পথের পাঁচালী উপন্যাসের অপু চরিত্র
কলমে – পূজা দাস এম এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
একটি উপন্যাস যে সকল গুন ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে সর্বাঙ্গিন সুন্দর ও সার্থক উপন্যাসের উন্নীত হয়, তার একটি বিশিষ্ট দিক হলো সেই উপন্যাসের চরিত্র ও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন। গল্প অথবা উপন্যাসের গতীবৃদ্ধি করে সেই গল্পস্থিত বিভিন্ন চরিত্রাবলী, তাদের বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলী, গভীরতা, ওজস্বিতা, সর্বোপরি গতিমুখরতা। বিভূতিভূষণ প্রধানত সামাজিক মানুষের ইতিহাস রচয়িতা। তাঁর সাহিত্য প্রধানত মানুষের সুখ দুঃখের পাঁচালী। তিনি তাঁর সাহিত্যের ভিতর দিয়ে চিরন্তন দুঃখবাদের এক করুণ সুর অন্তঃসলিলা ফাল্গুর মতো তুলে ধরেছেন। বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসে জীবন আর জীবন বোধের সূক্ষ্ম প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, আর এই প্রতিফলনের সার্থক রূপায়ণ দেখা যায় তার উপন্যাসের চরিত্রগুলিতে। আমাদের আলোচ্য বিষয় “পথের পাঁচালী” উপন্যাসের অপু চরিত্রের বাস্তবায়ন বা প্রসঙ্গতা। “পথের পাঁচালী” উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপুর দৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছেন। এই উপন্যাসের অপুর প্রকৃতি প্রেম আসলে লেখকেরই প্রকৃতিপ্রেম। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসের আসল উপজীব্য বিষয় হলো প্রকৃতি। আর এই প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে অপুর জীবন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে। অপু যেমন জীবনকে ভালোবেসেছে তার সাথে সাথে প্রকৃতিকেও ভালোবেসেছে। উপন্যাসে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত- অভিঘাতে অপুর জীবন অপরিণত থেকে ক্রমশ পরিনত হয়ে উঠেছে। উপন্যাসে সর্বশেষে পথের দেবতা অপুকে ঘরের বাধন অগ্রাহ্য করে, বৃহতের আনন্দযাত্রায় অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অপুই হলো “পথের পাঁচালী” উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই অপুর মাধ্যমেই পাঠক ঔপন্যাসিকের জীবন দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়।
■ উপন্যাসে অপুর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী:
“পথের পাঁচালী” উপন্যাসের প্রথম পর্বে অর্থাৎ ‘বল্লালীবলাই’ অংশে অপুর জন্ম হলেও তার চরিত্রের সক্রিয়তা ফুটে ওঠে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশে। তখন তার বয়স ছিল ছয় থেকে সাত বছর, এক ফুটফুটে শিশু সন্তান যেন। অপু কিশোর চরিত্র হলেও অপুর চোখে পৃথিবীর বিস্ময় ভরা সৌন্দর্য লেখক উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উপন্যাস অপু ছয় বছর বয়সে বাড়ির বাইরে আসে, প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখে এবং যাই দেখে তাতেই অপু অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যায়। সে ছিল তার দিদি দুর্গার প্রধান সঙ্গী উপহারছিল তার দিদি দুর্গার প্রধান সঙ্গী। অপু আর তার দিদি দুর্গা দুজনেই বাড়িতে থাকে খুব কম সময়, শুধু খাওয়ার সময় পর্যন্ত টুকু থাকে, তারপরেই বেরিয়ে পড়ে প্রকৃতির কোলে। এই প্রকৃতি যেন তাকে প্রশান্তি এনে দেয়। এমন কি দেখা যায় সর্বজয়া যখন অপুর প্রিয় খাবার চাল ভাজা ভেজে খাবার জন্য ডাকে, তা না খেয়ে অপু খেলতে বেরিয়ে পড়ে। খেলা করে যেন অপু বেশি খুশি থাকে, খেলাধুলা করেই যেন সে বেশি সুখী হয়। সরস্বতী পুজোর দিন বিকালে সে তার বাবা হরিহরের সাথে নীলকন্ঠ পাখি দেখতে বেরিয়েছিল। এই প্রথম তার বাড়ি চৌহদ্দি পেরিয়ে প্রথম বাইরে আসা। বর্ণ পরিচয়ের পাতায় সে যে খরগোশের ছবি দেখেছিল, এতদিনে চাক্ষুষ দেখল। তাই সে কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে “বনের মধ্যে কি গেল বাবা? বড় বড় কান?” তার বাবার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে কৌতূহলে বারবার জিজ্ঞাসা করে। মুখে শোনা নীলকুটি উঠে এলো তার চোখের সামনে। লারমার সাহেবের শিশু পুত্রের সমাধি ও দেখতে পেল। তার মনে হলে, “এক অদ্ভুত মায়ার রাজ্যের সিংহ দুয়ার যেন তার চোখের সামনে আজ খুলে গেল।” ঘরে খাবারের থেকে প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানা ফল ফুল বীজ জাতীয় খাবার অপুর কাছে অমৃত হয়ে উঠেছিল। বৈশাখ মাসের ঝড়ে যখন সবাই বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় করে, তখন অপু বেরিয়ে পড়ে, প্রকৃতি যেন তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আর নেচে নেচে সতুদের গাছের আম কুড়ায়। অপু, টুনি, বঙ্কু, নিলু, রানী, পুটি, অমলাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটাই। এরপরে অপুর জীবনে আসে এক চরম মোর সুখ দুঃখ সব সময়ের সঙ্গী তার দিদি দুর্গার অকাল মৃত্যু, তার জীবন বদলে দেয়।এরপরে ‘অক্রুর সংবাদ’ অংশে দেখা যায় অপু পরিবারের সঙ্গে কাশী যাত্রা করে। সেখানে গিয়েও তার জীবনে এক বন্ধু আছে সে হলো লীলা। অপুর মা যে বাড়িতে কাজ করত সেই বাড়ির মেয়ে। কাশীতে থাকাকালীন বাবার মৃত্যু, স্কুলে পড়াশোনা, মায়ের রান্নার কাজ নেওয়া,বড়লোক বাড়ীর লোকের হাতৈ অপুর মার খাওয়া, অপুর কবিতা ছাপানো প্রভূতি ঘটনার মধ্যে দিয়ে, নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে কিশোর অপুর জীবন যেন পরিণত অপুর জীবনের দিকে বাঁক নেয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আবার তার জন্মভূমি নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে ফিরে যাবে।
■ উপন্যাসে অপু চরিত্রের বৈশিষ্ট্য:
“পথের পাঁচালী” উপন্যাসের সর্ব প্রধান চরিত্র অপু বা অপূর্ব রায়। যদিও এই উপন্যাসের প্রধান অপুর পরিপূর্ণ ছবি পাওয়া যায় না, তার শৈশব নীলাই এখানে চিত্রিত, কিন্তু তার শৈশব জীবনের গতিপ্রকৃতির একটা ইতিহাস এখানে পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে অপুর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। অপু হরিহার নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হলেও, তার আসল পরিচয় সে নিঃসর্গ প্রকৃতির প্রতীক।
