।।বর্তমান সমাজদর্পণে রামকথার প্রতিচ্ছবি।।

কলমে: মধুরিমা চ্যাটার্জী।


            মহাভারতের আদিপর্বে একটি শ্লোক আছে –
“আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে।
আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভূবি।।”

অর্থাৎ, কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। মনে হচ্ছে তো মহাভারতের শ্লোক কেন রামায়ণ প্রসঙ্গে উত্থাপন করছি? আসলে এই উক্তিটি রামায়ণ সম্বন্ধেও একশো শতাংশ খাটে। বাল্মীকি আদিকবি এবং তাঁর রচিত ‘রামায়ণ’ আদি মহাকাব্য। কিন্তু কীভাবে সৃষ্টি হল এই রামায়ণের?

      রামায়ণ সৃষ্টির গল্পটা অনেকটা এইরকম,
জাহ্নবীর নিকটস্থ তমসা নদীর তীরে বাল্মীকি দেখেন বনের নিকটে এক কলকন্ঠ ক্রৌঞ্চ মিথুন বিহার করছিল, এমন সময় এক ব্যাধ এসে ক্রৌঞ্চকে বিনাশ করল। নিহত ক্রৌঞ্চকে শোনিতাক্ত দেখে এবং ক্রৌঞ্চীর করুণ রোদন শুনে ধর্মাত্মা বাল্মীকির মনে দয়ার সঞ্চার হল। ব্যাধের এই কাজকে অধর্মজনক মনে করে তিনি অভিশাপ দিয়ে বললেন, নিষাদ তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না, কারণ তুই ক্রৌঞ্চ-মিথুনের একটিকে কামমোহিত অবস্থায় বধ করেছিস। শোকে আকুল হয়ে বাল্মীকি কী বলেছেন তা তিনি নিজেই ভাবতে লাগলেন। এমন সময় ব্রহ্মা এসে জানালেন যে বাল্মীকির অভিশাপস্বরূপ এই শ্লোকোৎপত্তির কারণ তারই(ব্রহ্মারই) ইচ্ছা। আর ব্রহ্মারই আর্শীবাদে ও আদেশে বাল্মীকি রচনা করলেন রামায়ণ।

           রামায়ণ রচনার সময়টা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দ। তারপর বয়ে চলা সময়ের সাথে সাথে একটা বিষয় দেখা গেছে যে, ভারতীয় সাহিত্যে রামবিষয়ক অনেক কথা পাওয়া যায়, কিন্তু তার আখ্যানভাগ সর্বাংশে সমান নয়। এক্ষেত্রে “ভাষা ও ছন্দ”-এ রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন,
” নারদ কহিলা হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি, রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ “
কালের নিয়ম মেনে রামকথার নদীতে অনেকেই অবগাহন করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণ, তুলসীদাসের রামায়ণ কিম্বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং পরের দিকে অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণ হয়ে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ঘেঁটে রাজশেখর বসুর সারানুবাদ দেখলে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, রামরাজ্য সম্পর্কে তথ্যের অগাধ ও অবাধ প্রয়োগ সর্বত্র। একথা খুব সহজেই বলা যায়, রামায়ণ পাঠে পাঠক কিছু অতিকথনের মুখোমুখি হন, যেগুলি এই মহাকাব্যটিকে ধর্মগ্রন্থের সমতুল বর্ণনায় টেনে নিয়ে যায়। তবু এটা ধর্মগ্রন্থ নয়।

               বিশেষজ্ঞ পন্ডিতগণ অনেকেই একথা মানেন যে, বাল্মীকির মূল গ্রন্থের সবটাই বাল্মীকির লেখা নয়। তার সঙ্গে অনেক অংশ পরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে; মূলত ‘উত্তরকান্ড’। প্রক্ষিপ্তের উপস্থিতি সত্ত্বেও সমগ্র রচনাই যে বাল্মীকির মাহাত্ম্যে মহান ও অমলিন একথা স্বীকার্য।

           লেখকভেদে বদলে যাওয়া এই রামকথা বাস্তবিকপক্ষে কোনো ইতিহাস নয়। আর্য ও অনার্য পরম্পরায় সচল থাকা নীতিবোধ, বিশ্বাস, আচার ইত্যাদি সাংস্কৃতিক ধারাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান থেকেছে টানাপোড়েনেরই ইতিকথা। এই রামচরিতমানস বন্দনায় যেটা মূল সুর হয়ে বেজেছে তা হল সংগ্রামের কাহিনি। সহজ কথায়, ত্রেতাযুগে নররূপী নারায়ণের সঙ্গে অসভ্য রাক্ষসদের লড়াই, যার ফলে দাক্ষিণাত্যে আর্যসভ্যতার প্রসার, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সংক্রান্ত এক রূপক  ব্যাখ্যা হল রামায়ণ।

