হুতোম প্যাঁচার নকশার – সমাজ চিত্র

কলমে – পূজা দাস, এম. এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


“পাঠদ্দশায় আর একখানি পুস্তক আমাকে আলোড়িত করিয়াছিল। আনন্দ‌ও পাইয়া ছিলাম। সেখানি কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’।” ( ‌অক্ষয়চন্দ্র সরকার)

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্য সাহিত্যের ঐতিহ্যপুষ্ট রেনেসাঁসের অন্যতম দৃপ্তিমান নক্ষত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ। মাত্র তিরিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিধির মধ্যে বাঙালি জাতি ও বাংলা সাহিত্যের জন্য যিনি রেখে গেছেন অতুলনীয় স্বার স্বতার্ঘ্য।  কালীপ্রসন্ন সিংহের কৃতিত্ব অনুবাদ মূলক রচনায় নয়, মৌলিক গদ্য রচনা। এই সামাজিক রচনায় আছে হাস্যরস ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপে ভরা। কালীপ্রসন্ন ছিলেন বাংলাদেশের এক অদ্ভুত মানুষ, তার থেকেও অদ্ভুততর ছিল তাঁর সাহিত্য প্রতিভা। ধনী বংশে ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ধনী সমাজের কদাচারকে তীব্র শানিত ভাষায় ব্যঙ্গ করেছেন। উচ্চশৃঙ্খল আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও সর্বদা একটি মার্জিত পরিশীলিত ভদ্র মনের অধিকারী ছিলেন। কালীপ্রসন্নের হৃদয়বৃত্তি ও সুষম সমন্বয় ঘটেছিল রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের আদর্শ উদ্ভাসিত হয়ে। ‘মূল মহাভারতের অনুবাদ’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’ ও ‘বিদ্যোসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’, সামাজিক ভন্ডামির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রভৃতি তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের আলোক উজ্জ্বল কীর্তিস্তম্ভ। আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ তাঁর রচিত অদ্বিতীয় সমাজ চিত্রশালা, যেখানে তিনি ঊনবিংশ শতকের সমাজচিত্র কে তুলে ধরেছেন।

‘হুতোম প‍্যাঁচার নকশার পরিচয়:
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ হল কালীপ্রসন্ন সিংহের রচিত ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরো বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা, অথবা বলা যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন কালীন পর্যায়ের একটি গদ্য উপাখ্যান।
প্রথমে জেনে রাখা দরকার আসলে এই ‘নকশা’টি কি?- ‘প্রহসন’ কথাটির সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত, এই সূত্রে আরেকটি শব্দ এসে যায় সেটি হল ‘নকশা’। নকশা বলতে সাধারনত বোঝায় এমন রচনা, যার বিষয় হবে বিদ্রুপাত্মক এবং কোন অংশের সমালোচনা মূলক। নকশা হল হাস্যরসের পরিপূর্ণ এক ব্যঙ্গাত্মক রচনা যার মাধ্যমে সামাজিক অনাচার, ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্রুপ করা হত এবং সামাজিক দোষ দূর করতে শিক্ষাদান করা হতো। নকশা প্রধানত আকৃতিতে হয় নীতি দীর্ঘ, ভাষা হয় লঘু এবং ইঙ্গিতপূর্ন।
আপনার মুখ আপনি দেখ’ গ্রন্থটির উত্তর হিসেবে কালীপ্রসন্নসিংহ(১৮৪০-১৮৭০) রচনা করেছিলেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’টি। এইরকম তীব্র অশিষ্ট ভাষায় আক্রমণকারী কখনো স্বনামে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, কালীপ্রসন্ন সিংহ‌ও তাই করেননি – তিনি ‘হুতোম প্যাঁচা’ ছদ্মনামে তৎকালীন কলকাতাকে ব্যঙ্গের চাবুক মেরেছেন।  নকশাটি উৎসর্গ করা হয়েছিল মুলক চাঁদ শর্মাকে । ১৮৬১ সালে ‘চড়ক’ শিরোনাম একটি নকশা প্রকাশিত হয়। পরে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ নামে দুটি খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায় – প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬২সালে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড একত্র প্রকাশিত হয় 1965 সালে।  তৎকালীন সময়ে কলকাতা ধনী মধ্যবিত্ত ও সাধারণ সমাজ কি পরিমানে হুজুগ প্রিয় ছিল,  হুল্লোড়ের  ধুলোট উৎসবে কতটা মাখামাখি করতো, উৎসব অনুষ্ঠানে জঘন্য ব্যাপার কত অবলীলাক্রমে অনুষ্ঠিত হত, শিক্ষিত যুবক, ঘোর ব্রাহ্মণ, নাসিকা- ধ্বনীকারী বৈষ্ণব বাবাজি, অলিন্দাবিহারিনী স্থূলাঙ্গিনী বারবধু, চড়ক,গাজন, দুর্গোৎসব, মাহেশের রথ, চাকরে বাবু, মোসাহেব পরিবৃত্ত মানুষের স্তূপ অর্থাৎ জমিদার, পথের ভিখারী, কেরানি, দোকানি, হাঁটুরে, পুরুত ঠাকুর, নবীন নাগর ইত্যাদি কলকাতার সঙযাত্রার নানাবিধ রংদার ব্যাপার ছদ্মনামি হুতোম আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন।

