নবান্ন নাটক – বিশ্লেষণী আলোচনা 
নাম – অনন্যা সাহা, বি এ ( বাংলা ) , বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

 

কঠিন বাস্তবের আত্মকথাকে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য প্রস্ফুটিত করেছিলেন ‘নবান্ন’ নাটকের আখ্যান ভাগে। তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ সম্রাজ্যবাদের পদতলে কি ভাবে দলিত হয়েছিল সেই ইতিহাসের নজির হয়ে আজও রয়ে গিয়েছে ‘নবান্ন’। নবান্ন শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো নব অন্ন। নাট্যকার স্বযত্নে নিজ নাটক রচনার মাধ্যমে বাস্তবিক ভাবেই আমাদের কাছে নব অন্নের সদৃস নব্য ধারার নাটকের ডালি দিয়ে যান।

তৎকালীন সময়ের গণনাট্য আন্দোলনের ফলস্বরূপ ‘নবান্ন’ নাটকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাটকের মধ্যে পর্যবশিত প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রই সংগ্রামী এবং ধৈর্যশীল সত্তার অধিকারী যা নাটকটির বাস্তব পটভূমির ভিত্তিমূলকে বিশেষ গতি প্রদানে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রসঙ্গত এই নাটক ভাববাদী মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে কার্যকরী হয় এবং বাস্তববাদী মতাদর্শকে অবলম্বনের মাধ্যমে সাফল্যতা লাভ করে। নিম্নশ্রেণীর অবহেলিত জাতির দুর্দশা,জমিদার তথা শাসক শ্রেণীর অকথ্য অত্যাচার সার্থক ভাবে উঠে আসে এই নাটকেই। সমস্ত রকম বিলাসবহুল উপকরণকে বাদ দিয়ে নাটকের মধ্যে বর্ণিত সাধারণ মানুষের অতিন্দ্রীয় দুঃখের কথা , শ্রেণী চেতনার সূত্রে শোষক এবং শোষিতের মধ্যে হওয়া গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই নির্দেশ করে।

সমাজতন্ত্রে নিম্নশ্রেণীর মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই অবদমিত তাদের উন্নতি কখনোই তথাকথিত সমাজে গ্রাহ্য করা হয়নি। সর্বদা উচ্চ তথা শাসক শ্রেণীরই আধিপত্য ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। নিম্নশ্রেণীর মানুষেরাও যে, মানবসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এ কথা কেও মনেই করতোনা। যার কাছে জাত আছে ধনের প্রাচুর্য আছে সমাজে তারাই হতো সমস্ত কিছুর অধিকারী । এই ধারণার ভাঙন ঘটে বহু পরে। তবে সার্থক ভাবে এই ধারণার নিস্পত্তি কখনোই হয়না বরং ধনবান, অসাধু ব্যক্তিবর্গের করোতলেই রয়ে যায় সমাজের অধিকাংশ। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নিম্নশ্রেণীর মানুষের দুঃখের আখ্যানের পাশাপাশি লেখেন তাদের আত্মবিশ্বাসের কাহিনী। যে আত্মবিশ্বাসের খুঁটিকে অবলম্বন করে তারা স্বগর্বে গর্জে ওঠে এবং অন্যায়ের বিরোধিতা করার অমোঘ শক্তি অর্জন করে।

নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে ‘অরণী’ পত্রিকায়।এবং এর পরে ১৯৪৪ সালে প্রথম গ্রন্থকারে প্রকাশ লাভ করে। এই সালেই নাটকটি মঞ্চস্থ হয় শ্রীরঙ্গম নাট্যমঞ্চে ২৪-শে অক্টোবর। এই নাটক সম্মন্ধে বিজন ভট্টাচার্য ‘অভিনয় দর্পনের’ পঞ্চম সংখ্যায় লিখেছিলেন,’ নবান্ন যখন প্রযোজিত হয় তখন সে নাটক আমি দেশের কথা ভেবেই লিখেছিলাম কোনো দলীয় রাজনীতি বা বিশেষ মতবাদে প্রভাবিত হয়ে নয়।’ এই উক্তির ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি নিতান্ত রাজনৈতিক মতবাদকে কেন্দ্র করে নয় বরং তৎকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার ভিত্তিতে নবান্ন নাটকের ঘটনা আবহ অবর্তিত হয়। ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলনের প্রতিফলন উক্ত নাটকে প্রতিভাত হয়েছে , নাটকে উল্লিখিত প্রধান সমাদ্দারের দুই পুত্রের আত্মবিসর্জনের সূত্রে। এছাড়া এই বছরেই ১৬- ই অক্টোবর ২৪ পরগনা এবং মেদিনীপুরের কিছু অংশে ঘটে যাওয়া সাইক্লোনের ফলে ঘটিত ১৩৫০ এর মন্বন্তরের অপার্থিব দৃশ্য দেখা গিয়েছে নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক-এ। সর্বহারা মানুষের অন্নাভাবে শহরে ছুটে আসা,এর পাশাপাশি অন্নের সন্ধানে এই মানুষ গুলোরই শহরের ফুটপাতে এবং লঙ্গরখানায় অসহায়ের মত বিচরণ। ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য কুকুরের সাথে কুঞ্জর লড়াই। মন্বন্তরের সুযোগ নিয়ে কালীধনের অতিরিক্ত মুনাফা সঞ্চয় করে কালোবাজারী এবং সেবাশ্রমের প্রচ্ছদে নারীদেহের ব্যবসা। অন্যদিকে হারু দত্তের চরম শোষণ চালানোর প্রবণতা এ সমস্ত কিছুই তৎকালীন মন্বন্তরের জ্বলন্ত বাস্তবিক চিত্রকে আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে উক্ত নাটকের মাধ্যমে। সর্বোপরি বলা যেতে পারে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া সমাজে মনুষত্বের পতন, দুর্বল মানুষের প্রতি অত্যাচার, শাসকের অনৈতিক আধিপত্য ও বিলাসিতা, সর্বশেষে প্রকৃত মনুষত্বের জয়গান ঘোষিত হয়েছে নাটকের পটভূমিতে।

