পুতুল নাচের ইতিকথা – নামকরণ
অথবা, পুতুল ও পুতুলওয়ালার স্বরূপ ; অথবা, নিয়তিবাদের স্বরূপ
পরিশালীনমুক্ত রবীন্দ্র উত্তরতার স্বচ্ছন্দ এক কালচিহ্ন – কল্লোল গোষ্ঠী। তাদের প্রথম সমরোত্তর সংশয়, অস্থিরতা, নাগরিক মনোভব, নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গী, রোমান্টিক বিদ্রোহের আবহের মধ্যে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক, নতুন এবং স্বতন্ত্র মাত্রা সংযোজন করেছিলেন ‘ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়’। একজন আমাদের চিরপরিচিত শৈশবকে নতুন করে প্রত্যক্ষ করালেন, অপর একজন তাঁর সযত্নলালিত রাঢ়ের সীমানাকে তাঁর সাহিত্যে স্থান দিলেন আর তৃতীয় ব্যক্তিত্ব বিজ্ঞানবোধ ও মানবমুক্তির আস্বাদনে আস্বাদ্য করে তুললেন তাঁর সৃষ্টি সম্ভারকে। পল্লী প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন এই ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে নতুনভাবে ধরা পড়লেও মানিকের জীবনবোধ, রহস্যচেতনা, বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গী – ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেওয়া অন্য দুই বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র করেছেন।
“অনুভব করেছি ব্যাহত জীবন কামনার উজ্জ্বল তাপ,
সূর্যালোকের মত।
তুলনা পাইনি রাজকীয় কাব্য ইতিহাসে
এমন সহজ সরল বিরাট সুন্দরের।” (প্রথম কবিতার কাহিনী)
এই ‘সহজ সরল বিরাট সুন্দরের’ সাধনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্যকৃতির উপজীব্য বিষয়। এখানেই তিনি অনন্য। আলোচ্য ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ সেই অনন্যতার পরিচয়বাহী। উপন্যাস সম্পর্কে পিয়ের ফালোঁ বলেছেন –
“শিল্পী মনের উৎকৃষ্টতর ও গভীরতর অভিব্যক্তির নিদর্শন”
ঔপন্যাসিকের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী যাকে সমালোচকরা বলেছেন attitude to life তাই তাঁর সৃষ্টির শিরোনামের মধ্যে লিপিবদ্ধ থাকে। এই নামকরণ কখনও চরিত্রমূলক, কখনও ভাবমূলক, কখনও ঘটনামূলক কখনও বা দৃষ্টিভঙ্গিমূলক। উপন্যাসের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নামকরণ জীবনদৃষ্টিমূলক তবে রূপকাত্মক। জীবন সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গীর কথা লেখক এখানে রূপকাকারে প্রকাশ করেছেন। তাই নামকরণের মধ্য দিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসক্রিয়াই বিচার্য।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কাহিনি রচনা করলেও প্রথমদিকে ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদের চোরা মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ‘জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রম’ নিয়েই রচনা করেছেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। গাওদিয়ায় নানান সমস্যার মধ্যে মতি কুমুদ, বিন্দু নন্দলাল , যামিনী কবিরাজ সেনদিদি, গোপাল, যাদব পাগল দিদি এবং শশী কুসুমের জীবনবৃত্তের সঙ্গে অলক্ষে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে পুতুলের অনুষঙ্গের তাৎপর্য। জীবন ব্যাখ্যার হাতিয়ার রূপে রূপকটি অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে পুতুলের উল্লেখ পাই – পথের মোড়ে বকুল গাছের গোড়ায় কাঁচা পাকা পাতার সঙ্গে ন্যাকড়া জড়ানো পুতুল পড়ে থাকতে দেখা যায়, শশী বুঝতে পারে পুতুলটি শ্রীনাথের মেয়ের। শোকে পুতুলের জন্য মেয়েটি রাতে কাঁদবে আর সকালে এসে পাবে না। শশী এও জানে নিঃসন্তান সেনদিদি ভোরবেলা ঝাঁট দিয়ে এসে পুতুলটি কুড়িয়ে পাবে, সে দেবতার আশীর্বাদে ভেবে ঘরে নিয়ে যাবে। আবার দেখা যায়, শশীর ছোটোবোন