যদিও উপন্যাসে অপুর পরিপূর্ণ ছবি পাওয়া যায় না, তার শৈশব লীলাই এখানে চিত্রিত, কিন্তু তার শৈশব জীবনের গতি প্রকৃতির একটা ইতিহাস এখানে পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে অপুর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। সেই বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
(ক) শান্ত মুখচোরা: সমগ্র উপন্যাসে অপু শিশুর প্রাণ। তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য সে শান্ত ও ধীর প্রকৃতির। তার যেটুকু বাউন্ডুলে পনা দেখা গেছে শুধু তার দিদি দুর্গার সংস্পর্শে এসে। অপু শুধু শান্ত ধীরই নয়, উদাস খেয়ালী মন নিয়ে অপুর আবির্ভাব ঘটেনি, সে জন্ম-মৃত্যু শাসিত মর্তজীবনেরও বার্তাবহ, তাই সে কিছুটা মুখচোরাও হয়ে উঠেছে। মায়ের ওপর অভিমান, দিদির সঙ্গে ঝগড়া প্রভৃতির অপুর জারিজুরি থাকলেও, বাইরে সে কিন্তু বেজায় মুখচোরা বা লাজুক স্বভাবের। যখন ওড়কলমী ফুলের নোলক পরে মাকে দেখায় সে লজ্জায় নত হয়ে যায়। এমনকি যখন লক্ষণ মহাজনের ভাইয়ের বউ তার পরিচয় জানতে চাই তখন সে “সংকুচিত সুরে বলিল –ওই ওদের বাড়ি-“। এতটাই লাজুকতা তার মধ্যে ছিল।
(খ) কল্পনা প্রবণ: শিশু মন কল্পনাপ্রবণ ও কৌতুহলী পূর্ন হয়, তা অপুর চরিত্রের মধ্যেও বিদ্যমান। অপু কল্পনা প্রবণ,তাই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। নিশ্চিন্দিপুরের ঘনলতা গুল্ম সমন্বিত পটভূমিকায় রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীর অভিনয় কল্পনায় তার কবিত্ব শক্তি প্রথম উদ্বোধন হয়েছে। দূর দেশ অতীতকালে শৌর্যবীর্যের আখ্যায়িকা জন্মভূমির পরিচিত, শ্যামস্নিগ্ধ প্রতিবেশে যেনো নিতান্তই নিজের হয়ে উঠে তার বক্ষোরক্তে দোলা দিয়েছে। তার কল্পনা প্রবণতা আরো ধরা পড়ে “ছায়া ভরা বৈকালটিতে নির্জন বনের দিকে চাহিয়া তাহার অতি অদ্ভুত কথা সব মনে হয় ‘আজন্ম সাথী সুপরিচিত এই আনন্দভরা বহুরূপী বনটার সঙ্গে কত রহস্যময় স্বপ্ন দেশের বার্তা জড়ানো আছে।” তার কল্পনাও প্রবণ মন “সর্বদর্শন সংগ্রহ” পড়ে শকুনের ডিম মুখে পুড়ে আকাশ পথে উড়ে বেড়ানোর প্রচেষ্টায় তার কল্পনার মধ্যে একটু হাস্যকর ও আতিশয্যও সংক্রমিত হয়েছে। তার মায়ের মুখে মহাভারতের কাহিনী শুনে সে কল্পনার অতীত লোকে বিচরণ করেছে “কর্ণ যেন ওই অশ্বত্থ গাছটার ওপারে আকাশের তলে, অনেক দূরে কোথাও এখনো মাটি হইতে রথের চাকা দুই হাতে প্রাণ প্রাণে তুলিতেছে-।”
