কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলমে- শ্রেয়সী মিশ্র, বাংলা(এম.এ), মেদিনীপুর কলেজ
রবীন্দ্র-শরৎ উত্তরপর্বে বাংলা কথাসাহিত্যের গতি পরিবর্তনে যে তিনজনের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় তারা হলেন ত্রয়ী বন্দোপাধ্যায়ে- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।বাংলা সাহিত্যের উদ্ভাসিত নভোমন্ডলে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলেন কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে জীবনের বাস্তব ভূমি তে পদচারনা করে ,বাস্তবের গভীরে ডুব দিয়ে জীবনের জটিলতা কে ধরতে চেয়েছেন। সেজন্য তথাকথিত রোমান্টিকতা পরিত্যাগ করে মানিক বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান দৃষ্টি কে গ্ৰহন করেছেন। শুধু তাই নয় সামাজিক সমস্যা ও ব্যক্তির পতনের কারণ গুলিকে অনুসন্ধান করে তাকে তাঁর কথাসাহিত্যে রূপায়নের চেষ্টা করেছেন । এদিক থেকে তিনি দুঃসাহসী লেখক।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সহসম্পাদক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন,-
“মানিকই একমাত্র আধুনিক লেখক যে কল্লোল ডিঙিয়ে বিচিত্রায় চলে এসেছে – পটুয়াটোলা ডিঙিয়ে পটলডাঙায়।”
বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি নিজ মহিমায় আসীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্য জগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। অবচেতনার গহনে তাঁর সঞ্চালন, আপাত উদ্ভট সমস্যার মধ্যে তাঁর অবগাহন, কিন্তু এরই মধ্যে চিরকালীন স্বীকৃতি সত্যশিব সুন্দরের ভেজাল আবিষ্কারে তিনি নীলকন্ঠ।
■ জন্ম ও বংশ পরিচয় :-
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে ( ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জৈষ্ঠ্য) বিহারের সাঁওতাল পরগণা, বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে বর্তমান লৌহজং -এ। জন্ম পত্রিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তাঁর পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধ কুমার। আর ডাক নাম ছিল মানিক। পিতা হলেন হরিহর বন্দোপাধ্যায় আর মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। পিতা মাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে শেষ পর্যন্ত দশ জন বেঁচে ছিলেন, চারটি বড় বোনের সাথে মানিক ছিলেন ছয় পুত্রের মধ্যে চতুর্থ। পিতা হরিহর বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব- রেজিষ্টার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব – কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা- বিহার-ওড়িষ্যার দুমকা,আরা,সাসারাম, কলকাতা, বাঁকুড়া, বারাসত, তমলুক, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদি নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের ,লৌহজং এর গাউদিয়া গ্ৰামে। প্রথম জীবন থেকে মানিক ছিলেন দূরন্ত, চঞ্চল, নির্ভীক ও হাসিখুশি স্বভাবের। রোমান্টিক প্রকৃতির মানিক তাঁর জীবনের প্রথম দিক থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালো গান গাইতেন এবং বাঁশি বাজাতে পারতেন।
■ শিক্ষা ও কর্মজীবন :-
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে বাঁকুড়ার ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন।
কলেজ ক্যান্টিনে একদিন আড্ডা দেওয়া অবস্থায় এক বন্ধুর সাথে মানিক বাজী ধরেন তাঁর লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপাবেন। সে সময় কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত এবং কেবল নামকরা লেখকরাই তাতে লিখতেন। বন্ধুর সাথে বাজি ধরে মানিক লিখে ফেললেন তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ । এবং সেটি বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দেন। গল্পের শেষে নাম সাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় লেখাটি পাঠানোর চার মাস পর বিচিত্রায় ছাপেন। প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে,এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশের ফলে তাঁর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। শেষাবধি শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। সাহিত্য রচনাকেই তিনি তাঁর পেশা হিসেবে বেছে নেন।
পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন মা কিছু দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মানিক কয়েকমাস একটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তাঁর লেখায় কম্যুনিজম এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
■ সাহিত্য জীবন :-
