প্রিয় উপন্যাস – শ্রীকান্ত
কলমে- পূজা দাস এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
■ ভূমিকা :
‘আমার এই ‘ ভবঘুরে’জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথা মনে পড়িতেছে।'( শ্রীকান্ত প্রথম খন্ড) যখন এক দিকে রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের বিচিত্র ঐশ্বর্য ও সূক্ষ্ম তাৎপর্য এবং প্রভাত কুমারের রচনার মাধুর্য নিয়ে পাঠক সমাজ উন্মত্ত ,তখন অন্য গগনে অন্য অন্য বনান্তড়ালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক চন্দ্রের উদয় হয়। শরৎচন্দ্রের প্রথম ঔপন্যাসিক যিনি আত্ম কাহিনীর ছলে উপন্যাস লিখলেন ‘শ্রীকান্ত’। প্রথম খন্ড এবং অন্যান্য খণ্ড গুলি শিল্পসৃষ্টির দিক থেকে উন্নততর এবং শক্তিশালী চরিত্র অঙ্কনের সমৃদ্ধ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনকে নানা রূপে দেখেছিলেন। বহুরূপী জীবন পথ বিধৃত অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। জীবনে তিনি বহু মানুষ ও ঘটনার সংস্পর্শে এসেছেন। তার সমস্ত কিছুর একটা প্রভাব পাওয়া যায় শ্রীকান্ত উপন্যাস।
■ উপন্যাসের পরিচয় ও প্রকাশ :
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত একটি আত্মজীবনচরিত মূলক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল ‘শ্রীকান্ত’। এই উপন্যাসটিকে চারটি খন্ডে তিনি সমাপ্ত করেছিলেন। প্রথম খন্ডটি ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ নামে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সময় কাল ছিল সময় কাল ছিল ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত মোট তেরোটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তিনি এই খন্ডটি ‘শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা’ নামে লেখেন। পরের দুটি সংখ্যায় তিনি লেখকের নাম শ্রী শরচ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অবশিষ্ট সংখ্যা গুলিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামেই লেখেন। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স ১৩ টি সংখ্যায় রচনাটিকে ‘শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব’ নাম দিয়ে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই ফেব্রুয়ারি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী আবার প্রকাশিত হয় ভারত বর্ষ পত্রিকায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস থেকে ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস পর্যন্ত। এই রচনা অংশটি নিয়ে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে সেপ্টেম্বর ‘শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ঠিক দু’বছর পর ১৩২৭ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস থেকে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে পৌষ মাস পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। ১৩২৮বঙ্গাব্দে পৌষ মাসে নবম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে বহুদিন ওই পর্বের অসমাপ্ত অংশ শেষ করেননি। এর ঠিক পাঁচ বছর পর আরো ছয়টি পরিচ্ছেদ লেখা হলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ না করে সরাসরি শ্রীকান্ত তৃতীয় পর্ব নাম দিয়ে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ই এপ্রিল পুস্তকালে প্রকাশ করেন গুরুদাস এন্ড সন্স। বিচিত্রা পত্রিকায় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাস থেকে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ মাঘ মাস পর্যন্ত এই উপন্যাসের চতুর্থ পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। এটি বারোটি সংখ্যা নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ই মার্চ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় পুস্তক আকারে প্রকাশ করে ভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় এটি পঞ্চম পর্ব রচনার জন্য মনোভাব করলেও তা তিনি করেননি।
