শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) উপন্যাসের গঠন কৌশল
কলমে – পূজা দাস স্নাতকোত্তর (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিশ শতকের গোড়ার দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী জীবন যাপনের রূপকার ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবি যখন মধ্য গগনে তখন চন্দ্রের উদয় আর সেই চন্দ্রই হলো শরৎচন্দ্র। রবির প্রখর কিরণের তাপে ঝলসে গেল না শরৎচন্দ্রের স্বকীয়তা,বরং স্নিগ্ধ আলোক নিয়েই রবির পাশে উদিত হলেন তিনি। শরৎচন্দ্র ছিলেন মরমিদের জন্য দরদি মনের জনপ্রিয় বাঙালি কথা সাহিত্যিক। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানা সংকট ও সীমাবদ্ধ বাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরেছেন অসাধারণ দক্ষতায়, কুশলতায় লেখনির মাধ্যমে। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নরনারীরা বঞ্চিত বঞ্চিত জীবনের নিরুদ্ধ কামনা,আত্মকুণ্ঠার বেদনা ও ব্যক্তি সমাজের সংঘাতের যে রূপ সুধীজনীন সীমার মধ্যেই গণ্ডিবদ্ধ ছিল, শরৎচন্দ্র তাকে দরদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বহুজনীন রূপে পরিব্যাপ্ত করেছিলেন।
“ইদানিং দেখছি বড় বড় কথা সাহিত্যিক অল্প কিছুদিন সাহিত্য গগনে, আতশ বাজীর রোশনায় সৃষ্টি করে নিভে যান। কিন্তু শরৎচন্দ্র দীর্ঘদিন কথা সাহিত্যে সাধনা করেছেন, দীর্ঘতরদিন জনপ্রিয়তা রক্ষা করেছেন এবং সম্প্রতি বাংলা কথা সাহিত্যের অভূতপূর্ব রূপান্তর হলেও সাধারণ পাঠক সমাজে এখনো তিনি একচ্ছত্র সম্রাট।” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল কারণ তিনি উপন্যাসের উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের নিতান্তই পাঁচাপাঁচি সাধারণ নর-নারীর মলিন ও তুচ্ছ জীবনকে। তাতে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মতো কল্পচারী প্রেম ও রোমান্সের বিপুল ঐশ্বর্য নেই। এমনকি মানুষের দুঃখ বেদনাকে এমন ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন যে পাঠক পড়তে পড়তে সেই চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে তোলো। বলা যায়, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের গঠন কৌশল বা প্রণালী তার উপন্যাসকে বর্তমান ব্যস্ত জীবনেও পাঠক মহলে বিশেষ স্থানের অধিকার করে রেখেছে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিম্নে ‘শ্রীকান্ত (1মপর্ব) উপন্যাসের গঠন প্রণালী বা কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
■ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের বিশিষ্টতা:
শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা সর্ববাদি স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রতিভার উজ্জ্বলতা তাঁর প্রতিভাকে ম্লান করতে পারেনি। স্বকীয় গৌরবে ভাস্কর হয়ে তাঁর রচনার রবীন্দ্রযুগেও অনন্য সাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।এই কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যতা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল:
●আবেগ প্রবণতা: শরৎচন্দ্র আবেগপ্রবণত শিল্পী। শিল্পীদের মধ্যে অতিরিক্ত আবেগ প্রবণতা বহুলাংশে দেখা গেলে, তা শিল্প কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই শিল্পীর আবেগকে সংহত ও সংযত করে শিল্পকর্মে সৃষ্টি করতে হয়। কিন্তু শরৎচন্দ্র এই সিদ্ধান্তকে সর্বাগ্রে গ্রহণ করতে চাননি। শরৎচন্দ্র জীবনকে দেখেছেন ভাবাবেগের অতিশয্যের মধ্যে দিয়ে, তাই চরিত্রমূলের আবেগাতিরেক তার প্রায় সব রচনারই বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।এমনটি উপন্যাসের ভাষারীতি ও বাচনভঙ্গিতেও তার আবেগ উচ্ছ্বাসের প্রবণত লক্ষ্য করা।