“চতুর্বিংশৎ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান্ ঋষিঃ।
তথা সর্গশতান্ পঞ্চ ষটকান্ডানি তথোত্তরম্।।”

       – বাল্মীকি ঋষি চব্বিশ হাজার শ্লোক, পাঁচশ সর্গ এবং ছয় কান্ড তথা উত্তরকান্ড রচনা করেছিলেন। এই রামায়ণে সত্য ঘটনা কতটুকু আছে, রূপক বা nature myth কতটুকু আছে, রামায়ণকার বাল্মীকি বাস্তবিকই রামের সমকালীন কিনা – এইসব সন্ধান এবং ব্যাখ্যা এই আলোচনার বর্হিভূত। আসলে আমরা যে সংস্কারী বা সন্দিগ্ধ মন নিয়ে ‘আধুনিককালের আধুনিক রচনা’ বিচার করি তা নিয়ে রামায়ণ বিচার একপ্রকার অপ্রাসঙ্গিক এবং অমূলক। আদিকবি বাল্মীকি তৎকাল প্রচলিত কথারচনার রীতি ও নৈতিক আদর্শ অনুসারেই তাঁর মহাকাব্যের নায়ক-নায়িকাদের চরিত্র বিবৃত করেছেন।

        রামের জীবন কাহিনি ও তাঁর শাসনপ্রণালীর বর্ণনা ‘নানা মুনির নানা মতে’ বিভ্রান্তিকর। তবুও সাতকান্ডের অমৃতসুলভ রামকথা এখনকার প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কতখানি আত্মদীপ্তিতে উজ্জ্বল তার সন্ধান করাই আমার লেখনীর অভিপ্রায়। উত্তরকান্ডের বৈধতার বিতর্ককে একপাশে সরিয়ে রেখে আলোচনাকে সার্থক করে তুলতে ক্রমান্বয়ে কান্ড ধরে সন্ধানীদৃষ্টিতে বর্তমান সমাজে রামায়ণের প্রাসঙ্গিকতার খোঁজ চালালাম।

             রামায়ণের প্রথমকান্ড হল “বালকান্ড” বা “আদিকান্ড”। এই অংশে রামায়ণ রচনার প্রেক্ষাপট ও কারণ থেকে শুরু করে অযোধ্যাধিপতি দশরথের পরিচয়, রামের জন্ম, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণের গমন এবং এরপর একে একে বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্বলাভ, রামের হরধনুর্ভঙ্গ, রামাদির বিবাহ ও অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি উপাখ্যান গ্রন্থিত হয়েছে। সূচনাংশের নারদ-বাল্মীকি সংবাদে আমরা পাঠকবর্গ দেখতে পাচ্ছি বাল্মীকির সন্ধান অনুযায়ী অর্থাৎ
“গুণবান, বীর্যবান, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাদী, দৃঢ়ব্রত, সচ্চরিত্র, সর্বভূতের অধিকারী, বিদ্বান, কর্তব্যপালনে সমর্থ এবং অদ্বিতীয়, প্রিয়দর্শন, আত্মসংযমী, কান্তিমান, জিতক্রোধ ও অসূয়াশুন্য”
ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা রামের পরিচয় দিলেন নারদ। রামকে শুরুতেই যেভাবে মহান করে প্রতিষ্ঠা করলেন তাতে সত্যতা এবং স্বাভাবিকতা একটু হলেও নড়ে গেল। রামায়ণে যে রামেরই গুণাগুণ বর্ণিত হবে তা অভিপ্রেত। কিন্তু পাঠক কিছুটা হলেও এক্ষেত্রে অতিকথনের ঢেউ এ ধাক্কা খায়। কিছুটা পরে নারদ ভবিষ্যদুক্তি করে বলছেন, –
“রামরাজ্যে লোকে আনন্দিত, সন্তুষ্ট, পুষ্ট, ধর্মপরায়ণ, নিরাময়, নীরোগ এবং দুর্ভিক্ষভয়শূন্য হবে। কোনও পুরুষ কখনও পুত্রের মরণ দেখবে না, নারীগণ নিত্য অবিধবা থাকবে এবং পতিব্রতা হবে।”
রামরাজ্যের এহেন বর্ণনা একথায় স্বপ্নরাজ্যের তুল্য। অলৌকিকতার ছোঁয়া থাকলেও বোধহয় প্রত্যেক রাজ্যবাসী তথা দেশবাসী ঠিক এমনই একটা স্বপ্ন দেখে থাকেন এবং সত্যি হওয়ার আশাও করেন।

         বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজসুখ সন্ধানে সদাব্যস্ত। প্রয়োজনে এবং অভীষ্ট সিদ্ধার্থে মানুষ অনেক সময় ছলনা ও কূটনীতির আশ্রয় নিতেও পিছপা হন না। এইরূপ অযোধ্যার রাজা দশরথও অনেক তপোনুষ্ঠান করেছিলেন কিন্তু তাঁর পুত্রলাভ হয়নি। পুত্রলাভের কামনায় দশরথ অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকেও কৌশলে ব্যবহার করে সফল হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মহাত্মা দশরথের সন্তানলাভের কামনার তুলনায় প্রকট হয়ে উঠেছে ‘পুত্রলাভ’-এর কামনা।শুধু তাই নয়,স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দশরথের মধ্যেকার পক্ষপাতিত্ব। যজ্ঞাগ্নির পর প্রজাপতি-প্রেরিত পুরুষ যে দেব নির্মিত সন্তানদায়ক পায়েস রাজা দশরথের পত্নীদের খেতে দিয়েছিলেন তা দশরথ ভাগ করেছেন অনেকটা এইভাবে –
” … অন্তঃপুরে এসে পায়সের অর্ধাংশ কৌশল্যাকে দিলেন। অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধাংশ সুমিত্রাকে দিলেন। অবশিষ্টের অর্ধ কৈকেয়ীকে দিয়ে মনে মনে বিবেচনার পর শেষ অংশ আবার সুমিত্রাকেই দিলেন। তিন মহিষী সেই পায়স খেয়ে অচিরে গর্ভধারণ করলেন।”
এরপর দ্বাদশ মাস পূর্ণ হলে কৌশল্যা চৈত্রের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে রামকে প্রসব করলেন। তারপর কৈকেয়ী পুষ্যা নক্ষত্রে ভরতকে এবং সুমিত্রা অশ্লেষা নক্ষত্রে লক্ষ্মণ-শত্রুঘ্নকে প্রসব করলেন।

          মারীচ এবং সুবাহু—–দুই কামরূপী শক্তিশালী রাক্ষস। স্বভাবতই নানাপ্রকার বিঘ্নের একমাত্র কারণ। অতিরিক্ত বিঘ্ন সৃষ্টির ফলে মহামুনি বিশ্বামিত্র যজ্ঞে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। কিন্তু ক্রোধান্বিত বিশ্বামিত্র এই দুই রাক্ষসকে তাদের দুষ্কর্মের জন্য শাপ দিতে অক্ষম। কেন না যজ্ঞকালে শাপ দেওয়া অকর্তব্য। বিশ্বামিত্র এই দুষ্ট রাক্ষসদ্বয়কে বধ করতে রামকে প্রয়োজনের কথা রাজা দশরথকে জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রতি পিতা দশরথের পিতৃস্নেহ প্রকাশ পাচ্ছে। দশরথ জানাচ্ছেন –
“আমার ষাটহাজার বৎসর বয়স হয়েছে, কৃচ্ছ্রসাধনার ফলে রাম জন্মেছে তাকে নেওয়া আপনার উচিত নয়। আমার চারপুত্রের মধ্যে রামের প্রতিই আমার সমধিক স্নেহ।”

          ক্রোধ বরাবরই বুদ্ধি বিনাশ করে। ক্রোধের অন্ধকারে নিপতিত হয়ে মানুষ ঠিক ভুলের বিচার করতে ব্যর্থ হয়। রামায়ণে বালকান্ডের অন্তর্ভুক্ত সগর রাজার উপাখ্যানেও অতিরিক্ত ক্রোধে কীভাবে অন্ধতা প্রাপ্তি ঘটছে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। রামের পূর্বপুরুষ সগর রাজার দুই মহিষী। জ্যেষ্ঠা মহিষী বির্দভরাজকন্যা কেশিনী, কনিষ্ঠা মহিষী কশ্যপের কন্যা ও গরুড়ের ভগিনী সুমতি। কেশিনীর পুত্র অসমঞ্জ; পরবর্তীকালে অত্যাচারী ও দুর্বৃত্ত হয়ে উঠলে সগর তাকে নির্বাসিত করেন। আর অন্যদিকে সুমতি যে তুম্বাকার পিন্ড প্রসব করেছিলেন তা থেকে ষাটহাজার পুত্র নির্গত হয়। পরবর্তীকালে সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং ইন্দ্র সেই যজ্ঞের অশ্ব অপহরণ করেছিলেন। তখন সগর ষাটহাজার পুত্রকে আজ্ঞা দিলেন যতক্ষণ যজ্ঞাশ্ব এবং তার চোরকে না পাও ততক্ষণ পৃথিবী খনন করে অনুসন্ধান করো। তখন তারা প্রত্যেকে একবর্গ যোজন জমি শূল ও হল দ্বারা ভেদ করতে লাগলেন। বসুমতী আর্তনাদ করে উঠলেন। বহু প্রাণী বিনষ্ট হতে লাগলো। তখন বসুধারার স্বামী মহাত্মা কপিল (বাসুদেব) অতি ক্রোধাবিষ্ট হয়ে হুংকার করলেন এবং তাতে সমস্ত সগর সন্তান ভস্মরাশিতে পরিণত হলো। যদিও পরবর্তীকালে প্রিয়ভাষী বীর্যবান পৌত্র অংশুমান যজ্ঞাশ্ব নিয়ে ফিরে আসেন এবং পিতামহ সগর যথাবিধি যজ্ঞ সমাপন করেছিলেন।