‘নবান্ন’ নাটকের মোট ৪ টি অঙ্ক আছে এবং এই ৪ টি অঙ্কে আছে মোট ১৫ টি দৃশ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় অঙ্কে ৫টি, তৃতীয় অঙ্কে ২ টি শেষে চতুর্থ অঙ্কে ৩ টি। এই বিভাজনে নাটকের কাহিনী, ক্লাইম্যাক্স সমস্ত কিছুই অঙ্কিত হয়েছে যথাযথ ভাবে। প্রথম অঙ্কের শুরুতে আগস্ট আন্দোলনের খন্ড চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কুঞ্জ, রাধিকা,নিরঞ্জন,বিনোদিনী এই চারটি চরিত্রের সহযোগে ব্যক্ত করা হয়েছে সুমূহ অভাবের কথা। অর্থাভাব, কার্যাভাবের ফলে জর্জরিত মানব সমাজকে কি ভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হয় তার অসহনীয় দৃশ্য দেখা গিয়েছে এই অঙ্কে। কাহিনীর অগ্রগতির সাথে বিপদ আরো বেড়েছে । প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রাম উজার হয়ে গেছে । লোভী হারু দত্তের জন্য প্রধান সমাদ্দারের জমি প্রায় বিক্রি হয়ে যেতে বসেছে । তবে কুঞ্জর বাঁধায় জমি বিক্রি থেমে যায়। এবং এই বাঁধা দেওয়ার ফলও তাদের ভোগ করতে হয়। হারুদত্ত-এর লোকজন কুঞ্জ ও প্রধান সমাদ্দারকে মারধর করে এবং এই অঙ্কের শেষে কুঞ্জর পুত্র মাখনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু হয় যা আমাদের মনকে বিশেষ ভারাক্রান্ত করে তোলে। সমাজ,শাসক, প্রকৃতি সবের কবলে পরে নিম্নস্থ শ্রেণীর মানুষের এমন দুর্দশা প্রকৃত পক্ষেই অপ্রত্যাশীত। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে বাস্তবের পটভূমিতে যা প্রতিফলিত হয় লেখকের কলমে। দ্বিতীয় অঙ্কে কলকাতা শহরের প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত হয়েছে। সাথে কালীধন এবং তার সাগরেদ হারুদত্তের পরিকল্পনায় কালোবাজারির রমরমা বিশেষ চক্ষুবিদারক। নিজেদের লাভের জন্য সাধরনের প্রতি অন্যায় অত্যাচার তারা করে চলে ফলত এখানেই হয় মনুষত্বের মৃত্যু। অন্যের অসহায়তাকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন তারা নিজেদের পুঁজি বাড়িয়েই চলে। তাদের এই অরাজকতা যেন কখনো বন্ধ হওয়ার নয়। মানবিকতার খুন যে পাষন্ডেরা নিজ হস্তে করে, তাদেরই প্রতীক হলো এই কালীধন এবং হারুদত্ত। শহরে পৌঁছে কঙ্কালসার মানুষের দূরাবস্থা যে কি প্রকার হয় তার উদাহরণও নিহিত আছে এই অংশে। পার্কের দৃশ্য, উচ্চবৃত্ত মানুষের বাড়ির আস্তাকুড়ে কুঞ্জর সাথে ভুভুক্ষু কুকুরের লড়াই সবই মানবিকতা অবনমনের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। এ সবের মাঝে দেখা যায় অহিতকারিদের গ্রেপ্তারি। তবে এ গ্রেপ্তারি যে পাপের অন্ত নয়,তা আমরা বুঝতে পারি অসৎ চরিত্র গুলির ভাবভঙ্গিতে। তারা এই ভাবভঙ্গির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় আইন তাদের পতন হানতে অপারক। তারা এতো ক্ষমতাবান যে তাদের মোকাবিলার সামর্থ প্রশাসনের হাতেও নেই। পরবর্তীতে তৃতীয় অঙ্কে আছে লঙ্গরখানা এবং হাসপাতালের দৃশ্য। ক্ষুদার্থ মানুষের মিছিল এবং অসহায় চিকিৎসকের করুণ অবস্থা তৎকালীন সমাজেরই অংশ বিশেষ । এই অঙ্কেই পোড়ামাটির শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসে কুঞ্জ ও রাধিকা। এবং চতুর্থ অঙ্কে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব। যে গ্রামকে এই নাটক উৎসর্গ করা হয় সেই গ্রামের পটভূমিতেই এই অঙ্ক রচিত হয়েছে। আমিনপুর গ্রামে শহর ফেরত মানুষের সমাগম ঘটে পুনর্বার। যে গ্রামে অগুন্তি মানুষের ভিটে-মাটি ছিল সেই গ্রামকেই একদিন শুন্য হয়ে যেতে হয় ভাগ্যের ফেরে তবে শেষ পর্যন্ত এই আমিনপুরে আবার জনসমাগম ঘটে । এবং গ্রামবাসিরা নতুন উদ্দমে আত্মশক্তি সঞ্চয় করে এই গ্রামের বুকে টিকে থেকে, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি নেয়। তারা নিজেদের দুঃখমোচনের পন্থা খুঁজতে উদ্দত হয়। এবং নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে তারা একান্নবর্তী হয়ে অন্যায়ের প্রতিরোধের সংকল্প নেয়। কৃষক রমণীর নাচ গান, গরুর দৌড়, মোরগের লড়াই এ সবই ছিল নবান্ন উৎসবের অংশ। সবরকমের আনন্দের মাঝে প্রধানের প্রত্যাবর্তন আমিনপুরে নিয়ে আসে দ্বিগুন খুশির জোয়ার। যে আনন্দে অংশগ্রহণ করে সকলে। সকলের এই মেলবন্ধনেই গঠিত হয় নতুন গোষ্ঠী যে গোষ্ঠীর আবির্ভাব নাটকের শেষে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে
মানবতাবাদের বার্তা নিয়ে আসে।

জাতি, ধর্ম ভেদে মানুষ যখন একত্রিত হয় তখন তারা সর্বকার্য সিদ্ধ করতে সক্ষম হয়ে ওঠে কোনো বিরুদ্ধ শক্তি তাদের পথ রোধ করতে পারেনা। সত্যের এবং মানবতার পথে চলে, তারা হয়ে ওঠে অজেয়। সারা নাটক জুরে নানা ওঠা-পরা থাকলেও নাটকের শেষে আমরা শুনেছি ঐক্যের স্লোগান। যে স্লোগান আমাদের মননে অনুরণিত হয়েছে বারবার। নাট্যকার যে বাস্তব দূরাবস্থার কথা সমগ্র নাটক জুরে ব্যাখ্যা করেন। সেই দূরাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ ও তিনি ব্যাক্ত করেন। নাট্যকার নির্দেশিত এই উত্তরণের পন্থা হলো মানবিকতাবাদ। বিজন ভট্টাচার্য এই ভাবেই ‘নবান্ন’ নাটক টি গ্রথিত করে আমাদের কাছে তুলে ধরেন এবং এর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে প্রসস্থ হয় নির্মম বাস্তবতা বর্ণনের সার্থক জয়যাত্রা।।

তথ্য সূত্র : নবান্নের মূল পাঠ্য ( দেজ পাবলিশিং )