প্রিয় মনীষী- বিদ্যাসাগর
কলমে- অভিজিত ঘোষ, বি এ (বাংলা), বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য মনীষীগণ। এই সোনার বাংলা যেন সত্যিই এমন এক স্থান যার জন্য সমগ্র পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন হাজার হাজার মনীষীগণ। এই বাংলার পূন্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করে বেশ কয়েকজন মনীষী চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন শতকোটি মানুষের মননের মধ্যে।
মানুষ তো আমরা প্রত্যেকেই যাদের চেতনা আছে, বুদ্ধি আছে, মানসিকতা ও মানবিকতা আছে তারাই মানুষ কিন্তু মনীষী হলেন তাঁরাই যারা মনুস্য জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যাঁরা নিজেদের সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন অন্যের ভালোর জন্য। যাঁরা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন অচেতন মানুষের মধ্যে চেতনার আলো পৌঁছে দেবার জন্য।
বাংলার আকাশের দিকে তাকালে আমরা বেশ কয়েকজন ঔজ্জ্বল্যমান মনীষীদের দেখতে পাই। এই সমস্ত মনীষীদের কীর্তির কাছে মাথা নত করতে হয় বাংলা শুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে। এই সমস্ত মনীষীদের মধ্যে প্রিয় একজন মনীষীকে বেছে নেওয়া সত্যিই একটা কষ্টকর এবং দুঃসাধ্য ব্যাপার। যাইহোক প্রত্যেকেরই একটা পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে। আবার হয়তো সমস্ত মানুষের পছন্দ এক নয়। প্রিয় মনীষী বিচারের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন যে সমস্ত মনীষীদের, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
” বিখ্যাত ও প্রতিভাবান মনীষীদের ধ্যান,জ্ঞান শুধু তাদের নিজ খাতে সীমাবদ্ধ থাকে” –
এমন উক্তি সচরাচর মানুষের মধ্যেই শোনা যায়। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সত্যিই একজন এমন ব্যক্তিত্ব যাঁর ব্যক্তিসত্ত্বার দিকে তাকিয়ে, এই কথা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা স্বীকার করতে আর কোনোরূপ দ্বিধাবোধ থাকে না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী যিনি একাধারে জ্ঞান-বিদ্যা এবং অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। মানুষদের জন্য বিদ্যাসাগরের মন ছিল দয়া মায়া ও করুণায় ভরপুর। তিনি যেমন একাধারে “বিদ্যারসাগর” ঠিক তেমনি তিনি “দয়ারও সাগর”। তাই মহাকবি মধুসূদন তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন-
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে।”
বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে সেপ্টেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও অগাধ বুদ্ধির অধিকারী। তিনি দরিদ্রতার মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও, সেই দরিদ্রতা তার জীবনী কখনোই বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ছাত্র জীবন সমাপ্ত হলে প্রথমে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হয়ে নিজের কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন। তিনি নারী শিক্ষার জন্য যে সংগ্রাম এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে পরিশ্রম করেছেন, তা বাংলার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে আজও লিপিবদ্ধ আছে।
বাংলার মহিলাদেরকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য তিনি নিজ ব্যয়ে মোট কুড়িটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। এবং যেসব সম্প্রদায়ের ছেলেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তাদের জীবন থেকে অন্ধকার দূরে ঠেলে দেবার জন্য তিনি নিজ ব্যয়ে মোট ৩২ টি মডেল স্কুল তৈরি করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বহুমুখী শিক্ষাদানের প্রতিভা সত্যিই আজও অবিস্মরণীয়।
শুধুমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, সমাজ সংস্কারক হিসেবেও বিদ্যাসাগর একজন মহান ব্যক্তিত্ব। সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম। তাই শিক্ষা দানের পাশাপাশি সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করার জন্য তিনি বদ্ধপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সমাজ সংস্কারক হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার কারণেই, তিনি বাংলার ঘরের অবহেলিত নিপীড়িত নারীদের অন্ধকার ঘরের কোনা থেকে টেনে বের করে নিয়ে এসেছেন শিক্ষার সংস্পর্শে। বাল্যবিবাহের মতো দুষ্ট ব্যাধিকে সমাজ থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে তাঁকে অক্লেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে।
এছাড়াও বিধবাদেরকে সমাজে অবহেলিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে বিধবাবিবাহের মতো মহৎ কাজকে প্রচলিত করতে গিয়ে সমাজের বুকে তিনি নিন্দিত হয়েছেন। তিনি সমাজের বুকে এক সমালোচনার পাত্র হয়ে দাড়িয়েছেন। তবুও তিনি নিজের মহান কর্মযজ্ঞ থেকে দূরে সরে থাকেনি সমাজের দিকে তাকিয়ে কোনরুপ বিরূপ আচরণ তিনি করেননি। তিনি নিজের মহৎ কর্মকাণ্ডে অটল থেকেছেন।
তিনি শুধুমাত্র যে শিক্ষা ও সমাজের সংস্কার করে গেছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়াও একজন শিশুকে বাল্যকালে তৈরি করার জন্য তার ভিত মজবুতির সাথে গড়ে তোলার জন্য “বর্ণপরিচয়” রচনা করেছেন যা বাংলার ইতিহাসে এক জাজ্ব্যল্যমান ঘটনা।
বিদ্যাসাগর সমাজের অসহায়, পীড়িত মানুষদেরকে সেবা করেছেন। তিনি অধার্মিকদের ধর্মের প্রতি মতিময় করেছেন, অসহায়দের সহায়তা করেছেন, পীড়িত ও অবহেলিতদের শ্রদ্ধার সাথে শিক্ষার আলোকে নিয়ে এসেছেন। তিনি কর্মে মহান, শৌর্যে দীপ্ত এবং বীর্যে অগভীর মণণশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। এই সমস্ত বিশাল ও মহান কর্মযজ্ঞের সূচনা করে দিয়ে তিনি আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর মহান আদর্শ কর্ম প্রবণতা এবং জীবন প্রত্যয়। যা দেখে আজও আমরা অনুপ্রাণিত হই এবং একজন মহান মনিষী হিসেবে বিদ্যাসাগরের নাম সর্বাগ্রে শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে স্মরণ করে থাকি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাই যথার্থই বলেছেন-
“সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।”
[ বিশেষ সহায়তা:-
1. সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত- সাগর তর্পণ
2. সুশীল রায়- মনীষী জীবন কথা
3.মধুসূদন দত্ত- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
4.বিশেষ সহায়তা- আন্তর্জাল/ Internet ]