বিশ্বজনীনতার দর্পণে

Song Offerings

কলমে : ধৃতি সিনহা


            সালটা ছিল ২০০৪, আর তারিখ মার্চ মাসের ২৫ – বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে, গর্বে নয় লজ্জায়। কেন? সাল তারিখের হিসাব আমাদের মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে গেলেও সার্চ ইঞ্জিন কিন্তু আপনাকে ঠিক জানিয়ে দেবে কারণটা। শিরোনাম দেখে নিশয় ই আন্দাজ করে ফেলেছেন ! ঠিক। বিশ্বভারতীর সেফটি ভল্ট থেকে সেদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল বিশ্বকবির নোবেল পদক ! প্রশাসনিক তৎপরতা, চাপান উতোর অন্য প্রসঙ্গ ! প্রবন্ধের বক্তব্যের সাথে তার যোগ ও খুব ক্ষীণ ! তবু খুব অপ্রাসঙ্গিক নয় এই স্বীকারোক্তি যে আজ ১৮ বছর পরও আমরা সেই পদক ফিরিয়ে আনতে পারিনি। জাতীয় লজ্জার প্রসঙ্গটা মুলতুবি রেখে  বরং নোবেল পদক জয়ী প্রথম ভারতীয় (প্রথম এশীয়ও বটে) শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পর্বের কবিমানস বিশ্লেষণের দুঃসাধ্য চেষ্টার মধ্যে দিয়ে প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্যের দিকে এগনো যাক।


            সন্ধ্যাসঙ্গীত থেকে শুরু করে শেষলেখা পর্যন্ত  রবীন্দ্রকাব্য পরিক্রমায় সময়ের ব্যবধানে কবির  অনুভূতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে পাঠক পরিচিত হয়। এই অনুভূতির স্তর অনুযায়ী রবীন্দ্র-কাব্যকে ভাব-প্রকাশক নামে নির্দেশ করেছেন শ্রী উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সন্ধ্যাসঙ্গীত, প্রভাতসঙ্গীত এর উচ্ছ্বাস-যুগ থেকে বিবর্তনের খেয়া বেয়ে  কবি এসে পড়েছেন ভগবদরসলীলা যুগে, কবির অতিন্দ্রীয় অনুভূতি কখনো অসীম – সসীমের লীলাতত্ত্বকে আশ্রয় করে ব্যক্ত হয়েছে কখনোবা লীলাময়কে না পাওয়ার বিরহ বেদনার আর্তি হয়ে উঠেছে। কবির মিস্টিক অনুভূতির অনুষঙ্গে ভক্ত কবীরের দোঁহা, সূফীসাধকদের গান বা বাংলার একান্ত আপন বৈষ্ণব পদাবলীর কথা মনে হলেও প্রকৃতিভেদে গীতাঞ্জলির সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিচয় আছে। গীতাঞ্জলির স্রষ্টা ‘ প্রথমত কবি – জগৎ ও জীবনের রসসাধক, দ্বিতীয়ত ভগবৎপ্রেমিক ও অতীন্দ্রিয় সাধক’- কাজেই সীমার মধ্যেই যে অসীম রয়েছে, কবি সেই সর্বমানবের ভগবানের সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছেন।

           এ তথ্য আমরা সকলেই জানি মোট ১৫৭টি কবিতা সম্বলিত বাংলা গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ৩১শে শ্রাবণ ১৩১৭ সালে।গীতাঞ্জলিতে  লীলাময়কে না পাওয়ার বেদনার সঙ্গী হয়েছে ভগবত উপলব্ধির উপযোগী নির্মল মনের প্রার্থনা, দরিদ্র-অস্পৃশ্যদের মধ্যে ভগবানের অবস্থান ‘ ধরণীর ধূলায় ভূমার আসনের অনুভূতি’। আর ‘Song Offerings’ মানে গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ ! না বাংলা গীতাঞ্জলির হুবহু অনুবাদ নয় Song Offerings. ১৯১২ সালে ব্রিটেন যাত্রার সময় অসুস্থ হয়ে শিলাইদহে বিশ্রামের সময় গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদের কাজে হাত দেন কবি। মোট ১০৩টে কবিতা বা গানের মধ্যে ৫০টা নেওয়া হয়েছে মূল বই (গীতাঞ্জলি) থেকে,বাকি ৫০টা  নেওয়া হয়েছে অন্যান্য বই থেকে – গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, স্মরণ, চৈতালী, উৎসর্গ আর অচলায়তন থেকে।