        শুধু ক্রোধই নয় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও অনেক সময় পতনের কারণ হয়। বালকান্ডের অন্তর্ভুক্ত ত্রিশঙ্কুর উপাখ্যানও অনেকটা সেই কথাই বলছে। ত্রিশঙ্কু নামে এক ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ছিলেন। তাঁর আকাঙ্খা হয়েছিল যে যজ্ঞের প্রভাবে সশরীরে দেবলোকে যাবেন। কিন্তু বশিষ্ট এবং তাঁর শতপুত্র উভয়ই ত্রিশঙ্কুকে জানালেন যে ইহা অসাধ্য। পরবর্তীকালে নিজ চাহিদাতে অনড় ত্রিশঙ্কুর মতিগতি বুঝে ঋষিপুত্রগণ শাপ দিলে ত্রিশঙ্কু চন্ডালে পরিণত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্বামিত্রের তপোবলে সশরীরে তিনি স্বর্গারোহণ করলেন। তখন দেবগণসহ ইন্দ্র গুরু শাপে আক্রান্ত ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গবাসের অধিকার দিলেন না। অবশেষে সুরাসুর ও ঋষিগণের সঙ্গে বিশ্বামিত্রের বাদানুবাদের পর দেবগণ বললেন ত্রিশঙ্কু দেবতুল্য হয়ে জ্যোর্তিময়রূপ ধরে অবস্থান করবে আকাশে এবং নক্ষত্ররা তাঁকে অনুসরণ করবে।

            সন্তানস্নেহের বৈষম্যতার স্বীকার শুনঃশেপ। তাঁর উপাখ্যান থেকে জানতে পারছি অযোধ্যার রাজা অম্বরীষের যজ্ঞের পশু হরণ করেছিলেন ইন্দ্র। পুরোহিত অম্বরীষকে বিধান দিয়েছিলেন হয় যজ্ঞের আগে পশুকে অন্বেষণ করে নিয়ে আসুন নতুবা প্রায়শ্চিত্ত করুন। যজ্ঞীয় অপহৃত পশুকে না পেয়ে অম্বরীষ মহর্ষি ঋচীককে লক্ষ ধেনুর বিনিময়ে তাঁর এক পুত্রকে বিক্রয় করার প্রস্তাব দিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋচীকের প্রিয় এবং কনিষ্ঠ পুত্র ঋচীকের ভার্যার প্রিয়। সুতরাং জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ উভয়ই অবিক্রেয়। তখন মধ্যম পুত্র শুনঃশেপ বহু সুবর্ণ রত্ন ও ধেনুর পরিবর্তে বিক্রিত হয়ে অম্বরীষের সঙ্গে চলে গেলেন। এখনকার সময়পর্বে দাঁড়িয়েও একই পিতা মাতার একাধিক সন্তান এবং তাদের মধ্যেকার ভালোবাসা ও স্নেহ বন্টনে মাতা পিতার পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা, দ্বন্দ্ব-বিবাদের উৎপত্তি ও ভাই বোনেদের মধ্যেকার সম্পর্কের বাঁধন বেশ আলগা হয়ে পড়ছে।


           রামাদির বিবাহ অংশে একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে তা হল, আর্য সমাজে স্থিরীকৃত বিবাহ-রীতি অনুসারে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে অভিভাবকদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। অন্যদিকে এই রীতিতে অনার্যরা ছিল তুলনামূলক ভাবে বেশি স্বাধীন। জনক রাজার পছন্দে নির্দিষ্ট করা কিছু পাত্রের মধ্যে রাম হরধনুভঙ্গ করে মাত্র তেরো বছর বয়সে ছ’বছর বয়সী পাত্রী সীতাকে বিবাহ করেন। সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাহীন অবস্থায় বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন রাজা দশরথ ও জনক। এক্ষেত্রে যে বাল্যবিবাহের ইঙ্গিতও স্পষ্ট তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