(গ) প্রকৃতিপ্রেমিক অপু: অপুর চরিত্রের প্রধান ও সর্বপ্রথম বৈশিষ্ট্য হলো সে প্রকৃতি প্রেমিক। অপু হরিহর রায় নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হলেও, তার আসল পরিচয় সে নিসর্গ প্রকৃতির প্রতীক। নিশ্চিন্দিপুরের গাছগাছালি ঘেরা ধুলো মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়ে যে শিশু উদার প্রকৃতিকে চোখ মেলে দেখেছে ও পেয়েছে তার জীবনের প্রকৃতির আকর্ষণ স্বাভাবিক। তাকে চিনতে গেলে প্রকৃতির ভিতর দিয়ে চিনতে হয়। প্রকৃতির কোলে যা কিছু দেখে তা দেখেই অবাক হয়ে যায় এবং বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে, তাই তার দিদি তাকে ‘হাঁদা’ বলে ডাকে। প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে, তাই সে প্রকৃতির টানে বারবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
(ঘ) পড়াকু অপু: প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে ওঠা অপুর মধ্যে পড়াশোনার প্রতি এক গভীর আগ্রহ তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে বাউন্ডুলে দিদির সঙ্গী হলেও ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি তার গভীর প্রেম। বাল্যকাল থেকেই পড়াশোনা বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল অনেক, সে তৃতীয় ভাগ পড়লেও কবিরাজি ওষুধের বই, পাতা ছেঁড়া দাসুরায়ের পাঁচালী, ১৩০৩ সালের পুরাতন পাঁজী বই গুলি-“সে নানা স্থান হইতে চাহিয়া এগুলি জোগাড় করিয়াছে এবং এগুলি না পড়িতে পারিলেও রোজ একবার করে খুলিয়া দেখে।” এরপর সে প্রসন্ন গুরু মশায়ের পাঠশালায় ভর্তি হয়। তারপরে চার-পাঁচ বছর পর কাশি থাকাকালীন পড়াশোনার প্রতি আকুলতা, সে তার বাবাকে বলে স্কুলে ভর্তি করানো জন্য- “সবাই পড়ে ইস্কুলে বাবা, আমিও পড়বো।—।” অপু প্রকৃতির মত পড়াশোনাকেও ভালবাসত তাই একখানা নিত্যকর্ম পদ্ধতি, পুরানো প্রাকৃতিক ভূগোল, শুভঙ্করী প্রভৃতি- “সে ঐসব বই পড়িয়াছে- অনেক বার পড়া হয়ে গেলেও আবার পড়ে।” শুধু তাই নয়, বই পড়তে পাবার লোভে দুপুরে রানুদের মাছ পাহারা দিতেও রাজি হয়ে যায়। সর্বজয়া থেকে সতু কেউ বুঝতে পারে না তার বদলে সে কি সম্পদ আহরণে ব্যস্ত!
(ঙ) লেখক অপু: উপন্যাসে অপুকে লেখক বা কবি হিসেবেও লক্ষ্য করা যায়। কবি যেমন পরিচিত দেশটা অমরাবতীর নিঃশেষ সৌন্দর্য নিয়ে আসে, অপু তেমনি আপন কল্পনাশক্তির সাহায্যে নিশ্চিন্দিপুরের পরিচিত বির্বন দেশটাকে কল্পলোকের জাল বিস্তার করে। তার ‘নিসর্গ দৃষ্টি প্রধানত কবির দৃষ্টি’ ‘তার কাব্য মাধুর্যের কাব্য’।সে গল্প লেখে, কর্ণের দুঃখে ব্যথিত হয়, পল্লী প্রকৃতি ও ইছামতির নির্জনতাই তার কবি মনকে রঙিন করে রাখে। সে লিখতে শুরু করে অক্রুর সংবাদে ২৪ নম্বর পরিচ্ছেদে, নাটক রচনার মাধ্যমে, তার এই প্রথম সাহিত্যে হাতে খড়ি পরে। যাত্রা দলের আবির্ভাবে তার কল্পনা প্রথম সাহিত্যিক অভিব্যক্তির দিকে ঝুঁকেছে- প্রকৃতির সহিত ক্রীড়াশীলতা সক্রিয় সৃজনতায় পরিবর্তিত হয়েছে। যাত্রা গানের প্রভাবে অপুর জীবনের সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম সোপান রচনা করেছে। তাই তার লেখা নাটকে গ্রামে দেখা যাত্রার পালার ছাপ স্পষ্ট – “গত বৈশাখ মাসে দেখা যাত্রা পালা হইতে এক নাম গুলি ছাড়া মূলত কোন অংশ পৃথক নহে, বা সেই হইতেই হুবহু লইয়া…।”