।। বিনোদনের নিক্তিতে ‘সিনেমা’ না ‘ওয়েবসিরিজ’ কার পাল্লা ভারী? ।।
কলমে : : মধুরিমা চ্যাটার্জী
" পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! বায়োস্কোপ! আসুন! দেখুন! যাহা কেহ কখনও কল্পনাও করেন নাই। তাহাই সম্ভব হইয়াছে! ছবির মানুষ, জীবজন্তু জীবন্ত প্রাণীর ন্যায় হাঁটিয়া ছুটিয়া চলিয়া বেড়াইতেছে... " উপরের লেখাটা একটা বিজ্ঞাপন। দিয়েছিল স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ। ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শহর কলকাতায়। আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা ১৮৯৮-৯৯ সাল। নাটকের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে পাওয়া গেল স্টিফেন্স সাহেবের "বায়োস্কোপ"।
এরই কিছুটা আগের সময়। ১৮৭২ সাল, ছুটন্ত ঘোড়ার ছবি তুলতে অকৃতকার্য হলেন ইংল্যান্ডের জেমস এডওয়ার্ড ম্যুব্রিজ। কিন্তু ১৮৭৭ সালে তিনি কৃতকার্য হন। এই কাজ সম্পন্ন করতে দশ থেকে তিরিশটি ক্যামেরার প্রয়োজন হয়েছিল এবং ক্যামেরার শাটারগুলিতে লাগানো ছিল তার। এরপর ম্যুব্রিজ শিশু, নারী, পুরুষ, কুচকাওয়াজ-রত সৈন্য, ছুটে যাওয়া ক্রীড়াবিদ প্রভৃতির গতির ছবি তোলেন।
ফ্রান্সের শারীরতত্ত্ববিদ ই.জে.ম্যারি ম্যুব্রিজের পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং ১৮৮২ সালে উড়ন্ত পাখির ছবি তোলেন। ১৮৮৯ সাল। টমাস আলভা এডিসন আবিষ্কার করেন "কিনেমাটোস্কোপ"
(Kinematoscope)। এডিসন তাঁর কিনেমাটোস্কোপের মহড়া দেন ১৮৯৩ সালে এবং শব্দ ও ছবি একসঙ্গে বেরিয়ে আসায় মানুষজন মুগ্ধ হন। নিউইয়র্কের বাজার ডিঙিয়ে কিনেমাটোস্কোপ বিক্রি হতে থাকে বিশ্বের বাজারে। সমস্যা কেবল একটাই, এই যন্ত্রে একসঙ্গে কেবল একজনই ছবি দেখতে পারত। এই সমস্যারই সমাধানে ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অগস্ত লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের — দুই ভাই, ওয়াশিংটনে জেঙ্কিন্স এবং লন্ডনে আর.ডব্লু.পল অনেকে যাতে দেখতে পারেন এই উদ্দেশ্যে বিরামহীন পরিশ্রম করে আবিষ্কার করলেন “সিনেমাটোগ্রাফি”। যার থেকে পরবর্তীকালে “সিনেমা” শব্দটার উৎপত্তি। ১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর। অগস্ত লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের প্যারিসে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। তাঁদের প্রদর্শিত 'সর্তি দে লুসিনে লুমিয়ের দে লিও' ছবিটিকে প্রথম সত্যিকারের চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।চলমান ছবিকে প্রজেকশন বা অভিক্ষেপনের মাধ্যমে প্রথম সফলভাবে প্রদর্শনের নিদর্শন হিসেবে এই তারিখটিকেই(১৮৯৫, ২৮ শে ডিসেম্বর) গণ্য করা হয়। তবে এর আগেও ক্যামেরার সাহায্যে চলমান ছবিকে গ্রহণ এবং প্রদর্শনের কিছু নজির পাওয়া যায়। পূর্ববর্তী সেইসব সৃষ্টি গুণমানের দিক থেকে 'লুমিয়ের সিনেমাটোগ্রাফ' -এর সমান ছিল না। এরপর থেকেই সারা বিশ্ব জুড়ে তৈরী হয় একাধিক ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি। আর এক দশকের মধ্যেই চলচ্চিত্র পরিণত হয় এক বিশাল সর্বজনীন বিনোদনশিল্পে। এর পাঁচ মাস পর ভারতে প্রথম সিনেমা আসে। প্রথম দেখানো হয় বোম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে ৭ই জুলাই, ১৮৯৬ সালে। গোড়ার দিকের চলচ্চিত্র ছিল সাদা-কালো, দৈর্ঘ্য ছিল এক মিনিটেরও কম আর তা ছিল নির্বাক। ১৮৯৮ সালে প্রথম তৈরী হয় ঘূর্ণায়মান ক্যামেরা, যা প্যানিং শট নেওয়ার কাজটাকে সহজ করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে স্পেশাল এফেক্ট, কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতা বজায় রাখা ইত্যাদি নানারকম প্রয়োগকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯০০ সাল। ডি. ডব্লিউ.