গণদেবতা উপন্যাসে প্রাচীন – নবীন দ্বন্দ্ব
কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ , বি.এড
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের মধ্যে অন্যান্য বিষয়বস্তুর পাশাপাশি প্রাচীন ও নবীনের যে সংঘর্ষ সেটি উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘ হাসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে যেমন লক্ষ করা যায় সেখানে কাহার কুলের মুরুব্বী বনওয়ারী প্রাচীন ঐতিহ্যের অক্টোপাসের বাধার মতো মানুষ। সে নবীনযুগের নতুন ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারে না, তাঁর জীর্ণ সংস্কার বিশ্বাসকে সে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না, তাই একালের নব্যযুবক করালীর আচার – আচরণ তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে এই সব কোনো কিছুই লেখক তুলে ধরেননি, এখানে লেখক দেখিয়েছেন গ্রামের মানুষ কি ভাবে প্রাচীন বিষয়বস্তুকে ত্যাগ করে নতুনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আলোচ্য উপন্যাসে প্রাচীন – নবীনের দ্বন্দ্ব লক্ষ করা গিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটি ভিন্নভাবে লেখক পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় অনিরুদ্ধ কর্মকার ও গিরিশ সূত্রধরের জন্য গ্রামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল কারণ তাঁরা গ্রামের কাজ ছেড়ে জংশনে যেত কাজ করতে গ্রামে তাঁদের পোষাচ্ছিল না ফলে তাঁরা তাঁদের পুরুষানুক্রমে চলা কাজ ফেলে বেশি টাকার জন্য জংশনে যেত কাজ করতে, ফলে গ্রামের মানুষদের অসুবিধার অন্ত ছিল না – “তোমার পূর্বপুরুষের বাস হল গিয়ে মহাগ্রাম; এ গ্রামে কামার ছিল না বলেই তোমার পিতামহকে এনে বাস করানো হয়েছিল। সে তো তুমিও শুনেছ হে বাপু। এখন না বললে চলবে কেন?”
কারণ গ্রামে থেকে তাঁরা যে পারিশ্রমিক পেত শহরে গিয়ে তার থেকে বেশি পারিশ্রমিক পায়। পরবর্তীতে দেখা যায় অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সঙ্গে পাতু ও তারাচরণ নাপিতও জংশনে যাওয়া আরম্ভ করে পেটের দায়ে। অভাবের তাড়নার প্রথম ধাক্কা মারে সবসময় গরীবদের উপর, আলোচ্য উপন্যাস ‘গণদেবতা’-তেও অভাবের প্রথম শিকার এই গরীবরাই, আর ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে দেখা যায় এখানে সবার অবস্থাই শোচনীয়। গরীব কামার অনিরুদ্ধ ও ছুতোর গিরিশ অভাবের তাড়নাতেই জংশনে গিয়ে নিজেদের ব্যবসা পাতিয়েছিল – “ঘর – সংসার যখন করছি তখন ঘরের লোকের মুখে তো দুটো দিতে হবে। তাঁর ওপর ধরুন, আজকালকার হাল – চাল সে রকম নেই-” পুরোনো ঐতিহ্য ছেড়ে নতুনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কারণ গুলোর মধ্যে ‘অভাবের তাড়না’- কে নির্দ্বিধায় বলা যায় একটি বড়ো কারণ, কেননা ‘অভাবের তাড়না’ –ই মানুষকে বেশি মুনাফা করা যায় কোন কাজে সেই দিকে নিয়ে যায় ফলে পুরোনো ঐতিহ্য ছাড়তে না চাইলেও ছাড়তে হয় ।
