চর্যাপদের সমাজজীবন


কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ, বি.এড




বাংলা সাহিত্যকে যুগের দিক থেকে ভাগ করলে তিনটি যুগ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রথমটি হল প্রাচীন যুগ, এই প্রাচীন যুগের সাহিত্যের প্রাচীনতম যে নিদর্শন সেইটি  হলো ‘চর্যাপদ’। এখনো পর্যন্ত চর্যাপদই প্রথম বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন, এর পূর্বে আর কোনো বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় নি। চর্যাপদগুলি হলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের গুপ্ত সাধনপ্রাণালী সম্বলিত দার্শনিক জীবন জিজ্ঞাসার কাব্যিক নিদর্শন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা কৌশলে তাঁদের দেহসাধনাকে রূপক ও প্রতীকের তত্ত্বজালে গেঁথে দিয়েছেন উক্ত গানগুলোতে। যদিও এগুলো ধর্মসঙ্গীত হিসেবে পরিচিত।

ড. ক্ষেত্র গুপ্তের কথায় –
“চর্যাপদগুলি সাধনসংগীত সাধক কবিরা তাঁদের সাধনার লক্ষ্য এবং পদ্ধতি গানের মাধ্যমে প্রচার করেছেন। তত্ত্ব কথাটি প্রায়ই রূপকের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।”

জীবনের কথা বলে সাহিত্য। সময়ের কথা বলে সাহিত‍্য। একটা বিশেষ যুগের জীবন্ত দলিল সেই সময়কার সাহিত‍্য। ফলে সমাজের বিভিন্ন চিত্র গভীরভাবে মিশে থাকে প্রতিটি সাহিত্যকর্মের মধ্যে। চর্যাগানগুলিতেও তার ব‍্যত‍্যয় ঘটেনি। চর্যাপদে যেসকল রূপকের চিত্র আছে সেখান থেকে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকগণ হাজার বছর পূর্বে যে সমাজ ব্যবস্থা ছিল তার অনুসন্ধান করেছেন।

ভৌগলিক বর্ণনা –
চর্যাগীতিগুলি মূলত বাংলাদেশের বৌদ্ধ সাধকদের সাধনসঙ্গীত বলা যেতে পারে। এই কারনে তাঁদের রচনার মধ্যে উপমানরূপে বাংলার ভৌগলিক প্রকৃতির বর্ণনা অনেকাংশে লক্ষ করা যায়। এই ভৌগলিক প্রকৃতির মধ্যে সবথেকে বেশি সর্বগ্রাহ্য হলো ‘নাব্য ভূপ্রকৃতি’। বাংলা মূলত নদীমাতৃক হিসেবে পরিচিত, এখানে সর্বাধিক পরিমাণে নদী, পুকুর, ডোবা প্রমুখ লক্ষ করা যায়। চর্যাপদের পদগুলোতে প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যের নদী নির্ভর জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত চিত্র ফুটে উঠেছে, যা মূলত নদীকেন্দ্রিক বাঙালির জীবন-চিত্রের যথাযথ পরিচয় বহন করে। চর্যাপদের অনেকাংশেই নদী খাল নৌচালনার কথা উল্লেখিত আছে এবং এর পাশাপাশি সাঁকো নির্মাণের কথাও উল্লেখিত আছে। –
“ ভবণই গহণ গম্ভীর বেগে বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন রাহী ।।
ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামিলোঅ নিভর তরই ।।”
অর্থাৎ, ভবনদী এতো গম্ভীর বেগে বইছে যে দুই পাড়ে কাঁদা মাঝে থৈ নেই। ধর্মের জন্য চাটিল সাঁকো গড়ে, পারগামী লোক নিশ্চিন্তে পার হয় যাতে।
তৎকালীন সময় নৌকা ছিল সেইসময়ের মানুষদের একটি নিত্যদিনের যানবাহন। নদীমাতৃক এলাকা হওয়াতে নৌকাতে করেই তাঁরা চলাচল করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতো –
“সোনে ভরিলী করুণা নাবী ।
রূপা থোই নাহিকে ঠাবী ।। ”
গঙ্গা যমুনার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪ সংখ্যক পদে যা ডোম্বীপাদানাম্ এর রচনা –
“গঙ্গা জউণা মাঝেঁরে বহই নাই।”
এছাড়া ৩২ সংখ্যক চর্যায় ‘খাল’ এবং ‘ডোবা’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১০ সংখ্যক চর্যায় ‘সরোবর’-এর, ২৭ সংখ্যক ও ৪৭ সংখ্যক চর্যায় ‘পদ্ম’ এবং ২৩ সংখ্যক চর্যায় ‘পদ্মবন’-এর উল্লেখ লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম নদীকেন্দ্রিক জীবন সংস্কৃতির পরিচয় চর্যাপদেই পাওয়া যায়।