গ্রিফিথ এর হাত ধরে এল কন্টিন্যুইটির মাধ্যমে ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং ক্লোজ-আপ শটের ব্যবহার। এই সময়ের বেশিরভাগ ছবিকেই 'চেজ ফিল্ম' বলা যেতে পারে। প্রথম একাধিক রিল সংবলিত কাহিনীচিত্র তৈরী হয় অস্ট্রেলিয়ায়, ১৯০৬ সালে। এর আগে ১৯০৫-এ পিটসবার্গে স্থাপিত হয় 'দ্য নিকেলোডিয়ান' ; প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ। শুরু হয় সফলভাবে শুধুই চলচ্চিত্রের প্রদর্শন। ডি.ডব্লিউ.গ্রিফিথ। খানিক আগেই যাঁর নামোল্লেখ করেছি। ইনি হলেন মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের স্তম্ভস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেস শহরের প্রান্তে হলিউড অঞ্চলে প্রথম শ্যুটিং শুরু করেন তিনি এবং কালক্রমে এই হলিউড হয়ে ওঠে বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র। উৎকর্ষতার শীর্ষে এইভাবেই আরোহণ শুরু করে চলচ্চিত্র। শব্দহীন সিনেমা নিবার্কের বন্ধন ছিঁড়ে হতে শুরু করে শব্দমুখর। বিশ্ববিখ্যাত বিনোদন কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রাদার্স তৈরী করেন 'দ্য জ্যাজ সিঙ্গার'। ১৯২৭ সালে মুক্তি পাচ্ছে এই ছবি। প্রথম সিঙ্ক্রোনাইজড বা সমলয় সঙ্গীত এবং সমলয় সংলাপ ব্যবহৃত হচ্ছে এই চলচ্চিত্রে। ফলস্বরূপ অবসান ঘটছে চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের।
১৯২৯ সালের শেষে গিয়ে দেখা যায় হলিউডের প্রায় সমস্ত ছবিই সবাক। শব্দের ব্যবহার শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে হলিউডের চলচ্চিত্র শিল্প সেই সময়ের মারণ অর্থনৈতিক গ্রেট ডিপ্রেশনের হাত থেকে রক্ষা পায়। চলচ্চিত্রের আবিষ্কারক কে? সহজে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই আবিষ্কারের সঙ্গে দেশের গৌরবও জড়িত তাই, আমেরিকা মনে করেন টমাস আলভা এডিসনকে, ব্রিটিশরা ফ্রিজগ্রিনকে এবং ফ্রান্স লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়কে। আসলে শুধুমাত্র একক একটি দেশে একজন মানুষের হাত ধরে চলচ্চিত্রের জন্ম হয়নি। এর পিছনে রয়েছে অনেকের সমবেত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম। শুরু থেকেই এই ইতিহাস ঘেঁটে দেখাটা অনায়াসেই বলে দিচ্ছে আমি আমার আলোচনার গভীরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছি। আরো কিছুটা চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক ও প্রাচীন তথ্যের সন্ধান চালালে আমরা দেখতে পাই যে শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী শিল্পের উত্তরসূরী হিসেবে। কথকতা, সাহিত্য, নাটক এবং অন্যান্য দৃষ্টিগোচর শিল্পের কথা বাদ দিলেও চলমান এবং প্রক্ষিপ্ত ছবি সংবলিত বেশ কিছু অনুরূপ শিল্পমাধ্যম আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, যেমন----
ক. শ্যাডোগ্রাফি (হস্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে ছায়া তৈরী করে গল্প বলা)
খ. ক্যামেরা অবস্কিউরা (পিনহোল ক্যামেরার প্রাকৃতিক নীতির ভিত্তিতে তৈরী শিল্পমাধ্যম)