■ লেখক পরিচিতি :
রবীন্দ্র সমসাময়িক উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই মহান ব্যক্তি ৩১ শে ভাদ্র ১২৮৩ বঙ্গাব্দে (১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই সেপ্টেম্বর )পৃথিবী লোকে অবতীর্ণ হন। পিতার মাতুলালয় হুগলি জেলায় অবস্থিত দেবানন্দপুর গ্রামে তিনি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।আদি পিতৃপুরুষের নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কাঁচড়া পাড়ার নিকটবর্তী মামুদপুরে। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই ও বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দ্বিতীয়। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে শরৎচন্দ্রের পিতা পরিবার নিয়ে শ্বশুরালয় ভাগলপুরে থাকতেন। শরৎচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পিতা দেবানন্দপুরের প্যারি পন্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন এবং এরপর ভাগলপুর শহরে থাকা কালীন তাঁর মামা তাঁকে স্থানীয় বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। 1887 খ্রিস্টাব্দে । ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতার চাকরি চলে গেলে আবার সপরিবারে দেবানন্দপুর এ ফিরে যান। সেখানে তিনি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু স্কুলের ফি না দিতে পারার কারণে তাঁকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এরপর তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে ‘তেজ নারায়ন জুবলি’ কলেজে ভর্তি হন। তিনি প্রতি রাত্রে তার মাতামহের ছোট ভাই অঘোর নাথের দুই পুত্রকে পড়াতেন তার বিনিময়তার বিনিময়ে অঘোর নাথ তাঁর কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন এর পরেও তিনি এফ এ পরীক্ষায় বসতে পারেননি ফ্রি জোগাড় করতে না পারার জন্য। তিনি বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কেরানীগিরির চাকরি লাভ করেন প্রথমে তিনি বিবাহ করেন শান্তি দেবীকে তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় শান্তি দেবী ও একবছরের পুত্র সন্তান রেঙ্গুনে প্লেগ রোগে মারা যান। এরপরে তিনি মোক্ষদাকে বিবাহ করেন এবং তার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন ১৯৩৩ সালে ‘কুন্তলীন’পুরস্কার প্রাপ্ত ‘মন্দির’ গল্পের মধ্যে দিয়ে। উপন্যাস গুলি হল ‘বড়দিদি'(১৯১৩) ‘বিরাজ বৌ’ (১৯১৪)’পল্লীসমাজ'( ১৯১৬) ‘দেবদাস’ (১৯১৭) (প্রথমপর্ব ১৯১৭, দ্বিতীয় পর্ব
১৯১৮, তৃতীয় পর্ব ১৯২৭,চতুর্থ পর্ব ১৯৩৩) প্রভৃতি। নাটক ‘ষোড়শী’ (১৯২৮) ‘রমা’ (১৯২৮) ‘বিজয়া'(১৯৩৫) ।গল্প ‘রামের সুমতি’ (1914) ‘পরিণিতা’ (1914)’ বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪) ‘মহেশ’ (১৯২৬) ‘অভাগীর স্বর্গ'(১৯২৬) ইত্যাদি। প্রবন্ধ গুলি হল ‘নারীর মূল্য’ ‘তরুনের বিদ্রোহ’ (১৯১৬) ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ (১৯৩২) ইত্যাদি। এই মহান ব্যক্তি যকৃতের ক্যান্সারে ৪ নংভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিংহোমে ভর্তি হন এবং অস্ত্রপচারের চার দিন পর ১৬ই জানুয়ারি সকাল দশটায় পরলোকগমন করেন।
■ শ্রীকান্ত উপন্যাসের বিষয়বস্তু :
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি মূলত চারটি পর্বের বিভক্ত এখানে চারটি পর্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। প্রথম পর্বে বাল্য জীবনের যে পথ দিয়ে তার জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা ও দুঃসাহসের অনুমাত্র স্রোতে বেগ লাভ করেছে তা শুধুমাত্র ইন্দ্রের সহচর্য থেকেই। ইন্দ্রনাথের নিশীথ অভিযান সমস্ত দিক দিয়ে একেবারে অনন্য সাধারণ। তারপর শ্রীকান্তের দ্বিতীয় সৌভাগ্য আসে অন্নদা দিদির সঙ্গে পরিচয়। বেদের জীবন ও সাপুড়ে ঘর কন্যার মধ্যে যে চিত্র পাওয়া যায় তা বাঙালি জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিত্র। এছাড়াও এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার । ও নতুন দার দুটি দৃশ্যে শরৎচন্দ্রের রচনার মধ্যে বিশুদ্ধ হাস্যরস প্রাচুর্যের সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায় এই পর্যন্ত শ্রীকান্তের বাল্য শিক্ষার সমাপ্ত হয়েছে। কয়েক বছর পর একটা কুমারের শিকার পার্টিতে যোগ দেয়। পিয়ারি বাইজি অর্থাৎ রাজলক্ষ্মীর প্রসঙ্গ। শ্রীকান্ত তারপর হঠাৎ সন্ন্যাসীর চেলাগিরিতে ভর্তি হয়ে যাযাবর জীবনের সুখ ও নিরক্ষর লোকের ভক্তি উপভোগ করতে লাগলো।