সামাজিক শ্রেণি –
       আধুনিক কালের সমাজ ব্যবস্থার মতো ছিলনা প্রাচীন কালের সমাজ ব্যবস্থা। প্রাক-আধুনিক  সাহিত্যিকদের রচনাতে মূলত সাধারণ মানুষদের নয় দেবতা ও রাজাদের নিয়ে লেখার নিদর্শন পাওয়া যায়। কেবলমাত্র  চর্যাপদই একমাত্র ভিন্ন, এখানে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা রূপকের অন্তরালে বাংলাদেশের সামগ্রিক তথ্য, বিশেষ করে লোকায়ত জীবনকে ভিত্তি করে নিম্নবর্গের জীবনকথা শুনিয়েছেন। এখানে কোনো উচ্চবর্ণের মানুষদের কথা নেই আছে প্রান্তিক মানুষদের কথা। অনার্য, শবর, মাঝি তথাকথিত অমার্জিত মানুষদের কথা পাওয়া যায় চর্যাগানগুলিতে।
চর্যাপদে চোর, দস্যু, ডাকাতদের বর্ণনা অনেকাংশেই লক্ষ করা গিয়েছে কিন্তু এরা যেমন সেই সময় ছিল, তেমনি তখনের সময় বিচার ব্যবস্থাও ছিল অনেক কঠোর। চোর ধরার জন্য  –  ‘দুষাধী’ অর্থাৎ ‘দারগা’ এবং শাস্তি স্বরূপ ‘উআরি’ অর্থাৎ ‘থানার’ ব্যবস্থা ছিল সেইসময়, চর্যাপদে তার উল্লেখ আছে।
চর্যাপদকারেরা, তখনকার সময়ের মানুষদের অধঃপতনও তুলে ধরেছেন, তা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন চর্যাপদগুলির মধ্যে। গভীর রাত্রে গৃহবধূর অন্যত্র যাওয়ার উল্লেখ এখানে পাওয়া যায় –“রাতি ভইলেঁ কামরু জাঅ।” এছাড়া দুশ্চরিত্র ও মাতালদেরও যথেষ্ট উৎপাত ছিল সেইসময়ে।
সেইসময় মানুষ কতটা দুঃখ কষ্টে নিজেদের দিন কাটাতো তার পরিচয় চর্যাগীতের মধ্যে পাওয়া যায়। জীর্ণ কুঁড়ে ঘরের চাল, মাটির দেওয়াল নষ্ট হয়ে পড়া নিত্য উপবাস, জীবিকা অর্জনের অনিশ্চয়তা, উচ্চবর্ণের মানুষদের অবজ্ঞা প্রমুখ বিষয় চোখে পড়ে। নিরানন্দময় জীবনের আলো আঁধারিতে ভরা নিত্য চলমানতার বাস্তব চিত্র সর্বপ্রথম এই চর্যাপদের মধ্যেই লক্ষ করা যায়।