গ. শ্যাডো পাপেট্রি (দ্বিমাত্রিক পুতুলের ছায়ার সাহায্যে গল্প বলা)
ঘ. ম্যাজিক লণ্ঠন (সপ্তদশ শতকে উদ্ভাবিত এই শিল্পমাধ্যম প্রধানত আধুনিক প্রজেক্টর বা অভিক্ষেপণ যন্ত্রের পূর্বসূরী) এরপর পারসিস্টেন্স অফ ভিশন বা দৃষ্টির জড়তাকে কাজে লাগিয়ে তৈরী অ্যানিমেশন যন্ত্র, ১৮৩২ সালে ফেনাকিষ্টিস্কোপ, ১৮৬৬-তে জোট্রোপ এবং ১৮৬৮-তে ফ্লিপ বুক। ২০২০সালের করোনা অতিমারীর আচমকা আক্রমণে বদলে গিয়েছিল দৈনন্দিন জীবনের রূপটা। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এর ক্লান্ত মানুষ গুলো যেমন সাজিয়ে নিয়েছিল নিজের রোজকার ওয়ার্ক প্রজেক্ট, তেমনি অনলাইনেই খুঁজে পেয়েছিল বিনোদনের উপায়। সেইসব ঘরবন্দী দিনগুলোয় কেউ দেখেছিলেন সত্যজিৎ-মৃণাল সেন কিছু সিগনেচার সিনেমা ; তো কেউ কেউ বেছে নিয়েছিলেন ওয়েব সিরিজ। এবার আসি ওয়েব সিরিজ প্রসঙ্গে। খুব সহজ কথায় যদি ওয়েব সিরিজ কী এটার ব্যাখ্যা করি তাহলে বলতে হয় যে, সিনেমা আর সিরিয়াল(ধারাবাহিক নাটক) পাশাপাশি একটা অন্যতম জনপ্রিয় বিনোদনের অংশ। কিন্তু এইগুলোর মধ্যে একটি পার্থক্যের দাগ স্পষ্ট। আমরা টিভিতে যে ধারাবাহিক নাটক দেখি তারই ওয়েব ভার্সন হল 'ওয়েব সিরিজ'। বোঝার সুবিধার্থে এই কথা বললেও এই দুই এর মধ্যে কিন্তু পার্থক্য বিদ্যমান। ধারাবাহিক নাটকে গল্পে তেমন বৈচিত্র্য নেই, নেই সেই অর্থে ভারী বাজেটও। অন্যদিকে শব্দসহ চলমান ছবির সংমিশ্রণ গল্পনির্মাণে বৈচিত্র্যময় এবং বাজেট বহুল। ওয়েব সিরিজ গুলো হয় এপিসোডিক। একটি ওয়েব সিরিজে সাধারণত পাঁচ থেকে দশটি পর্ব থাকে। সময়ের হিসেবে প্রতিটি সিজিন হয় তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। তবে এই পর্বের সংখ্যা এবং দৈর্ঘ্য এক সিরিজ থেকে অন্য সিরিজে পরিবর্তিত হতে পারে। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে এই ওয়েব সিরিজ গুলোরও রয়েছে কিছু প্রকারভেদ। যেমন:
ক. থ্রিলার(যেমন: ‘অসুর’)
খ. অপরাধ(যেমন: ‘আশ্রম’
গ. জীবনী(যেমন: ‘1992: দ্য হর্ষদ মেহতা স্টোরি’)
ঘ. অ্যাকশন(যেমন: ‘অভ্র: দ্য সিজ উইদিন)
ঙ. নাটক(যেমন: ‘পাতাললোক’)
চ. কমেডি(যেমন: ‘পঞ্চায়েত’)
ছ. ভয়াবহ(যেমন: ‘বেতাল’)
জ. রোমান্স (‘লিটিল থিংস’) ১৯৯০ এর শেষের দিকে ওয়েব সিরিজ তৈরী হতে শুরু করছে এবং ২০০০ সাল নাগাদ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। ১৯৯৫ এ 'thespot.com' অথবা 'The Spot' এই প্ল্যাটফর্মেই ওয়েব সিরিজ তৈরী করে আপলোড করা হত। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে এই ধরনের একাধিক স্ট্রিমিং কোম্পানি গড়ে ওঠে। এখন ওয়েব সিরিজ দেখার বহুল প্রচলিত ঠিকানা 'নেটফ্লিক্স', 'অ্যামাজন প্রাইম', 'ডিজনি হটস্টার', 'হইচই' ইত্যাদি। বরাবর এগিয়ে থাকা আমেরিকার পাশাপাশি ভারতের ওয়েব সিরিজ গুলোও সমান জনপ্রিয়। তবে জনপ্রিয়তা অর্জনের তাগিদটা মাঝে মাঝে ছাড়িয়েছে রুচির সীমারেখা। অন্তরঙ্গ দৃশ্যের বহুল ব্যবহারে নেই কোনো বাধা। সেন্সর বোর্ডের শাসনহীন এইসব ওয়েব সিরিজ গুলো। বিধিনিষেধ না থাকায় ভাবনা গুলো খুব সহজেই স্ক্রিনে জীবন্ত। পোশাক- আশাকের উন্মুক্ততা এখন বিনোদনের অপর নাম। অন্যদিকে এখনকার সিনেমাগুলো খুব একটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। বিচার-বুদ্ধি আর যুক্তির শক্ত কাঠামোটা খাড়া না করে শুধুই বিনোদনের স্বাদ নিতে এখন দর্শক প্রেক্ষাগৃহমুখী হয়। তাই হাল