শ্রীকান্ত বার্মা যাত্রা করলো। শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে দেখা যায় বাড়ী এসে কিছুদিন বাসের পর অপরের কন্যাদায় ও নিজের বিবাহ দায় থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রীকান্ত দ্বিতীয়বার রাজলক্ষ্মীর কাছে যেতে বাধ্য হয়েছে। রাজলক্ষী আবার শ্রীকান্তের সঙ্গে বার্মায় যাবার কথা বললে শ্রীকান্ত পূর্বের মতো প্রস্তাবে অস্বীকার করে। এবারে বিদায়ের পালা দপ্ত নীরবতার মধ্যে নয় অপ্রতিরোধনীয় অশ্রু জলের মধ্যে সারা হল। তারপর শ্রীকান্তের বার্মা যাত্রা যেন শরৎচন্দ্রের কল্পনা ও বর্ণনা শক্তির নতুন বিজয় অভিযান। এই পর্বে অভয়ার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। তৃতীয় পর্বের গঙ্গা মাটির ক্ষুদ্র,সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে যে মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলেছে তাদের ব্যক্তিগত জীবন অপেক্ষা তাদের সমস্যায় বড়। এই পর্বে সুনন্দার দীপ্ত তেজস্বিনী কাহিনী পাওয়া যায়। চতুর্থ খন্ডে বন্ধু প্রীতি প্রেম এই পুরাতন সুরেরই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। গ্রামের রুক্ষ, বিদীর্ণ, ঝরা পাতার জঞ্জাল আবর্জনায় হতশ্রী চিত্র দেওয়া হয়েছে তা যেন তাদের বৃত্ত মন্দবেগ বন্ধুত্বের যোগ্য পটভূমি ও প্রতীক। কমলতার সঙ্গে প্রেমাভিনয়ের দৃশ্যগুলি আরো প্রাধান্য পেয়েছে। শ্রীকান্তের তৃতীয় ভাগে চরিত্রের যে দুর্বলতার সূচনা দেখা দিয়েছিল চতুর্থ ভাগে তার নিঃসংশায়িত রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
■ লেখকের বক্তব্য :
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ গ্রাম্য মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন কাহিনীকে। “বড়প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে”। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে বাল্যকালেই মন দিয়েছিল,পরিণত বয়সে শ্রীকান্তের বিপদেআপদে নানাভাবে তার পাশে থেকেও তাকে পেয়েও পাইনি রাজলক্ষ্মী। তৎকালীন সমাজের বাল্যবিবাহ নামক প্রথার বিষবাষ্পে সমাজ এতটা জর্জরিত হয়ে উঠেছিল যার প্রমাণ ছিল রাজলক্ষ্মী। সাধারণ ব্রাহ্মণ ঘরের কন্যা রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারী বাইজিতে পরিণত হওয়া। সমগ্র হিন্দু সমাজ জুড়ে জাতিভেদ প্রথার যে একটা মায়াজাল বিস্তার করে ছিল তার বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্র তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ইন্দ্রনাথের করেছিল মুখ দিয়ে নিজের বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন – “আরে এ যে মরা, মরার আবার জাত কি? এই যেমন আমাদের ডিঙিটা এর কি জাত আছে?”
শরৎচন্দ্র স্বয়ং শ্রীকান্তের ছদ্মবেশে গৌরী তেওয়ারির জীবনের যন্ত্রণাকৃত কথাগুলো শুনে মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিলেন –
“যে সমাজ এই দুইটি নিরুপায় ক্ষুদ্র বালিকার জন্যও স্থান দিতে পারে নাই, সে সমাজে আপনাকে এতোটুকু প্রসারিত করবার শক্তি রাখে না, সে সমাজের জন্য মনেরমধ্যে কিছু মাত্র গৌরব অনুভব করিতে পারি না।”
