বাংলার লোকসংস্কৃতি
– সোমা রানা (এম.এ বাংলা, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়)

■. ভূমিকা :
‘লোক’ কথাটির অর্থ হল ‘জন ‘ অর্থাৎ সাধারন মানুষজন৷ যারা শিষ্ট বা মার্জিত জনগোষ্ঠি থেকে একটু পিছিয়ে পড়া এবং গ্রামীণ জনজীবন সম্পৃক্ত এদের দ্বারা সৃষ্ট সংস্কৃতিকে ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে৷
‘লোকসংস্কৃতি’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Folklore’ কেউ কেউ আবার ‘Folk Culture’ ও বলে থাকেন৷ ১৮৪৮ সালে উইলিয়াম থমস ‘দি অ্যাথেনিয়াম ‘ পত্রিকায় প্রথম ‘Folklore’ শব্দটি ব্যবহার করেন৷

লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য :-
    লোকসংস্কৃতি ও তার বিভিন্ন ধারাগুলি বিষয়ে আমাদের প্রথমে জেনে নিতে হবে লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্টগুলি কী ?
ক.  লোকসংস্কৃতি আদিম ও শিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যবর্তী স্তর যা লোকয়ত৷
খ. গ্রাম্য সহজ-সরল অনাড়ম্বর সংস্কৃতিই লোকসংস্কৃতি৷ তবে, লোকসংস্কৃতি ঐতিহ‍্যনির্ভর।
গ. সংহত সমাজজীবনের সমষ্টিগত আবেগ-অনুভূতি – ভালোবাসা বিকশিত হয়ে লোকসংস্কৃতি সৃষ্টি হয়৷ অর্থাৎ একের সৃষ্টি দশজনের হাত বেয়ে দশজনের সম্পত্তিতে পরিনত হয়৷ সমষ্টিগত সৃষ্টি লোকসংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য৷
ঘ. লোকসংস্কৃতি একটি লোকগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বৈচিত্রকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে।
লোকসংস্কৃতি সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি৷ কেবলমাত্র আমোদ – প্রমোদ – বিনোদনের জন্য এটি সৃষ্টি হয় না৷
ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টকে কিছুটা লাঘব করার জন্য এটি অনুষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়।
ঙ. লোকসংস্কৃতি যেহেতু অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রামীণ কৃষিজীবি মানুষের সৃষ্টি৷ তাই শিক্ষিত শহুরে জনজীবনের পরিশীলতার ছাপ এখানে থাকে না৷
চ. লোকসংস্কৃতির স্রষ্টার নির্দিষ্ট কোনো নাম টাওয়া যায় না।
ছ. লোকসংস্কৃতি বিবর্তনধর্মী এবং অবশ‍্য‌ই মৌখিক।

লোকসংস্কৃতির সীমানা / বিভাগ :
লোকসংস্কৃতি মূলত দুটি ধারার চর্চা করা হয়। –
ক. বস্তুগত লোকসংস্কৃতি
খ. অবস্তুগত লোকসংস্কৃতি
(ক) ভাগের লোকসংস্কৃতি হল – বিশেষ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি যে সকল বস্তুকে সৃষ্টি করে তাকেই ‘বস্তুনির্ভর বা বস্তুগত লোকসংস্কৃতি বলে। এককথায় যেখান লেখ্য বিষয়ের কোনো সংযোগ নেই৷ যেমন-জীবিকার উপকরন, বাসগৃহ, খাদ্য-পানীয়, তৈজসপত্র, পোশাক – পরিচ্ছদ, বাদ্যযন্ত্র, প্রসাধিন ইত্যাদি।
(খ) অন্য পক্ষে ‘অবস্তুগত লোকসংস্কৃতি’র ক্ষেত্রে বলা যায় এটি মুখে মুখে প্রচারিত হয়। এছাড়া লোকসাহিত্য এর অন্তর্গত। যেমন- ছড়া, প্রবাদ, লোককথা, লোকসংগীত, ব্রতকথা, গীতিকা, লোকনৃত্য, লোকউৎসব, চিত্রশিল্প প্রভৃতি এর অন্তর্গত।