নারীজীবন –
কুড়ি সংখ্যক চর্যাগানে এক  অভাগিনীর জীবন দশা লক্ষ করা যায়, কুক্কুরীপা -এর এই পদটি হল –
“ফেটলিউ গো মাএ অন্তউড়ি চাহি।
জা এথু বাহাম সো এথু নাহি ।।
পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া।
নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া।। ”
অর্থাৎ, মা আঁতুড় দেখে প্রসব করলাম কিন্তু এখানে প্রসব করানোর মতো ব্যবস্থা ছিল না। প্রথম প্রসব আমার বাসনার পুঁটুলি। নাড়ী টিপতে টিপতে সেও চলে গেল।
চর্যাপদের কালের সমাজ ব্যবস্থায় অবশ্য নারীদের জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁরা স্বাধীন ভাবে তাঁদের জীবন অতিবাহিত করতে পারতো। তাঁরা স্বেচ্ছায় সঙ্গী ও পেশা নির্বাচন করতে পারতো। ১০ সংখ্যক পদ থেকে জানা যায় ডোমনী নগরে তাঁত ও চাঙারি বিক্রি করতো এবং ১৪ সংখ্যক পদে নারীদের নৌকা চালানো, নৌকার জল সেচন, লোক পারাপার ইত্যাদি কর্মে নিযুক্ত থাকার কথা জানা যায় –
“বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদগুরু পাঅ পএঁ জাইব পুণু জিণউরা।।
পাঞ্চ কেড়ুআল পড়ন্তেঁ মাঙ্গে পিটত কাচ্ছী বান্ধী।
গঅণদুখোলেঁ সিংচহুঁ পাণী ন পইসই সান্ধী।।
চন্দসুজজ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিংদা।
বাম দাহিণ দুই মাগ ন রেবই বাহতুচ্ছন্দা ।।
কবড়ী ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছড়ে পার করেই ।
জো রথে চড়িলা বাহবাণ জাই কুলেঁ কুল বুড়ই ।। ”
চর্যাপদের মধ্যে লোকায়ত বাংলার যে ছবি তা লক্ষ করা যায়। সমাজে অবস্থিত অবহেলিত, পদদলিত ও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের কথা সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের পদে তুলে ধরেছেন, তার পাশাপাশি নিম্নবর্গের মানুষদের জীবন জীবিকাকে তুলে ধরেছেন।

অধ্যাপিকা সত্যবতী গিরি“চর্যাপদে লোকজীবন” গ্রন্থে এইসকল মানুষদের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন – “ অরণ্যসংকুল, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবনই চর্যায় প্রাধান্য পেয়েছে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনে ভাত না থাকার কষ্ট, দারিদ্রের জন্যই স্বামী পরিত্যক্তা, সদ্য প্রসূতির মৃত, সন্তানের জন্য বেদনার হাহাকারই যেন শেষপর্যন্ত চর্যাবাহিত লোকজীবনের পরিসরকে আচ্ছন্ন করে থাকে।”

পরিবার জীবন –
বর্তমান যুগে একক পরিবারের প্রচলন বেশি থাকলেও চর্যাপদের কালে মোটেই একক পরিবারের প্রচলন ছিল না, তৎকালীন সময়ে একান্নবর্তী পরিবারের প্রচলন বেশি দেখা যেত। ১১ সংখ্যক চর্যাপদে শাশুড়ি, ননদ, শ্যালিকা প্রমুখদের নিয়ে এক বিরাট পরিবারের চিত্র লক্ষ করা যায় –
“মারিঅ সাসু নণন্দ ঘরে সালী।
মাঅ মরিঅ কাহ্ন ভইএ কবালী ।। ”
এছাড়া দ্বিতীয় সংখ্যক চর্যাপদেও এই একান্নবর্তী পরিবারের নিদর্শন পাওয়া যায় –
“সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ‌।” অর্থাৎ, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বধূটির সংসার।
তৎকালীন সময়ে বিত্ত- বর্ণ- বর্গ বিভাজন লক্ষ করা যায়। তখনকার দিনে নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা জীর্ণকুটির, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করত, এখনও এই চিত্র অবশ্য অনেক যায়গাতেই লক্ষ করা যায়। ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে এই সকল অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ যেমন ডোম, শবর প্রমুখেরা নগরের মধ্যে বাস করতে পারতো না তাঁরা বাস করত নগরের বাইরে। কবি কাহ্নপার চর্যাগীতের মধ্য দিয়ে সেই চিত্র ফুটে উঠেছে –
“নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্ম নাড়িআ।।”
অর্থাৎ, নগরের বাইরে ডোমনীর কুঁড়েঘর এবং সে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ব্রাহ্মণ বালককে। এছাড়া শবরপাদের চর্যাগীতের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে অনেকে আবার উঁচু পাহাড়েও বসবাস করত –
“উঞ্চাঁ উঞ্চাঁ পাবত তহিঁ বসই  সবরী বালী।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।”
অর্থাৎ, শবরী বালিকা উঁচু পাহাড়ে বাস করে, এবং সজ্জা হিসেবে সে ময়ূরের পুচ্ছ ও গুঞ্জা ফুলের মালা ব্যবহার করেছে।