অনিরুদ্ধ ও গিরিশের মতো পাতুকেও অর্থের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে দেখা যায়, পাতুদের পূর্বপুরুষদের কাজ ছিল গ্রামে ‘আঙোটজুতি’ -এর জোগাড় দেওয়া –
“আঙোটজুতি’র কথাটা তুমি জান না বাবা পাতু। গায়ের ভাগাড় তোমরা যে দখল কর – তার জন্যেই তোমাদিগে গাঁয়ের ‘আঙোটজুতি’ যোগাতে হয়।” কিন্তু গ্রামে তাঁর সেই ভাবে চলছিল না ফলে সেও অনিরুদ্ধ ও গিরিশের মতো জংশনে যেত তাঁদের সাথে কাজ করতে। – “অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সঙ্গে আর একজন আছে, পাতু মুচি।” এছাড়া পাতুকে চরকের সময় ভিন্ন গ্রামে গিয়েও বাজনা বাজাতে দেখা যায়- “পাতু নিজের গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে বাজাইতে গিয়াছে।”
উপন্যাসে প্রথমে যে দ্বারকা চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তিনি আসলে জমিদারের বংশোদ্ভূত উপন্যাস থেকে জানা যায় সেই কথা, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের আর জমিদারী ছিল না, কোনো কারণে– “লোকে এখন ও বলে – কেমন বংশ দেখতে হবে! এই চৌধুরীর পূর্ব পুরুষেরাই এককালে এই দুই খানি গ্রামের জমিদার ছিলেন, এখন ইনি অবশ্য সম্পন্ন চাষী – রূপেই গন্য, কারণ জমিদারী অন্য লোকের হাতে গিয়াছে।” অর্থাৎ দ্বারকা চৌধুরীদের এককালে এই জমিদারদের আধিপত্য থাকলেও পরবর্তীতে তাঁদের সেই আধিক্য কমতে থাকে এবং দ্বারকা চৌধুরীর সময় আশার যখন আসে তখন আর কোনো কিছুই অবস্থিত ছিল না – “দ্বারকা চৌধুরীর এক পুরুষ পূর্বে তাহাদের বংশের সম্মান – সমৃদ্ধির ভাণ্ডার নিঃশেষিত হইয়াছে।”
দ্বারকা চৌধুরীর সময় অবসানের পাশাপাশি শ্রীহরি ঘোষের সময় শুরু হতে দেখা যায় উপন্যাসে। শ্রীহরির প্রচুর সম্পদ, সে সেই সম্পদের জোড়ে একদিন যেমন জমিদারের গোমস্তা হয়েছিল – “জমিদারের এখন অবস্থা খারাপ, শ্রীহরির, টাকা আছে, আদায় হোক না হোক, সমস্ত টাকা শ্রীহরি দিবে – এই শর্তে জমিদার শ্রীহরিকে গোমস্তাগিরি দিয়েছে।”
তেমনি এই সম্পদের জোড়ে সে একদিন শিবকালিপুরের জমিদারীও কিনে নিয়েছিল – “শ্রীহরিই এখন এ গ্রামের জমিদার। শিবকালিপুরের জমিদারী সে – ই কিনিয়াছে।”
এই ভাবেই শিবকালিপুরে দ্বারকা চৌধুরীর সময়ের সাথে সাথে প্রাচীন সময়ের অবসান ঘটে আর শ্রীহরি ঘোষের হাত ধরে নতুন এক যুগের সূচনা হতে দেখা যায় গ্রামে।
পরবর্তীতে দেখা যায় শ্রীহরি ঘোষের জন্য দ্বারকা চৌধুরীর করুন পরিণতি হয় । শ্রীহরি ঘোষের লোকেরা দেবু ঘোষের গাছ কাটতে গেলে দেবু কুড়ুলের সামনে দাঁড়িয়ে পরেছিলেন তখন দ্বারকা চৌধুরী তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে এবং দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে নিজেই আহত হয়ে পরেন – “প্রথমে চৌধুরী সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িয়াছিল, চেতনা হইলেও ধরাধরি করিয়া বহিয়া আনিতে হইয়াছে।” এবং এই ঘটনার পর তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পরেন – “এবার চৌধুরী শয্যাশয়ী হইয়া আছে। সেই মাথায় আঘাত পাইয়া বিছানায় শুইয়েছে, আর উঠে নাই।” এই ভাবে দ্বারকা চৌধুরীর সময় ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখে যায় উপন্যাসে।