লোকসংস্কৃতির উপাদান :
একটি নির্দিষ্ট স্থানের মানুষজনের বছরের পর বছর চলে আসা বিশ্বাস, সংস্কার আচার অনুষ্ঠান প্রথা পদ্ধতি নিয়েই গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি, আর এগুলোকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি সাহিত‍্য, সংগীত ইত‍্যাদি হয়ে ওঠে লোকসংস্কৃতির উপাদান, যাকে ঘিরে বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ‍্যমে যুগপরম্পরায় বেঁচে থাকে এই লোকসংস্কৃতি। বাংলার লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলি হল –
১. লোকসাহিত্য :
      লোকমুখে কিংবা বংশ পরম্পরায় যে সব সাহিত্য মুখে মুখে প্রচার লাভ করে এবং যেখানে লোক সমাজের লোকায়িত মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না প্রভৃতি মিশে থাকে তাকে লোকসাহিত্য বলে৷
এই লোকসাহিত্যই হল লোকসংস্কৃতির মূল উপাদান।
যেমন: – মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, মৈমনসিংহ গীতিকা, নাথ গীতিকা, বিভিন্ন রূপকথা ইত্যাদি৷

২. বাংলার লোকসংগীত :
    বাংলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে লোকসংগীত।
লোকসমাজের মানুষজনের ব্যবহারিক কাজকর্ম ধর্মীয় আচার, বিনোদন প্রভৃতির ক্ষেত্রে আপনমনের মাধুরী লোকসমাজের নানা বিষয় আশয়ের সাথে মিশিয়ে লৌকিক সুরাপিত যে সুর পরিবেশিত হয় তাকে লোকসংগীত বলে৷
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসংগীতকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন :-
ক. আঞ্চলিক সংগীত
খ. ব্যবহারিক সংগীত
গ. আনুষ্ঠানিক সংগীত
ঘ. প্রেম সংগীত
ঙ. কর্ম সংগীত
      আঞ্চলিক সংগীতগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, টুসু, পটুয়ার গান, বাউল,ভাদুগান ইত্যাদি৷
এছাড়া কর্ম সংগীত গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- চাষের গান, ধামাল, ঝাপান, নৌকা বাইচের গান বেশ প্রচলিত। এই লোকসংগীত গুলি লোকবাদ্য সহযোগে লৌকিক ঢঙে গাওয়া হয়৷ যেমন- একতারা, বাঁশি, ঢোল, ধামসা- মাদল এই সংগীতের প্রধান উপকরন। বর্তমানে এই একবিংশ শতকের নবীন গায়ক ও শ্রোতারা এই Folk Music এর প্রতি বেশিই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন।

৩. বাংলার লোকনৃত্য :
গ্রাম বাংলা অনেক লোকনৃত্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে তাদের নিজ নিজ বৈচিত্রের গুনে৷ যেমন :- পুরুলিয়ার ছৌ নাচ, পাতা নাচ, গম্ভীরা নাচ, সাঁওতালী নাচ, ঝুমুর নাচ প্রভৃতি বেশ উল্লেখযোগ্য৷
সাধারণত বিবাহ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ফসল উৎপাদন কে কেন্দ্র করে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় ৷

৪. বাংলার লোকউৎসব :
লোক সমাজের মানুষজন তাদের ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রনাকে কিছুটা কমানোর জন্য কিংবা ধর্মীয় পূজা – অর্চনার জন্য লোক উৎসবে মেতে ওঠেন৷
যেমন : শিবের গাজন, করমপূজা, ভাদুপূজা, বাঁধনা পরব, মকরপরব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য৷ লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই লোক উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

