পুতুল নাচের ইতিকথা : শশী কুসুমের সম্পর্কের প্রকৃতি


      বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নির্ভর বাস্তবতার তন্নিষ্ঠ শিল্পীরূপে বাংলা কথাসাহিত‍্যে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের বিশেষ প্রতিষ্ঠা। তিনি বলেছেন –
“উপন‍্যাসেও কল্পনা পার হয়ে যেতে পারে বাস্তবতার সীমা, গড়ে উঠতে পারে এমন এক মানস জগৎ যার অস্তিত্ব লেখকের মন ছাড়া কোথাও নেই।” (লেখকের কথা)
এই গভীর চেতনা যা জীবন রহস‍্যবোধের‌ই নামান্তর, তা সাধারণভাবে আর্টিস্ট মাত্রের‌ই অবলম্বন বা অন্বিষ্ট, কিন্তু মানিক সম্পর্কে একথা আরো বিশেষ অর্থে সত‍্য। মানিকের এই জীবনচেতনা সত‍্য জীবনের প্রচ্ছন্ন ও আলোছায়ায় অনতিস্পষ্ট রহস‍্যলোকের সৌন্দর্য ও সংকেতকে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে চেয়েছে। বলা যায়, এই জীবন রহস‍্যচেতনা ও বিজ্ঞাননিষ্ঠ বাস্তবতা বোধের সমন্বয়সাধন বা সম্পর্ক নির্ধারণের প্রয়াসেই যেন সারাজীবন আত্মনিয়োগ করেছিলেন মানিক।

       মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের শিল্পসত্তায় জীবনরহস‍্যের উপলব্ধি এসেছে নানা পথ বেয়ে, তা কখনো মৃত‍্যু, কখনো বা অতিলৌকিকৎঅনুভূতি – তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পথ হল নরনারীর প্রেম যৌনতা নির্ভর জটিল অন্তর্লোকের পথ। এই পথেই মানিক অনেক অজানা গূঢ় রহস‍্যের সন্ধান পেয়েছেন, যার ফলে জীবন সম্পর্কে তাঁর সামগ্রিক বোধে প্রায় এক আমূল রূপান্তর ঘটতে চলেছিল। আর এই তাৎপর্যপূর্ণ তমোগহন পথে জীবনকে খোঁজার প্রয়াসে তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন এক পথিক সত্তা। তাঁর সৃষ্টির জগৎ তাই বিশেষভাবে নরনারীর যৌন রহস‍্যচেতনার অজস্র কাহিনিতে পূর্ণ। তবে, তাঁর প্রথমদিকের কিছু রচনাতে প্রেমের রোমান্টিক মাধুর্য আত্মপ্রকাশ করেছে বলা চলে। অল্পবয়সে লেখা ‘অতসীমামী’, এবং ‘নেকী’ গল্পে প্রেম সম্পর্কে মানিকের রোমান্টিক কাব‍্যময় ধারণার পরিস্ফুট পরিচয় পাওয়া যায়। ‘দিবারাত্রির কাব‍্য’ উপন‍্যাসে আনন্দ উপাখ‍্যানের প্রেমচেতনা মৃত‍্যু চেতনার সঙ্গে মিলিত হয়ে রহস‍্যময় রোমান্টিক আবহ সৃষ্টি করেছে। এই রোমান্টিক মনের পরিচয় পাই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন‍্যাসের শশী চরিত্রের মধ‍্যে। শহর থেকে আসা চিকিৎসক শশীর চিন্তায় ধরা পড়েছে – “একদিন কেয়ারি করা ফুল বাগানের মাঝখানে বসানো লাল টাইলসে ছায়া বাংলোয় শশী খাঁচার মধ‍্যে কেনারি পাখির নাচ দেখিবে, দামি ব্লাউজে ঢাকা বুকখানা শশীর বুকের কাছে স্পন্দিত হ‌ইবে…” কিন্তু গ্রাম‍্য পরিবেশে থাকতে থাকতে এই গ্রামকেই তার ভালো লেগে যায় – “জীবনকে দেখিতে শিখিয়া…সে অবাক হ‌ইয়া দেখিয়াছে যে, এইখানে ডোবা আর জঙ্গল আর মশাভরা গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়। একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারি শুরু করিয়া ক্রমে ক্রমে এ জীবন শশীর যে ভালো লাগিতেছে…”