খাদ‍্যদ্রব‍্য –
দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময়ে বাঙালিদের খাদ্য তালিকায় কী কী সামগ্রী থাকতো না চর্যাপদগুলি বিশ্লেষণ করে জানা সম্ভব হয়েছে। যেমন-
ক) প্রাচীন যুগের বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ছিল ভাত।
খ) মাছ, মাংস, দুধ , লাউ অবশ্য খাদ্য হিসেবে প্রিয় ছিল।
ভুসুকু পাদের পদে হরিণের মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায় –
“অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।”
অর্থাৎ, তখনকার দিনে হরিণের মাংসের প্রচলন ছিল। দুগ্ধ দহণের কথাও পাওয়া যায় ৩৩ সংখ্যক চর্যাগীতে – “দুহিল দুধু কি বেণ্টে ষামাঅ।।”
গ) তেঁতুলের উল্লেখও পাওয়া যায় – “ রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ ।। ”
ঘ) তখনকার দিনে যে মদ্যপান চলত তার উদাহরণও লক্ষ করা যায় চর্যার গানে । চর্যাপদের তৃতীয় সংখ্যক পদে তার উদাহরণ পাওয়া যায় –
“এক সে সুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণি বান্ধঅ।। ”
এছাড়া চর্যাপদ থেকে তখনকার দিনে অন্তজ শ্রেণির মানুষেরা কিভাবে অনাহারে দিন কাটাতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় –
“পারত মোর ঘর নাহি পরবেষী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।। ”

ব‍্যবহৃত সাজসজ্জা –

চর্যাপদে, প্রাচীন যুগে বাঙালিরা যেসকল আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র ব্যবহার করতো তার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তখনকার দিনে যে খাটের ব্যবহার হতো তার উল্লেখ ২৮ সংখ্যক চর্যাপদে পাওয়া যায় –
“তিঅধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী।”
এছাড়া চর্যাপদের মধ্যে হাড়ি, পিড়িঁ চাঙাড়ি-
“তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া।”
ঘড়ার উল্লেখও পাওয়া যায় – “এক ঘড়ুলী সরুই নাল ।”
সেই সময় নারী ও পুরুষেরা নির্বিশেষে অলঙ্কার পড়ত। কর্ণভূষণের উল্লেখ কুক্করীপাদানাম্ -এর পদে যায় পাওয়া –
“কানেট চৌরি নিল অধরাতী। ”
১১ সংখ্যক চর্যায় নূপুর ও কুণ্ডলের বর্ণনা পাওয়া যায় –
“আলি কালি ঘন্টা নেউর চরণে ।
রবিশশি কুণ্ডল কিউ আভরণে।।”
শবর শ্রেণির রমণীরা যেমন রূপসজ্জা স্বরূপ ময়ূরপুঞ্ছ এবং গুঞ্জরী মালা ব্যবহার করত, তেমনি কাপালী শ্রেণির মানুষেরা যে হারের মালা পরত –
“তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী।। ”

অধ্যাপক সনৎ কুমার নস্কর চর্যার পদ রচনার সময়কালীন অরণ্য নির্ভর, অন্ত্যেবাসীর কথা বলতে গিয়ে বলেছেন –
“চর্যার যে লোকজীবনের সাক্ষাৎ মেলে তা মূলত পল্লিবাসীর। তার মধ্যে আবার দরিদ্র ইতরজনই বেশি। টিলা বা নীচু পর্বতে জনপদ সন্নিহিত অরণ্যে যারা বসবাস করত, বলাবাহুল্য, তারা সমাজের মূল স্রোতের বাইরে অবস্থান করত। ফলে এদের বেশভূষায় খুব একটা অভিজাত্য ছিল না।”

