাপঞ্চক -এর ভাব সংঘাতের মধ্য দিয়ে নাটকের দ্বন্দ্ব এবং তত্ত্ব উভয়ই সন্নিহিত।
মন্ত্র যখন মননে সাহায্য করে না, যখন তা স্বার্থরক্ষার উপায় স্বরূপ হয়ে উঠে জীবনকে বিশুদ্ধ করে তোলে তখন মানবতার জন্যই তাকে আঘাত দেওয়া প্রয়োজন। কতকগুলি বিশেষ শব্দসমষ্টির মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে এই বিশ্বাস যখন মানুষের মনকে পেয়ে বসে তখন সে আর সেই শব্দের উপরে উঠতে চায় না, তখন মনন হারিয়ে সে উচ্চারণের ফাঁদেই জড়িয়ে পড়ে। তখন চিত্তকে যা মুক্ত করবে বলে রচিত তাই-ই চিত্তকে বদ্ধ করে। এবং দাঁড়ায় এই , মন্ত্র পড়ে দীর্ঘজীবন লাভ করা, শত্রু জয় করা ইত্যাদি নানাপ্রকার নিরর্থক দুশ্চেষ্টায় মানুষের মূঢ় মন প্রলুব্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে।
‘অচলায়তন‘ নাটকেও সেই মন্ত্রের কথা পাই যা মননে সাহায্য করে না, বরং তা ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যে আবদ্ধ করে। এখানে মন্ত্রের অলৌকিক শক্তিতে সকলের বিশ্বাস উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়, ‘ওঁ তট তট তোতয় তোতয়‘ মন্ত্র ‘প্রত্যহ সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে ঊনসত্তরবার করে জপ করলে নব্বই বৎসর পরমায়ু হয়।’ দীপকেতন পূজায় ডুমুরতলা থেকে মাটি নিয়ে পঞ্চগব্য মেখে বিরোচন মন্ত্র পড়তে হবে। তারপর সেই মাটি দিয়ে ছোট ছোট মন্দির গড়ে তার উপর ধ্বজা বসাতে হবে। এইরূপ হাজারটা গড়ে সূর্যাস্তের পর জলগ্রহণ করলে তবে প্রেতলোকে পিতামহদের ঘর তৈরি হয়। এই প্রকার ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যমূলক মন্ত্রকেই রবীন্দ্রনাথ কটাক্ষ করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যটুকু উপলব্ধি করতে পারলেই ‘অচলায়তন’ -এর তত্ত্ব সহজ স্পষ্টতার সঙ্গে ধরা দেয়।
নাটকে সুভদ্র তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বন্ধ আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে। উত্তর দিকটা একজটা দেবীর এবং এটা একটা ভয়ঙ্কর পাপ কাজ। তাই প্রয়োজন প্রায়শ্চিত্তের। কিন্তু তিনশো বছর ঐ প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয়নি বলে আচার্য এবং উপাধ্যায় সকলেই ভুলতে বসেছেন। একমাত্র যিনি এর সন্ধান দিতে পারেন তিনি হলেন মহাপঞ্চক। পুঁথির পান্ডিত্য এবং শুষ্ক সংস্কারে নিজেকে ঘিরে রাখা এক মানুষ। নিয়মতান্ত্রিক পথই তার একমাত্র পথ। বর্তমান সময় পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও অনেকটা এইরকম। মহাপঞ্চক এবং অচলায়তনের একাধিক কঠিন ও কঠোর নিয়মের চাপে পড়ে যেমন কুশলশীলদের করুণ অবস্থা তেমনি স্কুলের প্রাণহীন পাঠ্যবই, বিস্তর সিলেবাস ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের পাহাড় তুলতে গিয়ে নিঃশব্দেই চাপা পড়ে যায় রঙিন ফুলের মতো শৈশব আর তার স্বপ্নগুলো। পড়াশোনাটা আত্মস্থ নয়, মুখস্থ করে সাফল্য হাসিল করতে চায় এখনকার পড়ুয়ারা।
“অচলায়তন”-এর পাশে একই সময়মঞ্চের উপর দাঁড়াচ্ছে রবীন্দ্রনাথেরই অপর একটি ছোট্ট নাটিকা “ডাকঘর“(১৯১২খ্রিঃ)। প্রধান চরিত্রে পাই অমল নামের ছোট্ট একটি ছেলে।
