নাট্যকার মধুসূদন দত্ত

কলমে – শ্রেয়সী মিশ্র , বাংলা (এম.এ), মেদিনীপুর কলেজ


     মধুসূদন ছিলেন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। নাটকের সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকবি মধুসূদনের প্রথম আবির্ভাব। মধুসূদনের আবির্ভাবে বাংলা নাটক সংস্কৃত নাটকের প্রভাব থেকে দূরে সরে গেল। মধুসূদনের আবির্ভাবের পূর্বে তখন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ও ইংরেজি নাটকের অনুবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চ ও গড়ে উঠেছিল। রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ও করে দিয়েছিলেন মধুসূদন। অন্যদিকে বেলগাছিয়া নাট্যশালা স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই কারনে যে, এই রঙ্গালয়কে কেন্দ্র করে নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব। বাংলা নাট্য সাহিত্যের অবদান কতখানি তা আর বলার অবকাশ রাখে না।

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্ৰন্থে এই বিষয়ে লিখেছেন, “এই নাট্যালয় বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনিয়া দিবার পক্ষে উপায়স্বরূপ হইল। ইহা অমর কবি মধুসূদনের সহিত আমাদের পরিচয় করাইয়া দিল”।

মধুসূদনের থেকেই বাংলা নাটকের বিকাশ পর্ব শুরু হয়। একদিকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার দাবি, অন্যদিকে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র এই দুয়ের সংঘাতে বাংলা নাটকের বিকাশ পর্ব শুরু।

জন্ম ও বংশ পরিচয়  :-
      ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির  যশোর জেলার, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্ৰামের  এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন ১৩ বছর বয়স, সেই সময় থেকে তাকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে বর্তমান কার্ল মার্কস সরণী অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজি যুবতীকে বিবাহ করেন। পুরোপুরি ইউরোপীয় না হলেও শ্বেতাঙ্গিনী খ্রিস্ট রমণী হিসেবে তাঁর পরিচয় ছিল। উভয়ের দাম্পত্য জীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই কন্যা ও দুই পুত্রের জন্ম হয়। কন্যা – বার্থা ও ফিজি নামে এবং  জর্জ জন ম্যাকটা ডাট ও মাইকেল জেমস নামে দুই পুত্র। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার কিছু কাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসী তরুণীর প্রেমে পড়ে যান এবং তাঁকে স্ত্রী রুপে গ্ৰহন করেন। মাইকেলের দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটার ও চারটি সন্তান জন্মগ্ৰহন করেছিলেন। চার সন্তানের মধ্যে দুজন জন্মেছিলেন কলকাতায় আর বাকি দুজন জন্মেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে। ভার্সাই এ একটি কন্যাসন্তান জন্মের পরই মারা যায়। বাকি সন্তানরা হলেন- এলইজা শর্মিষ্ঠা দত্ত, মেঘনাদ মিলটন দত্ত, আলবার্ট নেপোলিয়ন দত্ত।

শিক্ষা ও কর্মজীবন :- 
      মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাঁকে রামায়ন, মহাভারত,পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্ৰামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তাঁর প্রাথমিকশিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা,ফরাসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়ি তেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ার পর তিনি তদানীন্তন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ  ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্য প্রীতির সঞ্চারন করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতি ও তাঁকে বেশ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় , রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক,প্যারীচরন সরকার প্রমুখ উনবিংশ শতাব্দীর বিশেষ ব্যক্তিবর্গ।
১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মিশন রোতে অবস্থিত ‘ওল্ড মিশন চার্চ’ নামেএক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্ৰহন করেন। তাকে দিক্ষীত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি।তিনিই তার ‘মাইকেল’ নামকরন করেন ‌। ধর্মগ্ৰহনের পর মধুসূদন বিশপস কলেজ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্ৰিক, লাতিন,সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শেখেন। অধ্যয়ন শেষ করে কলকাতায় চাকরির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মাদ্রাজে চলে যান।
          মধুসূদন মাদ্রাজে ও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন না। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান।এই সময় তিনি ইংরেজি পত্র পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকা ও সম্পাদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালেই অর্থাভাবে বন্ধ করে দিতে হয় পত্রিকাটি। ধীরে ধীরে কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