           অন্তর্সম্পদেও  Song Offerings আর গীতাঞ্জলির মধ্যে তফাৎ আছে। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির যে স্তর পরম্পরা  গীতাঞ্জলির শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা ইংরাজি অনুবাদে সেই পরম্পরা বজায় না থাকলেও  বিশ্বের দরবারে তার কাব্য যেভাবে সমাদৃত হয়েছে তা Song Offerings এর বিশ্বজনীনতার অন্যতম প্রমাণ। ঔপনিষদিক চিন্তার সাথে সাথে প্রাচ্যের জীবনও ছায়া ফেলে গেছে Song Offerings এর পাতায়। মধ্যযুগীয় ভক্তিবাদী চেতনা, বাউল বৈষ্ণব দর্শনের নির্যাসও মুগ্ধ করেছে সাগরপারের পাঠকদের। তাই গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদের ভূমিকায় খ্যাতনামা কবি ইয়েটস মন্তব্য করেছেন –
“ I may have changed his well chosen words in my memory but not his thought.”

            পশ্চিমী সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের মন এবং অতীন্দ্রিয় সত্তার মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তার প্রমাণ আছে তাদের ভক্তিবাদী কবিতায় কারণ সেগুলি যারা রচনা করেছেন তারা মূলত সাধক। ফলে অতীন্দ্রিয় সত্তার সাথে এক হয়ে তাকে অনুভব করার, লীলাময়ের লীলাকে জগৎ সংসারে উপলব্ধি করার, তাঁকে আপন করে নেওয়ার মনোভাব – এক কথায় প্রাচ্যের এই মরমী চেতনা তাদের সামনে ঈশ্বর সাধনার এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে যেখানে দুর্বোধ্যতা বা জটিলতার সম্ভাবনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছেন সহজভাবে  –
“ And a supreme transparence and simplicity what you will find in every line of Rabindra Nath Tagore… The result is an incomparable unity of rhythm and language, of language and idea.”

Song Offerings এর বিভিন্ন কবিতায় গানে প্রকাশ পেয়েছে প্রার্থনার নানা রূপ। প্রথম কবিতায় –
“Though hast made me endless, such is thy pleasure”
কবি মানবজীবনে পরম কারুণিক ঈশ্বরের অপার কৃপার কথা স্মরণ করে বলেছেন –
“ Ages pass, and still thou pourest, and still there is room to fill”.
আবার শেষ কবিতায় অসাধারণ প্রতীকের মধ্যে দিয়ে কবি যে তাঁর অন্তরের বিনম্র শ্রদ্ধা শুধু জানিয়েছেন তাই নয় পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার আকুতিও সেই প্রতীকের মধ্যে দিয়েই ব্যঞ্জিত হয়েছে –

“ Like a flock of homesick cranes flying night and day back to their mountain nests let all my life take its voyage to its eternal home in one salutation to thee”. (১০৩ নং)
( হংস যেমন মানসযাত্রী / তেমনি সারা দিবসরাত্রি / একটি নমস্কারে, প্রভু, / একটি নমস্কারে / সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক / মহামরণ – পারে। )

           কবির ঈশ্বর উপাসনার গানের পথে এগিয়ে চলেছে। তাই  গীতাঞ্জলি বা তার ইংরাজিওনুবাদে কবি স্পষ্ট করেছেন সেই গানের স্বরূপ। আড়ম্বর বর্জন করে সহজ সরল ভাষায় তিনি তাঁর অঞ্জলি নিবেদন করেছেন লীলাময়ের পায়ে।তাঁর পরাণসখাকে পেতে হবে এই জগতের মাঝে, সবার সাথে এক হয়ে। তাই শিশুর রূপকেও কবি Song Offerings এর ৮নং গানে ব্যক্ত করেছেন এই কথা।আবার পরমাত্মার সাথে মিলনের যে পথ, যে পথে কবির অভসার, সেই পথ বিস্তীর্ণ – ব্যাপ্ত – সুদূর প্রসারিত ! প্রতি মূহুর্তের অপেক্ষা পথ শেষে করুণাময়ের সান্নিধ্যলাভ – এগিয়ে চলার মন্ত্রকে পাথেয় করে প্রতিটি দরজায় আঘাত দিতে হবে তবেই তাঁর আশ্বাস বাণীকে অনুভব করা সম্ভব। কবির নিজের বয়ানে –