মা নীরদাসুন্দরী দেবীর আদিনিবাস ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্ৰামে।এই গ্ৰামের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা ‘ । পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমনের কারনে এই সমস্ত এলাকার মানুষদের জীবন চিত্র সম্পর্কে বেশ ধারণা ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন মানিক। তাঁর এই সকল অভিজ্ঞতা কেই তিনি সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সব চরিত্রের আড়ালে। সাহিত্য রচনাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র সাধনার বিষয়। কুলহারা জীবনের রহস্যময় হাতছানি নয়,সংগ্ৰামী সংকল্পে জীবনের মুখোমুখি পাঠক কে দাঁড় করিয়েছেন। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, এছাড়া মার্কসবাদ ও তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
‘গল্প লেখার গল্প’ তে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, –
“ক্লাসে বসে মুগ্ধ হয়ে লেকচার শুনি,ল্যাবরেটরিতে মশগুল হয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি , নতুন এক রহস্যময় জগতের হাজার সংকেত মনের মধ্যে ঝিকমিকিয়ে যায়। হাজার নতুন প্রশ্নের ভারে মন টলমল করে। ছেলেবেলা থেকে ‘কেন?’ মানসিক রোগে ভুগছি, ছোটোবড় সব বিষয়েই মর্মভেদ করার অদম্য আগ্ৰহ যে রোগের প্রধান লক্ষন”
বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র মানিক বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়েই সাহিত্য সাধনার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০ টি উপন্যাস ও ৩০০ টি গল্প রচনা করেছিলেন।
উপন্যাস – ‘দিবারাত্রির কাব্য'(১৯৩৫), ‘জননী'(১৯৩৫), ‘পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৪৬), ‘পদ্মা নদীর মাঝি'(১৯৩৬), ‘জীবনের জটিলতা’ (১৯৩৬), ‘অমৃতস্যঃ পুত্রা'(১৯৩৮), ‘শহরতলি’ (১ম খন্ড১৯৪০), শহরতলি'(২য় খন্ড১৯৪১), ‘অহিংসা'(১৯৪১),’ধরাবাঁধা জীবন'(১৯৪১), ‘চতুস্কোণ'(১৯৪২), ‘প্রতিবিম্ব'(১৯৪৩), ‘দর্পণ’ (১৯৪৫), ‘চিন্তামণি'(১৯৪৬), ‘শহরবাসের ইতিকথা'(১৯৪৬), ‘চিহ্ন'(১৯৪৭), ‘আদায়ের ইতিহাস’ (১৯৪৭), ‘জীয়ন্ত'(১৯৫০), ‘পেশা'(১৯৫১), ‘স্বাধীনতার স্বাদ'(১৯৫১), ‘সোনার চেয়ে দামী (১ম খন্ড১৯৫১), ‘সোনার চেয়ে দামী'(২য় খন্ড ১৯৫২), ‘ইতিকথার পরের কথা'(১৯৫২), ‘পাশাপাশি'(১৯৫২), ‘সার্বজনীন'(১৯৫২), ‘নাগপাশ'(১৯৫৩), ‘ফেরিওয়ালা'(১৯৫৩), ‘আরোগ্য'(১৯৫৩), ‘চালচলন'(১৯৫৩), ‘তেইশ বছর আগে পরে'(১৯৫৩), ‘হরফ'(১৯৫৪), ‘শুভাশুভ'(১৯৫৪), ‘পরাধীন প্রেম'(১৯৫৫), ‘হলুদ নদী সবুজ বন'(১৯৫৬), ‘মাশুল'(১৯৫৫)।
ছোটো গল্প – ‘অতসী মামী’ ও ‘অন্যান্য গল্প'(১৯৩৫), ‘প্রাগৈতিহাসিক'(১৯৩৭), ‘মিহি ও মোটা কাহিনী'(১৯৩৮), ‘সরীসৃপ'(১৯৩৯), ‘বৌ'(১৯৪০), ‘সমুদ্রের স্বাদ'(১৯৪৩), ‘ভেজাল'(১৯৪৪), ‘হলুদপোড়া'(১৯৪৫), ‘হারাণের নাতজামাই’, ‘আজ কাল পরশুর গল্প'(১৯৪৬), ‘পরিস্থিতি'(১৯৪৬), ‘খতিয়ান'(১৯৪৭), ‘মাটির মাশুল'(১৯৪৮), ‘ছোটো বড়'(১৯৪৮), ‘ছোটো বকুলপুরের যাত্রী'(১৯৪৯), ‘ফেরিওয়ালা'(১৯৫৩), ‘লাজুকলতা'(১৯৫৪), ‘আত্মহত্যা অধিকার’
নাটক – ‘ভিটেমাটি’ (১৯৪৬)
■ সাহিত্যে বিশিষ্টতা :–
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিস্তৃত সাহিত্য ভান্ডারে নানান বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়
১) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে রোমান্টিক ভাবালুতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, জীবন কে দেখতে চেয়েছেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের দৃষ্টি দিয়ে।
২) ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে মানিকের চরিত্রগুলো আলোকিত।
৩) মানুষের আদিম বৃত্তি যৌন লালসার নৃশংস রূপটি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাহিত্যে।
৪) দরিদ্র মানুষের আশা ও স্বপ্ন ভঙ্গের কাহিনী লক্ষ্য করা যায় তাঁর গল্প, উপন্যাসে।
৫) দাম্পত্য জীবনের জটিলতা তাঁর সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে।
৬) তিনি সত্যের প্রতি আস্থা রেখে মার্কসবাদী চিন্তাধারায় সাহিত্যে সাধারণ মানুষকে নিজের অধিকার দিয়েছেন।
তাই মানিকের সাহিত্য যেমন আকর্ষণীয় তেমনি শিল্প সাফল্য ও উপস্থাপন কৌশল পাঠক কে মুগ্ধ করে।
ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন – ‘ আমাদের কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন আগুনের এক মস্ত মশাল’।
পুরস্কার ও সম্মান :- বেঁচে থাকাকালীন কোনো পুরস্কার প্রাপ্ত হননি পুতুল নাচের ইতিকথার স্রস্টা বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রয়ে গেছেন বাঙালির স্মরনে- মননে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তববাদী, তিনি রোমান্টিক সৌন্দর্য জড়িত বিশ্বস্বপ্নের প্রত্যক্ষ কে আচ্ছন্ন করে দেখতে চান নি। তিনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পৃথিবী কে দেখেছেন। বিশ্লেষনের তীক্ষ্ণ আলোকপাতে যন্ত্রণাবিদ্ধ চেতনাকে আবিষ্কার করেছেন। তাঁর রচনায় তিনি আধুনিক জীবনের প্রতি নীরব,নিষ্ক্রিয় ও বিমূঢ় দৃষ্টিপাতে কখন ও বা শাণিত আঘাতে তার বর্ণাঢ্য মুখোশের অন্তরাল থেকে কুশ্রী মুখাবয়বের উদঘাটনে শক্তির বিচিত্র লীলার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। সবশেষে বলা যায় রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কালে, বাংলা সাহিত্যের প্রধান শিল্পীদের অন্যতম হলেন, কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই রূপ প্রথম স্তরের কথাসাহিত্যিক সমকালে এবং পরে আর দেখা যায় নি।