আত্মা মুক্ত নাকি পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত – এই প্রশ্ন মূলত দার্শনিকদের। তবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন যে পরিবেশ বাধাদানের চেষ্টা করলেও আত্মা শরৎকালের রৌদ্রের মতই বিশুদ্ধতায় ঝলমল করে এবং বায়ুর মত মুক্ত। অবিদ্যার দ্বারা আবৃত থাকে বলে সে তার স্বরূপ চিনতে পারে না। নাটকে অমলরূপী আত্মাকেও তাই নানা বাধানিষেধের শিকলে আটকে রাখার চেষ্টা দেখতে পাই –
“কবিরাজ : ওকে বাইরে একেবারে যেতে দিতে পারবেন না।
মাধবদত্ত : ছেলেমানুষ, ওকে দিনরাত ঘরের মধ্যে ধরে রাখা যে ভারি শক্ত।
কবিরাজ : তা কী করবেন বলেন। এই শরৎকালের রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ঐ বালকের পক্ষে বিষবৎ।”
অনেক সময় মনে সংশয় জাগে যে এই বস্তুতান্ত্রিক জগতে যেখানে লাভ এবং লোভই বড় হয়ে উঠেছে সেখানে কি কোনো ভালোবাসার মর্যাদা আছে! নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এই অন্ধজগতে কেবলই দিকভ্রষ্ট হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। নাটককার রবীন্দ্রনাথ তার উত্তর মুক্ত আত্মা অমলের মধ্য দিয়েছেন। ভালোবাসার টান বিরূপ মনেও ভালোবাসার আলো জ্বালায়। অমল যখন দইওয়ালাকে ডাকে তখন অকারণ আহ্বানে দইওয়ালা অসন্তুষ্টই হয়েছিল –
“অমল : দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা।
দইওয়ালা : ডাকছ কেন। দই কিনবে?
অমল : কেমন করে কিনব। আমার তো পয়সা নেই।
দইওয়ালা : কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন।”
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মার মধুর স্পর্শে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে গেল। বস্তুগত লাভ আর সীমিত সময় তুচ্ছ হয়ে গেল দইওয়ালার কাছে –
“দইওয়ালা : বাবা, এক ভাঁড় দই তুমি খাও।
অমল : আমার তো পয়সা নেই।
দইওয়ালা : না না, না না -পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই একটু খেলে আমি কত খুশি হব।
অমল : তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল।
দইওয়ালা : কিচ্ছু দেরি হয় নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।”
অন্যদিকে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসার প্রতিমূর্তি সুধার মধ্যেও প্রথমে ধরা পড়ে সাধারণ জাগতিক ভালোবাসার স্বরূপ যখন সে বলে ওঠে,
“ফুল অমনি কেমন করে দেব। দাম দিতে হবে যে।”
কিন্তু পরিশেষে তারও মোহ ভেঙে যায়। জাগতিক ভালোবাসার উপর কামনাহীন প্রেমের পতাকা ওড়ে যখন সুধা জানায়, সুধা তাকে ভোলে নাই।
লাভক্ষতির হিসাবে মাপা সম্পর্ক গুলোর মধ্যেকার দূরত্ব ও সংকীর্ণতা কাটুক। আত্মারই আপন করার ছন্দ বাজুক মধুর সুরে এমনটাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের মতই আমাদের সবার আশা।
যন্ত্রের অসহিষ্ণু বন্ধনের উপরে জয়যুক্ত হচ্ছে মুক্ত প্রাণের অবাধ লীলা রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ (১৯২২ খ্রিঃ) নাটকে। নদী আটকে বড় বাঁধ দেওয়ার যে বিশ্বব্যাপী প্রবণতা একশো বছর আগে মাথা চাড়া দিয়েছিল, তার বিপদের জায়গা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন নাটককার –
‘পথিক। আকাশে ওটা কী গড়ে তুলেছে? দেখতে ভয় লাগে।
নাগরিক। জান না? বিদেশী বুঝি? ওটা যন্ত্র।
….
