রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা কাব্যের বিষয়বস্তু
৹ চিত্রাঙ্গদা একটি কাব্যনাট্য।
৹ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্যটি রচনা করেছেন – ১৮৯২ সালে।
৹ মহাভারতের আদিপর্বে অর্জুনের বনবাস অধ্যায়ে অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার কাহিনি বর্ণিত আছে। সেই কাহিনি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্যটি রচনা করেন।
৹ আবার, রবীন্দ্রনাথের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য হল – চিত্রাঙ্গদা।
৹ চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যে দৃশ্য সংখ্যা – ৬
৹ কাব্যনাট্যটির পটভূমি – মণিপুর।
এবার আসি ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটিকার বিষয়বস্তুতে –
আগেই জেনেছি, মহাভারতের অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার কাহিনির প্রভাব আছে চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যে। মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী –
অর্জুনের ১২বছর ব্যাপী বনবাস পর্বে অর্জুন উলুপীর কাছে বিদায় নিয়ে মহেন্দ্র পর্বত দেখে মণিপুরে এলেন। সেখানে রাজা চিত্রবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন তার পাণিপ্রার্থী হয়ে চিত্রবাহনের কাছে গেলেন।
রাজা চিত্রবাহন অর্জুনের পরিচয় পেয়ে সন্তুষ্ট হলেন এবং চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ের জন্য শর্ত রাখলেন। চিত্রবাহনের পূর্বজ রাজা প্রভঞ্জন পুত্রের জন্য মহাদেবের কাছে তপস্যা করলে মহাদেব তাকে বর দেন যে বংশের প্রতিটি পুরুষের একটিমাত্র সন্তান হবে। বর অনুযায়ী, পূর্বপুরুষদের একটি মাত্র পুত্র সন্তান হলেও রাজা চিত্রবাহনের কন্যা সন্তান হয়েছে। রাজা সেই চিত্রাঙ্গদাকেই পুত্রসম পালন করেছেন এবং তার গর্ভজাত পুত্রকেই বংশধর হিসাবে গণ্য করবেন। তাই অর্জুন – চিত্রাঙ্গদার পুত্রকে মণিপুরে রেখে যেতে হবে আর সেই হবে পরবর্তী বংশধর। অর্জুন এই শর্তে রাজি হয়ে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করে তিন বছর সেখানে বাস করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাভারতের এই কাহিনিকে গ্রহণ করলেন তবে নিজের মতো করে। চিত্রাঙ্গদা নাটকের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ কাহিনির সূত্র ধরিয়ে দিতে জানাচ্ছেন,
“মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজকূলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল তখন রাজা তাকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা, শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজনীতি। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করে ভ্রমণ করতে করতে এসেছেন মণিপুরে। তখন এই নাটকের আখ্যান আরম্ভ।”
রবীন্দ্রনাথ কেবল কাহিনির সূত্রকে নয়, কাহিনির বিষয়বস্তুকেও নিজের মতো করে পরিবেশন করেছেন। ফলে চিত্রাঙ্গদা নাটকের প্রেক্ষাপট মহাভারতের রাজকীয় পরিবেশ থেকে সরে গেছে ‘রমণীয় প্রকৃতির’ মধ্যে। আর নাটকের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই –
● বীর চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অর্জুনের প্রথম সাক্ষাত –
নাটকের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বীরবেশী চিত্রাঙ্গদার শিকারের আয়োজন দেখিয়েছেন। সেখানে অর্জুনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে চিত্রাঙ্গদা প্রথমে এতদিনের অভ্যাস – শিক্ষা বশত অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ আহ্বান করে তাঁর হাতে মরতে চেয়েছেন –
“অর্জুন ! তুমি অর্জুন!
ফিরে এসো, ফিরে এসো,
ক্ষমা দিয়ে কোরো না অসম্মান
যুদ্ধে করো আহ্বান!
বীর হাতে মৃত্যুর গৌরব
করি যেন অনুভব –
অর্জুন! তুমি অর্জুন!”
(১ম দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
● চিত্রাঙ্গদার আপন নারী হৃদয়ের অনুভূতি –
পরমুহুর্তেই বীরের নির্মোক খসিয়ে প্রণয়প্রার্থী হয়ে অর্জুনের প্রতি আপন প্রেম নিবেদনে অস্থির হয়েছেন। বীরবেশী পুরুষের অভ্যাসগত নির্মোক খসিয়ে নারী তার অন্তরস্থিত প্রেমানুভূতির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। চিত্রাঙ্গদার এই পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন সখীর অভিব্যক্তিতে –
“সখী, কী দেখা দেখিলে তুমি!
এক পলকের আঘাতেই
খসিল কি আপন পুরানো পরিচয়।
রবিকরপাতে
কোরকের আবরণ টুটি
মাধবী কী প্রথম চিনিল আপনারে!”
(১ম দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
● চিত্রাঙ্গদার প্রেম নিবেদন এবং অর্জুন কতৃক প্রত্যাখ্যান –
মৃগয়ায় অর্জুন বীর পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদাকে প্রথম সাক্ষাতে বালক বলে মনে করেছিল। তারপর অর্জুনকে চিত্রাঙ্গদা প্রেম নিবেদন করলে অর্জুন ব্রহ্মচারী ব্রতের দোহাই দিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করে। ব্রহ্মচারী ব্রতের দোহাই বলার কারণ এটাই যে অর্জুনের দ্বাদশবর্ষ বনবাস বৃত্তান্ত জানা থাকলে জানতে পারি যে এর মধ্যে অর্জুনের উলুপীর সঙ্গে বিবাহ ও সন্তান লাভ হয়েছিল। তারপরেই মণিপুরের প্রবেশ। অপরদিকে, চিত্রাঙ্গদা বীরত্বের নির্মোক মানসিকভাবে খসাতে পারলেও নারীজনিত আচরণ তার জানা ছিল না ফলে অর্জুনকে তার প্রতি আকৃষ্ট করাতে অপরাগ চিত্রাঙ্গদার
কাতরোক্তি –
“হায়, হায়, নারীরে করেছি ব্যর্থ
দীর্ঘকাল জীবনে আমার
ধিক ধনূঃশর!