             দ্বিতীয় কান্ড হল “অযোধ্যা কান্ড“। এই অংশে আমরা দেখি দাসী মন্থরার মন্ত্রণায় প্ররোচিত হয়ে কৈকেয়ীর ছলনায় রামের রাজসিংহাসনলাভের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। শুধুই তাই নয়, পিতৃসত্য পালনে রামচন্দ্রকে বনবাসে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হয়। পতিব্রতা সহধর্মিণী সীতা এবং একান্ত অনুগত ভাই লক্ষ্মণ তাঁর সঙ্গী হন। এই অযোধ্যা কান্ডেই প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র রামের বিরহে রাজা দশরথের মৃত্যু ঘটছে। শুধু তাই নয়, মাতুলালয় থেকে ভরতের অযোধ্যায় ফিরে আসা এবং মাতা কৈকেয়ী এর এহেন কার্যে চরম ধিক্কার জানিয়ে ভ্রাতৃপ্রেমবশত বন থেকে রামকে খুঁজে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যর্থ প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করি। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে রাজ পরিবারের আভ্যন্তরীণ জটিল ও কুটিল রাজনৈতিক সমীকরণের উপস্থিতি। মন্থরার প্ররোচনায় ভেদবুদ্ধি লুপ্ত হয়েছে কৈকেয়ীর। মন্থরা শয়নগৃহে গিয়ে কৈকেয়ীকে বলছেন—-
” ওরে মূঢ়,ওঠ, শুয়ে আছ কেন, তোমার বিপদ উপস্থিত হয়েছে। তুমি দুঃখভারে প্রপীড়িত, নিজের প্রকৃত অবস্থা বুঝছ না। তুমি প্রিয়া নও, কেবল বাইরে সুভাগার আচরণ পেয়ে থাক, তবু তুমি সৌভাগ্যের গর্ব কর! তোমার সৌভাগ্য গ্রীষ্মে নদীর স্রোতের ন্যায় অস্থায়ী।”

মন্থরা আরও জানাচ্ছেন,
” জন্মক্রম অনুসারে রামের পর ভরতেরই অধিকার, সেজন্যই রাম তাকে ভয় করবে। ভাগ্যবতী কৌশল্যা রাজমাতা হবেন, তুমি তাঁর দাসী হয়ে হাত জোড় করে থাকবে, আর ভরত রামের দাস হবে।”
এইপ্রকার মন্ত্রণার জালে আটকা পড়ে কৈকেয়ী রাজা দশরথকে  প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করাচ্ছেন এবং দুই বর চেয়ে নিচ্ছেন –

ক. অভিষেকের যে আয়োজন হয়েছে তাতে রামের পরিবর্তে ভরতের অভিষেক হবে।
খ. রাম চীর-অজিনধারী তপস্বী হয়ে চতুর্দশ বর্ষ দন্ডকারণ্যে বাস করুক, ভরতের যৌবরাজ্য নিষ্কন্টক হক।

        বর্তমান সময়পর্বে দাঁড়িয়েও অনেক সময় এহেন নীচবুদ্ধি প্রয়োগের দ্বারা নিজ কার্যসিদ্ধির ঘটনা প্রায়শই দেখি। মূলত লোভ ও লালসা মানুষের মনুষ্যত্বকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

            “অরণ্য কান্ড” হল রামায়ণের তৃতীয় কান্ড। এই কান্ডের মূল বিষয় হল রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বনবাসী জীবন এবং রাবণ কর্তৃক সীতা হরণ। বর্ণনার শুরুতে দেখা যায় যে, রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ চিত্রকূট, অগস্ত্যের বন হয়ে পঞ্চবটীতে আসেন। দন্ডকারণ্যের বিস্তীর্ণ অরণ্যে তাঁরা তখন প্রায় দশবছর কাটিয়েছেন। সেই ঘুরে বেড়ানোতেই তাঁদের নিজের এলাকায় পেয়েছেন সূর্পণখা। বীর্যবান, সুদর্শন রাজপুত্র রাম ও লক্ষ্মণকে দেখে সূর্পণখার ভালো লাগে। মনে ভালোবাসার উদয় হয়। কিন্তু রাক্ষসী সূর্পণখার আসল পরিচয় স্পষ্ট হলে প্রেম নিবেদনের অপরাধে তাঁর শাস্তি জুটেছে। কাটা গেছে নাক আর কান। এক্ষেত্রে রামের কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন লক্ষ্মণ। পিছপা হননি নারী নিগ্রহের মতো নিন্দিত কর্মে। বোধ হয় সংযতচিত্তের পরিচয় এটা নয়। এই ঘটনার পশ্চাতে আসলে অনুরণিত হয়েছে আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার অহংকারী স্বর। পাশাপাশি অনার্যের প্রতি প্রবল অবজ্ঞা। শুধু তাই নয়, বর্ণবৈষম্য তথা জাত্যাভিমানের দর্পও প্রকট, যেখানে আর্য যুবকের প্রতি অনার্য দলিতকন্যার প্রেমের প্রকাশে কোনো অধিকার নেই। আর্যের রাজত্বে অনার্যের অবস্থান নিঃশব্দে ও নতমস্তকে। তাই সমকক্ষতা দাবি সেখানে শুধু অন্যায় নয়, নীতিবিরুদ্ধও।

      অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে সেই প্রতিবাদী কন্ঠকে কী করে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিতে হয় তার ঘটনাও এই কান্ডেই আছে। সূর্পণখা রক্তাক্ত হয়ে তার সকল ব্যথার কথা ভাইদের জানালে তারাও স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদী হন। কিন্তু ফলাফল হয় অকাল মৃত্যু। এরপর অগত্যাই রাবণের শরণাপন্ন হওয়া। এদিকে অন্যায়ের শাস্তিবিধানে রাজা রাবণের অন্ধ ক্রোধের মাঝে পড়ে মারীচের দমবন্ধকর পরিস্থিতি। একদিকে রাবণের আজ্ঞাবহ না হলে রাবণের হাতেই মৃত্যু আর অন্যদিকে রাবণের কথায় চললে রামের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু। এখানে বলা যায় মারীচ যেন  সাধারণ জনগণেরই প্রতিনিধি। শুধু তাই নয়, এই কান্ডেই সীতাকে হারিয়ে রামের ভালোবাসার গভীরতারও সাক্ষ্য মেলে।

            রামকথার পরবর্তী কান্ড(চতুর্থ কান্ড) হল “কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড”। এখানে মূলত বানরদের সঙ্গে রামের মিত্রতা এবং সীতা উদ্ধারের পরিকল্পনা বর্ণনা করা হয়েছে। এই কান্ডেই হনুমানের মতো বীরকে আমরা দেখি বিপদগ্রস্ত রামচন্দ্রের পাশে। এসব সত্ত্বেও এখানে কিন্তু রাজনীতির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ সুগ্রীবের কাছে রামের বালী-বধ এর প্রতিশ্রুতি। এক শরেই বালীকে বধ করে মিত্র সুগ্রীবকে অধিশ্বর করেছেন রাম। সীতাকে উদ্ধারের জন্য রামের সুগ্রীবকে প্রয়োজন। কিন্তু রামের এহেন আড়াল থেকে বালী-বধ কি ক্ষত্রিয়-বীরোচিত কার্য? আপন ব্যক্তি-স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য তো এও একপ্রকার হত্যা নয় কি? বীর্যবান, শক্তিবান, ন্যায়পরায়ণ, যুক্তিবাদী, সচ্চরিত্র, দয়ালু রাম তো বালীকে সম্মুখ-সমরে আহ্বান জানাতে পারতেন কিন্তু তিনি কৌশলে ও অছিলায় ‘প্রশাসক’ বালীর প্রাণনাশ করলেন।

             ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীরা এই প্রকার হত্যাকার্য ও ধ্বংসলীলা চালায়। বেশিরভাগ সময় এই জঘন্য অপরাধগুলো ঘটে থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফলে অনায়াসে ক্ষমতা কায়েম করে সাধারণ জনমানসে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে তারা বিরাজ করেন। আধুনিক সময়পর্বে দাঁড়িয়ে তাই বলা যায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এমন আগ্রাসী মনোভাব নতুন কিছু নয়।

            এই কিষ্কিন্ধ্যা কান্ডে যেমন রাম-সুগ্রীবের মৈত্রী স্থাপন, রামের বালীবধ, এবং সুগ্রীবের রাজ্যলাভ ইত্যাদি আছে তেমনি আবার সীতার দুঃখে কাতর বিচক্ষণ রাম সুগ্রীবকে ভুল বুঝেছেন। তিনি এবং লক্ষ্মণ মনে করেছেন সুগ্রীব রাজ্য ও মহিষী ফিরে পেয়ে রামকে দেওয়া সীতা উদ্ধারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হয়েছেন। এবং পরবর্তীকালে লক্ষ্মণও সুগ্রীবকে ভৎর্সনা করেছেন।
        মানসিক অস্থিরতা অনেক সময় কাছের সম্পর্কের হানি ঘটায়। বন্ধু দুর্লভ বর্তমান সময়ে কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়। এইভাবেই আমরা জীবনের পাঠ নিয়ে থাকি। কখনও কখনও বিশ্বাস করে ভুল করি, কখনো আবার জিতেও যাই।

            রামায়ণের পঞ্চম কান্ড হল “সুন্দর কান্ড”। এই কান্ডে হনুমানের লঙ্কাযাত্রা, লঙ্কায় প্রবেশ, জানকী দর্শন এবং অমৃতফল লাভ, মধুবন ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে বানরকুলে সেই আনন্দবার্তা প্রচার ইত্যাদিতে ভরা এই পর্ব। হনুমানের সাগরলঙ্ঘন করে লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করার মতো দুষ্কর কর্ম পাঠককে অবাক করে। আরো অবাক হই হনুমানের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষার একাগ্রতায়। রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কাপুরী এবং তাঁর একান্ত অনুগত শতাধিক নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর রাক্ষস-রাক্ষসীদের মধ্যে বেশ আলাদাভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন বৃদ্ধা রাক্ষসী ত্রিজটা এবং রাবণের ভ্রাতা বিভীষণ। যখন অন্যান্য রাক্ষসীরা রাবণের বশবর্তী হওয়ার জন্য প্রাণনাশের ভয় দেখাচ্ছে তখন জনকতনয়া সীতা মনোবল ফিরে পাচ্ছেন ত্রিজটার কথায়, তার স্বপ্নদর্শন বর্ণনায়। ত্রিজটা জানাচ্ছেন রাক্ষসকুল ধ্বংস হবে এবং জয় হবে সীতাপতির। দশরথপুত্রবধূ সীতা হৃষ্ট হয়ে জানাচ্ছেন,
“তোমার কথা যদি সত্য হয় তবে আমি তোমাদের রক্ষা করব।”