বিবাহরীতি –
চর্যাপদের সময় নৃত্য-গীতি, বাদ্যযন্ত্র, হৈ হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে বিবাহ রীতি সম্পন্ন হতো। বিবাহের পাত্র মাদল বাজিয়ে বিবাহ করতে যেত। সেইসময় অনুলোম – প্রতিলোম বিবাহের প্রচলন ছিল। বিবাহ করার জন্য জাত-পাত ভেদ-বৈষম্য দেখ হতো না । পণের ব্যবস্থা ছিল এবং পণের লোভে নিম্নসমাজের নারীদেরও বিবাহ করার প্রচলন এখানে লক্ষ করা যায় –
“জঅ জঅ দুংদুহি সাদ উছলিআঁ ।
কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিআ ।।
ডোম্বি বিবাহিআ অহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম।।”
অর্থাৎ, কাহ্ন ডোমনীকে বিবাহ করতে চলল, ডোমনীকে বিবাহ করে জাত গেলেও যৌতুক রূপে যা পাওয়া গেল তাতে ধর্ম রক্ষা পেল কাহ্নের।
চর্যাপদে সুখী দাম্পত্য জীবনের চিত্র লক্ষ করা যায়। তখনকার দিনে আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও সুখ যে ছিল, তা লক্ষ করা যায় শবর – শবরীর সাংসারিক জীবন থেকে-
“উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাড়া তোহৌরী ।
নিঅ ঘরিণী ণামে সহজ সুন্দরী ।।”
এছাড়া শবরপাদের রচিত পদেও অনুরূপ এই শবর – শবরী সুখী দাম্পত্য জীবনের উল্লেখ আছে –
“কঙ্গুচিনা পাকেলা রে শবরাশবরি মাতেলা।
অণুদিণ সবরো কিম্পি ন চেবই মহাসুহেঁ ভেলা।‌। ”

সাংস্কৃতিক জগত –
তৎকালীন সময়ে নিম্নজাতির মেয়েরা নৃত্য গীতে পারদর্শী ছিল। তাঁরা চৌষট্টি পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্মের উপর অসাধারণ নাচ করার কৌশল জানতো। –
“এক সো পদমা চৌসটঠী পাখুড়ী ।
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।। ”
এই তথ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় দশম – দ্বাদশ শতাব্দীর এই বিস্তীর্ণ সময় পর্বে নিম্নবর্গের নারীরা নৃত্যের মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতো।
শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে-
“এই নৃত্য গীতকুশলতার সঙ্গে এই ডোম্বীনারীগণের চরিত্রেও হয়তো চঞ্চলতা আসিত এবং সমাজের উচ্চশ্রেণির জনগণেরও তাহারা মনোহারিনী হইয়া উঠিত।”

এছাড়া বিবাহের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ধর্মীয় উৎসব পার্বণেও নৃত্য গীতের প্রচলন লক্ষ করা যায়। তখন নাট্যভিনয়েরও প্রচলন ছিল তার উল্লেখ পাওয়া যায় সতেরো সংখ্যক চর্যাগীতে –
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।”

ক্রীড়া –
চর্যাপদে ক্রীড়া বিষয়ক কোনো তথ্য তেমন পাওয়া যায়না। তবে অশ্ব চালনা, পাশাখেলার প্রচলন ছিল তৎকালীন সময়ে। বারো সংখ্যক চর্যাপদে দাবাখেলার প্রসঙ্গ অবশ্য লক্ষ করা যায় –
“করুণা পিহাড়ি খেলহুঁ নয়বল।
সদগুরু বোহেঁ জিতেল ভববল।। ” – নয়বল অর্থাৎ দাবা।

অধ্যাপক বীতশোক ভট্টাচার্য তাঁর ‘পদচিহ্ন চর্যাগীতি’ বইতে জানিয়েছেন-
“কর্মচণ্ডালিকা বা কামচণ্ডালী গানের ধারা ও তাৎপর্য আজ অবলুপ্ত। এ অনুষ্ঠান ছিল হয়তো আদিবাসীদের স্বভাবে তা হয়তো ছিল লোকায়ত ।”

যদিও চর্যাপদ বৌদ্ধ সাধন সংগীত হিসেবে পরিচিত কিন্তু তা সত্ত্বে চর্যাকারেরা যে ভাবে সেইসময়কার চিত্র উক্ত পদগুলোতে তুলে ধরেছেন তাতে চর্যাপদ হয়ে উঠেছে সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থার জীবন্ত দলিল।