৫. বাংলার লোকনাটক :-
লোকনাটক বলতে আমরা বুঝি কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান, পূজা, ধর্মীয় আচার কিংবা অবসর বিনোদনের জন্য কাহিনি, সংলাপ চরিত্রের সম্মনয়ে সরল অভিনয়ের স্বতস্ফূর্ত: প্রকাশ রূপ৷
লোকনাটকে লোকসাধারণ লোকজ পোশাক পরে অভিনয় করেন সাধারণ স্থানে এতে কোনো বাঁধাধরা মঞ্চ থাকে না। বাংলার লোকনাটকের সমৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে – বোলান, গাম্ভীরা, আলকাপ, ঘাটু, ভাসান, পালাকীর্তন প্রভৃতি৷

৬. বাংলার শিল্প :
বাংলার লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধি করেছে৷
যেমন বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প, পটচিত্র, আলপনা, গয়নাবড়ি, পটুয়া শিল্প, কালীঘাটের পট , টেরাকোটার কাজ, শাঁখের কাজ প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির অঙ্গ৷

ছড়া –
লোকসংস্কৃতির অন্যতম এক প্রধান উপাদান হচ্ছে ছড়া। এটি প্রধানত শিশু মনোরঞ্জনের জন্য রচিত হয়৷ শিশু মনোরঞ্জনের জন্য রচিত হলেও এতে মিশে থাকে লোকায়িত জীবনের লোকসংস্কৃতি৷

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: –
“প্রত্যেক ছড়ায় প্রত্যেক তুচ্ছ কথা বাংলাদেশের একটি মূর্তি গ্রামের একটি সংগীত গৃহের একটি আস্বাদ পাওয়া যায়৷ “

ছড়ার সংজ্ঞা হিসেবে বলা চলে – সাধারণত কল্পনাপ্রবণ মানসিকতা লঘু বিষয় দ্যোতক ছন্দময় লোকসাহিত্যের দলগত অভিব্যক্তি কে ছড়া বলে৷ এই ছড়াকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় –
১. আনুষ্ঠানিক ছড়া
২. শিক্ষামূলক ছড়া
৩.শিশু কেন্দ্রিক ছড়া
আয় ঘুম, আয় ঘুম, বাগদিপাড়া দিয়ে৷ বাগদিদের ছেলে ঘুমালো, জাল মুড়ি দিয়ে৷
বাগদীদের ছেলে কিভাবে যেখানে সেখানে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ি। এই ছবি পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন৷ তাই ছড়ায় কেবল শিশু মনোরঞ্জনের জন্য রচিত হলেও এর মধ্যে সমাজের নানা দিক নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে৷ ছড়ার সহজ সরল কাব্যরস পাঠককে আকৃষ্ট করে৷ তাই ছড়া লোকসংস্কৃতির উপাদান হিসেবে অনন্য৷

৮. ব্রত পালন :
বাড়ির নারীরা স্বামী ও গৃহের মঙ্গল কামনা ,ধনসম্পত্তি প্রাপ্তি ইতাদি নানা কারনে অনেক গুলি ব্রত পালন করেন৷ যা লোকসংস্কৃতির উপাদান হিসাবে গোনা হয় ৷
যেমন – সেঁজুতি ব্রত, লক্ষ্মীব্রত, মাঘমন্ডল ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রত, শিবরাত্রী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷

উপসংহার :-
লোকসংস্কৃতি অল্পশিক্ষিত জনগনের সৃষ্টি বলে একে অবহেলিত চোখে দেখা উচিত নয়। সব সংস্কৃতিকেই সম্মান করা উচিত৷ কেননা লোকসংস্কৃতি ধ্বংস হলে একটি জাতি ও সমাজ অবলুপ্তি হতে পারে।
সভ্যতা যত এগিয়ে যাক না কেন সংস্কার আরো তীব্রতর হচ্ছে। ফলে মানুষের মনে লোকাচার এসে বাসা বাঁধছে৷ কুসংস্কার নয়, বেঁচে থাকুক লোকসংস্কৃতি৷ বেঁচে থাককু প্রতিটি মানব জাতির নিজ অস্তিত্ব, নিজ পরিচয়৷

তথ্যসূত্র :- ১. ইন্টারনেট
            ২. ‘লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য পরিচয় ‘-
                                  – ড. নীলোৎপল জানা৷