        অন্যদিকে ব্যতিক্রমী বিভীষণ চরম ক্রুদ্ধ , জ্ঞানশূন্য রাবণকে রোষ ত্যাগ করে শান্ত হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি রাবণকে বলেছেন,
” তুমি ধর্মজ্ঞ, কার্যজ্ঞ, রাজধর্মবিশারদ ও বিচক্ষণ, যদি ক্রোধের বশীভূত হও তবে তোমার শাস্ত্রজ্ঞান বৃথা হবে। অতএব শান্তচিত্তে উচিত অনুচিত বিচার করে এই দূতকে দন্ড দাও।”
রাক্ষসকুলে জন্মগ্রহণ করে এবং রাবণের ভ্রাতা হয়েও বিভীষণ অবাক করেন। বিভীষণ এবং তার কথার মধ্য দিয়ে রামায়ণ রচয়িতা আসলে মানবসমাজকে শিক্ষাদানের কাজটা অনায়াসভঙ্গিতে সেরে ফেলেছেন। দম্ভ, অহংকার এইসব এক লহমায় চূর্ণ হয়ে যায় সত্যের কাছে। তার স্বচ্ছতা নিত্য অমলিন।

            রামায়ণের ষষ্ঠ কান্ড “যুদ্ধকান্ড”। মনে করা হয় এই কান্ডটিতেই বাল্মীকি রামায়ণের সমাপ্তি। অনেকেই মনে করেন যে এর পরের কান্ড অর্থাৎ ‘উত্তরকান্ড’ বাল্মীকির রচনা নয়। কারণ উত্তরকান্ডের রচনাশৈলী পূর্বোক্ত ছয় কান্ডের সঙ্গে মেলে না। যাই হোক, যুদ্ধকান্ডে যে পুরোপুরি যুদ্ধের বর্ণনা থাকবে তা খুবই স্বাভাবিক। তবে এই কান্ডের আকর্ষণীয় বিষয় হল ইন্দ্রজিতের বীরত্ব প্রকাশ। এই অংশেই রাম-লক্ষ্মণ এবং তাঁদের পরম মিত্র সুগ্রীব ও তাঁর শক্তিশালী বানরবাহিনীর দ্বারা ধূম্রাক্ষ, বজ্রদংষ্ট্র, অকম্পন, প্রহস্ত, কম্পন, প্রজঙ্ঘ, শোনিতাক্ষ, যূপাক্ষ, কুম্ভ, নিকুম্ভ , নরান্তক, দেবান্তক, মহোদয়, ত্রিশিরা, মহাপার্শ্ব এবং একে একে কুম্ভকর্ণ, মকরাক্ষ বধের ঘটনা দেখি। শুধু তাই নয়, ইন্দ্রজিৎ এবং রাবণও পরাজয় স্বীকার করেছেন এবং নিহত হয়েছেন। কাহিনি অনুসারে এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক এবং অনুমেয়।

             রামকে প্রতিহত করতে রাবণ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মন্ত্রণা ও ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন। রামের মায়ামুন্ড নির্মাণ করে সীতাকে নিজ দখলে আনতে চেয়েছেন।
         অন্যদিকে বিভীষণের যথার্থ পত্নী সরমা। রাবণ যখন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রামের মৃত্যুর খবর সীতাকে জানাচ্ছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই সীতা বিচলিত হচ্ছেন, দুঃখে কাতর হয়ে পড়ছেন। বিভীষণ পত্নী সরমাকে তখন আমরা দেখছি সীতার পাশে। তিনি আসল সত্যটা অর্থাৎ রাম জীবিত আছেন এবং রাম খুব শীঘ্রই রাক্ষসকুল ধ্বংস করে সীতাকে উদ্ধার করবেন এই ধরনের কথা বলে সীতাকে প্রবোধ দিয়েছেন।

               রাবণ বধের পর লঙ্কার সিংহাসনে বিভীষণের অভিষেক ঘটছে। এই ঘটনাগুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখলে যে ঘটনাটা পাঠককে অবাক করে সবচেয়ে বেশি তা হল, রামের সীতা প্রত্যাখ্যান এবং সীতার অগ্নিপরীক্ষা। বৈদেহীর প্রতি রামের একনিষ্ঠ প্রেম-ভালোবাসায় পূর্ণ হৃদয়ের এহেন পরিবর্তন বেশ বিস্মিত করে। বিচক্ষণ রামের অস্থির মতির পরিচায়ক এই ঘটনা। পরবর্তীতে রামের প্রত্যাবর্তন এবং অভিষেক ইত্যাদি মিলনান্তক ঘটনার মধ্যে দিয়েই এই যুদ্ধকান্ডের পরিসমাপ্তি ঘটছে।