● পরিবারকেন্দ্রিকতা: ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি পারিবারিক জীবনের রূপকার। তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস এবং বড় গল্পগুলিতে(বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, মেজদিদি ইত্যাদি) গ্রাম বাংলা মফস্বলের পারিবারিক জীবন কাহিনী ও সমস্যাই প্রাধান্য হওয়ায় সেখানে এক অভিনব পরিবার রসের আবেদন সৃষ্টিতে তিনি সার্থক হয়েছেন। শরৎচন্দ্রের যেসব উপন্যাস সমস্যার মধ্যে সমাজ জিজ্ঞাসার প্রাধান্য দেখা যায়, সেখানেও পরিবার জীবনের চিত্র ফুটে ওঠে এবং সমগ্র উপন্যাস বা রচনা জুড়ে পরিবার রসের একটা জাল বিস্তার করে। সমকালের সংসারী বাঙালি নরনারী, শিশু-কিশোরের জীবন ও বাংলার পল্লী-সমাজ তাঁর গল্প বা উপন্যাস গুলির মধ্যে সার্থকভাবে ধরা পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসটি একটি সামাজিক উপন্যাস হলেও, এখানে পারিবারিক- রসের প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।
● সামাজিকতা সংস্কার ও নীতিবোধ: শরৎচন্দ্রের প্রতিটি উপন্যাসই কোন না কোন সামাজিক সমস্যায় জড়িত। বাংলাদেশের গ্রাম সমাজের নানা কদাচার, সমাজ-প্রধানদের অন্যায়, স্বার্থপরতা, জমিদারদের অত্যাচার, শোষন ও মানুষের হীনমন্যতাগুলিকে তিনি তাঁর উপন্যাসের প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি নরনারী বিবাহকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এই বিবাহের মধ্যে কামনা- বাসনা চরিতার্থতা না থাকলেও, মনের দিক থেকে তিনি এই বিবাহকে গুরুতর মূল্য দিয়েছেন। উদাহরণে দৃষ্টান্ত – রাজলক্ষ্মীর মত নারীর জীবনে বাইজি বৃত্তির মধ্যে বঙ্কুর মাতৃত্বের সংস্কার কাজ করেছে। মৃণালের বিবাহেই তার বাসনা ও কামনার সমাপ্তি ঘটেছে, অথচ এই অসম মিলনকেও শরৎচন্দ্র এমন ভাবে বর্ননা করেছেন, যেখানে জীবন সংগ্রামে ভগ্নতরীর ঐ পথেই আশ্রয় খুজেছেন। বৈধব্যের সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারেনি রমা কিংবা সাবিত্রী, মুক্তির কথা ভাবতেও পারেনি বড় দিদি। অন্যদিকে তিনি বিবাহিত নারীর অন্তরে অন্তপুরুষের প্রতি আকর্ষণের সুতীব্র চিত্র এঁকেছেন। বিধবা নারীর প্রেমের কাহিনীতে তাঁর শিল্পী চিত্তের বিশেষ প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে – রাজলক্ষী,অচলা, সাবিত্রী, কিরনময়ীর মধ্যে দিয়ে। এদের মধ্যে কেউ বন্দরে ভেড়ানো নৌকা, ঢেউয়ের আঘাতে দীর্ণ; আবার কেউ মাছ দরিয়ায় আতঙ্কে -উল্লাসে আর তো হয়ে উঠেছে, তীরের বন্ধন হারিয়েছে। শরৎচন্দ্র আবদ্ধতা প্রাচীনকাল থেকে গড়ে ওঠা পাকা বন্দরের মোহে, কিন্তু তার নিরাপত্তা আর মূল্যে সংশয়ী। ঔপন্যাসিকের বিংশ শতকের আধুনিকতার চিহ্ন ফুটে উঠেছে এই সংশয় আর যন্ত্রনাতেই।
● নারীকেন্দ্রিকতা: শরৎ-সাহিত্যে প্রধানত নারী মনের প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই নারীর প্রাধান্য, পুরুষ সেখানে গৌণভাবে অবস্থান করে- এদের স্বভাব হয় উদাসীন,নিষ্ক্রিয় ও ভাবুক প্রকৃতির। অপরদিকে নারীর বিচিত্ররূপ তিনি তার সমগ্র উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। নারী তাঁর উপন্যাসে হয়ে উঠেছে সহনশীলাা(অন্নদা দিদি), সেবা পরায়ণ (সাবিত্রী), স্বৈরিনী(কিরণময়ী), আবার অন্যদিকে প্রেমিকা (রাজলক্ষ্মী), এমনকি প্রতিবাদ মুখরা (অভয়া, কমলা) প্রভৃতি নারীরা নানা স্বভাব প্রকৃতিতে পরিপূর্ণা।কিন্তু এই নারীরাই সমাজে আবার অবহেলিত, লাঞ্ছিত। সামাজিক আঘাতে এবং সংস্কারের নিষেধ এই দ্বৈত টানা পোড়েনে নারী-মনস্তত্ত্ব শরৎ উপন্যাসে অদ্বিতীয় ভাষারূপ পেয়েছে।
