রামায়ণ : বর্তমান সমাজের জীবনবেদ
কলমে : – ধৃতি সিনহা
একটা খুব সাধারণ খবরের কথা দিয়ে আজকের প্রবন্ধ শুরু করছি। অভিনেত্রী দীপিকা চিখলিয়া (Dipika Chikhlia) মনে পড়ছে ? যিনি রামানন্দ সাগর পরিচালিত ধারাবাহিক রামায়ণে (হিন্দি ভাষার) সীতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ! কিছুদিন আগে রিইউনিয়ন পার্টিতে তোলা তার কিছু ছবি ইন্সটাগ্রামে দিয়ে ট্রোলের শিকার হয়েছেন। ছবিগুলো মুছে দিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, যে দর্শক তাকে সীতা হিসাবে মনে রেখেছেন, তাদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিলনা। ‘খুব সাধারণ খবর’ বলেছিলাম ? কিন্তু ‘খুব সাধারণ’ বোধহয় নয় ! জনচেতনায় রামায়ণের চরিত্রগুলোর যে ব্যাপক প্রভাব রয়ে গেছে – এবং সময় নিরপেক্ষ ভাবেই রয়ে গেছে তা আরো একবার বোঝা গেল। তবে দর্শকদের দিক থেকেও আর একটু বিবেচনা বোধের প্রয়োজন ছিল বৈকি। জানি।পক্ষে – বিপক্ষে বলবেন অনেকে। কিন্তু তর্ক উস্কে দেওয়া বা রামায়ণের কোনো চরিত্রবিশেষকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য নয় বরং সুপ্রাচীন এই কাব্যের দর্শনে আধুনিক কালের চিন্তা – ভাবনা যেভাবে ফুটে উঠেছে , তার ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই প্রবন্ধ লেখা।
আদি কবি বাল্মীকির হাতেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে সংস্কৃত রামায়ণ। বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ যেমন অনূদিত হয়েছে – অনেক ক্ষেত্রেই যেমন হয়েছে স্বাধীন অনুবাদ, তেমনি নতুন করে রচিতও হয়েছে। তামিল (কম্ব রামায়ণ), কন্নড় (তোরাভাই রামায়ণ),মালায়ালাম (অধ্যাত্ম রামায়ণ), গুজরাটি (গিরিধর রামায়ণ), বাংলা (কৃত্তিবাসী রামায়ণ), অসমীয়া (মাধবকন্ডলী রামায়ণ) – প্রভৃতি দেশীয় ভাষার সাথে সাথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভন্ন দেশেও যেমন মালয়েশিয়া ( হিকায়াত- সেরি- রাম), থাইল্যান্ডেও ( রামাকৃতি ) রামায়ণের কাহিনী প্রচলিত আছে। এই প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে বৈচিত্র্যও কম নয় – কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত মিলেছে এক লক্ষ্যে – মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠায়।
মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠা দিতে রামচন্দ্র এসেছেন নরচন্দ্রমা হিসাবে, বিষ্ণুর অবতারত্বের প্রসঙ্গ এখানে গৌণ। তমসা নদীর তীরে নারদ ও বাল্মীকির কথোপকথনে রামকে “ ধর্মজ্ঞ, সত্যসন্ধ, প্রজাগনের হিতে রত, যশস্বী, জ্ঞানী, শুদ্ধাচার, বিনীতস্বভাব এবং স্থিরচিত্ত” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে ‘রাম’ আমাদের মনের সেই শুভ চেতনা যাকে লড়তে হয় অশুভ শক্তির সঙ্গে। তাই কবি কাব্যের শুরুতেই এই মানবীয় গুণের আবাহনের মধ্যে দিয়ে মানুষের কল্যাণকামী সত্তার বন্দনা করেছেন। মহাকবির কাছে-
অকর্দম তীর্থং ভরদ্বাজ নিশাময়।
রমণীয়ং প্রসন্নাম্বু সন্মনুষ্যমনো যথা।।
অর্থাৎ (তমসা নদীর অনাবিল জলের মতোই স্বচ্ছ মানুষের মন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।)
মানুষকে বিশ্বাস করার প্রসঙ্গ দিয়ে তাঁর কাব্যের যাত্রা শুরু। ক্রৌঞ্চবধের ঘটনায় বাল্মীকি রচিত প্রথম শ্লোকে –
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগ্মঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।।