মধুসূদন দত্তের সাহিত্য জীবন :- 
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘রত্নাবলী ‘ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাটকের সাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষেই তিনি নাটক রচনায় আগ্ৰহী হয়ে ওঠেন। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর রচিত ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক টি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া নাট্যশালায় শর্মিষ্ঠা নাটক টি মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম যথার্থ মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে রচনা করেন দুটি প্রহসন – ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদ বধ কাব্য'(১৮৬১)নামে মহাকাব্য। ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য'(১৮৬১),  ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’,(১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য'(১৮৬২), ‘চতুর্দশপদী কবিতা'(১৮৬৬)।
         

তাঁর রচিত নাটক গুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় –
১) পৌরাণিক নাটক -‘ শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০)
২) ঐতিহাসিক নাটক – ‘কৃষ্ণকুমারী'(১৮৬১)
৩) রূপক নাটক – ‘মায়াকানন'(১৮৭৩)
৪)  প্রহসন – ‘একেই কি বলে সভ্যতা'(১৮৬০), ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'(১৮৬০)।

বাংলাসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান :-
বাংলা নাট্য জগতের  উদ্ভাসিত নভোমন্ডলে বিশিষ্ট নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের নানান বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায় –
১) মাইকেল নাটকের সর্বপ্রধান গুন ও বৈশিষ্ট্য হল তিনি নাটকের কাহিনী কে আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত দৃঢ়সূত্রে আবদ্ধ করেছেন।
২) মধুসূদন প্রথম পাশ্চাত্য কলাঙ্গিক কে নাটকে অনুসরন করেছেন। তবে তিনি যেমন সংস্কৃত নাটকের প্রভাব স্বীকার করেছেন তেমনি পাশ্চাত্য প্রভাব ও অনুসরন করেছেন।
৩) মধুসূদন দুঃখ করে লিখেছিলেন,
” অলীক কুনাট্যরঙ্গে / মজে লোকে রাঢ় বঙ্গে / নিরখিয়া প্রানে নাহি সয়”।
রায় বঙ্গের অধিবাসীদের কুনাট্য প্রীতি দূর করে তিনি তাদের যথার্থ নাটকের স্বাদ দিতে পেরেছেন বলেই নাট্যসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
৫) মধুসূদনের নাটক গুলি বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনীত হওয়ায় সেগুলোর অভিনয় মূল্য ও যথেষ্ট।
৬) বাংলা নাটকে প্রথম তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন।
৭) তার নাটকের সংলাপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একঘেয়ে ও বৈচিত্র্যহীন হলেও প্রহসনে যে সংলাপ তিনি ব্যবহার করেছেন তার নাট্যপজোগীতা অসাধারণ।
৮) মধুসূদন তাঁর নাটকে গ্ৰীক নাটকের ঐক্যবিধি অনুসরন করেছেন। এজন্য তাঁর নাটক দৃঢ়সংবদ্ধ ও গতিশীল।

সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন –
“নাট্যসাহিত্যে ও তাঁহার দান উপেক্ষনীয় নয়, তিনি ই আধুনিক বাংলা নাটকের জনক এবং পরে নাট্যসাহিত্য খুব বেশি দূর অগ্ৰসর হয় নাই। শুধু সাহিত্যিক মআনদন্ড দিয়ে বিচার করিলে বলা যাইতে পারে যে ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এখন ও বাংলা নাটকের ইতিহাসে উচ্চস্থান পাইবে”।

পুরস্কার ও সম্মান :-
     মাইকেল মধুসূদন দত্ত মৃত্যুর পর ১৫ বছর ধরে মূলত উপেক্ষিত ছিলেন। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনে সাগরদাঁড়িতে মেলা অনুষ্ঠিত হয় মধুসূদন দত্তের স্মৃতি চারনার উদ্দেশে।তাঁর আয়োজন করে যশোর জেলা পরিষদ। প্রতি বছর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিভিন্ন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মধুসূদন দত্তের সম্মাননায় যশোর জেলায় তাঁর নামে একটি স্কুল ও কলেজের নামকরণ করা হয়েছে।
        ত্রিপুরায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজের নাম তাঁর নামে। এছাড়াও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে মাইকেল মধুসূদন মেমোরিয়াল কলেজ।

       মধুসূদনের প্রতিভা মূলত কবির হলেও নাট্যকার হিসেবে ও তাঁর খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। তিনি বিভিন্ন উপাদান থেকে তাঁর নাটকের নাট্যচরিত্রগুলি গ্ৰহণ করলে ও চরিত্র গুলির মধ্যে মৌলিকতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তিনি বাংলা নাটকের একটি পথরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন যা পরবর্তী বহু নাট্যকার অনুসরন করেছেন। বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত।