সাধ‍্যসাধন তত্ত্ব ব‍্যাখ‍্যা


বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের আকর গ্রন্থ হিসাবে বিশেষভাবে পরিগণিত কৃষ্ণদাস কবিরাজের “শ্রীচৈতন‍্যচরিতামৃত”। শ্রীচৈতন‍্যচরিতামৃত গ্রন্থে বেশ কিছু তত্ত্ব কথা ব‍্যাখ‍্যাত হয়েছে, যেগুলি কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাপ্রভু চৈতন‍্যদেবের জীবনচরিত ব‍্যাখ‍্যা করতে গিয়ে সুনিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। মূলত চৈতন‍্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ‍্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে এই তত্ত্বগুলি ব‍্যাখ‍্যাত হয়েছে – কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, সখীতত্ত্ব, প্রেমবিলাসবিবর্ত তত্ত্ব এবং সাধ‍্যসাধনতত্ত্ব।

আজকের আলোচিত সাধ‍্যসাধন তত্ত্বটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন‍্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ‍্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে রায় রামানন্দ ও চৈতন‍্যমহাপ্রভুর কথোপকথন সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

সন্ন‍্যাস গ্রহণের পরে শ্রী চৈতন‍্য মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করছিলেন, তখন গোদাবরী নদীর তীরে শ্রী রামানন্দ রায়ের সাথে চৈতন‍্য মহাপ্রভুর প্রথম সাক্ষাৎ হয়।
বৈষ্ণব ধর্ম সাহিত‍্যে এই সাক্ষাৎ অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
ওইদিন সন্ধ‍্যায় গোদাবরীর তীরে পুনরায় রায় রামানন্দ এবং চৈতন‍্য মহাপ্রভু পুনরায় মিলিত হন এবং চৈতন‍্য মহাপ্রভুর আদেশে রায় রামানন্দ জীবনের তত্ত্ব অর্থাৎ সাধ‍্য সাধন তত্ত্ব নির্ণয় করেন –

সাধ‍্য সাধন তত্ত্ব নির্ণয় –

১) “প্রভু কহে – পঢ় শ্লোক সাধ‍্যের নির্ণয়।
রায় কহে – স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি হয়।”
অর্থাৎ, বিষ্ণুভক্তি হচ্ছে সাধ‍্যবস্তু যা মানবের চরম কাম‍্য বস্তু। জীব হল শ্রীকৃষ্ণের নিত‍্যদাস। রায় রামানন্দ বলেন – ‘স্বধর্মাচারণ’ অর্থাৎ নিজ নিজ বর্ণাশ্রম ধর্ম – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ‍্য ও শূদ্রত্ব প্রতিপালনের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলাভ করাই হচ্ছে সাধ‍্য বস্তু।

কিন্তু, মহাপ্রভু বলেন, “এহো বাহ‍্য, আগে কহ আর”।
অর্থাৎ, মহাপ্রভু মতে, বর্ণাশ্রমানুগত শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলাভ – বহিরঙ্গ কথা। কেননা বর্ণাশ্রমধর্ম পালনের দ্বারা সর্গসুখ লাভ এবং নির্বাণমুক্তি হতে পারে কিন্তু এতে জীবনের স্বসুখ হয়ে থাকে অত‌এব তা স্বার্থযুক্ত এবং কামনা কলুষিত। স্বসুখবাসনা শূন‍্য কৃষ্ণপ্রেম নেই , তাই এ সিদ্ধান্ত সাধ‍্যবস্তু সম্বন্ধে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নয়।

২) তদুত্তরে রায় রামানন্দ বললেন – “কৃষ্ণে কর্মার্পণ সাধ‍্যসার”
অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণে সমস্ত কর্মফল সমর্পণ বা নিষ্কাম কর্মযজ্ঞের অনুষ্ঠান‌ই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সাধ‍্যবস্তু।

কিন্তু নিষ্কাম কর্মযজ্ঞের অনুষ্ঠান সাধ‍্য নয় – সাধনামাত্র ; কারণ এই সাধন দ্বারা কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি রূপ সাধ‍্যলাভ হয়ে থাকে। নিজেকে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি করবার ভাবনা যেখানে আছে সেখানে কৃষ্ণপ্রেম থাকতে পারে না, কাজেই মহাপ্রভু একেও বাহ‍্যবস্তু বলেন।

৩) রায় রামানন্দ তখন এর অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাধ‍্যবস্তু নির্ণয়ে বলেন –
“স্বধর্মত‍্যাগ‌ এই সাধ‍্যসার”

অর্থাৎ রায় রামানন্দের মতে, বর্ণাশ্রমধর্মত‍্যাগ‌ই শ্রেষ্ঠ সাধ‍্য। এখানে সবধর্ম পরিত‍্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের শরণ গ্রহণ করলে সব পাপ থেকে মুক্তি বলা হয়েছে।

কিন্তু সব পাপ থেকে মুক্তি রূপ সকাম সাধনা এখানে আছে অত‌এব এও বাহ‍্য।

৪) অতঃপর রায় রামানন্দ – “মিশ্রভক্তি সাধ‍্যসার” বলে ‘জ্ঞান মিশ্রিত ভক্তি’র কথা বলেন – ১) ব্রহ্মস্বরূপ   ২) জীবস্বরূপ   ৩) ব্রহ্ম ও জীবের ঐক‍্য স্বরূপ বিষয়কে জ্ঞান বলে এবং এর সঙ্গে মিশ্রিত ভক্তিই হল জ্ঞান মিশ্রা ভক্তি।

কিন্তু চৈতন‍্যদেব ব্রহ্ম ও জীবের ঐক‍্যস্বরূপ জ্ঞানমিশ্রভক্তিকে স্বীকার করতে পারেননি, কারণ ব্রহ্মা স্রষ্টা আর জীব সৃষ্টি – তা কখনো এক হতে পারে না।

৫) মহাপ্রভু একে বাহ‍্য বলায় রামানন্দ এ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাধ‍্যবস্তু বলতে বললেন –
“জ্ঞানশূন‍্যা ভক্তি সাধ‍্যসার”
জ্ঞান শূন‍্য অর্থে জ্ঞানের অভাব নয়, জ্ঞানের সর্বাধিক পূর্ণতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে।

তবে জ্ঞান শূন‍্য ভক্তি জীব ব্রহ্মের সেব‍্য সেবক ভাব বিকাশের ও শ্রীকৃষ্ণ সেবার বাসনবিকাশের অনুকূল হতে পারে কিন্তু তা শ্রেষ্ঠ সাধন বস্তু হতে পারে না। সেজন‍্য‌ই মহাপ্রভু বলেন – “আগে কহ আর।”

৬) তদুত্তরে রায় রামানন্দ বললেন – “প্রেমভক্তি সর্বসাধ‍্যসার”
অর্থাৎ কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছাযুক্ত ভক্তিই হচ্ছে ‘সর্বসাধ‍্যসার’। এর প্রত‍্যুত্তরে মহাপ্রভুর এর উৎকৃষ্ট বলতে বলে কৌশলে প্রেমভক্তির বিভিন্ন স্তর সম্বন্ধে আলোচনার অবতারণা করলেন।
৹ মহাপ্রভুর নির্দেশ পেয়ে রায় রামানন্দ ‘প্রেমভক্তি’র মধ‍্যে ‘দাস‍্যপ্রেম’কে শ্রেষ্ঠ সাধ‍্য বললে মহাপ্রভু তা গ্রহণ করলেন না কারণ দাস‍্যপ্রেমে গৌরববুদ্ধি থাকে বলে এর বেশি বিকাশ হয় না।
৹ তদুত্তরে রায় রামানন্দ ‘সখ‍্য প্রেম’ কে উল্লেখ করলে মহাপ্রভু একে দাস‍্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্বীকার করলেও সখার সঙ্গে সখীর প্রেম চিরস্থায়ী নয়, বিচ্ছেদ ঘটতে পারে বলে আর‌ও উৎকৃষ্ট সাধ‍্যের কথা বলতে বললেন।
৹ তখন রামানন্দ রায় বাৎসল‍্য প্রেমকে ‘সর্বসাধ‍্যসার’ বললেন কারণ এতে – শ্রীকৃষ্ণ পাল‍্য এবং নন্দ যশোদাদি পালক। এতে শান্ত, দাস‍্য, সখ‍্যভাব তো আছেই উপরন্তু বাৎসল‍্যের পাল‍্য পালক ভাব‌ও আছে। কিন্তু মহাপ্রভু ‘এহোত্তম’ বললে রায় রামানন্দ বলেন –  “কান্তাপ্রেম সর্বসাধ‍্যসার”