ধিক বাহুবল!”
(২য় দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
এরপর প্রত্যাখ্যাত চিত্রাঙ্গদার অর্জুনকে পাবার জন্য মদনের কাছে প্রার্থনা ও সাধনা এবং তাতে জয়লাভ –
“পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা
লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা –
* * * * * *
দয়া করো অভাগীরে –
শুধু এক বরষের জন্যে
পুষ্পলাবণ্যে
মোর দেহ পাক তব স্বর্গের মূল্য
মর্তে অতুল্য”
(২য় দৃশ্য, মদনের প্রতি চিত্রাঙ্গদা, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
আর তার ফলপ্রসূ অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার সম্ভোগবিলাস প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ এখানেই কাহিনি শেষ করতে পারতেন, যাকে বলে ‘হ্যাপি এন্ডিং’। কিন্তু চিত্রাঙ্গদার একবছরের সৌন্দর্যলাভ মনে অনেক প্রশ্ন রাখে।
তাই চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে সম্ভোগবিলাসের পর ক্লান্ত অর্জুনের খেদোক্তি –
“ছিন্ন করো এখনি বীর্যবিলোপী এ কুহেলিকা;
এই কর্মহারা কারাগারে রয়েছে কোন পরমাদে”
(৪র্থ দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
তারপরেই মণিপুর রাজ্যের বিপদের আভাসে গ্রামবাসীর থেকে অর্জুন স্নেহে মমতায় প্রজাবৎসল এবং সাহসে শক্তিতে সবল – যুগপৎ শক্তির আধার চিত্রাঙ্গদার কথা জানে পেরে তার সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহ প্রকাশ করে –
“শুনি স্নেহে সে নারী
বীর্যে সে পুরুষ
শুনি সিংহাসনা যেন সে
সিংহবাহিনী
* * * * * *
আগ্রহ মোর অধীর অতি –
কোথা সে রমণী বীর্যবতী
কোষবিমুক্তা কৃপাণলতা –
দারুণ সে, সুন্দর সে”
(৪র্থ দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
এমতাবস্থায়, চিত্রাঙ্গদা রূপের মিথ্যে নির্মোক খসিয়ে সত্যরূপে অর্জুনের কাছে ধরা দেয়। এবং অর্জুন – চিত্রাঙ্গদার মিলন হয়।
রবীন্দ্রনাথের কাহিনিতে অর্জুনের অবস্থান বেশ গৌণ, চিত্রাঙ্গদার হৃদয়দ্বন্দ্বই প্রধান। তারপরেও অর্জুনের গুরুত্ব থেকে যায় নারীর রূপকে অতিক্রম করে নারীর বীরত্বকে সম্মান দেবার জন্য। স্নেহ, মমতার পাশাপাশি সাহস শক্তি, কোমলতার পাশাপাশি কাঠিন্য উভয়েই যুগপৎ মিলনেই নারীত্বের পূর্ণ প্রকাশ – এই ভাবনাকে বীর পুরুষ অর্জুন
সম্মান জানিয়েছেন এবং তাতে আকর্ষণ অনুভব করেছেন।
আসলে রবীন্দ্রভাবনা আরো বিস্তৃত আর রবীন্দ্রভাবনায় প্রেম আরো ব্যাপক গভীর। আর তার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন নাটকের একেবারে শুরুর আগে –
“এই নাট্যকাহিনীতে আছে –
প্রথমে প্রেমের বন্ধন মোহাবেশে,
পরে তার মুক্তি সেই কুহক হতে
সহজ সত্যের নিরলংকৃত মহিমায়।”
নরনারীর প্রেমসম্বন্ধের মূল উপজীব্য স্থূল দেহভাবনা নয়, সূক্ষ বিদেহীমূর্তিতে তা পরিণত। চিত্রাঙ্গদা নাটকে প্রেমের এই তত্ত্বই রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে রবীন্দ্রভাবনায় ও রবীন্দ্রকাব্যে প্রেমের বিবর্তনরূপটা বুঝতে পারলে।
প্রথমের দিকের কাব্য ‘কড়ি ও কোমল’ এ দেহাশ্রিত প্রেমের প্রশান্তি লক্ষ্য করা যায়। এরপর ‘মানসী’ থেকে ‘সোনার তরী’তে প্রেম স্থূল ইন্দ্রিয়বিলাসের পথ থেকে সরে এসে সূক্ষ ভাবচারী হয়ে পড়ে। আবার, পরবর্তীকালে ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘মদনভস্মের পূর্বে’ ও ‘মদনভস্মের পরে’ কবিতা দুটিতে প্রেমের ইন্দ্রিয়বিলাস ও ইন্দিয়াতীত দুই রূপই ধরা পড়েছে। অর্থাৎ দেহ ও সত্য, দেহাতীতও। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার প্রেম প্রথমে দেহকে আশ্রয় করেছে তারপর তা দেহাতীতের সন্ধান পেয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদার মধ্যে উর্বশী ও লক্ষীকে একাসনে বসিয়ে প্রেয়বোধের সঙ্গে শ্রেয়বোধের সামঞ্জস্য স্থাপন করেছেন –
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্দ্ধে
সে নহি, নহি
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি, নহি
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।”
(৬ঠ দৃশ্য, চিত্রাঙ্গদা নাটক)
– – – – –