সুরদাসের প্রার্থনা ও অনন্ত প্রেম কবিতার বিষয়বস্তু
◆ সুরদাসের প্রার্থনা –
কবিতাটির বিষয় কবিতার শিরোনাম মেনেই বলা যায় দেবীর প্রতি সুরদাসের প্রার্থনা।
কী প্রার্থনা ?
সমগ্র কবিতা জুড়ে সুরদাস দেবীর কাছে অন্ধ হয়ে যাবার প্রার্থনা করেছে। সুরদাসের ভাবনায় দেবীকে যে চোখে দেখেছে সেই দৃষ্টির মধ্যে বাসনা আছে, আশা আছে, সেই দৃষ্টি সংকীর্ণ, সসীম জাগতিক ভাবনায় সীমাবদ্ধ –
“জান, কি আমি এ পাপ আঁখি মেলি তোমারে দেখেছি চেয়ে ?
গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা ওই মুখপানে ধেয়ে।”
তাই সুরদাস প্রার্থনার আগেই প্রথম কাতরোক্তি –
“ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন, আমি কবি সুরদাস।
দেবী আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে, পুরাইতে হবে আশ।”
আবার কখনো বলেছে দেবীর পবিত্র নির্মল জ্যোতিতে সুরদাসের মনের , হৃদয়ের, দৃষ্টিকোণের মলিনতা দূর হোক –
১) “তুমিই লক্ষী, তুমিই শক্তি / হৃদয়ে আমার পাঠাও ভক্তি – / পাপের তিমির পুড়ে যায় জ্বলে কোথা সে পুণ্যজ্যোতি”
২) “খুলে দাও মুখ, আনন্দময়ী, আবরণে নাহি কাজ / নিরখি তোমার ভীষণ মধুর / আছ কাছে তবু আছি অতি দূর / উজ্জ্বল যেন দেবরোষানল, উদ্যত যেন বাজ”
কিন্তু প্রশ্ন সুরদাসের প্রার্থনা কবিতায় সুরদাস বারবার কোন পাপের কথা বলতে চেয়েছে ?
এর উত্তর জানতে গেলে আগে জানতে হয় সুরদাস কে ?
ইতিহাস বলছে, পঞ্চদশ শতকের হিন্দি সাহিত্যের ভক্ত কবি সুরদাস। কিংবদন্তী আছে – ১) সুরদাস জন্মান্ধ ছিলেন
২) তিনি স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বরণ করেছিলেন
৩) কোনো এক অন্যায় কর্মের শাস্তিস্বরূপ চোখ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
বিষয়টাকে বিশদে বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, দীন দরিদ্র ছোটবেলায় গৃহত্যাগী সুরদাস সান্নিধ্য পেয়েছিলেন কৃষ্ণচর্চাযর প্রাণস্বরূপ ভক্ত বল্লভাচার্যের। বল্লভাচার্যের সহায়তায় গোবর্ধন পাহাড়ের শ্রীনাথজীর মন্দিরে প্রধান পুজারীর পুরোহিত হিসাবে নিয়োজিত হন সুরদাস। এখানে স্থানীয় রাজার মহিষীর প্রতি আকৃষ্ট হন। রাজমহিষীর রূপ তাকে বিভ্রান্ত করে, শ্রীনাথজীর সাধনা থেকে বিরত হন। তাই এর শাস্তিস্বরূপ সুরদাস নিজে অন্ধত্ব বরণ করেন অথবা রাজা তাঁর চোখ কেড়ে নেন।
এই কিংবদন্তীকেই স্বাধীনভাবে ব্যাখ্যা করে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ সুরদাসের প্রার্থনা কবিতায়। কিংবদন্তীর রাজমহিষীর পরিবর্তে সুরদাসের সামনে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন জাগতিক রূপ বা খন্ড প্রকৃতির রূপ। এর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে সুরদাস পূর্ণ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বিরত থাকছে, পূর্ণ সৌন্দর্যের ধ্যান থেকে চ্যুত হয়েছে –
“ইহারা আমায় ভুলায় সতত, কোথা নিয়ে যায় টেনে
মাধুরীমদিরা পান করে শেষে প্রাণ পথ নাহি চেনে।”
তাই সুরদাসকে উপলক্ষ্য করে আসলে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ইন্দ্রিয়কে রুদ্ধ করে অনন্তকে পাবার সাধনা করেছেন সমগ্র কবিতায়। তাঁর এই কাতরোক্তিই বারে বারে ফিরে এসেছে কবিতা জুড়ে –
১) “আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম-
লও, বিঁধে দাও বাসনাঘন এ কালো নয়ন মম।”
২) “আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে ; একাকী অসীম ভরা
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন, মিলাবে সকল ধারা।”
৩) “সে নব জগতে কালস্রোত নাই, পরিবর্তন নাহি-
আজি এইদিন অনন্ত হয়ে চিরদিন রবে চাহি।”
রোমান্টিক কবির প্রেম ধরা পড়েছে সুদূরের প্রতি আকর্ষণে, সসীম থেকে অসীমে , অনন্তের যাত্রায়।
এখন প্রশ্ন, এই প্রেমের স্বরূপ কেমন ? তার উত্তর আছে পরবর্তী –
‘অনন্ত প্রেম’ কবিতার ভাববস্তু বিশ্লেষণে –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় প্রেম অসীমের মধ্যে হলেও বিমূর্ত নয়। তিনি শরীরকে প্রাধান্য দেননি ঠিকই কিন্তু উপেক্ষাও করেননি। তাই ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতায় প্রেমভাবনা ধরা পড়েছে নরনারীর মধ্যে। এবং রবীন্দ্রনাথ বলছেন নরনারীর মধ্যেকার এই প্রেম জন্মজন্মান্তরের। প্রকৃত প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ দুই নরনারীর মধ্যেকার সম্পর্ক জন্ম জন্মাজন্মান্তরের সম্পর্ক। তারই অনুরণন ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতার প্রথম লাইনে –
