সুর্বনরেখা নদীর আত্মকথা

– সোমা রানা (এম.এ বাংলা, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়)


ভূমিকা :
     বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ৷ এদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদনদী। আমি শ্যামল বাংলার মায়াবী আঁচলে বয়ে চলা তেমনি এক নদী৷ প্রকৃতি আমার মা৷ নাম আমার সুর্বনরেখা৷ বুকে আমার টলটল করছে কাঁচের মত স্বচ্ছ জল৷ পরনে আমার নীল ঘাগড়া৷
” যুবকরা নাকি জলটুঙ্গি পাহাড় হয়,
যুবতীরা সুবর্নরেখা,” (পুর্নেন্দু পত্রী)

■. আত্মকথা বলার কারন :
      এতকাল তোমরা গঙ্গা, যমুনা, ভাগীরথি আরো কত খ্যাতনামা নদীর মনের কথা শুনেছো, জেনেছোI আমার কথা শুধু ভূগোল বইতে পড়েছো। আমার আত্মকথা কেউ লিখে না, আমাকে নিয়ে তো কেউ চর্চাই করে না৷ আমিও কুলুকুল শব্দ করে গান করি। আমার মনের কথা কই।
এই কথা বুঝতে গেলে কান নয়, চাই মন৷ সে ক্ষমতা কারোর নেই৷ তাই আজ আমি নিজের কথাই নিজে বলব৷ বলব আমার আত্মকথা৷
আমি সুর্বনরেখা। নিশ্চয়ই আমার এই নামটি শোনা মাত্রই তোমাদের ঋত্বীক ঘটকের ‘সুবর্নরেখা’ সিনেমার কথা মনে পড়ল৷ আমি তা নই৷ আমি সুর্বনরেখা নদী৷

জন্ম পরিচয় :
    জন্ম আমার ঝাড়খন্ডের রাঁচির এক ছোট্টো গ্রাম পিসকা থেকে৷ অনেকে এই গ্রামকে নাগরি গ্রাম বলে চেনেন৷ গ্রামটি রাঁচি থেকে ১৬ কিমি দূরে ছোটনাগপুর মালভূমিতে অবস্থিত৷ আর সেখানেই আছে হুড্রু জলপ্রপাত এবং সেখান থেকেই আমার উৎপত্তি৷

সুবর্ণরেখার দৈর্ঘ্য ও বিস্তার :
    আমি নদী৷ ফলে স্বভাব আমার বয়ে চলা৷ গতিশীলতাই আমার প্রধান ধর্ম। ঝাড়খন্ড,বাংলা, ওড়িশা এই তিন রাজ্যের ওপর আমার লম্বা দেহ এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে৷ এক মায়াবী যৌবনা নারীর মতো।
আমার দৈর্ঘ্য উচ্চতা আমি কোনো দিন মাপ-জোঁক করে দেখিনি তবে তোমাদের হাতের মুঠোফোনে গুগল, ইউকিপিড়িয়া না- কিসব আছে সেখানে বলে আমি নাকি ৩৯৫ কিমি লম্বা৷ আর অববাহিকার আয়তনে ১৮, ৯৫১ বর্গ কিমি।

সুবর্ণরেখা নদীর যাত্রাপথে :
      আমি নদী৷ ফলে স্বভাব দোষে আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য সাগরের সাথে মিলিত হওয়া। সাগরকে খুঁজে খুঁজে জন্মের পর থেকেই সেই নাগরি গ্রাম থেকেই আমার পথচলা৷ তারপর ঝাড়খন্ডের রাঁচি, পশ্চিম সিংভূম, পূর্ব সিংভূম, সরাইকেলা খারসওয়ান জেলা ইত্যাদি নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌছালাম। এর মধ্যেই বাম দিক থেকে আমি ডুলুং, জুমার আর ডানদিক থেকে খরকাই , করকরি, কাঞ্চি রারু, শঙ্খ ইত্যাদি বন্ধু-বান্ধবীসম উপনদীগুলিকে সঙ্গী করে নিয়েছি৷ তারপর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, চান্ডিল, ঘাটশিলা, ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ভসরাঘাট, সোনাকোনিয়া, হয়ে প্রবেশ করলাম ওড়িশার বালেশ্বরে৷ বালেশ্বরে মধ্য দিযে প্রবাহিত হয়ে পৌঁছালাম তালসারির কাছে, সেখানে দেখা পেলাম বঙ্গোপসাগরের৷ এটাই আমার মিলন ক্ষেত্র অর্থাৎ মোহনা৷                                               

■. সুবর্ণরেখা নদীর নাম মাহাত্ম্য :
     আমাকে অনেকেই অনেক নামে ডাকেন যেমন সাবরনেকা, শবরনেকা৷ ময়ূরভঞ্জে আমার নাম শবররখা৷ (শবররখা- সুবন্নখা – সুবর্নরেখা)৷ শবরী ভাষায় ‘নেকা ‘ হল নদীবাচক।
‘সুবর্নরেখা’- আমার এই নামটির মধ্যে অনেক রহস্য জড়িয়ে আছে৷ ‘সুর্বনরেখা’- কথার অর্থ হল ‘সোনার রেখা’৷ আমার বালুচরে পাওয়া যায় স্বর্ণরেনু৷ বিশ্বাস হচ্ছে না তো ? গোপীবল্লভপুর, ভসরাঘাট, সাঁকরাইল ইত্যাদি নানা জায়গা কিংবা আমার নদী তীরবর্তী যেকোনো জায়গায় এলে দেখতে পাবেন সেখানকার মানুষরা কিভাবে বালি ছেঁকে তার থেকে সোনা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত৷ তবে সোনার পরিমাণ খুবই সামান্য৷ এভাবেই আমার গায়ে লুকিয়ে থাকা স্বর্ণরেণু দিয়ে আমি স্থানীয় লোকেদের জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করি৷ সন্তানের মতো তাদের মুখে আহার তুলে দেই৷