‘হুতোম প‍্যাঁচার নকশা’র বিষয়বস্তু: 
কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতকের কলকাতার উৎশৃঙ্খল জীবনযাত্রা। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার হঠাৎ করে ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্যের শিখরে নব্যসমাজ এবং তারা প্রায় সব ধরনের মানুষের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রণীত নতুন শাসন ব্যবস্থায় নব্য শিক্ষিত ও চাকুরে বাবু সম্প্রদায়কে লেখক বিশেষভাবে কটাক্ষ করেছেন,  তবে বাদ যায়নি অন্যরাও। নকশায় নবগঠিত উচ্চ শ্রেণীকে লেখক তিনটি ভাগে আমাদের সামনে পরিচিত করেছেন। প্রথম ভাগে, ‘সাহেবি ওল্ড’ অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষিত, সাহেবি চালচলনে অন্ধ অনুকরণকারী। এরা সবাই ইংরেজি জানে, এদের চাল চলন বেশভূষা পুরো ইংরেজদের মতো।  ইংরেজদের এরা অন্ধভাবে অনুকরণ করতে ভালোবাসা।  দ্বিতীয় ভাগে, ‘ইংরেজি শিক্ষিত নব্যপন্থী’ এরা ইংরেজদের স্কুলে ইংরেজি পরে ইংরেজি শিখেছি, কিন্তু এখনো ধুতি চাদর ছাড়তে পারেনি।  কারণ এরা ইংরেজি শিখেছে প্রধানত পেটের দায়ে, ফলত ইংরেজ সরকারের কেরানী ও ডেপুটি গিরি করে এদের এদের জীবন চলে।  তৃতীয় ভাগে, ইংরেজি না জানা ‘গোঁড়া হিন্দু’।  মূলত সকালে উঠে এরা স্নানাহ্নিক সেরে তবেই ঘর থেকে বৈর হন। যেহেতু এরা গোঁড়া তাই কঠোর ভাবে জাত পাত মেনে চলেন। এরা সকলেই কম বেশি জাল-জুয়াচুরি-ফন্দি- ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। ইংরেজ সরকার প্রতি এদের কোন ক্ষোভ নেই, যদি না সরকার এদের কোন আইন বা ধর্মের বিপক্ষে যায়। এই নকশাই ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও ছিল তার মাত্রা অতিক্রম করেননি। গ্রন্থে এমন সব চরিত্র আছে যা ভাষায় নিন্দা করার মত নয় কালীপ্রসন্ন তাদেরকে উপস্থিত করেছেন। হুতুম পেঁচার নকশা যেহেতু নকশা জাতীয় গদ্য রচনা তাই রচনাটি দুটি ভাগে ঘটনাকে ছোট ছোট নকশা আকারে তিনি তুলে ধরেছেন পাঠকদের সম্মুখে। প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে যেসব নকশা গুলি রয়েছে সেগুলি হল প্রথম ভাগ – 1. কলিকাতার চড়ক-পাব্বর্ণ, 2. কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা, 3. হুজুক-ক. ছেলে ধরা, খ. প্রতাপচাঁদ, গ. মহাপুরুষ, ঘ.লালা রাজাদের বাড়ির দাঙ্গা, ঙ. কৃশ্চানি হুজুক, চ.মিউটিনি,ছ. মরাফেরা, জ. আমাদের জাতী ও নিন্দুকেরা, ঝ. নানা সাহেব, ঞ. সাতপেয়ে গোরু, ট.দরিয়াই ঘোড়া, ঠ. লক্ষ্নৌয়ের বাদশা, ড. শিব কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঢ. ছুচোর ছেলে বুঁচো,ণ. জস্টিস ওয়েলস্, ত. টেকচাঁদের পিসি, থ. পাদ্রি লং ও নীলদর্পণ, দ. রামপ্রসাদ রায়, ধ. রসরাজ ও যেমন কর্ম তেমন ফল; বুজরুকি-  ক. হোসেন খাঁ, খ.ভূত নাবানো, গ. নাক কাটা বঙ্গ, ঘ.বাবু পদ্মলোচন দত্ত ও হঠাৎ অবতার, ঙ. মাহেশের স্নান যাত্রা। দ্বিতীয় ভাগ – 1. রথ, 2. দুর্গোৎসব, 3. রামলীলা, 4. রেলওয়ে।