          আলোচনার সম্পূর্ণাতার্থে এবং প্রক্ষিপ্ততার বিতর্ককে আমল না দিয়ে সর্বশেষ কান্ড “উত্তরকান্ড”-কে নিয়ে কিছু কথা বলা হল। এই অংশে মিলনান্তক বর্ণনা এক নিমিষেই বিয়োগান্তক হয়ে ওঠে। পূর্ববর্তী যুদ্ধকান্ডে আমরা দেখি রাম রাজ্যে লোক নিন্দায় সীতার ত্যাজ্য হওয়ার ঘটনা এবং পাশাপাশি অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন। এই কান্ডেও শূদ্র হয়ে তপস্যা করার অপরাধে রাজা রামের হাতে মাথা কাটা যায় শম্বুকের অথচ চন্ডালরাজ গুহক রামের বন্ধু! এহেন চারিত্রিক বৈপরীত্যতা ব্যাখ্যার সহজ উত্তর আছে কি? আবার অন্যদিকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ছুটিয়ে রাজ্য বিস্তারের রাজবার্তা রামের সাম্রাজ্য লোভী পুরুষতান্ত্রিক মনের পরিচয় বহন করে। সীতার অবস্থা মূলত রাম রাজ্যে নারীর স্বাধীনতাহীন অবস্থাকেই স্পষ্ট করে। অগ্নিদেবের কাছে সতীত্বের পরীক্ষা, পাতাল প্রবেশ কিংবা সন্দেহের বশে স্বামীর প্রত্যাখ্যান ও গঞ্জনা কিছুটা হলেও স্বামী হিসাবে রামের অযোগ্যতাকেও প্রকাশ করে। বর্তমান সময় ও সমাজে এহেন অনেক সীতাকেই নীরবে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। ‘শিক্ষিত’ বলে দাবী করা আধুনিক মানুষজন হিসেবে আমরা কি সত্যিই ততটা উদার? প্রশ্নটা থেকে যায়। 

‘সীতার রসাতলে প্রবেশ’ অংশে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী রাম জানাচ্ছেন,
‘পূর্বে লঙ্কায় সুরগণের সমক্ষে বৈদেহী শপথ করেছিলেন সেজন্যই এঁকে গৃহে নিয়েছিলাম।’

এই অংশে রামের কন্ঠে সীতার প্রতি দয়ার স্বর শোনা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোথাও যেন অবহেলিত ও অপমানিত হচ্ছে সীতার রামের প্রতি একনিষ্ঠ আন্তরিক ভালোবাসা। লোকাপবাদের ভয়ে রাম পুনর্বার ত্যাগ করছেন পবিত্র সীতাকে। কিন্তু শুদ্ধস্বভাবা মৈথিলী রামের প্রতি নিজের ভালোবাসা এবং চরিত্রের মর্যাদাকে সাক্ষী রেখে পাতাল প্রবেশ করছেন। যোগ্য উত্তর দিচ্ছেন। অন্তরালে স্পষ্ট এক প্রতিবাদী নারী কন্ঠস্বর। বিচক্ষণ রাম কতখানি সত্যের পূজারী তা প্রশ্ন তোলে। কিছুটা হলেও প্রশ্ন থেকে যায় রামের মেরুদন্ডহীনতা নিয়ে।

        ব্যস্ত শহর। ততোধিক ব্যস্ত শহরবাসী। ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপে চাপা পড়ে গেছে মন-মানবিকতা এবং একান্ত নিজস্ব অনুভূতি ও অভিব্যক্তি। দুচোখ জুড়ে শুধুই আকাশ ছুঁতে চাওয়ার স্বপ্ন। বলা ভালো সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই, পর্যবসিত হয়েছে লোভ-লালসায়। ছল করে সবকিছুটা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে শুধুমাত্র নিজের করে নেওয়ায় বিশ্বাসী এখনকার অধিকাংশ মানুষজন। অর্থ-যশ ও প্রতিপত্তি লাভের আশায় শিকড়হীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষের প্রয়োজন এক আদর্শের। দু হাজার বাইশ সালের ‘ডিজিট্যালাইজড’ সময় সরণীতে দাঁড়িয়ে দেখি রাম ও রামায়ণ আজ সেলুলয়েড বন্দী। নিছক বিনোদনের অংশমাত্র। আলাদা করে শিক্ষালাভ বা চরিত্র গঠনের জন্য ব্যবহৃত নয়। দেবতা রামের দেবত্বকে যদি একটু সরিয়ে রেখে বিচার করি তাহলে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে যে সমাজচিত্রটা দেখি তা বেশ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিরাজমান। তাই সদর্থক দিক থেকে রাম ও রামায়ণ হয়ে উঠুক মানুষের যথার্থ চরিত্র নির্মাণের হাতিয়ার।