এখানেই দরদী লেখক ক্ষান্ত হননি তিনি আরো বলেছেন “ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে এমনই মুদ্রিত হয়ে হইয়া গিয়াছিল যে এত কাল পরেও সমস্ত স্মরণে রহিয়াছে এবং আদর্শ হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জাতিভেদের বিরুদ্ধেএকটা বিদ্রোহের ভাবআজিও যায় নাই।” বিদ্রোহ ভাব আজও যায় নাই এই হৃদয়েরএই হৃদয়ের। এই বিদ্রোহী মনোভাবের পরিস্ফুটন দেখা গিয়েছিল পরবর্তী উপন্যাস পল্লীসমাজে বলে মনে করা যায়।
■ ভালোলাগার বিষয় :
‘ শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি পাঠ করে এটুকু অনুধাবন করা যেতে পারে যে এটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব জীবন সম্পর্কে কাহিনী কয়েক খন্ডে উল্লেখিত হয়েছে। এই উপন্যাসে প্রথমে দৃশায়িত হয় ইন্দ্রনাথ ও অন্নদাদিদি। যারা শ্রীকান্তর চরিত্রকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়াও উপন্যাসে নারীর প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো আছেই। শ্রীকান্তের জীবনে ইন্দ্রনাথ যেমন অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে যুক্ত তেমনি অন্নদা দিদিরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে নারী চরিত্রগত শ্রেণীবিভাগ যেন তিনি করেছেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের মাধ্যমে। বাল্যকালে তার প্রথম পরিচয় হয় অন্নদাদিদির সাথে তারপরে আসে রাজলক্ষ্মী, তারপর আসে অভয়া ও কমললতা। কিন্তুু সমগ্র উপন্যাস জুড়েই শ্রীকান্তের চরিত্রের প্রভাব ফেলেছিল অন্নদাদিদি ও ইন্দ্রনাথ। যখন শ্রীকান্তের বাল্য হৃদয়ের সমাজ সংস্কার বিধি নিষেধ প্রবেশ করতে পারেনি তখন অন্নদা দিদির সংস্পর্শে আসে শ্রীকান্ত। শ্রীকান্ত অন্নদা দিদির কাছ থেকে শিখেছিল নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও প্রেম, যা বাল্যকালে থেকে পরিণত শ্রীকান্তকে চালনা করেছিল। অন্যদিকে রাজলক্ষ্মীর মত নারী একজন বাইজি কোন পরিস্থিতিতে তাকে এই পেশা গ্রহণ করতে হয়েছে। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের পুনরায় দেখা হয় কুমারের শিকারের পার্টিতে। শ্রীকান্তের কাছে প্রেমিকা হিসেবে তুলে ধরেছে রাজলক্ষী। এমনকি শ্রীকান্ত যখন বার্মা যাবে বলে ঠিক করে তখন রাজলক্ষ্মী সমাজভয় তুচ্ছ করে শ্রীকান্তের সঙ্গিনী হতে চাই। কিন্তু শ্রীকান্ত তাকে বাঁধা দেন। এককথায় শ্রীকান্ত চরিত্রের ওপর অন্নদাদিদি যে প্রভাব বিস্তার করেছিল রাজলক্ষ্মী, অভয়, কমলতা কেউ তার সমকক্ষ ছিল না। এছাড়াও নতুন দা ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার হাস্যরাস্পদ বিষয়। তবে নতুনদা শুধু হাস্যরসাস্পদ বিষয় নয় ,তার মধ্যে কলকাতার তৎকালীন মেকি স্বার্থপরতার সমাজ চিত্র। সবথেকে বড় কথা ইন্দ্রনাথ না থাকলে হয়তো বালক শ্রীকান্ত আজকের শ্রীকান্ত হয়ে উঠতে পারত না।
■ উপসংহার :
“শরৎচন্দ্র বাস্তব জীবনকে গ্রহণ করে অতি বিচিত্র কৌশলে তার সঙ্গে রোমান্সের অদ্ভুত মিল ঘটিয়েছেন”।(অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
মানুষের দুঃখ বেদনা, সেটা তার নিজের দোষেই আসুক কিংবা সামাজিক উৎপীড়নে আসুক সেটা তিনি আবেগ ও সহানুভূতির সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে। যা দেখে পাঠক মহল চরিত্র গুলির সাথে এমনভাবে একাত্ন হয়ে যাই যে সেই দিন-দরিদ্র দুঃখ ভরাতুর ছায়া গুলির কাছে পাঠক মহল নিজেকে উপলব্ধি করে। এছাড়া শ্রীকান্ত উপন্যাসে নিতান্ত সাধারণ বাংলাদেশের নরনারীর মলিন ও তুচ্ছ জীবনকেই তিনি তুলে ধরেছেন। তাতে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মত কল্পচারী প্রেম নেই বললেই চলে। এককথায় শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসের নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ স্মৃতিচারণা করেছেন। শ্রীকান্ত হিসাবে এখানে শরৎচন্দ্র স্বয়ং যেন নিজেকে প্রকাশিত করেছেন। “তাঁর বড় গুণ তিনি বড়কে বড় করে বলেননি।” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) রচনার গুণে বাস্তবের পটভূমিকাকে তিনি এত সজীব করে তুলেছেন যে, তিনি যে আদর্শবাদী ও রোমান্টিক উপন্যাসে সেটা ধরা পড়েনা তাঁর ‘শ্রীকান্ত’উপন্যাসে।