‘হুতোম প‍্যাঁচার নকশায়’ তৎকালীন সমাজ চিত্র :
  কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ উনিশ শতকের কলকাতার এক অনন্য সমাজচিত্র।

“হুতোম প্যাঁচাও এই পরিবর্তনের সময় একটি মহার্ঘ্য রত্ন।  ইহাতে তৎকালীন সমাজের অতি সুন্দর চিত্র আছে,  হুতোম-হুতোমীর ভাষার প্রবর্তক এবং বহু সংখ্যক হুতোমী পুস্তকে আদি পুরুষ। বোধহয়, মৌলিকতায় তৎকালীন সমস্ত পুস্তকের শিরস্থানীয়।” (মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী)

শুধু চিত্র বললে ঠিক হয় না- বইটি আসলে চিত্রশালা”। (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)

চড়কের পার্বনের রঙ্গ, বারোয়ারি নামে সমকালীন সমাজের দুর্নীতি, মরা ফেলা, ছেলেধরা, মিউটিনি, সাতপেয়ে গোরু আর দরিয়ায় ঘোড়ার হুজুগের ব্যঙ্গ প্রসঙ্গ, বিচিত্র বুজরুকির নমুনা, মাহেশের স্নানযাত্রার বর্ণনা, রামলীলার হট্ট উৎসব ও নব প্রবর্তিত রেলওয়ে অতি বাস্তব চিত্র।  হুতুমের নকশা থেকে এরা কেউই বাদ পড়েনি।

হুতোম তাঁর ভূমিকায় বলেছেন যে, “আমি কারেও লক্ষ্য করিনাই অথচ সকলেরই লক্ষ্য করিচি, এমনকি স্বয়ং নকশার মধ্যেও থাকতে ভুলি নাই।”

এখন দেখে নেওয়া যাক, তৎকালীন সমাজ ও ব্যক্তি চরিত্রের কোন কোন চিত্র তুলে ধরেছেন –

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:তৎকালীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন; নীল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ বা ওয়াজিদ আলী শাহের আগমন বিষয়কে আরও সরেস করে তুলেছেন। তৎকালীন সময়ে কালীপ্রসন্ন যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন, তার এক পথ স্বচ্ছ দর্পণ হল ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’।

বাবু কালচার:  ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন হলে, এই সময় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ‌একশ্রেনীর মানুষ হঠাৎ আর্থিক দিক থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠে। অর্থের অহংকারে তারা এক প্রচন্ড রকমের বিলাসের যাত্রা শুরু করে,গড়ে ওঠে বাবু কালচার‌। নকশায়’ সমস্ত স্তরের মানুষদেরই ছবি আছে বটে, তবে কালীপ্রসন্ন মুখাত আঘাত করেছেন হঠাৎ বাবুদের। সে যুগে নানারকম জাল- জচ্চুরি এবং ফন্দি ফিকিরের আশ্রয় নিয়ে যারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠেছিলেন, শহরের গ্লানি- মন্থনের কাজে তারাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বীর কৃষ্ণ দাঁ ও পদ্মলোচন দত্ত তার স্বার্থক উদাহরণ। অর্থের বাষ্পে ফেঁপে ওঠা বেলুনের মতোই এই সমাজ শত্রুর দলকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের কষাঘাতে তিনি জর্জরিত করেছেন। তার হাতে ‘হঠাৎ অবতার’ পদ্মালোচনের বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে “হঠাৎ টাকা হলে মেজাজ যে রকম গরম হয়, একদম গাঁজাতেও হয় না।”  শুধু আক্রমণের তির্যকতাই নয়, দেশ ও মানুষের প্রতি অশ্রু রেখায় নকশাটির ধ্রুবপদ। – তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ-  ‘রেলওয়ে’। তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা কিভাবে পদে পদে বঞ্চিত হত, জমাদার ও চাপরাশিদের  বেত কি নির্মমভাবে বর্ষিত হত, এবং কিভাবে তারা গাড়িতে স্থান লাভ করে, রেল কর্মচারীদের অত্যাচার অবিচারের চেহারা কালীপ্রসনের বিরল – সৌষ্ঠব বর্ণন – নৈপুণ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
অপর এক দৃষ্টান্তে দেখা যায় ‘কলিকাতার চড়ক পাব্বনে’ সন্ধ্যা বেলায় বেড়াতে যাবার সাজসজ্জায় -“ফিটন প্রস্তুত, পোশাক পরা, রুমালে বোকো মেখে বেরুচ্ছিলেন।” কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর গ্রন্থে এই বিলাসী মানুষজনদের সামাজিক অবক্ষয়ের একটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং এ বিষয়ে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।