           শশীর এই চেতনা আসলে মানিকের‌ই চেতনা। ভদ্র জীবনের বিকৃতির ফলে মানিক যে অস্বস্তিবোধ করছিলেন নিম্নেতর শ্রেণীর জীবনের অকুন্ঠ বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে তার জীবনদর্শন পরিণতি লাভ করেছিল। শশীর মধ‍্যেই তার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। শশীর দ্বিধান্বিত সত্তার জটিলতার রহস‍্যরূপ উন্মোচিত হয়েছে কুসুমের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ‍্য দিয়ে। শশী কুসুমের সম্পর্ক নানা দ্বিধায় বিজড়িত, কখনো নৈকট‍্যলাভে আতুর কখনো সমাজ সামাজিকতার মধ‍্যে কতদূর সীমা টানা প্রয়োজন – এ বিষয়ে শঙ্কাতুর।

        পরানের স্ত্রী কুসুম, স্পষ্টবক্তা কুসুম, সরল কুসুম, নিঃসঙ্গ কুসুম শশীকে মনে করেছিল ভিনদেশী পুরুষ, তাই চাঁদ ওঠবার আভাস দেখলেই তার মনে গুনগুনিয়ে উঠেছে – “ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন / লাজরক্ত হ‌ইল কন‍্যা পরথম যৌবন।”
বস্তুত উপন‍্যাসে কুসুমের দিকে প্রণয় ব‍্যাকুলতার যে তীব্রতা ব‍্যক্ত বা আভাসিত হয়েছে, শশীর দিক থেকে আদৌ তেমন হয়নি। সে তার শিক্ষা সংস্কৃতি সামাজিক মর্যাদা ও ব‍্যক্তিত্বের অনিবার্য দূরত্ব নিয়ে কখনোই কুসুমের পরোক্ষ প্রণয় নিবেদনে সাড়া দেয়নি, আপন হৃদয়ের নিভৃত জগতে কোনোদিন আহ্বান করেনি, কেবল “মৃদু স্নেহসিঞ্চিত অবজ্ঞার সাত বছর পাগলামিকে সে প্রশ্রয়” দিয়েছিল মাত্র। অথচ সত্তার গভীরে কুসুমের প্রতি তার যে একধরণের দুর্মর আসক্তি ছিল, আকন্ঠ পিপাসা ছিল – সে বিষয়ে শশী আদৌ সচেতন নয় – “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?” শহরে যাওয়ার জন‍্যে তার মনে যে সুতীব্র আগ্রহ, তা যে দীর্ঘদিনের মধ‍্যেও বাস্তব রূপ নিতে পারে নি, সে কেবল কুসুমের প্রতি একধরণের অনতিস্ফুট অথচ দুর্নিবার আকর্ষণের জন‍্য‌ই শশী স্পষ্টত‌ই অনুভব করেছে যে –
“এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার শক্তি নাই। নিঃসন্দেহে এজন‍্য দায়ী কুসুম। শশীর কল্পনার উৎস সে যেন চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে।”

         দ্বিধা সংকোচ কুসুমের মনেও ছিল, সেও জানত এই আসক্তি অবৈধ, পরকীয়া। মনের এই আকর্ষণ বিকর্ষণের বিপরীত প্রবণতার মধ‍্যে সুষ্ঠ সামঞ্জস‍্য আনতে পারেনি বলেই কুসুমের কথায় আচরণে ফুটে উঠেছে এলোমেলো খামখেয়ালি ও পাগলামি ভাব, তা শশীর চোখ এড়ায়নি – “কত বছর আজ সে কুসুমের পাগলামি দেখিতেছে।”
তাই সে শশীর চোখে কখনো সরল বালিকা – “মতির চেয়েও সরল, মতির চেয়েও নির্বোধ”, আবার কখনো রহস‍্যময়ী, পরিণতবুদ্ধি, কখনো ঈর্ষার গূঢ় জ্বালায় তিক্ত, কখনো বা কুটিল কৌশলী নারী যে “নিখুঁত কৌশলে মতির বিবাহ সম্বন্ধে (শশীর) মনের মোড় ঘুরাইয়া দেয়।” কিন্তু বিচিত্ররূপিনী নারীর এই সামঞ্জস‍্যহীন খাপছাড়া প্রকৃতির নেপথ‍্য উৎসমূলে আছে শশীর জন‍্য উদ্দাম দুর্মর প্রেম – “উন্মাদ ভালোবাসা”। দেহ পিপাসার উজ্জ্বল শিখায় এই প্রেম খরদীপ্তিতে জ্বলে উঠেছে, যার রহস‍্যের তল পায় না কুসুম নিজেও – “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু ?”