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে গ্রাম বাংলার যে পূজা – পার্বণ তার নিদর্শন খুব ভালো করে পাওয়া যায় কিন্তু কালের প্রভাবে এই পার্বণের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। উপন্যাসে বিভিন্ন পার্বনের মধ্যে গাজনের উল্লেখও পাওয়া যায়, এটি গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্য। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়, আর চৈত্র সংক্রান্তিতে চরক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। উপন্যাসে দেখা যায় গ্রামে বহুদিনের প্রচলিত গাজন সেটেলমেন্টের ফলে বন্ধ হওয়ার জোগাড়। দ্বারকা চৌধুরী যে গ্রামের প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ তিনি ব্যাপারটি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না ফলে অনেকের কাছে গিয়েই তিনি গাজনের কথা বলেন, মুকুন্দ মণ্ডলের কাছে গিয়েছিলেন পুজার খরচের ব্যাপারে, কিন্তু তিনি খরচ জোগাতে অস্বীকার করেন কারণ জরীপের সময় তিনি দেখেছেন তাঁর জমি আর নেই কারণ তাঁর অজ্ঞাতেই তাঁর বাবা সেই জমি বেঁচে দিয়েছিলেন। শ্রীহরির কাছে গিয়েও তিনি কোনো আশা দেখেননি বরং সে- “জমিদারের পত্র দেখালেন, তিনি খরচ দেবেন না। পুজো বন্ধ হয় হোক ।”
ভক্তরাও তেমন উৎসাহীত ছিল না – “এবার ভক্তরা বলছে, ও – রকম যেচেমেগে পুজোতে আমরা নাই ।”
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় শ্রীহরি নিজের কৃতিত্ব দেখানোর জন্যে হলেও গ্রামে গাজনের ব্যবস্থা করেন এবং একটি ছোটো মেলারও আয়োজন করে – “চণ্ডীমণ্ডপ ঘিরিয়া মেলা বসিয়াছে। খানবিশেক দোকান। তেলেভাজা মিস্টির দোকানই বেশী । বেগুনী, ফুলুরী, পাঁপড় – ভাজা হইতেছে।এমনকি শ্রীহরি দশ খানা ঢাকেরও বন্দোবস্তকরেছিলেন – “ঘোষ এবার দশখানা ঢাকের বন্দোবস্ত করিয়াছে। ”
এই ভাবে গ্রাম্য সমাজের যে ঐতিহ্য সেটি বজায় থাকলেও প্রাচীনত্বের মধ্যে নতুনত্বের প্রবেশ ঘটেছে সেটি ভালো ভাবেই লক্ষ করা যায়। কারণ প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে আধুনিকতা প্রবেশ করলে সেখানে জাঁকজমক বেশি দেখা যায়, আর আধুনিক যুগের মানুষদের মধ্যে ভক্তি শ্রদ্ধা থাকলেও জাঁকজমকের প্রতিই টান তাঁদের থাকে।
আধুনিকতার জোয়ার গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের উপরও পরেছিল ফলে তার মেঝে পাকা মসৃণ হয়ে উঠেছিল, চণ্ডীমণ্ডপে ওঠার জন্য পাকা সিঁড়িও তৈরি হয়েছিল- “এ যে সব পাকা হইয়া গিয়াছে। পথ হইতে চণ্ডীমণ্ডপে উঠিবার পাকা সিঁড়িগুলিকে বেষ্টন করিয়া যেন- ধরিয়া রাখিয়াছে । ষষ্ঠীতলার বকুল গাছটির চারিপাশ পাকা গোল বেদী করিয়া বাঁধানো। চণ্ডীমণ্ডপের মেঝে পাকা হইয়াছে মসৃণ সিমেন্টের পালিশ ঝকমক করিতেছে।” এছাড়া চণ্ডীমণ্ডপে নতুন করে দেউল ও নাটমন্দিরও করছিলেন শ্রীহরি ঘোষ। এমনকি গ্রামে আগে যে পাঠশালা বসত চণ্ডীমণ্ডপে সেটিরও কিছু পরিবর্তন হয় পাঠশালার জন্য নতুন ঘর নির্মিত হয় যাতে ছোটোরা সেখানে ভালো করে পড়তে পারে – “এই চণ্ডীমণ্ডপে বসিবার জন্যই গ্রামে স্কুল – ঘর করা হইয়াছে।”