অর্থাৎ ক্রৌঞ্চ বধের জন্য ব্যাধের পতিত হওয়ার সরল ব্যাখ্যার ভেতরে রয়ে গেছে Right to Life এর কথা। যেখানে প্রতিটা প্রাণীর নিরাপদে বেঁচে থাকার সংবিধান স্বীকৃত অধিকার আছে। নিষ্ঠুর হত্যার বিরোধিতার কথাও এই প্রসঙ্গেই আলোচিত হয়েছে। আজকের দিনে নির্বিচারে পশুহত্যা,পশুপাচার যেখানে বেড়ে চলেছে সেখানে মহাকবি কাব্যের শুরুতেই অকারণ হত্যার বিরোধিতা করেছেন।
আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের যে ধারা এখনো অব্যাহত, রামায়ণ থেকে তার সূত্রপাত। রাক্ষস বংশীয় বিভীষণ, হনুমান সুগ্রীব, নিষাদরাজ গুহ – বংশমর্যাদায় সমান না হলেও তারা সূর্যবংশীয় রামের বন্ধু ছিলেন। জটায়ুর সৎকার রামচন্দ্র করেছিলেন, উল্লেখ্য দশরথের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন না হলেও রাম এই কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। বন্ধু বিভীষণের রাজ্যাভিষেকের গুরুত্ব সীতার সঙ্গলাভের থেকেও তাঁর কাছে বেশি। কৈকেয়ীর প্ররোচনায় বনবাসী হলেও অযোধ্যায় ফিরে ভরতকে সন্তানের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে কৈকেয়ীর সঙ্গে মনোমালিন্য দূর করতে চেষ্টা করেছেন। ভরতের অনুরোধে পুষ্পক রথে অযোধ্যা ফিরে সেই রথ ( যা রাবণ কেড়ে নিয়েছিল ) কুবেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাম। কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে এদের বিশ্লেষণ না করে সার্বিকভাবে দেখতে হবে। বর্তমান যুগেও আমরা যে কর্মসংস্কৃতির কথা বলি, দায়িত্ববোধের কথা বলি বা বন্ধুত্বের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের ভেদ যেমন আমরা করি না – সুপ্রাচীন যুগের কবি সেই কথা আগেই বলে গেছেন।
বর্ণাশ্রম প্রথা আর্যসমাজে প্রচলিত ছিল। সংস্কারবদ্ধ আর্যসমাজে পৌরহিত্যপ্রথা বা বলা যেতে পারে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত মানবতাবাদের পথ আটকেছে বারবার। এই পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে আজকের বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসের। ক্রেতাযুগে রাম যেমন সুশাসনে সচেষ্ট হয়েছিলেন – দমন করেছিলেন সন্ত্রাস ( খর ও দূষণের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন অরণ্য ঋষিদের, বধ করেছিলেন তাড়কা রাক্ষসীর), দূর করেছিলেন সমাজের উচ্চ – নীচ এই ভেদ ( গুহ, হনুমানের সাথে বন্ধুত্ব) – তেমনি বিভিন্ন দেশ আজও লড়ে যাচ্ছে বহিঃশত্রুর সাথে, সাম্প্রদায়িক হিংসার পাশাপাশি সম্প্রীতির কথা শোনা যাচ্ছে এখনো ! এভাবে আধুনিক যুগের সমান্তরালে রামায়ণের পরিক্রমাও চলছে । কারণ –
“রামায়ণ – মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান। “
অনার্য আদিবাসীদের জীবন, সমাজ , রীতি-নীতির প্রসঙ্গ বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে রামায়ণে। আদিবাসী আচার ও মননের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার ইঙ্গিত বুঝতে সচেতন পাঠকের অসুবিধা হয়না। দক্ষিণ ভারতের সুগ্রীব, হনুমান, জাম্ববান, সুষেণ আর উত্তর ভারতের গুহক – রামের বন্ধু বলে পরিচিত। ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অরণ্যবাসী শুধু ভালবাসার মন্ত্রে উদবোধিত হয়ে সুগ্রীবের ডাকে বেঁধেছিল সেতু ! আজওতো আমরা জানি একতাই বল। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা অতিমারী – জাতিধর্ম নির্বিশেষে জোটবদ্ধ না হলে কবেই লুপ্ত হয়ে যেত মানবসভ্যতা !