এরপর অপুকে লিখতে দেখা যায় তাদের স্কুলে পত্রিকায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার বাবা বেঁচে থাকতে তার ছাপানো পত্রিকা দেখে যেতে পারেননি, যে তাকে লেখার প্রেরণা জাগিয়েছিল। অপুর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সবদিক বিবেচনা করে দেখা যায় , বিভূতিভূষণের চরিত্রের প্রভাব অপুর মধ্যে স্পষ্ট। অপুকে কেন্দ্র করেই বিভূতিভূষণ নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
উপন্যাসের অপু চরিত্রের এতসব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও পথের পাঁচালীতে অপুর কাহিনী সম্পূর্ণ নয় বা পরিপূর্ণ নয়। পূর্ণতর অপুকে পেতে গেলে বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের পাতা উল্টাতে হয়।
■ অপুর সাথে নানা চরিত্রের সমীকরণ:
একটি প্রধান নদী যেমন তার শাখা নদী নিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গতিবেগে বয়ে চলে। ঠিক তেমনই একটি উপন্যাসেও সেইভাবে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি অপ্রধান চরিত্রগুলি এসে উপন্যাসটিকে পরিপূর্ণ করে তোলে। শুধু পরিপূর্ণই নয় উপন্যাসটিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যায় এই অপ্রধান চরিত্রেরা। আমাদের আলোচ্য “পথের পাঁচালী” উপন্যাসেও প্রধান চরিত্র অপুর পাশাপাশি সমানতালে উপন্যাসটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে যে চরিত্রেরা, তারা হল- দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়া, লীলা এই চরিত্রগুলির সাথে অপুর এক সমীকরণ উপন্যাসে দেখা যায়, যা আমাদের আলোচ্য বিষয় –
● অপু-দূর্গা: “পথের পাঁচালী” উপন্যাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র হলো দূর্গা। উপন্যাসে তার পরিচয় হরিহর ও সর্বজয়ার কন্যা হলেও, সে যেই পরিচয় অসাধারণ হয়ে উঠেছে তা হলো অপুর দিদি। উপন্যাসে তার পথ চলা অল্প হলেও, মৃত্যু তার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারেনি, বারবার সে ফিরে এসেছে অপুর স্মৃতিতে। উপন্যাসের অনাটকীয় পরিবেশে দূর্গাই নাটকীয় পরিবেশের অবসর সৃষ্টি করেছে। অপু উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও দুর্গা এই উপন্যাসের অলংকার।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় –
“অপু এই উপন্যাসের প্রধান প্রাণ – কিন্তু দুর্গাই উপন্যাসের লাবণ্য। নিশ্চিন্দিপুরের জল মাটি দিয়ে তৈরি এই দুর্গা প্রতিমায় পথের পাঁচালী অধিষ্ঠাত্রী দেবী।”
দুর্গার হাত ধরেই অপু মিশেছিল প্রকৃতির জগতে, দুর্গার সাহায্য করেছিল অপুকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে। দুর্গা দুরন্ত ও দামাল হলেও তার মধ্যে বিরাজ করে মর্তপ্রীতি, জীবন বাসনা ও নরমমন। সে গাছ থেকে পেড়ে আনা আমটা, কুলটা কোনদিনও তার ভাইকে না দিয়ে খেত না। এমনকি ছোট ভাই অপুর রেল গাড়ির কথা শুনে তারও রেলগাড়ি দেখার স্বাদ হয়েছিল। দিদি দুর্গায় হয়ে উঠেছিল সব থেকে প্রিয় খেলার সাথী। কিন্তু হঠাৎ করে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনকে বদলে দেয়, সে হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, অসহায়। উপন্যাসে দুর্গার মৃত্যু যেন স্বাভাবিক নয় –