“… melt into tears of a thousand streams and deluge the world with the flood of the assurance  “ I am“ “. ( ১২ নং)
ঈশ্বরের মিলিত হওয়ার চেষ্টা ও বারবার বিফল হওয়ার যন্ত্রনা কবিকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে তাঁর লক্ষ্যের প্রতি। ঈশ্বরের এই প্রত্যাখ্যান তাঁর কাছে আশীর্বাদের মতো , যার হাত ধরে জীবনের অনিশ্চয়তা – দুর্বলতা – জটিলতার মুখোমুখি হতে তিনি ভয় পাননি। Song Offerings বহু কবিতায় এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে।

            ডিভোশানাল পোয়েট্রি ( Devotional Poetry ) হলেও Song Offerings কোনো ভাবেই নিতান্ত আটপৌরে জীবনকে অস্বীকার করেনা  বরং মানুষ যেভাবে অর্থ – ক্ষমতার অন্ধ শেকলে নিজেকে ক্রমশ বেঁধে ফেলছে সেই সত্যকেও কবি তাঁর কাব্যে বন্দির সাথে কথোপকথনের সূত্রে তুলে ধরেছেন। জগতকে হাতের মুঠোয় আনতে গিয়ে সে নিজেই বন্দি হয়ে গেছে। আপাত সরল উক্তি – প্রত্যুক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন  ব্যক্তিমানুষের আত্মোপলব্ধিকে। (৩১ নং )। কবি তাকিয়ে আছেন সেই নির্ভীক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে যারা জ্ঞানের আলোয় দূর করবে অজ্ঞানতার অন্ধকার, ভাঙবে পরাধীনতার শেকল, সত্যের অন্তহীন পথে তাদের এগিয়ে যেতে হবে –

“… Where the mind is led forward by thee into ever – widening thought and action –
Into that heaven of freedom , my Father , let my country awake . “  (৩৫ নং)
(…নিত্য যেথা / তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা / নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি , পিতঃ / ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত। )

 
        জীবনপথের বাধা – বিপত্তির মোকাবিলা করার জন্য, মনের সঙ্কীর্ণতা দূর করার জন্য কবির প্রর্থনা –
“ Give me the strength to…..
অর্থাৎ পরমেশ্বরের কাছে শুধু মানসিক দৃঢ়তা চেয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গ প্রায় একভাবেই ঠাঁই পেয়েছে গীতাঞ্জলির পাতাতেও –
“ বিপদে মোরে রক্ষা কর
               এ নহে মোর প্রর্থনা ,
     বিপদে আমি না যেন করি ভয় ।“ (৪ নং )

           কবির ঈশ্বর সাধনার পথ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু তার উপলব্ধি যখন এক হয়ে যায় সাধারণ মানুষের সাথে ! তাঁর প্রার্থনায় যখন পাঠক খুঁজে পায় নিজের মনের কথা ! থাকুক না ভাষার ব্যবধান ! রইলই বা অনুবাদের অনতিক্রান্ত দূরত্বটুকু ! কবির উপলব্ধি তখন ব্যক্তিগত – এর সীমা পেরিয়ে হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন। সাকার – নিরাকারের অবান্তর দ্বন্দ্বে না গিয়ে ঈশ্বর সাধনার আতিশয্যহীন পথের খোঁজ কবি আমাদের দিলেন। পশ্চিমের জগতের সঙ্গে পরিচয় করালেন বাংলার নিজস্ব ঋতুবৈচিত্রের, কবি বাদ দিলেননা কোকিল বা বাবলা গাছের মতো বিষয়কেও। প্রার্থনা সঙ্গীতে তাদেরকেও জায়গা দিলেন কবি। বর্ণনার এই সারল্যে- সাবলীলতায় মুগ্ধ হয়েছেন পাঠক। ঈশ্বরের সঙ্গ লাভের দুর্দমনীয় বাসনা প্রকাশের প্রত্যক্ষ ভঙ্গী –
“That I want thee , only thee – let my heart repeat without end ”
– তাদের আপ্লুত করেছে।  এক্ষেত্রে প্রতীক, চিত্রকল্পের চেয়ে এই প্রত্যক্ষ ভঙ্গী তাঁর গভীর আকুতিকে মূর্ত করে তুলেছে যথাযথভাবে।