সুগ্রীবের বন্ধুত্ব আর হনুমানের ভক্তি রামচন্দ্রের শক্তির আধার হিসাবে রামায়ণে গুরুত্ব পেয়েছে। রামের প্রতি আস্থা, আদেশ পালনে তৎপরতা, বিশ্বস্ততায় – হনুমান দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ভক্তসেবক হিসাবে যেমন তেমনি বজরংবলী হিসাবেও তিনি পূজিত হন ভারতের নানা জায়গায়। রামচন্দ্রের বিপত্তারণ তাই ভক্তদের ও সঙ্কটমোচন ! বাল্মীকি মনুষ্যেতর প্রাণীর গুরুত্বকেও তাঁর কাব্যে অত্যন্ত মুন্সিয়ানায় প্রকাশ করেছেন। ভক্তির পরাকাষ্ঠা বোঝাতে ‘রামভক্ত হনুমান’ – প্রবাদের কথাও অজানা নয়। শ্লেষ অর্থে ব্যবহৃত হলেও এই প্রবাদে একনিষ্ঠতার ভাবই ফুটে ওঠে।
রামায়ণ ও মহাভারত – দুই মহাকাব্যই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে। তবু রামায়ণকে অনেক বেশি ধর্ম নিরপেক্ষ আর মানবিক বলে মনে হয়। নিষাদ প্রজাতির একলব্যের গুরুদক্ষিণার মূল্যে তীরন্দাজিতে অর্জুনের খ্যাতি বজায় রেখেছিলেন গুরু দ্রোণ বা সূতপুত্র হওয়ার কারণে কর্ণ হয়েছিলেন উপহাসের পাত্র সেখানে রামায়ণে নিষাদ প্রজাতির দস্যু রত্নাকর নিজের পরিশ্রমে, তপস্যায় পরিণত হয়েছেন মহামুনি বাল্মীকিতে। দস্যু রত্নাকর শুধু রামনামের গুণে বাল্মীকি মুনিতে রূপান্তরিত হয়েছেন ! এই ব্যাখ্যাকে শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিলেও আমাদের উত্তর আধুনিক মন মানতে চায় অধ্যবসায়ের জোরে ব্রাহ্মণ হোক – হোক ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র – বিদ্যা , জ্ঞানের আলোর স্পর্শ পাবে সবাই। রামায়ণ এই ব্যাখ্যারও সূত্রধার।
ভারতীয় সংবিধান – নর আর নারীর সমানাধিকারের কথা বলে। কিন্তু সমাজ কী বলে ? সমাজ নারী আর পুরুষের জন্য আলাদা দুটো মানদন্ড তৈরি করে তার ভিত্তিতে বিধান দিয়ে থাকে। উঁচু স্বরে কথা না বলা, স্বামীর কথা একবাক্যে মেনে চলা – এরকম আরো অনেক উপদেশ চলে আসছে বহুকাল ধরে! এক কথায় সীতাই আদর্শ স্ত্রী ! কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে সীতা কেমন ? খুব অন্তর্মুখী ? না। সীতাকে একজন যুক্তিবাদী, আত্মাভিমানী, প্রতিক্রিয়াশীল সত্তা বলেই মনে হয়েছে। বনগমন নিশিত করতে রামচন্দ্রের যুক্তি সীতা যে ভাষায় নস্যাৎ করেছেন তা উল্লেখযোগ্য –
“ …তুমি আমাকে তুচ্ছ ভেবে কী বলছ, আমার হাসি পাচ্ছে। তোমার কথা শাস্ত্রজ্ঞ বীর রাজপুত্রের অযোগ্য এবং শোনাও উচিত নয়।…আমার পিতা মিথিলাধিপ যদি জানতেন যে তাঁর জামাতা আকারে পুরুষ কিন্তু কার্যে স্ত্রী, তবে কি মনে করতেন ? “
যুদ্ধকান্ডে সীতার অগ্নিপরীক্ষা যেন যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি সমাজের অবিশ্বাসের প্রমাণ। খুব প্রাসঙ্গিক আজ কোনো মেয়ে অপহৃত হলে বা ধর্ষিত হলে সমাজ প্রথমে মেয়েটার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলে। অপরাধী যদিবা ছাড়া পেয়ে যায় কিন্তু কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে কাটে মেয়েটার জীবন। যেমন কেটেছিল সীতার ! অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করেও নির্বাসিত হয়েছিলেন বনে ! তাই উত্তরকান্ডে সীতার পাতাল প্রবেশের মধ্যে দিয়ে নারীর আত্মমর্যাদার শিখাকে উস্কে দিলেন কবি।