● পল্লীগ্রামের চিত্র: বাংলার পলিগ্রামের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, কারণ তিনি তাঁর জীবনের অনেকটা সময়ই এই পল্লী বা গ্রামীণ সমাজের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। পল্লী গ্রামের পটভূমি তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। পল্লীর মানুষকে তিনি তাঁর উপন্যাসে দুটি রূপে তুলে ধরেছেন, তাদের একদল পরশ্রীকাতর, কুটবুদ্ধি ও সংকীর্ণমনা এবং স্বার্থসর্বস্ব আর একদল সরল হৃদয়, উদার চরিত্র , সূক্ষ্ম নাগরবৈদগ্ধ-বর্জিত, প্রসন্ন হাস্যে উজ্জ্বল।
● কথনরীতি: পাঠক মনকে আদ্যস্ত আবিষ্ট করে রাখার মতো কথন শক্তি ছিল এই কথা শিল্পীর করায়ত্ত। কাহিনী পরিবেশনের যোগ্য, কথা শিল্পের কলা কৌশল, কথনবয়নের নিপুণতা, চরিত্র সৃষ্টির নৈপুণ্য, মনোজগতের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ শরৎ সাহিত্যকে কালজয়ী হতে সাহায্য করেছে।
■ ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের গঠন কৌশল:
“…শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ইহাকে ঠিক উপন্যাস বলা চলে কিনা, তা একটু বিবেচনার বিষয়। উপন্যাসের নিবিড়, অবিচ্ছিন্ন ঐক্য ইহার নাই; কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পরিচ্ছেদের সমষ্টি। কিন্তু ইহার গ্রন্থন সূত্রটা যতই শিথিল হোক না কেন, গ্রথিত পরিচ্ছেদগুলি এক একটি মহামূল্য রত্ন।” শ্রীকান্ত উপন্যাসের গঠনশৈলী আলোচনা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক ডঃ শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন।
● উপন্যাসের প্লট:
প্লট সম্পর্কে শরৎচন্দ্র বলেছেন,“প্লট সম্বন্ধে আমাকে কোনদিনও চিন্তা করতে হয় নাই। কতগুলি চরিত্র ঠিক করিয়া নিই; তাহাদিগকে ফোটাবার জন্য যাহা দরকার আপনি আসিয়া পড়ে।”
উপন্যাসে প্লট একটি দীর্ঘ কাহিনী। যেখানে মানব- মানবীর তথা ব্যক্তির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, ঘৃণা ও ভালোবাসা ইত্যাদি ঘটনা প্রাধান্য লাভ করে। উপন্যাসের প্লট বা আখ্যান হয় সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। প্লটের মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়াকান্ডকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয় যাতে তা বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে এবং কাহিনীকে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও বাস্তবোচিত করে তোলে। আমাদের আলোচ্য ‘শ্রীকান্ত’ (প্রথম খন্ড) উপন্যাসের প্লটের গঠন অনেকটা যৌগিক প্লটের মতো। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্লটে মোট বারোটি পরিচ্ছেদ আছে। উপন্যাসের পরিচ্ছেদ গুলিকে খুব নিপুনভাবে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক, যেমন প্রথম পরিচ্ছেদে- ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের প্রথম পরিচয়, শ্রীকান্তের মেজদার কাহিনী, শ্রীনাথ বহুরূপীর কাহিনী। এই পরিচ্ছেদে মূলত ইন্দ্রনাথকেই লেখক উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের নৈশ অভিযান। তৃতীয় পরিচ্ছেদে, শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথের মাছ চুরি এবং মৃতদেহের সামনে পড়ে মৃতদেহ সম্পর্কে ইন্দ্রনাথের কিছু হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য। শ্রীকান্তের মনোভাব বর্নিত। এছাড়া আছে অন্নদাদিদি ও শাহজীর কাহিনী, নিরুদিদির কথা, নতুনদাদার কাহিনী, রাজলক্ষীর কাহিনী, রাম তেওয়ারির মেয়েদের কথা ইত্যাদি এইভাবে ঔপন্যাসিক একের পর এক প্লটে কাহিনীকে সাজিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসের শুরুতেই ঔপন্যাসিকের অকপট