ধনী সমাজের কপটতা: কালীপ্রসন্ন ছিলেন এক ধনী পরিবারের সন্তান, তাই তিনি ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করেছে। তাঁর নকশাই ধনী সমাজের হীনতা, কপটতা ও ভণ্ডামির ছবি ফুটে উঠেছে। কিভাবে শোষিত‌ শ্রেণীর ওপর শাসক শ্রেণী শাসন করতো, তাদের ঠকাত, তাদের অত্যাচার করত সবই এই নকশার মধ্যে ফুটে উঠেছে। কালীপ্রসন্ন ব্যাঙ্গের চাবুক মেরেছেন যে –
“চোরেরা যেমন চুরি করতে গেলে মদ ঠোঁটে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এঁরা সেইরূপ স্বার্থ সাধনার্থ স্বদেশের ভালো চেষ্টা করেন।– পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙে আপনার গোঁপে তেল দেওয়া ছিল এদের পলিসি।” অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণের ভাষা ছিল তীক্ষ্ণ ও ঝাঁঝালো। কালীপ্রসন্ন সিংহ যেমন তাঁর নকশায় বড়োলোক বাবুদের ব্যাঙ্গ করতে ছাড়েননি, তেমনি তাঁর নকশায় ফুটে উঠেছে সমাজের একটা বাস্তব চিত্রায়ন।

সামাজিক সংস্কার:  হুতুম পেঁচার নকশায়  ঊনিশ শতকের বাংলা সমাজের সতীদাহ প্রথারোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ,  বহুবিবাহ প্রভূতির বিষয়ে নানান ঘটনা প্রতিফলন পাওয়া যায়। বিধবা বিবাহের মতো সৎ কাজকে, তৎকালীন সমাজে কিছু লোক অসৎ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছেন “ও ওল্ড ফুল মরে যাক না কেন ওকে আমরা চাইনি; এবারে এমন বাবা এনে দেবো যে, তুমি, বাবা ও আমি একত্র তিনজনে বসে হেলথ ডিংক করবো—।”  সেই সময় এইসব প্রথার বিরুদ্ধে প্রচলনের ও স্বপক্ষের বিরুদ্ধ যে আন্দোলন হয়েছিল সে সম্পর্ক নকশাই রচিত হয়েছিল সে সম্পর্কেও নকশায় রচিত হয়েছে। সমাজ সংস্কারের প্রসঙ্গে তিনি রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেও ভুলেননি। নকশায় যে সব মনীষীদের বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।

লোকসংস্কৃতি:  মূলত নকশাগুলি লোকায়িত কাঠামোর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। হুতোম প্যাঁচার নকশাই লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদান সম্পর্কে জানতে পাওয়া যায়, সেগুলি – ঝাপ,চড়ক পাবন, নীলরাত্রি, মাহেশের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, দুর্গোৎসব, রামলীলা প্রভৃতি। তৎকালীন লোকসংস্কৃতিতে তিনি যে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তার পরিচয় পাওয়া যায়, ঝাপের কাঁটার ব্যবহার বর্ণনায়, এর উপকার- “এজন্মে বিছানায় ছারপোকা হবে না।” আরো বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির কথা জানা যায়- পাঁচালী, যাত্রাগান, পিঠে পার্ব্বন, ষষ্ঠীর বাটা ইত্যাদি। এই সময় বাবুসমাজের সমাদৃত ছিল বাইনাচ, খেমটানাচ, কবি ও কীর্তন।যাকে কালীপ্রসন্ন ব্যঙ্গের ভাষায় বলেছেন “কুকুরের বিয়ের মজলিস।” এছাড়া  তিনি পাঁচালী, টপ্পা,আখরায়,হাফ আখড়াই প্রভূতি উপকরণকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।