নারীর আত্মাভিমানের সাথে সাথে মহকবি ‘রামায়ণ’ নামকরণের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট করে দেন যা শুভ, মঙ্গলময় – সেই পথে রাম (নর )ও সীতার যাত্রা (নারীর ) একসাথে শুরু হয়েছে। বাল্মীকি তাঁর কাব্যে একাধিকবার সীতাকে ‘রামা’ নামে উল্লেখ করেছেন। তাই ‘রামায়ণ’ কাব্যনাম বিশ্লেষণে ‘রাম’ এর সাথে ‘রামা’কেও সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রাবন্ধিক উজ্জ্বল চোক্সি ( Ujjwal Chouksey ) বাল্মীকির লিঙ্গসাম্যের ধারণাকে নতুন ভাবে উপস্থাপিত করেছেন –
“… Raamaaa the feminine form of Rama stands for Sita and so the word Ramayana, split up in two ways – Rama+Ayana and also Raamaa+Ayana – denotes the concurrent and coordinated March of both Rama…and Raamaa… Thus the concept of equal importance to man and woman is inherent in the very title of Ramayana. “
এই লিঙ্গসাম্যের কথাইতো বিভন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ, খবরের কাগজের প্রবন্ধে বার বার উঠে আসছে। আদিকবি কিন্তু কাব্যনামেই সেই সাম্যের স্পর্শ রেখে গেছেন।
রামায়ণকার চরিত্রদের মুখে যে কথা বসিয়েছেন তাতে তার সুরুচির পরিচয় যেমন পাই তেমনি মার্জিত কথোপকথনের আবেদনের ক্ষেত্রটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডে পম্পাতীরে রাম মুগ্ধ হয়েছিলেন হনুমানের বক্তব্যে –
“ …ইনি নিশ্চয় বহুবার সমগ্র ব্যাকরণ শুনেছেন সেজন্য একটিও অপশব্দ বলেননি… এঁর বাক্য দ্রুত নয়, বিলম্বিতও নয়, শুনলে মনে আনন্দ হয়। “
অশোক বনে বন্দিনী সীতার প্রতি ত্রিজটা রাক্ষসীর রোষাগ্নি মুহূর্তে নিবে যায় লঙ্কার পতন স্বপ্নে দেখে । অন্যান্য রাক্ষসীদের সে সচেতন করে –
“ এখন এঁকে সান্ত্বনা দাও, ক্ষমা চাও…ইনিই তোমাদের রক্ষা করবেন। “
রাবণবধের পর বিভীষণকে প্রবোধ দিতে রাম তাঁর পরম শত্রু সম্পর্কে যে ভাষয় কথা বলেছেন, তা উল্লেখযোগ্য –
“ … এই মহাবীর নিশ্চেষ্ট হয়ে নিহত হন নি । ইনি নিঃশঙ্ক মহোৎসাহী যোদ্ধা, ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, এঁর জন্য শোক করা উচিত নয়। “
শিক্ষনীয় এই ভঙ্গী। আজ আমরা কথাবার্তায় শালীনতার সীমা পেরিয়ে যাই অনায়াসে – তা রাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক বা শিক্ষাক্ষেত্রে – লঘু গুরু জ্ঞানের বোধ আজ আমরা হারিয়ে ফেলছি – রামায়ণ কিন্তু পারস্পরিক সম্মানের কথা বলেছে। সেই জায়গা থেকে কি অনেকটাই সরে যাচ্ছি না আমরা ?