স্বীকারোক্তির কথা- “লিখিতে বসিয়া আমি অনেক সময়ই আশ্চর্য হইয়া ভাবি, এইসব এলোমেলো ঘটনা আমার মনের মধ্যে এমন পরিপাটি ভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছিল কে? যেমন করিয়া বলি তেমন করিয়া তাহারা একটির পর একটি সুশৃঙ্খলিত হইয়া ঘটে নাই।” ঘটনা গুলির খানিকটা এলোমেলো মনে হলেও দেখা যায় প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে সপ্তম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ঘটনা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের মধ্যে দিয়ে।
● প্রাকৃতিক পটভূমি:
প্রকৃতির চিত্রণে শরৎচন্দ্র একদিকে যেমন চিত্রকর, অপরদিকে দার্শনিকও বটে। উপন্যাসে প্রকৃতির প্রসঙ্গ কোনো নতুন বিষয় নয়, তা উঠে আসে শরৎচন্দ্রের নিজস্ব রীতিতে। নক্ষত্রখচিত অন্ধকার আকাশ, কালো মেঘ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, সূর্যাস্ত, গঙ্গা-এইসব প্রাকৃতিক বিষয়গুলি শ্রীকান্ত ছাড়াও আরো অন্যান্য ছোটগল্প ও উপন্যাসে পাওয়া যায়। শ্রীকান্ত উপন্যাসের শুরুতেই লেখক বলেছেন, “ভগবান আমার মধ্যে কল্পনার কবিত্বের বাষ্পটুকু দেন নাই। এই দুটো পোড়া চোখ দিয়ে যা কিছু দেখি ঠিক তাহাই লিখি।” এই প্রসঙ্গটি উপন্যাসের প্রকৃতি চিত্রনে লেখকের অতি বিনয়েরই বিরোধিতা করে। অনেকক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের অন্তরে এক কবির আবির্ভাব হয়েছে। আবার কোন কোন স্থানে নিসর্গ প্রাকৃতিক বর্ণনা অসাধারণ প্রতীকী ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। এই সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক নিপুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বোধ-
১) “রাত্রির যে একটা গভীর রূপ আছে, তাহাকে পৃথিবীর গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, জল-মাটি, বন- জঙ্গল প্রভৃতি জাতীয় দৃশ্যমান বস্তু হইতে পৃথক করিয়া একান্ত করিয়া দেখা যায় ইহা যেন আজ এই প্রথম চোখে পড়িল।”
ঔপন্যাসিক এখানে নতুনভাবে প্রকৃতিকে দেখেছেন আর এই দার্শনিক অনুভব মূলত শরৎচন্দ্রের কবিসত্ত্বাকে বিকশিত করে। আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায় –
২) “অস্তগামী সূর্যের তীর্যক রশ্মি ছটা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিয়া দীঘির কালো জলে সোনা মাখাইয়া দিল।”- এই উপলব্ধিতে আমাদের স্মরণে আসে ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথকে। এই প্রাকৃতিক বর্ণনা শুধু প্রকৃতিকেই আটকে থাকেনি, তার প্রভাব পড়েছে রাজলক্ষ্মীর প্রেমের ওপর। দ্বাদশ পরিচ্ছদে দেখা যায়-
৩) “চোখের ওপর সূর্য অস্ত গেল। সেই দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমার সমস্ত অন্তঃকরণটা যেন গলিয়া রাঙা হইয়া উঠিল। মনে মনে কহিলাম রাজলক্ষ্মীকে আর তো ছোট করিয়া দেখিতে পারি না।”
এখানে যেমন সূর্যাস্তের যে সৌন্দর্য তার চেতনার বিষয় ফুটে উঠেছে, তেমনি সূর্যাস্তের সময় রঙিন রাগে রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে শ্রীকান্তের মনোভাবও ফুটে উঠেছে। শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে যেমন অন্ধকার, চাঁদ, মেঘ বা শশ্মানের ভয়ংকর পরিস্থিতির বর্ণনা ছবি উপহার দিয়েছেন, তেমনি প্রকৃতি নির্মাণে গভীর দার্শনিক প্রত্যয়ও ধরা পড়েছে অন্ধকারে প্রেক্ষিতে। আর সব থেকে বড় বিষয় নিসর্গ প্রকৃতি এখানে শুধু চিত্রগুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের সাপেক্ষে অনেকাংশে ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে।
● চরিত্র:
“গল্প, উপন্যাসের চরিত্র আঁকতে গিয়ে লেখকেরা নানা উপায় বেছে নেন। উদ্দেশ্য চরিত্রটিকে কম বেশি জ্যান্ত করে পাঠকের সামনে ছেড়ে দেওয়া- যেন তারা নিজেদেরই একটা প্রাণ উপার্জন করে।” (পবিত্র সরকার)
উপন্যাস জীবনের ব্যাখ্যা করে। তাই অবশ্যই সেখানে মানব জীবনের কাহিনী বর্ণিত হয়। উপন্যাসে পর্যায়ক্রমে কখনো বা ঘটনা সংস্থাপনা, আবার কখনো চরিত্র ভাবনা বড় হয়ে ওঠে। সেখানে চরিত্রও ঔপন্যাসিকের অন্তর্ভেদী নানা বৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিভাত হয়। উপন্যাস যেন এক কথায় চরিত্রের -চিত্রশালা। এখানে বিচিত্র চরিত্রের ভিড়, জনতার মুখরিত কলকোলাহল। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের চরিত্র সৃজনের রীতিতে শরৎচন্দ্র নতুনত্ব এনেছেন। শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ, অন্নদাদিদি, পিয়ারী প্রভৃতি চরিত্রেরা বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। এই চরিত্রেরা শরৎচন্দ্রের নিজস্ব জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত বিশেষ অভিজ্ঞতার ভিত্তি থেকে উঠে এসেছে। বাহ্যিক যে পরিচয় থাকুক না কেন হৃদয় বোধের চেতনায় এরা প্রত্যেকে অসাধারণ। এছাড়া লেখকের আত্মজীবনের নানা অংশ চরিত্রের মধ্যে স্থান পেয়েছে। শ্রীকান্ত চরিত্রের মধ্যে ভবঘুরে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গেলেও, তার চরিত্রে আড়ালে খুঁজে পাওয়া যায় গভীর সহানুভূতিশীল এক প্রেমিককে। ইন্দ্রনাথের দুঃসাহসিক অভিযান, বেপরোয়া স্বভাব, প্রচন্ড ক্রোধ, শাসনে বাধা না পড়া মানসিকতার মধ্যেও রয়েছে আশ্চর্য মহানুভবতা। কলঙ্কিনী কুলত্যাগিনী পরিষদের আড়ালে অন্নদা দিদি এক অন্যতম পতিব্রতা নারী, সে তার সতীত্বের আদর্শে উজ্জ্বল চরিত্র হয়ে উঠেছে। পিয়ারী বাইজি তার বাইজিবৃত্তিতে যেমন পারদর্শী হয়ে উঠেছে, তেমনি তার নারীসত্ত্বায় গড়ে উঠেছে মহনীয়তার রূপ। পবিত্র প্রেমের আদর্শ নিয়ে শ্রীকান্তের প্রতি রাজলক্ষ্মী গভীর অনুরাগে রঞ্জিত, আবার অন্যদিকে মাতৃত্বের দীপ্তিতে সে দীপ্তিময়ী নারী। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের সমস্ত বিচিত্র চরিত্রসমূহ বাংলা উপন্যাস এক নতুন পথের সূচনা করেছে।
● ভাষা ও সংলাপ:
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য চর্চায় যা রেখে দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অভিনব। এই সৃজনকর্মে যে গদ্য ভাষা সৃষ্টি করেছেন তা বাঙালির কাছে সহজবদ্ধ ও সুখপাঠ্য।
নিজের ভাষা শৈলী সম্পর্কে তিনি একটা সভাই বলেছিলেন,“আমি ভাষা ভালো জানি না- vocabulary কম – লোকের ভালো লাগে কেন, তা জানিনা। যা বোঝাতে চাই তাই মনে রাখি। তার জন্য লেখা অনেক ঘষামাজা করতে হয় – স্বতঃউৎসের মতো বেরোয় না। যারা বলে যা লিখে যাব তাই ভাল, তারা প্রকাণ্ড ভুল করে। মানুষের বলার মত লেখাতেও অনেক lrrevant কথা থাকে সেদিকে নজর রাখতে হয়।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য ভাষার অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য সহ ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে লক্ষণীয়। শ্রীকান্ত উপন্যাসের ভাষা মূলত সাধু গদ্যের কাঠামোই চলিতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। বর্ণনা অংশে লেখক সাধু গদ্যের ব্যবহার করেছেন ঠিকই তবে তাও চলিতে প্রায় কাছাকাছি। আর সংলাপ অংশে একেবারে প্রাত্যহিক জীবনের মুখের ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন। সংলাপ রচনা সময় শরৎচন্দ্র প্রায়শই সংলাপের সঙ্গে চরিত্রের অভিব্যক্তিকে জুড়ে দিয়েছেন- “তোর নাম কি রে?