সিন্ধুর পুতুলেরা সার সার ঘুমোচ্ছে শশীর খাটের তলায়, ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে পূর্ণ সেই খেলাঘর, এই খেলাঘর অবস্থা সাপেক্ষে পাল্টে যায়। খুকির ক্রীড়াভূমি থেকে বয়স্কের লীলাভূমি পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়, উপন্যাসটি তারই সাক্ষ্য বহন করে। গাওদিয়ার গ্রাম্য গ্রাম্য মতিকে যখন জয়া বাজিয়ে নিচ্ছিল কুমুদ জয়াকে বলে – “স্পীড একটু কমাও জয়া, ভড়কে যাবে। পুতুল তো নয়।” লেখক নির্থকভাবে কুমুদের মুখে ‘পুতুল’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। আবার, গাওদিয়ার স্মৃতি ভুলে যাবার কথা স্মরণ করিয়ে দেবার সময় মতির মনে সংক্রমিত হয় পুতুলের মত কুমুদের হাতে নড়াচড়া করার প্রসঙ্গ।
উপন্যাসের দীর্ঘসময় জুড়ে প্রতাপ ও একাধিপত্যে কুসুম ও অন্যান্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে শশী ; কিন্তু পরিণতির দিকে উপন্যাস যখন পৌঁছেছে তখন শশীকে অনেকখানি ব্যক্তিত্বশূন্য আত্মনির্ভরতাহীন এবং বিমূঢ় দেখিয়েছে। কুসুমের বিস্ময়কর পরিবর্তন তাকে পুত্তলিকায় রূপান্তরিত করেছে। আবার মতির অত্যাশ্চর্য ভালোবাসার নিগঢ়ে বাঁধা জীবন মতির পুতুলসত্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জয়াকে, সেও শশীর মতো হতবাক।
যাদব পন্ডিত সকলের আচরণের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকেই যেন পুতুলে পরিণত করেছে নিজের জীবনের বিনিময়ে। জীবনভর পুতুল খেলায় কাটিয়ে দিতে চায় উপন্যাসের কুশীলবেরা, কিন্তু আড়ালে নিয়ন্ত্রক শক্তি নিয়তির হাতেই অর্পিত অপরকে নিজের আয়ত্তে আনতে গিয়ে মানুষ সে কথা বিস্মৃত হয়, নিয়তির অমোঘত্ব এবং নিশ্চিত অক্ষয় হয়েই থাকে। তাই অনন্তর মুখ দিয়ে লেখক বলিয়েছেন –
“সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।”
পুতুল সদৃশ মানবজীবনের সেই ইতিকথা শোনাতেই লেখক ব্যাকুল। হারু ঘোষের ইচ্ছার সমাপ্তি ঘটে আকস্মিক বজ্রপাতে – এখান থেকে সূচনা উপন্যাসের, সমাপ্তিতে লেখক উদ্দেশ্যটি নিজের ভাষ্যে ইতি টেনেছেন –
“নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে ? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে। মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন অপরিবর্ত্তনীয়।”
মানুষের ব্যক্তিত্ব ইচ্ছা কীভাবে নিয়তির কাছে এক অদৃশ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পিত বারংবার তার পরিচয় উপন্যাসে পাওয়া যায়। শহরের জন্য কাঙাল গ্রামীণ শশীর সংশয়িত প্রশ্ন, “এ কি বন্ধন, এ কি দাসত্ব ?” , এই বন্ধন দাসত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে শহরে চলে যায় শশী, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে প্রতিজ্ঞা টেকে না, ফিরে আসতে হয় –
“গ্রামই তার নিয়তি, তার স্বাধীনতা কেউ হরণ করেনি, তবু শশীর মনে হয় চিরকালের জন্য সে মার্কামারা গ্রাম্য ডাক্তার হইয়া গিয়াছে – এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার তার শক্তি নাই।”
উপন্যাসটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিয়তি উপন্যাসে কখনো ব্যক্তি কখনো ঘটনার ওপর আপতিত হয়েছে। ব্যক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নিয়তি তার শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কাছাকাছি চলে এসেছে মৃত্যু ও নিয়তি, আর অত্যন্ত তাৎপর্যময় ভাবেই উভয়েরই প্রতীক হিসাবে পুতুলকে ব্যবহার করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসলে দূরদর্শী মানিক সমগ্র উপন্যাসে যে প্যাটার্ন বুনেছেন তাতে দেখা যায় মানুষের সমস্ত প্রয়াস নিষ্ক্রিয়তায় গিয়ে পৌঁছায়, ব্যর্থ হয়। কেউই নিজের জীবনকে নিজের অভিপ্রায় মতো গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে ? আপাতভাবে সবকিছুর দায় ‘নিয়তি’, সবকিছু ‘অদৃষ্টের লেখন’ মনে হলেও তা লেখকের কলমের মুন্সিয়ানা মাত্র। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা মুখ্যত নিজের মনের গঠনের কারণে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা ডেকে এনেছে আর গৌণত অন্যের সহায়তা করেছে তাদের ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিতে। একদিকে, গোপালের গ্রাম ছাড়ার মূলে শশী, তেমনি শশীর কলকাতা যাবার আকাঙক্ষার ব্যর্থতার কারণ গোপাল। যাদব পন্ডিতের আত্মহননের কারণ অবশ্যই তিনি নিজে, আবার অন্যদিকে ইচ্ছামৃত্যু চাক্ষুষ করার অতি উৎসাহে গ্রামবাসীরা তাঁকে আত্মহননের পথে বাধ্য করেছে। শশীর দ্বিধা কুসুমের প্রেমের উজ্জীবনকে ব্যর্থ করেছে, কুসুমও একইভাবে শেষপর্যন্ত শশীর প্রেমের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সুতরাং মানুষের চরিত্রই তার নিয়তি – অর্থাৎ মানুষই পুতুল আবার পুতুলওয়ালাও। গ্রিক অথবা ভারতীয় নিয়তিবাদের সঙ্গে সম্যক পরিচিতি সত্ত্বেও আলোচ্য ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে মানিক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে কোনো
অলৌকিক নিয়তিবাদ নয় – মানুষই মানুষের নিয়তি। শশীর অনুভবে এই অমোঘ সত্যের স্বরূপ লেখক প্রকাশ করেছেন –
১) “মৃত্যু পর্যন্ত অন্যমনস্ক বাঁচিয়া থাকার মধ্যে জীবনের অনেক কিছুই যেন তাহার অপচয়িত হইয়া যাইবে। শুধু তাহার নয় সকলের। জীবনের এই ক্ষতি প্রতিকারহীন”
২) “শশী ইহাও বুঝিয়াছে যে জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না। শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের বিনিময়, জীবনদেবতার এই রীতি।”
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদা বিজ্ঞানসন্ধিৎসু মন নিয়ে যুক্তি তর্কের ওপর দাঁড়িয়ে মানবচরিত্রের অন্তগূঢ় রহস্যোন্মচনে সর্বদা ব্যাপৃত থেকেছেন, মানুষের মনোজগতের নিগূঢ়তম অর্থ আবিষ্কারে তৎপর থেকেছেন। তিনি মানুষের অপরাজিত মহিমায় বিশ্বাসী, অস্তিবাদ তাঁর মজ্জায়, আবার মানুষের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন। ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘জীবনের জটিলতা’ – প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলিতে সেই জীবনদর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে, আলোচ্য উপন্যাসের নাম শুধু ‘পুতুল নাচ’ নয়, এটি ইতিকথা ধর্মী উপন্যাস। ‘ইতিকথা’ এখানে উপন্যাস। গ্রাম্যজীবনের দ্বন্দ্বময়তায় তাদের সংগ্রামে ‘ইতিকথা’ নামটি যথার্থ হয়ে উঠেছে। স্পষ্টত বোঝা যায়, পুতুল সদৃশ মানুষের বিচিত্র সমস্যা – সংঘাত – সংকট, বিচিত্র জীবনচর্যা সম্পর্কে ইঙ্গিতদানের মধ্য দিয়ে একটি পূর্ণায়ত জীবনসমীক্ষার দিকেই মানিক দৃষ্টি দিয়েছেন। শশীর চেতনায় এবং বিপরীতের টানাপোড়েনে রচিত হয়েছে মানুষের মানবিক সম্পর্কের আদি মধ্য অন্ত যুক্ত নিজসৃষ্ট নিয়তি শাসিত জীবনের ইতিহাস, উপন্যাসের নামকরণেও এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হওয়ার কারণে নামকরণও যথার্থ ও সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানবজীবনের এই বহুবিচিত্র দ্বান্দ্বিকতার ইতিকথা রচনার নজির মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য উপন্যাসেও পাওয়া যায়। তিনি ক্রনিক্যাল বা ইতিহাসধর্মী ইতিকথা রচনা করে তাঁর মানবদরদী ও অন্বেষণধর্মী মনকে বারবার উদঘাটিত করতে চেয়েছেন – ‘সহরবাসের ইতিকথা’, ‘জীয়ন্ত’ (পূর্বনাম – কলম পোষার ইতিকথা), ‘ইতিকথার পরের কথা’ ইত্যাদি নামের উপন্যাসে।