বাল্মীকির রাম – বুদ্ধদেব বসুর কথায় –
“ মনুষ্যত্বের মহত্তর আদর্শের প্রতিভূ তিনি, বিশেষ কোনো একটি দেশের বা যুগের নয়, সর্বদেশের, সর্বকালের”
– সর্বকালের এই মানব রাম তাই অসাধ্য সাধনের ক্ষমতা রাখেন না। তাই স্ত্রীকে উদ্ধার করতে অন্যের সাহায্যপ্রার্থী ! লোকলজ্জার ভয়ে স্ত্রীকে ত্যাগ দিতেও দ্বিধা করেননি। কিন্তু রাম চরিত্রের আরো দিক আছে যাকে সামনে রেখে কবি গড়ে দিতে চেয়েছেন একটা আদর্শ । দশরথ ও রাবণের বহুবিবাহ, রাবণের পরস্ত্রী হরণের ঘটনা, ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ও বারবণিতা প্রসঙ্গ ইত্যাদি – সেযুগের আর্য সমাজের ভন্ডামিকে স্পষ্ট করে তোলে। এর পাশে রাম – ‘এই সব ক্লিন্নতার ঊর্ধ্বে ‘ – সীতাই তাঁর একমাত্র সহধর্মিনী। সুগ্রীবপত্নীকে জোর করে অঙ্কশায়িনী করার অপরাধে বধ করেছেন বালীকে, তারাকে সহমরণে বাধা দিয়ে সুগ্রীবকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। আসলে –
“ সাধারণ জ্ঞান সমৃদ্ধ ও ফলিত সমাজ সত্যের আধারে নায়ক ও আদিবাসী সমাজকে চিত্রিত করতে চেয়েছেন রামায়ণের রচয়িতা “।
আজকের এই দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজেও যখন কেউ সুবিচার পান, শাস্তি হয় দোষীর তখনতো জয় হয় সেই শুভ আদর্শের যার স্বপ্ন বাল্মীকি আমাদের দেখিয়ে গেছেন।
মহাকাব্যের বিভিন্ন চরিত্রের গুরুত্ব কাল নিরপেক্ষ – কারণ তাদের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদেরই আবেগ – অনুভূতির বিভন্ন রূপ – কখনো প্রেম , কখনো প্রতিহিংসা, সম্ভোগ লালসা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি। চিত্রকূট পর্বতে রাম আর ভরত পরস্পরের জন্য রাজসিংহাসনের অধিকার ছেড়ে দিতে চেয়েছেন – আর এই অধিকারের লড়াই নিয়েই গড়ে উঠেছে মহাভারত ! দুই মহাকাব্যই তুলে ধরেছে সত্যের দুটো রূপ। রামায়ণে গুরুত্ব পেয়েছে শুভবোধ আর মহাভারতে জয় করার ধারণা প্রাধান্য পেয়েছে। শাশ্বত মূল্যবোধের ধারক রামায়ণ। তবে কবি আদর্শ সমাজব্যবস্থা বা ‘রামরাজ্য’এর পাশাপাশি তুলে ধরেছেন বেশ কিছু প্রশ্ন। শূর্পনখার প্রেম নিবেদনের পরিণাম, বালী হত্যা, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, শম্বুক বধের মতো ঘটনাগুলো শুধু সুশাসনের ইঙ্গিত দেয় না বরং নিরপেক্ষভাবে শাসনযন্ত্রের ভালো – মন্দের বিচারের পথও তৈরি রাখে , যে পথে এগিয়ে পাঠকও বুঝে নিতে পারে শাসনতন্ত্রের চিরকালীন রাজনীতিকে।
প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বঙ্গীয়যুবক ও তিন কবি’ প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন –
“ রামায়ণ আজ পড়ে কে ?”
– অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের সময় বা তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই আদর্শবোধ, মূল্যবোধ ফিকে হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই তবু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজ পর্যন্ত মুদির দোকান থেকে রাজপ্রাসাদ – রামায়ণ সমাদৃত হয়ে আসছে। কবিগুরুর চোখে –
“ রামায়ণেও যুদ্ধব্যাপার যথেষ্ঠ আছে…তথাপি রামায়ণে যে রস সর্বাপেখা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহা বীররস নহে। তাহাতে বাহুবলের গৌরব ঘোষিত হয় নাই, যুদ্ধ ঘটনাই তাহার মুখ্য বর্ণনারর বিষয় নহে। “
কিন্তু সমস্যার কথা রাম জনমানসে থেকে যাচ্ছেন বীরযোদ্ধা হিসাবে। তাঁর কল্যাণকামী আদর্শের কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনায়। আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে ধর্মে ধর্মে হানাহানি দেখি , দেখি ধর্মের নামে চলছে যথেচ্ছাচার – এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে জাগিয়ে তুলতে হবে আমাদের যুক্তিবোধ, সহনশীলতা সর্বোপরি মানবতাবোধ যার কথা রামায়ণ বলে চলেছে বহুকাল ধরে।
তথ্যসুত্র –
বাল্মীকি রামায়ণ সারানুবাদ – রাজশেখর বসু ।
রবীন্দ্র রচনাবলী : তৃতীয় খন্ড – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
প্রবন্ধ- সংকলন – বুদ্ধদেব বসু।
রামায়ণ : প্রকৃতি, পর্যাবরণ ও সমাজ – ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ।
নানা চর্চা – নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী ।
https://www.news18.com/news/movies/ramayans-sita-aka-dipika-chikhlia-on-backlash-for-now-deleted-photos-feeling-bad-that-i-have-been-trolled-5231941.html
https://www.academia.edu/6102132/Relevance_Of_Ramayana_in_Current_Scenario
http://www.sabrizain.org/malaya/library/effectoframayana.pdf