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।”
রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রতিধ্বনি আধুনিক গানেও আছে –
“যতবার তুমি জননী হয়েছে ততবার আমি পিতা
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা।
বার বার আসি আমরা দুজন বার বার ফিরে যাই।
আবার আসবো আবার বলবো শুধু তোমাকেই চাই।” (কবীর সুমন)
অর্থাৎ প্রেম সুস্থিত, বিমূর্ত, অনুভববেদ্য ও শাশ্বত। বারবার বিভিন্ন রূপে নর, নারী, প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে। পৃথিবীর আদিকাল থেকে সৃষ্টির প্রাক মুহূর্ত থেকে প্রেম বিরাজমান। প্রেমের মধ্যেকার অনুভূতিগুলো – হাসি কান্না, বিরহ, মিলন, অপেক্ষা, লজ্জা ইত্যাদি দশা নরনারীর মধ্যে অবয়ব পেয়ে বিভিন্ন সময় ধরে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়ে এসেছে মাত্র। তাই রবীন্দ্রনাথ বলছেন –
“বিরহবিধুর নয়নসলিলে মিলনমধুর লাজে
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।” (অনন্ত প্রেম)
এবং প্রতি জনমে সেই প্রেম বিভিন্ন প্রকাশের মধ্য দিয়ে নতুন রূপে ধরা পড়েছে। যেমন বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার প্রসঙ্গ অনুসরণ করে বলা যায় – কৃষ্ণ ও রাধার মধ্যে যে প্রেম আর রাম ও সীতার মধ্যে যে প্রেম তা আসলে এক। কিন্তু জন্মান্তরে নতুন রূপে ধরা পড়েছে মাত্র।
শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রভাবনায় নরনারীর এই প্রেম “কায়া নৈকট্য হারিয়ে বস্তুনিরপেক্ষ হয়ে ভাবলোকে উত্তীর্ণ হয়ে যায়।” কেননা, আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ দেহকে উপেক্ষা করেননি ঠিকই কিন্তু তাকে প্রাধান্যও দেননি। ভোগবাসনা মানুষের মনে মোহ উৎপন্ন করে, মোহ থেকে বিভ্রম জাগে, এই বিভ্রম মানুষের স্বচ্ছ দৃষ্টিকে ম্লান করে দেয়, বৃহতের সঙ্গে যোগ চ্ছিন্ন করে দেয়। তাই ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতায় সুরদাসের প্রার্থনা –
“হৃদয় আকাশে থাক না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।
বাসনামলিন আঁখিকলঙ্ক ছায়া ফেলিবে না তায়”। (সুরদাসের প্রার্থনা)
তেমনি ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতায় কবির আকুতি – “নিবাও বাসনা বহ্নি”।
আসলে, রবীন্দ্রনাথ বলতে চাইছেন প্রেম অনন্ত, তা বিভিন্ন সময়ে নরনারীর মধ্যে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। কিন্তু নরনারীর দেহ আত্মার লীলাই সেখানে মুখ্য নয়। সেটা গৌণ। তার মধ্যে প্রেমের খন্ড অংশ প্রকাশ পায় মাত্র। সেখানে প্রেমের সমগ্রতাকে উপলব্ধি করা যায় না।
সেই প্রেমকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে তাকে দেশ কালের সংকীর্ণতার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হবে। জীবনানন্দ দাশ তাই তাঁর বনলতা সেনকে খুঁজে পেতে –
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি…”
‘হাজার বছর’ এর মধ্য দিয়ে কালের গন্ডি আর সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের মধ্য দিয়ে দেশের গন্ডি অতিক্রমের কথা বলেছেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথও ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতায় বলছেন –
“কালের তিমির রজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।”
কিংবা – “আমরা দুজন করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে”
এইভাবে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত প্রেমের মুল সুরটিকে সসীমের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে অতীতের সঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে অসীমের মধ্যে ধরিয়ে দিয়েছেন। নিখিলের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। আর রবীন্দ্রপ্রেমের এই উদার নিখিল ব্যপ্তি সুগভীর বিশ্ববোধের স্তরে উন্নীত হয়েছে। তখন সেই প্রেম ক্রমে নরনারী, প্রকৃতি, দেশ, কাল পেরিয়ে শাশ্বত রূপ ধারণ করেছে –
“নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল স্মৃতি –
সকল কালের সকল কবির গীতি” (অনন্ত প্রেম)
– – – – – –