● শিক্ষা ও সাহিত্য: উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নকশায় অনেক ভিন্নধর্মী চিত্র পাওয়া যায়।  এই নকশাগুলি থেকে একদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং অন্যদিকে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার নানান কথা জানা যায়। এই সময়ের বাংলা গ্রন্থের মধ্যে যে গুলি বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য ছিল – চাণ্যকের শ্লোক, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ও সীতার বনবাস, টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরে দুলাল প্রভূতি।
কালীপ্রসন্ন সিংহ একদিকে ইংরেজি জানা নব্য বাবু ও অন্যদিকে গোঁড়া হিন্দু সমাজ উভয়ের জীবনের স্ববিরোধীতাকে তুলে ধরেছিলেন । কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা প্রগতিশীলতা অপেক্ষা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে অধিকমাত্রায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন । তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তৎকালীন সমাজকে বিশ্লেষণ করেন এবং বাবু সংস্কৃতির তীব্র সমালোচনা করে তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন করতে তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।

কালীপ্রসন্ন সিংহের ভাবনা  ও হুতোম প‍্যাঁচার নকশা –

“যাঁদের  অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,  তাদের ভেতরে সর্বপ্রথমে মনে পড়ে কালীপ্রসন্ন সিংহের কথা।” – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

ঊনবিংশ  শতকের পূর্ণ প্রগতিশীলতার প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তাঁর রচিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’  তাঁকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তে যে শুধু সমাজ চিত্র আছে তা নয়, এমনকি এতে  সংস্কারব্রতীর উপদেশ‌ও নেই,  ‘রসসৃষ্টি’ হিসাবে ‘নকশার’ একটা অসামান্য মর্যাদাও রয়েছে। শুধু আক্রমণের  তীক্ষ্ণতায় নয়, পত্রেপত্রে   প্রসঙ্গেপ্রসঙ্গে কালীপ্রসন্নের অশ্রুসিক্ত দীর্ঘশ্বাস ধরা পড়েছে। তিনি যতখানি আঘাত করেছেন, আহত হয়েছেন তার চাইতেও বেশি।   কালীপ্রসন্ন যেমন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছিলেন, তেমনি তৎকালীন সাহিত্যকেও মর্যাদা দিয়েছেন। দীনবন্ধুকে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের জন্য গ্রেফতার করা হলে তিনি সেই প্রসঙ্গে নকশার ভূমিকা অংশে ব্যক্ত করেছেন- “নীলদর্পণের হ্যাঙ্গাম দেখে শুনে – ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধরতে আর সাহস হয় না, সুতরাং বুড়ো বয়সে সঙ সেজে রং কত্তে হলো —“। হুতুমপেঁচার বইখানি প্রকাশের পর লেখক সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে –
“—- সে সময় লেখক একবার স্বপ্নেও প্রত্যাশা করেন নাই যে, এখানি বাঙালি সমাজে সমাদৃত হবে ও দেশের প্রায়  সমস্ত লোকে পড়বেন।”
হুতুম কলকাতার আকাশে শ’খানেক বছর আগে যে নকশা উড়িয়েছিলেন, সেগুলি  এখনও আধুনিক ভব্যসভ্য কলকাতার আকাশে মহানন্দে উড্ডীয়মান।

“নকশা বা টুকরো টুকরো ঘটনা আর সঙ্গে ঝালমসলা মেশানো হুতোমী মন্তব্য, কলকেতাই চলতি বুলিতে খুলেছে ভালো।” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

হুতোমের উদ্দেশ্য ছিল সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন, সেই জন্য কলকাতার বদ সহবত শোধরাতে গেলে এই ধরনের ঝাঁঝালো ভাষা চাই। তাই তিনি হুতোম পেঁচার নকশাই অবিকল শহুরে চলতি কথার ব্যবহার করেছেন। কোন কোন সময়ে অবিকল বাস্তবতার ঝোঁকে তিনি অশ্লীল ইতর শব্দ ব্যবহারেও লজ্জিত হননি। নকশাটির বারোআনা সাফল্য লাভ করেছে হুতোমি ভাষার উপরে।

এই প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন  –
“কোনো কোনো সময়ে আমরা যেন ফাজিল ছোকরা হুতোমের বাঁকানো ঠোঁট কুঞ্চিত চোখের তির্যক দৃষ্টিও ঐ ভাষার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি।”

সবদিক বিশ্লেষণ করে দেখা করে যায়, অনেক বই লিখলেও ‘হুতোম প্যাঁচার নকশার’ জন্য তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যে চিরস্মরনীয় হয়ে  থাকবেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ মৃত্যুহীন কৃতিত্ব বয়ে নিয়ে বেড়াবে।