“দুর্গার প্রতি লেখকের অপরিসীম মমত্ববোধ ছিল বলেই তিনি তাকে ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ করতে চাননি, উপন্যাসে তার প্রয়োজন শেষ হতেই তাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সাহিত্যের চিরন্তন ধর্ম স্বর্ণ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”
( বিভূতিভূষণ : মন ও শিল্প – গোপিকানাথ রায়চৌধুরী)
● অপু- হরিহর:উপন্যাসে হরিহরের মধ্যে যেন এক সর্বজনীন পিতৃহৃদয় ধরা পড়েছে। পিতার মধ্যে নিজের সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা সমস্ত মানবিক ভিত্তিগুলো হরিহরের মধ্যে বর্তমান। হরিহর বাউন্ডুলে কিন্তু সংসার ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনাসক্ত নয়। তার যাযাবর ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে সংসার থেকে পলায়ন নয়, দরিদ্রগ্রস্ত সংসারটাকে সুঅবস্থায় ফেরানোর জন্যই। হরিহরের মধ্যে সংসার অভিঙ্গতার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে একটা শিল্পী মন। তার কথকবৃত্তি, গ্রন্থ সংগ্রহের প্রবণতা তারই ইঙ্গিত বহন করে। হরিহরের মধ্যে শিল্পীর যে মার্জিতবোধ ও দার্শনিক সুলভ উদাসীনতা তাই অপুর চরিত্রে বহু বিচিত্রায় ধরা পড়েছে।
● অপু – সর্বজয়া: সর্বজয়ার মধ্যে ভারতীয় নারীর সনাতন ধর্ম রক্ষিত হয়েছে। একদিকে যেমন সে হয়ে উঠেছে হরিহরের সংসারের আদর্শ গৃহিনী আর অন্যদিকে সে অপু ও দুর্গার স্নেহশীল জননী। সর্বজয়া অশিক্ষিত ,সংকীর্ণ হৃদয়া, মুখরা, স্বার্থপরনারী। তার এই স্বভাব গড়ে উঠেছে দরিদ্র সংসারের আবর্তে। অপু শিক্ষা লাভ করে বড় হবে তা সে চায়না, সে চায় গ্রামে থেকে পুরোহিতগিরি করে অপুর তার জীবন কাটায়। প্রকৃতপক্ষে দোষে গুণে জড়ানো স্নেহ মমতায় পরিপূর্ণ এক ঘরোয়া মা সর্বজয়া। অপুর উপরেই তার ভালবাসা গাড়ত্ব বেশি, তা বলে সে দুর্গাকে ভালোবাসত না তা নয়। যখন দূর্গাকে ভুবন মুখুয্যের স্ত্রী অভিশাপ দিচ্ছিল তখন সর্বজয়ার “ছেলেমেয়ের বর্ষনসিক্ত কচিমুখ মনে করিয়া সে ভাবিল যদি গালাগাল ওদের লাগে!…..কথাটা ভাবতেই তাহার গা শিহরিয়া উঠিয়া সর্বশরীর যেন অবশ হইয়া গেল।” দুর্গার মৃত্যুর পর, দুর্গা স্মৃতি বহন করে নিশ্চিন্দি পুরে থাকা সর্বজয়ার কাছে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় কাশীযাত্রা করবে।এখানেই মা সর্বজয়ার পরিচয়।
● অপু ও লীলা: “অক্রুর সংবাদ” অংশে কাশীযাত্রার পর অপুর জীবনে আর একজন সঙ্গীর আবির্ভাব ঘটে – সে হল লীলা। অপুর মা সর্বজয়া যে বড় বাড়িতে কাজ করত সেই বাড়ির মেজো রানীর মেয়ে লীলা। দুর্গার মৃত্যুর পর অপুর জীবনে যে নিঃসঙ্গতা, শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যতা নিঃসঙ্গতা পূরণ করেছিল লীলা। কাশিতে যাবার পরে অপুর একমাত্র সুহৃদ হয়ে উঠেছিল লীলা। এই লীলা অপুর শুধুমাত্র কৈশোর জীবনকে প্রভাবিত করেনি, অপুর যৌবনেও সে প্রভাব ফেলেছিল।