স্বসুখ বাসনা পরিত‍্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন‍্য বাসনাম। যে কৃষ্ণপ্রীতি তাকে কান্তাপ্রেম বলে। কান্তাপ্রেমে শান্তের নিষ্ঠা, দাস‍্যের সেবা, সখ‍্যের অসংকোচ ভাব, বাৎসল‍্যের পালন ও মমতাধিক‍্যের সঙ্গে কৃষ্ণের সুখের জন‍্য নিজাঙ্গ দ্বারা সেবা আছে। সেজন‍্য রামানন্দ কান্তাপ্রেমকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন। এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে রামানন্দ বলেছেন –
“পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি এই প্রেমা হ‌ইতে।
এই প্রেমের বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে।”
এরপরেও মহাপ্রভু কান্তাপ্রেম অপেক্ষা উত্তম কিছু বলতে বললে রায় রামানন্দ বললেন –
“ইহার মধ‍্যে রাধার প্রেম সাধ‍্য – শিরোমণি।
   যাহার মহিমা সর্বশাস্ত্রেতে বাখানি।”

অর্থাৎ, কান্তাপ্রেমের মধ‍্যে রাধার প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ। এবং মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী গোপীগণের কান্তাপ্রেম অপেক্ষা রাধার কান্তাপ্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণে রায় রামানন্দ বলেন – রাসোৎসবে শত গোপীও রাধা সহ কৃষ্ণলীলায় মত্ত। রাধা তা দেখে অভিমান করে চলে গেলে অন‍্যান‍্য গোপীদের ত‍্যাগ করে কৃষ্ণ তাঁকে খুঁজতে গেলেন।

“শতকোটি গোপীতে নহে কামনির্বাপন
         ইহাতেই অনুমনি শ্রীরাধিকার গুণ।”

অর্থাৎ, শ্রীমহাপ্রভুর ও রায় রামানন্দের মতানুসারে কান্তাপ্রেম এবং তন্মধ‍্যে শ্রীরাধার প্রেমভক্তিই হল পরম সাধ‍্য, সর্বসাধ‍্যসার, এখানেই সাধ‍্যের পরিণতি।
সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে বলা যায়, সাধ‍্য হল যা অভিলাষিত, যা সাধনার মাধ‍্যমে প্রাপ্ত তাই সাধ‍্য। আর, সাধন হল সাধ‍্যবস্তু পাওয়ার উপায়।
মানুষ সর্বদা সুখের আগ্রহী এবং সেই সুখের সন্ধানেই সদা প্রয়াসী। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ পরমার্থিক সুখের দিকে না গিয়ে ব‍্যবহারিক জগতের সুখ লাভেই মত্ত থাকে। ভারতীয় ধর্ম দর্শন অনুযায়ী এই জাতীয় সুখের দ্বারা মোক্ষলাভ করা যায় না। তাই এই সুখ আধ‍্যাত্মিক ক্ষেত্রে পরিগণিত নয়। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী, সাধ‍্য বা প্রাপ্তি চার রকমের – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই সুখতত্ত্ব বৈষ্ণব দর্শনেও আলোচিত এবং তা রায় রামানন্দ দ্বারা বর্ণিত ও ব‍্যাখ‍্যাত।
শ্রী চৈতন‍্যদেবের সঙ্গে আলোচনায় রায় রামানন্দ পরম সুখের সন্ধানে যাওয়ার জন‍্য বিভিন্ন সাধনপন্থার একে একে বিবরণ ও ব‍্যাখ‍্যা দিতে থাকেন পর্যায়ক্রমে। এর কারণ হিসাবে বলা যায় – সাংসারিক জীব মানুষ যে জীবের সাধ‍্যকে এতদিন ধরে রেখেছে তা কতটা ভ্রান্তিময় তা বোঝানোর জন‍্য পর্যায়ক্রমে ব‍্যাখ‍্যা করেছেন।

এছাড়া বলা যেতে পারে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ সেসব বাঙালী বৈষ্ণবদের জন‍্য এই কাব‍্য লিখিয়েছেন যারা সংস্কৃত জানেন না। তাই বৈষ্ণবীয় তত্ত্বকে নতুন আদর্শে প্রতিষ্ঠা করাও তাঁর লক্ষ‍্য ছিল। এইভাবে তিনি উৎকর্ষতা অনুযায়ী , সাধ‍্যসাধন তত্ত্বের ব‍্যাখ‍্যা করেছেন এবং এব‍্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহে সার্থক।

– – – – –