পথিক। বাবা রে! ওটাকে অসুরের মাথার মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা। তোমাদের উত্তরকূটের শিয়রের কাছে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে; দিনরাত্তির দেখতে দেখতে তোমাদের প্রাণপুরুষ যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।’
সাম্প্রতিককালে মানবসভ্যতা পরিণত হয়েছে যন্ত্রসভ্যতায়। মানুষ যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে না যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এটা এখন বড় প্রশ্ন। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী শক্তির উগ্রতায় চাপা পড়েছে প্রাণের স্পন্দন ও মানবিক সম্পর্কের সাধারণ প্রকাশ। একান্ত নিজস্ব অভিব্যক্তি হারিয়ে মানুষ এখন অনেকাংশেই যান্ত্রিক। শক্তি দেবতারই ঐশ্বর্য। একথা ভুললেই অনর্থ সৃষ্টি হয়। যেমনটা এই নাটকে দেখি বিভূতির ক্ষেত্রে। দেবতার কাজ করার জন্য নয় বরং দেবতার হাতে বেড়ি পরাবার চেষ্টা করেছেন তিনি। উত্তরকূট যখন শিবতরাই এর প্রজাদের কিছুতেই বাধ্য করতে পারল না তখন বিভূতি দেবতার দেওয়া মুক্তধারার জলকে আয়ত্ত করে বিরোধী প্রজাদের বশ মানাবার উপায় বার করেছিল। অহংবোধ যে খন্ডতার সৃষ্টি করে তারই প্রমাণ পাই আমরা।
শুধু নদী বাঁধই নয়, নদীর অপর্যাপ্ত জল ছাড়ার ফলে ভেসে যায় অনেক জেলা-পরগনা। স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি হারিয়ে মানুষ পথে বসে। মনুষ্যেতর প্রাণীরাও পড়ে বিষম সংকটে। শুধু রাজশক্তির অঙ্গুলিহেলনে নদীর জলের তোড়ে ভেসে যায় মানুষ। তবু তো বজায় থাকে রাজনীতির আস্ফালন। পূর্ণতা পায় ভোগের লালসা। আর এইভাবেই চলতে থাকে ক্ষমতা কায়েম করার জঘন্য খেলা।
নদী-রাজনীতি এই মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশের এক সংঘাতের ক্ষেত্র। জাতীয়তাবাদ কেন সংকীর্ণ করছে আমাদের দৃষ্টিকে, কীভাবে বাঁধ তুলে দেশে দেশে বৈষম্য বাড়ছে তার কথা এখন বাসি হলেও ভয়ঙ্কর সত্যি। মানবজীবনের স্বচ্ছন্দ ও অবিরাম গতি মুক্তধারা। কিন্তু যন্ত্রশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আজ বিশ্বের কত জাতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল জাতিকে অত্যাচার করছে , পদানত করে রাখার চেষ্টা করছে তার নানা নজির আমরা প্রায়শই দেখতে পাই।
১৩৩০ সাল, রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করছেন শিলঙে। এই সময়পর্বে ভাবনা স্তর বেয়ে কাগজে কলমে মূর্ততা পাচ্ছে নাটক ‘যক্ষপুরী‘। পান্ডুলিপিতেই থাকাকালীন ‘যক্ষপুরী’ হয়ে উঠছে ‘নন্দিনী’। ‘প্রবাসী’র ১৩৩১ সালের আশ্বিন সংখ্যায় এই ‘নন্দিনী’ ই কিছু পরিবর্তিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘রক্তকরবী‘ (১৯২৩খ্রিঃ) নামে।
এই নাটকের দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রস্তাবনা’য় বলেছেন –
“কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।”
নাটকে সেই আকর্ষণজীবী মকররাজের যক্ষপুরীকেই দেখানো হয়েছে, অপরদিকে কর্ষণজীবীদের প্রতিভূ করা হয়েছে নন্দিনীকে। নন্দিনীর পরণে সেইজন্যই ধানী রঙের শাড়ি-মরা সোনার তালের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকা সোনার ধান। এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টিতে বিশেষ স্থান পেয়েছে পৌষের গানটি, যেটি অনুপস্থিত কর্ষণজীবীদের এবং যক্ষপুরীর সংখ্যায় পরিণত হওয়া মানুষগুলির অবচেতন মনের দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। শ্রম ও শ্রমিকের যে অবমাননা দেখানো হয়েছে এবং তারই সাথে যেভাবে মানুষের ব্যক্তিপরিচয় মুছে দিয়ে তাকে সংখ্যায় রূপান্তরিত করা হয়েছে ,তা আজকের কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডেও সমান সত্য।
১৩৩০ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যা। ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয় ‘রথযাত্রা‘ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটিকা। ‘রথের রশি‘ তারই পরিবর্তিত ও আগাগোড়া পুনর্লিখিত রূপ।