আমার অবদান :
    আমার দেহের ভেতর বাসা বাঁধে কত প্রানী, মাছ, ব্যাঙ। সবাইকে আমি আপন ভেবে আশ্রয় দিয়েছি৷ আমার জলকে কাজে লাগিয়ে সোনালি ফসলের বন্যা বয়ে যায় এ অঞ্চলে৷ দেখে আমার খুব ভালো লাগে৷
তবে চাষবাস ছাড়াও জেলেরা মাছ ধরে, স্থানীয় বাসিন্দারা সোনা ছেঁকে জীবিকা নির্বাহ করে৷ আমার বয়ে চলার পথে আমাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কত শহর-নগর, গ্রামীন আদিবাসী জনপদ। তার মধ্যে চান্ডীল, জামশেদপুর, ঘাটশিলা, গোপীবল্লভপুর উল্লেখযোগ্য৷
ভাবলে গর্ব লাগে আমাকে আঁকাড়ে ধরেই গড়ে উঠেছে নানা পর্যটক কেন্দ্র কেমন গেতুলসুদ ড্যাম , হুড্রু ফলস, চান্ডিল ড্যাম , কুঠিঘাট, হাতিবাড়ি ইত্যাদি আরো নানা মন মাতানো পর্যট্ক কেন্দ্র৷ যা সারা বছর প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে৷
শুধু তাই নয় সীমান্ত ঘেঁষা ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের আমি আপন করে নিয়েছি। দু-হাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছি৷ সেচের জল, পানীয় জল, বিদ্যুৎ উৎপন্ন, জামশেদপুর-ঘাটশিলার কারখানার জল সবাইকে দিয়েছি আয়নার মতো স্বচ্ছ জল৷
কত অকৃত্রিম বহুবিচিত্র সংস্কৃতি, লোকউৎসব, মেলার কেন্দ্রবিন্দু আমি৷ সুবর্নরৈখিক জনজীবনের মিশ্রসংস্কৃতি, মিশ্রভাষাকে ( সুবর্ণরৈখিক ভাষা) আমি একসূত্রে বেঁধে রেখেছি৷ তিন রাজ্যের আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসার যোগসূত্র আমি।

সুবর্নরেখার পৌরাণিক মাহাত্ম্য :
    কথিত আছে সুর্বনরেখা নদীর সাথে নাকি মহাভারতের যোগ আছে৷ লোকবিশ্বাস অনুযায়ী পান্ডবরা বারো বছরের বনবাস কাটিয়ে অজ্ঞাতবাসের জন্য এসেছিলেন ‘সোনারেখা’ বা সুবর্ন রেখা নদীর তীরে৷
ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার গভীর অরন্যে৷ অজ্ঞাতবাসের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির দিন যুধিষ্ঠির বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷ কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন উত্তর বাহিনী গঙ্গা৷ তিনি তখন সুবর্নরেখার অববাহিকা অঞ্চলে বাস করেন৷ সাহায্যে এগিয়ে এলেন অর্জুন৷ তিনি তখন মাটিতে তির ছুড়লেন মাটি থেকে বেরিয়ে এলেন মন্দাকিনীর ধারা এসে মিলিত হল সুবর্নরেখা৷ সুবর্নরেখা হয়ে গেল উত্তরবাহিনী গঙ্গা৷ যুধিষ্ঠির নদীর তীরে বালির চরে বসে ছাতু দিয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন। স্থানীয় বিশ্বাসে আজও এই অঞ্চলে সুবর্ণরেখা নদীর উভয় তীরে পান্ডবদের পিতৃশ্রাদ্ধের স্মরনে চৈত্রসংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হয় বালিযাত্রা মেলা৷ এটি আদিবাসী – অআদিবাসী সকল মানুষের মিলন মেলা৷

■. উপসংহার :
আমি সুবর্ণরেখা, এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে কেবল নদী নই তাদের ‘সোনার জীবনরেখা’। ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি পরম্পরায় মানুষের হৃদয়ের সাথে এক সুতোয় বাঁধা৷ সমান্তরালে বয়ে চলেছে আমাদের এই মধুর সম্পর্ক।আগে দুঃখ ছিল একটাই অন্যান্য নদীগুলোকে নিয়ে যেমন ‘ইছামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম ‘ , ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘তিস্তা বৃত্তান্ত’ আখ্যান উপন্যাস রচিত হত। আমাকে নিয়ে তেমন হত না। আমার এই দুঃখ বুঝতে পারলেন সন্তোষ রানা ,নলিনী বেরা-র মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি৷ লিখলেন আমার সীমান্ত ঘেঁষা জনপদকে নিয়ে৷ নকশাল বিপ্লবী সন্তোষ রানা আমার জনপদ ঘেঁষা স্মৃতিকথার নাম দিলেন ‘রাজনীতির এক জীবন ‘। আর নলিনী বেরা তাঁর আখ্যানের নাম দিলেন ‘সুবর্ণরেখার সুবর্ণরেনু’ এই দুটি স্মৃতিকথা ও উপন্যাস তাঁদেরকে ২০১৮ ও ২০১৯ উপহার দিল আনন্দ পুরস্কার৷ দিল আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা৷
তবুও বর্তমান দিনে আমাকে নিয়ে গবেষণা ও চর্চা খুব কমই হচ্ছে। হলে আমি সন্ধান দিতাম সেই স্বর্ণ খনির যেখান থেকে আমি বয়ে আনি স্বর্ণ রেনু।