/ শ্রী-কা-ন্ত —- আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলাম, সিদ্ধি? এ আমি খাই না। সে ততধিক বিস্মিত হইয়া কহিল, খাসনে?” এখানে ‘বিস্তৃত হইয়া কহিলাম’ এবং ‘ততধিক বিস্মিত হইয়া কহিল’ অভিব্যক্তি যেমন আছে আবার শ্রী-কা-ন্ত উচ্চারণের ব্যবহার আরেক অভিব্যক্তির বুঝিয়ে দেয়। শুধু চলিত ভাষায় নয় এই উপন্যাসের সংলাপ রচনা এমন কিছু ব্যবহার লক্ষিত হয়, যা একেবারেই মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে, যেমন- ছোঁড়াটাকে দেনা দাঁড় টানুক কিংবা ব্যবসা বার করে দিচ্ছি- বললে ইন্দ্রনাথ। আবার এমন কিছু সংলাপ রয়েছে যার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নাটকীয়তা, সৃষ্টি করেছে ঘটনার গতিবেগ, যেমন – “তোমরা কটি ভাইবোন?/ ভাই আর নেই, চারটি বোন।/ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে?/ আজ্ঞে হ্যাঁ। মা-ই বিয়ে দিয়েছেন।” অন্যদিকে চরিত্রের স্বাভাবিকতা রক্ষার্থে হিন্দি বাংলা মেশানো এমন কিছু বাক্য ব্যবহার করেছেন, যা হাস্যরসত্ব হলেও চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছে। যেমন- খোটাশালার ব্যাটারা আমাকে যেন কিলাকে কাঁঠাল পাকা দিয়া কিংবা কহিল বাবাজী আয়না-টাইনা হ্যায়? অবশেষে বলা যায়, শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের গদ্য ভাষার জন্য যে শব্দচয়ন ও বাক্যবন্ধ নির্বাচন করেছেন তা অতুলনীয়। উপমা, রূপক, শ্লেষ প্রভৃতি অলংকারের সার্থক ব্যবহার করে আপন অন্তরের গভীর উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শরৎচন্দ্র পূর্বকাল ও পরবর্তীকালের বাংলা গদ্য ভাষার মধ্যে একটা প্রাণের আবেগ সঞ্চার করে দিতে পেরেছিলেন।
● শ্রেনিবিচার:
উপন্যাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। কখনো ওটা কাহিনী নির্ভর হয়, কখনো চরিত্র নির্ভর হয়, কখনো মনস্তাত্ত্বিক, কখনো বক্তব্যধর্মী। বিষয়, চরিত্র, প্রবণতা এবং গঠনগত সৌকর্যের ভিত্তিতে উপন্যাসকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে বেছে নিয়েছেন ভ্রমণ কাহিনীর প্যাটার্নের আত্মজীবনীমূলক কাহিনি। তবে প্রকরণ হিসাবে অভিনবত্বের দাবিদার তিনি, শ্রীকান্ত আদতে আত্মকাহিনীর ছলে লেখা উপন্যাস। তিনি উপন্যাসের শুরু করেছেন পুরানো দিনের স্মৃতিচারণা দিয়ে। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় পৌঁছে বাল্য ও যৌবনের দিকে ফিরে তাকানোই উপন্যাসের কাহিনী গ্রথিত হয়েছে। স্মৃতির পাতায় জীবনের ছবি খুঁজতে গিয়ে গভীর আত্মসমীক্ষার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন-
“বহুরূপী জীবনপট বিধৃত বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তিনি জীবনে বহু মানুষ ও ঘটনার সংস্পর্শে এসেছেন। এই সমস্ত কিছুর প্রসাদ তাঁর উপন্যাসে মেলে।”
বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে আত্মজীবনের উপাদানের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের জীবন দর্শন। লেখক এখানে নিজের জীবনকে নিরাসক্ত হয়ে পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দেখেছেন। ভালোভাবে দেখতে
গিয়ে ঘটনা সংস্থানের মধ্যে বৈচিত্র এনেছেন। জীবনকথার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শূন্যস্থান গুলি কল্পনার দ্বারা পূরণ করেছেন। তথ্যের সত্যকে সাহিত্য সত্যে পরিণত করেছেন হৃদয়ের উত্তাপের স্পর্শে।
ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,“শরৎচন্দ্র বাস্তব জীবনকে গ্রহণ করে অতি বিচিত্র কৌশলে তার সঙ্গে রোমান্সের অদ্ভুত মিল ঘটিয়েছেন”।
এভাবে তিনি ভেতরে ও বাইরে সামঞ্জস্য যা সৃজন করেছেন তা একেবারে অভিনব হয়েছে।
■ শরৎচন্দ্রের বিশিষ্টতা:
বাংলা সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে শরৎচন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছিল অতি ধীরে সংকোচ-জড়িত পদক্ষেপে। তার এক একটাই কারণ রবীন্দ্র প্রতিভা। টলস্টয়ের মতো আদর্শ রসসাহিত্যের মৌলিক গুণ দিয়ে পাঠকের মনকে স্পর্শ করার ক্ষমতা ছিল শরৎচন্দ্রের। তাঁর লেখনীর মানুষের মনকে স্পর্শ করার ক্ষমতা অসাধারণ। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। যেইসব বৈশিষ্ট্য শ্রীকান্ত উপন্যাস ফুটে ওঠেছে-
● শরৎচন্দ্রের রচনার প্রথম গুণ যা নজরে পড়ে তা হল বাস্তবতা।শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের রচনা রচনা শৈলীর অঙ্গ হিসাবে বাস্তবতাকে রস সাহিত্যে রচনার একটি মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। “ভগবান আমার মধ্যে কল্পনার বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পোড়া দিয়ে আমি যা আমি যা কিছু দেখি ঠিক তাহাই দেখি।” – বাস্তবতা প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের উক্তিটি খাপ খায়। তাই দেখি কল্পনার লীলা তাতে বড় একটা নজরে আসে না। সাধারণ মানুষকে ঘিরে মাটির পৃথিবীর বুকে দৈনন্দিন জীবন হতে তাঁর সাহিত্যের কাঁচামাল তিনি সংগ্রহ করেছেন। ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের নিশীথ অভিযান ও শ্রীকান্তের গভীর রাতে শ্মশান ভ্রমণের বর্ণনা এই দুটি ঘটনা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই চিত্রকর্ষক করেছিল তা নিঃসন্দেহ।
● তাঁর রচনার আরেকটি দিক হল আন্তরিকতা। সার্থক শিল্পীর মতে, যে মৌলিক গুণগুলি একান্ত প্রয়োজনীয় তাদের মধ্যে আন্তরিকতা প্রধান। শরৎচন্দ্রের মধ্যেও এই গুণ বিলক্ষণ বর্তমান। শ্রীকান্ত উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে যে ভাবটি তিনি ফোটাতে চেয়েছেন, তা তিনি নিজের অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়- শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মী প্রেমের কাহিনীর মাধ্যমে। তাদের প্রেম সমাজ ব্যবস্থায় অনুমোদিত না হলেও, তাদের জন্য তিনি যে প্রশস্ত রচনা করেছেন তার মধ্যে কোথাও কৃত্রিমতা নেই। তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন বলেই শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষীর প্রেমকে এমন দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
● ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় গুণ শরৎচন্দ্রের উপমা ও রূপকল্প বা চিত্রকল্প ব্যবহারের দক্ষতা। উপন্যাসের পরতে পরতে তিনি এমন সব উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন, যা অতি সাধারন ঘটনাকেও অনন্য সাধারণ করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, “আমি ঘাড় ফিরাইয়া ইন্দ্রের দিকে দেখিলাম, যেন ভষ্মাচ্ছাদিত বহ্নি। যেন যুগযুগান্তর ব্যাপী কঠোর তপস্যা সাঙ্গ করিয়া তিনি এইমাত্র আসন হইতে উঠিয়া আসিলেন।”
■ শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের ত্রুটি:
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসের জনপ্রিয়তা থাকলেও সমালোচকেরা এই উপন্যাসের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সমালোচনা করেছেন। শ্রীকান্ত উপন্যাসের ত্রুটিগুলি হল-
১. শ্রীকান্ত উপন্যাসের ত্রুটিপূর্ণ দিক হচ্ছে কাহিনির বুননে অসহিষ্ণুতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপন্যাসটির ঘটনাগুলি জমাট বেঁধে উঠতে পারেনি। যেমন, নতুনদাদার কাহিনি। তাছাড়া শ্রীকান্তের অসুস্থতায় রামবাবুর পরিবারের পাশে না থাকা। অনেকক্ষেত্রে উপন্যাসটির বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর সঙ্গে উপন্যাসের মূল ঘটনার তেমন কোন যোগ নেই। তাঁর উপন্যাসের ঘটনাগুলি এতটাই স্বতন্ত্র যে যে উপন্যাসের ঘটনাগুলোকে পৃথকভাবে লিখলে তা ছোট গল্প বা বড় গল্পের রূপ নেবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ছিনাথ বহুরূপীর কাহিনি।