এই নাটকের রথ মানব সমাজের প্রতীক। সমাজ বহমান, আর তার এই বয়ে চলাতেই সৃষ্টি হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস। আদি যুগে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করেছেন পুরোহিতেরা। তাদেরকে ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যেকার যোগসূত্র বলে একদিন মনে করা হত। মন্ত্রতন্ত্রের দ্বারা রহস্যময়তা সৃষ্টি করে তারা ছিলেন সমাজের উচ্চস্তরে। কিন্তু তাদের মনে জ্ঞানসাধনার পরিবর্তে দেখা দিল অহংবোধের খন্ডদৃষ্টি। তাই সমাজ পরিচালনার ভার তাদের হাতে থাকল না –
“সেদিন নেই রে
যেদিন পুরুতের মন্তর-পড়া হাতের টানে চলত রথ।
ওরা ছিল কালের প্রথম বাহন।”
গোষ্ঠী তথা রাজ্য রক্ষার জন্য সৃষ্টি হল যোদ্ধার দল। অস্ত্রশক্তির জোরে তারা মর্যাদা আদায় করে নিলেও সমাজরথ নিয়ন্ত্রণের প্রধান শক্তি হয়ে তারাও থাকতে পারল না—-
‘স্বয়ং রাজা লাগালেন হাত, আমরাও ছিলুম পিছনে।
একটু ক্যাঁচকোচও করলে না চাকাটা।’
এরপর উঠে এল শিল্পপতি, ব্যবসায়ী। রবীন্দ্রনাথ এদের পরিচয় দিলেন ‘ধনিক’ বলে, ইহাদের দলপতি ‘শেঠজি’। এরাই মূলত বৈশ্য। আজকের দিনে এই বৈশ্য তথা শিল্পপতিরাই সমাজে কর্তৃত্ব করে। রাজশক্তি এদের ইঙ্গিতেই পরিচালিত –
‘দ্বিতীয় নাগরিক। কলিযুগে না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র,
চলে কেবল স্বর্ণচক্র।
তৃতীয় সৈনিক। … একালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে, পিছনে থাকে বেনে। যাকে বলে অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।’
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য যখন রথ চালাতে অক্ষম, শ্রেণীদ্বন্দ্বের কারণে তাদের আভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া লুপ্ত তখন নতুন যুগের সারথির আসন গ্রহণ করে শূদ্র তথা সাধারণ শ্রমিক সম্প্রদায়। তাদেরই স্পর্শে সমাজ-রথে প্রাণ সঞ্চার হল –
‘আজকের মতো বলো সবাই মিলে-
যারা এতদিন মরেছিল তারা উঠুক বেঁচে,
যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে
তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’
রবীন্দ্রনাথ নিপীড়িত মানুষের নব জাগরণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আজকের উন্নত ও শিক্ষিত সমাজে প্রায় দেখি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দলিত সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার। সমাজের এই অন্ধকার দিকটা রবীন্দ্রনাথ মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। শ্রমিক-চাষী-নিপীড়িত মানবের জাগরণের পরবর্তী কথাটা রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন ‘রথের রশি’ র কবির মুখ দিয়ে-
‘তার পরে কোন্- এক যুগে কোন্-একদিন
আসবে উলটোরথের পালা।’
অন্তরের শুচিতা হারিয়ে মহামিলনের কথাই নাটককার বলেছেন।
গল্পগুচ্ছের ‘একটা আষাঢ়ে গল্প’ নামক গল্প অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘তাসের দেশ‘ (১৯৪০খ্রিঃ)। ইহা রূপকথা জাতীয় রচনা হলেও রূপকথার ছদ্মবেশটি উন্মোচন করলে ইহার কাহিনির সাথে আমাদের মানব জীবনের যোগসূত্রটি আবিষ্কার করা দুরূহ ব্যাপার নয়। নাটককার রবীন্দ্রনাথ যেন দেখাতে চাইলেন যে চারিদিকের পেষণে পিষ্ট প্রাণশক্তি আত্মপ্রকাশের জন্য অস্থির হয়ে থাকে, তাকে জাগ্রত করবার জন্য কোনো সংঘাতের প্রয়োজন হয় না, একটা জীবন্ত দৃষ্টান্ত সম্মুখে তুলে ধরাই যথেষ্ট। সেই সজীব দৃষ্টান্ত রাজপুত্র, তারই স্পর্শে তাসের দেশে প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল।
ভারতবর্ষে মানুষকে কর্মের ভিত্তিতে একসময় চারবর্ণে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই নাটকেও তাসের চারটি রঙের ভিত্তিতেই সেই বর্ণ বিভাগ হয়েছে –
“ছক্কা। শুভ গোধূলিলগ্নে পিতামহ চার মুখে একসঙ্গে তুললেন চার হাই।
সদাগর। বাস্ রে। ফল হল কী।
ছক্কা। বেরিয়ে পড়ল ফস ফস করে ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, চিঁড়েতন। এঁরা সকলেই প্রণম্য। (প্রণাম)।
রাজপুত্র। সকলেই কুলীন?
ছক্কা। কুলীন বইকি। মুখ্য কুলীন। মুখ থেকে উৎপত্তি।”
ভারতে জড়তা এসেছে শাস্ত্রীয় আচার নিয়ম পালনের জন্য এবং রাষ্ট্রক্ষেত্রে বহুদিন পরাধীন থাকার জন্য। তাই সর্বত্রই আজ রাজপুত্রের আগমনের প্রয়োজন। শাস্ত্রের বন্ধনকে ছিন্ন করে, সকল জড়তা দূর করে, ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ -এর শিকল ভেঙে আনবে বাইরের আলো। করবে হৃদয়কে আলোড়িত –
“সংশয় পারাবার/অন্তরে হব পার,/ উদবেগে তাকায়ো না বাইরে। …
হোয়ো নাকো কুন্ঠিত,/তালে তার দিয়ো তাল,
জয়-জয় জয়গান গাইয়ো।
হাঁই মারো,
সহজ কথায়, এই নাটকে নিয়মে বাঁধা জীবনের জড়তা থেকে মুক্তির কথা, গতির মহিমা প্রচার এবং এরই সাথে যৌবনের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে।
একজন কবি বা স্রষ্টার কাজ, যা ঘটছে শুধু তার বর্ণনাই নয় বরং, যা ঘটতে পারে তারও বর্ণনা করা। আপামর বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সেই পরিচয়ই দিয়েছেন। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতই নাটকেও ‘থার্ড আই’-এর সার্থক ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এঁকে ফেলেছিলেন আগামীর অজানা দিনগুলোর স্বরূপ এবং আসন্ন সমস্যাগুলিকে। স্বপ্ন হারিয়ে অর্থ-সম্পত্তি আর প্রতিপত্তির পিছনে দৌড়তে থাকা নীরস জীবনের কথা অনেক আগেই শুনিয়ে গেছেন তিনি। আর আজ আমরা সেই মতোই দিন কাটাই। নাটক গুলোর সমাপ্তিতে জয় লাভ করেছে আত্মা, মুক্ত প্রাণ, প্রকৃতি এবং প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা।
‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। তাই তো আমাদের বিশ্বাস দিন বদলে যাবে ফের , হাত ধরে সময়ের। কেটে যাবে সাম্প্রদায়িকতার বৈষম্য, জাতিভেদের সংকীর্ণতা, লাভ , লোভ আর স্বার্থচরিতার্থতার নেশা, সাম্রাজ্য দখলের লড়াই। আসবে সোনালী দিন। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে আন্তরিক ভালোবাসা। আর তবেই বোধহয় আমরা আত্মস্থ করতে পারব প্রকৃত শিক্ষাকে, যা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন তাঁর অপার সৃষ্টি সম্ভারের মাধ্যমে।
আমি আপনাদের মকটেক্স গুলো দিতে চাই
আমার বাংলা চ্যানেলের কমিউনিটি পোস্ট ফলো করো, নির্দিষ্ট সময়ে অ্যাডমিশন নেওয়া হবে।
স্যার আমি মক টেস্ট দিতে ও পিডিএফ ডাউনলোড করতে চাই