আমলের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোকে একটা সহজ সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা যায়। কমবেশি প্রতিটা সিনেমায় থাকে একটা হিরো,একটা হিরোইন আর ভিলেন। ফরেন লোকেশন, ভালো চারটে গান, রোম্যান্স আর অ্যাকশন। সত্যি কি এর বাইরে আর কিছু দেখানো হয়! মৌলিক গল্পের ব্যবহার তো গাঁটে গোনা। কলাকুশলীদের অভিনয়ও ততটা নজরকাড়া হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভীষণ একপেশে। যাইহোক এই বিষয় গুলো আমার আলোচনার বহির্ভূত। আলোচনার শুরুতে চলচ্চিত্রের সাল তারিখ সমেত যে ইতিহাসের পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করেছিলাম সেটা খানিক দেশের গন্ডি পেরিয়ে মূলত বিশ্ব চলচ্চিত্রের আদিপর্বটাকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। এবার যদি বাংলা চলচ্চিত্রের দিকে দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখব যে, ১৮৯৬ এর ৭ই জুলাই ভারতে প্রথম সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৮৯৭ এ কলকাতায় বাণিজ্যিক ভাবে চৌরঙ্গীর থিয়েটার রয়্যালে সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রে আট খন্ডে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করেছিল। এরপরের বছর স্টার থিয়েটারের প্রচারিত বায়োস্কোপের হ্যান্ডবিল দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠা সেদিনের সেই বাঙালি যুবক হীরালাল সেন এবং তাঁর ভাই মতিলাল সেন ১৮৯৮ সালে তৈরী করলেন 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি'। শুরু হল বাংলা সিনেমার পথচলা। ১৯০২ সাল। সেন ভ্রাতৃদ্বয় বিদেশ থেকে মুভি ক্যামেরা ও প্রদর্শনের যন্ত্রপাতি আনালেন।এই মুভি ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় নাটকের অংশ তুলে রেখে সেগুলোই আবার প্রদর্শন করতেন। অন্যদিকে ফ্রামজি ম্যাডান এর আগেই কলকাতায় ম্যাডান কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে চলচ্চিত্র দেখানো শুরু করেছিলেন।গড়ের মাঠে তাঁবু ফেলে ম্যাডান কোম্পানি সিনেমা দেখাতেন। পরবর্তীকালে ১৯০৭ এ জে.এফ.ম্যাডান কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য নির্মাণ করলেন স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ---- 'এলফিনস্টোন পিকচারস প্যালেস'। ১৯১৩ তে মুম্বাইতে দাদাসাহেব ফালকে তৈরী করলেন ভারতীয় প্রথম ফিচার ফিল্ম ---- 'রাজা হরিশচন্দ্র'। ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩১০০ ফুট। ফিল্মের ওপর সেন্সরশিপ চালু হচ্ছে ১৯১৮ এ। এরই হাত ধরে আসছে 'ইন্ডিয়ান সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট'। যদি প্রথম বাংলা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবির কথা বলি তাহলে বলতে হয় ১৯১৯ এ ম্যাডান কোম্পানি প্রযোজিত 'বিল্বমঙ্গল'। পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বাংলা সিনেমার আকাশ জুড়ে থেকেছেন একাধিক নক্ষত্রসম উজ্জ্বল চিত্রপরিচালক, অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। ১৯৫৫ এ সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' দেখছে দর্শক। খ্যাতির ঢেউ ভারত ডিঙিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বতটে। এরপর একে একে 'হীরক রাজার দেশে', 'গুপী গাইন বাঘা বাইন', 'ফেলুদা' সিরিজ,' জন অরণ্য', 'নায়ক', 'চিড়িয়াখানা', 'সীমাবদ্ধ' ইত্যাদি ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। এরপর ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় , উৎপলেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ পরিচালকবর্গ পথ দেখিয়েছেন বাংলা সিনেমাকে। বর্তমান সময়ে এইধারাটাকে বেশ কিছুটা যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা হলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক গাঙ্গুলি, গৌতম ঘোষ, সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। যদি আলাদা করে সিনেমার নামোল্লেখ করি তা প্রবন্ধের আয়তন বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। তবে যাঁদের নামোল্লেখ করলাম শুধুমাত্র তাঁরাই নয় বাংলা সিনেমার চরম দুর্দশার দিনগুলোতেও পাশে থেকেছেন একাধিক পরিচালক। সেই অর্থে তাঁরা মাইলফলক সিনেমা তৈরী না করলেও দিনের পর দিন লড়াই করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বাংলা সিনেমা ও ইন্ড্রাস্টিকে। বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে চড়াই উতরাই এর ধকল সামলে বাংলা সিনেমার দর্শক আজ দেখতে পেলেন 'শব্দ', 'তারিখ', 'অন্তহীন', 'আরেকটি প্রেমের গল্প', 'মনের মানুষ', 'দহন', 'রেইনকোট', 'চিত্রাঙ্গদা', 'বাড়িওয়ালী', 'বাস্তূশাপ', 'দৃষ্টিকোণ', 'নগরকীর্তন', 'রাজকাহিনী', 'জুলফিকার', 'বুনোহাঁস', 'সমান্তরাল', 'এক যে ছিল রাজা', 'চাঁদের পাহাড়' ইত্যাদি ইত্যাদি। এরই মধ্যে সমানখাতে বয়ে চলেছে দেব , জিৎ ও অঙ্কুশের কিছু বাণিজ্যিক ছবি। দর্শকের দাবি অনুযায়ী যেগুলোর লক্ষ্য 'এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট'। আসলে এই পথচলাটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। কারণ এই জার্নিটা হল 'বই' থেকে 'মুভি' র জার্নি। দর্শকদের চাহিদা পূরণ, জমিয়ে ব্যবসা করে বক্স অফিসে বাজিমাত , লক্ষ-কোটির অঙ্ক ছোঁয়া আর সমাজকে সংশোধনের পাঠ দিয়ে সৃষ্টির মতো সৃষ্টি আর বলার মতো স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছে পুরস্কার লাভ ------ এই দুয়ে অনেক তফাৎ। ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা দশটা-পাঁচটার সাধারণ জীবন। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে দিনগুলো মাস পেরিয়ে বছরে পড়ে। গাঁটে গোনা মাইনেতে অনেক স্বপ্নই অধরা থাকে মধ্যবিত্ত জীবনে। ছবিতে বা মোবাইলে বা কোনো ক্যালেন্ডার-ডাইরির পাতায় রঙিন আইফেল টাওয়ার, সুইজারল্যান্ডের বরফ মোড়া আল্পস, লন্ডনের টেমস, ভেনিসের গন্ডলা দেখে কাটানো মানুষগুলো তবু সিনেমার দৌলতে দু-আড়াই ঘন্টায় ঘুরতে পারে ওইসব বিদেশি জায়গায়। ইন্টারভ্যালে ফ্যান্টাসির ঘোর কিছুটা ফিকে হলেও শেষ অবধি বেশ ভালোই কাটে দর্শকদের। যেখানে প্রশ্নটা বিনোদনের, যেখানে সিনেমা আর ওয়েব সিরিজের যৌথ রাজত্ব সেখানে কি সত্যি কোনো প্রতিযোগিতা স্থান পায়? আসলে সিনেমার পথচলাটা অনেক দীর্ঘ। সেই অর্থে ওয়েব সিরিজ বেশ নবীন। তবুও ডিজিট্যালি স্মার্ট মানুষজন সিনেমার পাশাপাশি ওয়েব সিরিজকেও আপন করে নিয়েছে। সৃষ্টির জাদুদন্ড হাতে নিয়ে সৃজনশীল প্রতিভার ছোঁয়ায়, সাউন্ড-লাইট-ক্যামেরার সংসারে, সুপারস্টারদের চোখ ধাঁধানো স্টারডমে বেঁচে থাকুক চলচ্চিত্রের চলমানতা। সাথে ফ্যানেদের ফ্যান্টাসি জিইয়ে রাখুক ওয়েব সিরিজ। প্রতিযোগিতা হোক সমানে সমানে। বিচারকের আসনে তো রইল-ই অর্ডিয়েন্স। --------------------------