■ অপুর চরিত্রে বিভূতিভূষণের প্রভাব:
বিভূতিভূষণের উপন্যাসের পটভূমি পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল ও শহরজুড়ে বিস্তৃত। “পথের পাঁচালী”র নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন –
“পথের পাঁচালীর চিত্রগুলি সবই আমার স্বগ্রাম ব্যারাকপুর। জেলা যশোহর। গ্রামের নিচেই ইছামতি নদী।”
বিভূতিভূষণ নিশ্চিন্দিপুর গ্রামকে যেমন নিজের গ্রামের পটভূমিতে অঙ্কিত করেছেন, তেমনি অপুর চরিত্রকেও যেন নিজের ভাবানুবতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন। বলাই যায়, বিভূতিভূষণের মন নিগড়ে যেন অপুর জন্ম, তাই তার চরিত্রে এত জৌলুষ, এত বৈভব, এত অলংকার। উপন্যাসে ঔপন্যাসিক যেন অপুর দৃষ্টিতে প্রকৃতির রূপ,রস, সৌন্দর্য দৃশায়িত করে তৃপ্ত হয়েছেন। প্রকৃতিই এই উপন্যাসের আসল বিষয়। প্রকৃতিকেই কেন্দ্র করে অপু বেড়ে উঠেছে, সে যেমন জীবনকে ভালোবেসেছে তেমনি, প্রকৃতিকেও ভালোবেসেছে। উপন্যাসের অপুর প্রকৃতি প্রেম আসলে বিভূতিভূষণেরই প্রকৃতি প্রেম।
তাই অরুন কুমার মুখোপাধ্যায়ের কথায় –
“বিভূতিভূষণ আর অপু দুই নয় এক। তাই ‘স্মৃতির রেখা’ আর ‘পথের পাঁচালী’ একই মনের দুই প্রকাশ।”
এছাড়াও অপু বিখ্যাত ইংরেজ কবি ওয়াটসওয়ার্থের ‘prelude’ এর ‘there was a boy’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়াও অপুর মা সর্বজয়া সম্পর্কে ঔপন্যাসিক তৃনাঙ্কুর গ্রন্থে বলেছেন – “সর্বজয়ার একটা অস্পষ্ট ভিত্তি আছে – আমার মা।”
বিভূতিভূষণের ছোট বোন ‘মনিকে’ তিনি ‘দুর্গা’ বলেই ডাকতেন, উপন্যাসের মতোই বোনটি অল্প বয়সে মারা যায়। জানা যায়, অপুর মত বিভূতিভূষনও প্রসন্ন গুরু-মশাইয়ের পাঠশালায় পড়তে যেতেন। হরিহরের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দের মধ্যেও দেখা যায়। মহানন্দের বিধবা ভগিনী মেনকা দেবী ভ্রাতার সংসারে জড়িয়ে পড়েন, ইনিই উপন্যাসের ইন্দ্রির ঠাকুরন। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের অপুর জীবনে কৈশোরের কাহিনি ফুটে উঠেছে, আর ‘অপরাজিতা’ উপন্যাস অপুর যৌবন জীবন ফুটে উঠেছে।
‘অপরাজিত’ , ‘পথের পাঁচালী’র পরবর্তী অংশ শেষ করার পর বিভূতিভূষণ লিখেছেন –
“অপুকে জন্ম থেকে ৩৪ বৎসর পর্যন্ত আমি কলমের ডগাই সৃষ্টি করেচি। তাকে ছাড়তে সত্যি কারের বেদনা অনুভব করচি – তবে সে অনেকখানি আমার নিজের সঙ্গে সেই জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে বিদায় দিতে…।”
বিভূতিভূষণের একাধিক সাহিত্যে যে টুকরো টুকরো অনুভূতির চিহ্ন মিলবে, অপু তাদেরই নির্যাস। লেখক এর মানসরাজ্যের সত্যকারেরই প্রতিভূ। কেবল লেখক কেন সকল সংবেদনশীল মনেরই একটা আদি – কল্প হয়ে ওঠে অপু, তাঁর নব্বই বর্ষ অতিক্রমের পরিক্রমাই। বাংলা সাহিত্যের অপু কেবল বাঙালি মনের সাহিত্যগত মূর্তি নয়, অনুভূতির অনবদ্য সৃজন, কল্পলোকের মানসপ্রতিমা – এখানেই অপু চরিত্রের সর্বতম সিদ্ধি লাভ।