মৃত্যুকেও কবি দেখেছেন জীবনের পরিপূরক হিসাবে। অবস্থা ভেদে সত্যের এই দুই রূপ – জীবন  আর মৃত্যু কে লীলাময়ের খেলার রূপ বলে তিনি মনে করেছেন। মৃত্যু তাঁর কাছে বিভীষিকা নয় – জীবনের শেষ নয় ! তাই খুব সহজেই কবি বলতে পারেন –
“ At this time of my parting , wish me good luck, my friends! “.

এ যেন এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব। এই মৃত্যু জীবনকে উজ্জ্বল করে। পরম আরাধ্যের সাথে লীন হতে কবি ছেড়ে  যেতে চেয়েছেন মনের সঙ্কীর্ণতা, গ্লানি । প্রাপ্তি – অপ্রাপ্তির হিসেব রইল পড়ে ! ‘নব নব মৃত্যুপথে’ কবি এগিয়ে চলেছেন তাঁর লক্ষ্যের দিকে।  জীবননাথের সঙ্গ লাভে অধীর কবি বিদায় নিয়েছেন তাঁর পরিচিত জগত থেকে –

“ My  whole body and my limbs have thrilled with his touch who is beyond touch ; and if the end comes here, let it come – let this be my parting word .” (৯৬ নং)

           ভক্ত – ভগবানের সম্পর্কের রসায়ন সংস্কৃতি ভেদে আলাদা। ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যেই তার অসংখ্য রূপবৈচিত্র্য দেখা যায়। বিভিন্ন  ধর্মাচরণের মধ্যে তার স্পষ্ট ছাপ থাকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিরও নিজস্ব দর্শন আছে। ধর্মাচরণের প্রসঙ্গকে বাদ দিয়ে কবি গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তির আত্মোপলব্ধিকে। জন্মভূমি তাঁর চোখে অসীম আনন্দে উজ্জ্বল। সংসার বিবাগী তপস্বী নন তিনি। আক্ষেপ বা অনুতাপের প্রসঙ্গ তাঁর কাব্যে খুব একটা চোখে পড়েনা। Song Offerings এর ৫০ নং কবিতায় সেই অনুতাপের আভাস আমরা পাই। রাজা আর ভিখারির আপাত সরল গল্পের রূপকে ঈশ্বরে পূর্ণ সমর্পনের সত্যকে  কবি তুলে ধরেছেন। স্বার্থবুদ্ধিতে অন্ধ সাধারণ মানুষকে  ঈশ্বর পরীক্ষা করেছেন যুগে যুগে। চরমত্যাগ করতে আমরা অসমর্থ তাই ঈশ্বরের কৃপালাভেও আমরা বঞ্চিত। ভিখারির কথায় প্রতিধ্বনি তোলে  অনুতপ্ত মানবাত্মা –

“ I BITTERLY WEPT AND WISHED THAT I HAD THE HEART TO GIVE THEE MY ALL . “
( তখন কাঁদি চোখের জলে / দুটি নয়ন ভরে / তোমায় কেন দিই নি আমার / সকল শূন্য করে।)

           গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস (W.B.Yeats)। ভূমিকায় তিনি কবির জীবনদর্শনের ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে তাঁর কাব্যসত্যকে তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত কবি চসারের সঙ্গে তুলনা করে তিনি  কবিগুরুর স্বতস্ফূর্ততা ,আবেগোচ্ছ্বাসের সাবলীল প্রকাশকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। ইয়েটসের ভাষায়  –
“ These verses … be carried about by students at the university to be laid aside when the work of life beigns… “ ইয়েটসের মন্তব্যে বিশ্বের দরবারে গীতাঞ্জলির সমাদরের কারণ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আদ্রেঁ জিদ ফরাসি গীতাঞ্জলির ভূমিকায় ঔপনিষদিক ধর্মতত্ত্বের সাবলীল ও বোধগম্য ব্যাখ্যার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এজরা পাউন্ডের বক্তব্যে ধরা পড়ে  ইংরাজিতে অনূদিত হলেও  গীতাঞ্জলি বা Song Offerings এর স্বাতন্ত্র্য –
“ এ কবিতা পড়তে হবে আস্তে আস্তে, নিস্তব্ধ শান্তিতে, চেঁচিয়ে। কারণ এর ইংরেজি অনুবাদ লিখেছেন একজন বিরাট সংগীতকার, একজন ওস্তাদ শিল্পী যার কারবার আমাদের চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম সংগীত নিয়ে। “