        এই ‘উন্মাদ ভালোবাসা’ পুতুল নাচের ইতিকথা উপন‍্যাসের কুসুমের‌ও। কিন্তু তাও একদিন স্তমিত হয়ে এল শশীর কাছে প্রত‍্যাশিত সাড়া না পেয়ে। শবরীর প্রতীক্ষা অন্তহীন হতে পারে, কিন্তু কুসুম শবরী নয়, তাই সে অনন্তকাল পথ চেয়ে থাকতছ পারে না। তাই একদিন গাওদিয়ার জীবনকে চিরকালের জন‍্য পিছনে ফেলে পিতৃগৃহের দিকে যাত্রা করল। শশীর সেই মুহূর্তের ব‍্যাকুল আহ্বানে উত্তরে সে বলেছিল –
“লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়…
কাকে ডাকছেন ছোটবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে ? কুসুম কি বেঁচে আছে ? সে মরে গেছে।”
এর আগে ও পরে চিকিৎসক শশী যেসব মৃত‍্যুর মুখোমুখি হয়েছে সেসব তার সত্তাকে বিষণ্ণ ও জিজ্ঞাসু করেছে কিন্তু বিচূর্ণ করেনি। কুসুমের এই আত্মিক মৃত‍্যু যেন শশীর অন্তর্জীবনকে একেবারে বিপর্যস্ত করে দিল।

      কুসুমের স্পষ্টোক্তি, পেটের ব‍্যথার ছল করে শশীর ঘরে যাওয়া, শশীর অত সাধের গোলাপ চারা মাড়িয়ে দিয়ে অম্লান বদনে বলা –
“ইচ্ছে করেই দিয়েছি ছোটবাবু। চারার জন‍্যে এত মায়া কেন ? “
শশীর রোমান্টিক কল্পনার প্রতীক গোলাপ চারাকে অবলীলায় মাড়িয়ে দেয় কুসুম। এবং বুঝিয়ে দেয় গোলাপ চারার প্রতি শশীর যে ভালোবাসা তা আসলে কুসুমের প্রাপ‍্য। এইভাবে শরীরী কামনার তীব্রতায় অসামাজিক প্রেমের সমস্ত শর্তকে অগ্রাহ‍্য করেই বারংবার কুসুম হাজির হয়েছে শশীর জানালায়। আজ সেই কুসুমের প্রেমহীন সহজ অনায়াস স্পষ্টোক্তি :
“আপনি দেবতার মতোছোটবাবু।”
প্রাণের, শরীরের একান্ত কাম‍্য পুরুষ যাকে ঘিরে তার রহস‍্যনিকেতন ভরপুর, সময়ের পরিবর্তনে, ঘটনার বিচিত্রপ্রবাহে সেই পাথরের দেবতায় পরিণত হয়েছে কুসুমের কাছে।

     

অবচেতনার যৌন প্রবৃত্তির প্রধান আশ্রয় দেহকামনা। মনিকের একেবারে প্রথমদিকের উপন‍্যাস ‘দিবারাত্রির কাব‍্য’ এর রোমান্টিক প্রবণতার মধ‍্যেও এই দেহচেতনার আভাস ব‍্যঞ্জিত হয়েছে। কিশোরী আনন্দের প্রতি হেরম্বের রহস‍্যময় আকর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল আনন্দের দেহজ সৌন্দর্য, যা উপন‍্যাসের অন্তে নিজেকে অপ্রত‍্যাশিত নগ্নতায় অনাবৃত করে দিয়েছে। ‘অহিংসা’ উপন‍্যাসে যৌবনময়ী নারী মাধবীর জন‍্য প্রবীণ আশ্রম গুরু সদানন্দের তীব্র আসক্তি নিহিত এবং ‘চতুষ্কোণ’ উপন‍্যাসে রাজকুমারের নারীর নগ্ন শরীর দর্শনের অদ্ভূত তীব্র আগ্রহের রহস‍্যচেতনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ‍্য। এইভাবেই মানিকের উপন‍্যাসে ক্রমেই দেহাশ্রিত যৌনচেতনা ও রোমান্টিক প্রেমের রহস‍্য মিশে একাকার হয়ে গিয়ে উপন‍্যাসে জীবন রহস‍্যের এক নতুন উদ্ভাসন ঘটিয়েছে।