২. শ্রীকান্ত উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টিতে কখনো অসামঞ্জস্যতাও দেখা গিয়েছে। এই উপন্যাসে এমন কয়েকটি চরিত্র এসে হাজির হয়, যার নিজস্ব কোনো ভূমিকা নেই। যেমন নতুনদা, শাহজী প্রমুখ। আবার এমন চরিত্রও উঠে এসেছে যে হঠাৎ করে আবার মিলিয়ে গেছে।
৩. শ্রীকান্ত উপন্যাসে সমাজ সমস্যা আলোচনার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রণালী তিনি ব্যবহার করেননি। এমনকি সমাধানের কোনো সুক্ষ ইঙ্গিত বা তার প্রতিকারের পথ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না। যেমন- রাম তেওয়ারির মেয়েদের কাহিনীতে দেখা যায় যে, স্বধর্মে বিবাহের ফলে তারা যে সমস্যার মুখে পড়েছিল তার কোন সমাধান উপন্যাসে বর্ণিত হয়নি।
৪. শরৎচন্দ্র হিন্দু বিধবা নারীদের প্রতি সামাজিক অবিচারকে তুলে ধরেছেন ঠিকই, এমনকি তাদের গোপনে প্রনয়ের প্রতি তিনি সমবেদনাও জানিয়েছেন। কিন্তু বঙ্কিম যুগের লেখকের মত সাহস করে বিধবাদের পুনর্বিবাহ দিয়ে, তাদের সুখী জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এর প্রধান দৃষ্টান্ত রাজলক্ষী ও নিরুদিদি। ছোটবেলার প্রেম, শ্রীকান্তকে বিবাহের পরেও রাজলক্ষ্মী মনে মনে ভালোবেসে এসেছে। অনেকটা পরে হলেও শ্রীকান্ত রাজলক্ষীকে মন দিয়েছে। কিন্তু তাদের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজ ও রাজলক্ষ্মীর মাতৃত্ববোধ। তাই তাদের প্রেমের বানী হয়ে উঠেছে,“প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।” অপরদিকে নিরুদিদি বিধবা হয়েও পরপুরুষকে ভালোবাসার পরিণতি হয়েছিল যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
৫. দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসা বা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা পূর্ন কোনো মহৎ মানুষের চিত্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে অনুপস্থিত। এখানে একদম সাধারন জীবন থেকে উঠে আসা চরিত্রই নায়কের ভূমিকা নিয়েছে।
৬. আবেগ ও মননের সমানুপাতিক প্রয়োগে ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি যে সমগ্রতা লাভ করে, তার দুঃখজনক অনুপস্থিতি চোখে পড়ে।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের পর আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যিনি তাঁর সীমিত কালখন্ড ও ভূমিখণ্ডকে স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করে এক যুগতীর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন বাঙালি পাঠক সমাজে। তাঁর কালজয়ী খ্যাতি দেশের সীমাকে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথকে পরিলঙ্ঘন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে বিদেশি পাঠকদের মনকেও জয় করেছে। উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রকে তিনি উচ্চ অভিজাত ভূমি থেকে বাস্তব সাধারণ মানুষের জীবনে নামিয়ে এনেছেন। ঔপন্যাসিকের নির্মোহতা নয়, বরং হৃদয়ের প্রতি সহানুভূতি দিয়েই, তিনি তাঁর উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীকে নির্বাচন করেছেন। তার উদাহরণ হিসাবে ফুটে উঠেছে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে।
শ্রীকান্ত উপন্যাস সম্পর্কে মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন,
“ইহাই একান্তই আত্ম নিবেদন এবং যেন অপরের নিকট নয়ইহার একান্তই আত্ম নিবেদন এবং যেন অপরের নিকট নয়। নিজেরই এক ক্রন্দন, নিঃসঙ্গ আত্মার নিরুদ্দিষ্ট আত্মরব।”