          লন্ডনে রথেনস্টাইনের বাড়িতে গীতাঞ্জলির কবিতা পাঠের আসরে  কবি মে সিনক্লেয়ারও আলোচ্য কাব্যের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে গীতাঞ্জলিতে মানুষের আবেগের যে প্রকাশ দেখা গেছে তা সুইনবার্নের থেকেও পরিশীলিত।এমন ছন্দোবদ্ধ সঙ্গীত যা পশ্চিমী শ্রোতার কাছে নতুন –  শেলীর অপার্থিব চেতনা , সূক্ষ্মতার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ সমীকৃত হয়েছেন। মিল্টন বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনায় কবিগুরুর বক্তব্যবিষয় পরিবেশনার সহজ রীতিকে তিনি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছেন। এমনকি সেকালের বিখ্যাত পত্র – পত্রিকাও গীতাঞ্জলির কবিকে সেযুগের বিপন্ন অস্তিত্বের কবিতার ত্রাতার সম্মান দিয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্যই বলা প্রয়োজন তখনো গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার পায়নি। এথেনিয়াম পত্রিকার বক্তব্যেও গীতাঞ্জলির বিশ্বজনীন আবেদনের রূপ প্রকাশিত হয়েছে  –
“ তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) কবিতামালায় এমন এক স্নিগ্ধ প্রশান্তি রয়েছে যার শিক্ষা পশ্চিমের অশান্তচিত্ত মানুষের বড় দরকার। “

           বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। দেশের – জাতির গৌরব রবীন্দ্রনাথ। অথচ তাঁর নোবেল পদক নিয়েও নিন্দুকেরা সমালোচনা করেছে। যার প্রমাণ রদেনস্টাইনের স্মৃতিকথায় চিরকাল থাকবে। ব্যথিত কবি নিন্দুকদের প্রতি তাঁর মনোভাব ভাষণে স্পষ্ট করেছিলেন। শুধু গীতাঞ্জলি নয়, সেই সময় অনূদিত হচ্ছে  তাঁর অন্যান্য কবিতা, ছোটগল্প নাটক। তাঁর খ্যাতি ব্যাপ্ত হয়ছে জগৎ জুড়ে। Song Offerings জয় করেছে বিশ্ববাসীর মন। আর বাঙালী পাঠক ! বাঙালী পাঠক আজ ও ডুবে থাকে তাঁর গীতাঞ্জলির কথায়। আলোচনার শুরুতে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে Song Offerings গীতাঞ্জলির ভাবানুবাদ। পশ্চিমী শ্রোতার কাছে এর যে আবেদন তার থেকে অনেক বেশি আপন বাঙালীর কাছে গীতাঞ্জলি। একথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। 


তথ্যসূত্র : –
রবীন্দ্র রচনাবলী – ষষ্ঠ খণ্ড ।
রবীন্দ্র –কাব্য –পরিক্রমা – উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
একত্রে রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরী।
গীতাঞ্জলি :  বঙ্গ সংস্কৃতির বিশ্বদর্শন (প্রবন্ধ)  – হায়াৎ সাইফ  ( সৌজন্যে ফেসবুক)
গীতাঞ্জলি (প্রবন্ধ) – পলাশ সরকার।  ( সৌজন্যে banglasahayak.com)
Song Offerings – Rabindra Nath Tagore.
https://www.researchgate.net/publication/279404078_Gitanjali_Song_Offerings_a_Bibliometric_Study
The “Gitanjali”: Or Song-Offerings of Rabindra Nath Tagore Author(s): May Sinclair