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে যতগুলো চরিত্র আছে তাঁদের মধ্যে এক বিশিষ্ট চরিত্র হলেন ন্যায়রত্ন মহাশয় অর্থাৎ ঠাকুর মশায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন। যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাচীন ঐতিহ্য হস্তান্তর করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় নতুন – পুরাতনের মেলবন্ধন ঘটাতে সবসময় তৎপর। আর তাঁর এই মেলবন্ধনের দূত হলেন দেবনাথ ঘোষ। ন্যায়রত্ন মহাশয় দেবনাথ ঘোষকে বড়ো ভালোবাসতেন ফলে তিনি পণ্ডিত দেবু ঘোষকে তাঁর কর্মে উৎসাহ এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্প বলেছিলেন, উপন্যাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। উপন্যাসে যতীনের মুখে তাই শোনা যায় –
“ন্যায়রত্ন হিসাবের উর্ধ্বে – পরিমাপের অতিরিক্ত। আরও তাহার পাশের এই মানুষটির – পণ্ডিত দেবু ঘোষ; অর্ধশিক্ষিত চাষীর ছেলে, হৃদয়ের প্রসারতায় তাহার নির্ধারিত মূল্যাঙ্ককে ছাড়াইয়া গিয়াছে।”
উপন্যাসের শেষে লেখক শিবকালিপুর গ্রামে নতুনের যে সূর্যদ্বয় তার আভাস দিয়ে গিয়েছেন যতীনের মাধ্যমে। গ্রামে অনেক রকম অরাজকতা সৃষ্টি হতে দেখা যায়, কিছু পরিবর্তন হলেও কিছু থেকে যায় ফলে গ্রামের মানুষ যাতে তাঁদের জীবন ভালো করে অতিবাহিত করতে পারে তারই পূর্বাভাস দিয়েছিল লেখক, আর সেটি ন্যায়রত্নের পৌত্র আর দেবনাথ ঘোষের মাধ্যমে তা সম্ভব হতে পারে – “মনে পড়িল – ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বানাথকে । সে আসিবে। দেবু ঘোষ নবরূপে পল্লীর এই শৃঙ্খলাহীন যুগে, ভাঙাগড়ার আসরের মধ্যে – শ্রীহরি পাল, কঙ্কণার বাবু থানার জমাদার, দারোগার রক্তচক্ষুকে তুচ্ছ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে , মহামারীর আক্রমণকে সে রোধ করিয়াছে। দেবুর বুকে বুক রাখিয়া আলিঙ্গনের সময় সে স্পষ্ট অনুভব করিয়াছে অভয়ের বাণী তাহার বুকের মধ্যে আলোড়িত হইতে। সকল বাধা দূর করিয়া জীবনের সার্থকতা লাভের অদম্য আগ্রহের বাণী!”
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা গল্প বিচিত্রা’ গ্রন্থে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন, –
“…… তারাশঙ্কর ঐতিহ্য বিশ্বাসী – যা বংশগত, সংস্কারগত উত্তরাধিকারে আমাদের মধ্যে এতকাল ধরে চলে আসছে – তাকে কখনো কখনো নিষ্ঠুরভাবে আঘাত দিলেও তার কোনো ঐকান্তিক পরিবর্তন তিনি ‘কামনা’ করতে পারেননি। রাজনৈতিক মতবাদকে তারাশঙ্কর মানবতাবাদের মত প্রসারিত করেছেন কিন্তু গ্রামীণ সংস্কার বিশ্বাসকে ত্যাগ করাও তার পক্ষে সুকঠিন হয়েছে। তাই অতীত আর – ক্রমাবক্ষীয় পুরাতন আর অপ্রতিরোধ্য নবীন – এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব তারাশঙ্করের শিল্পসত্তারও দ্বন্দ্ব।
তারাশঙ্করের যুক্তি সচেতন মন এ সত্য উপলব্ধি করে যে নতুনের আবির্ভাবকে প্রতিহত করবার শক্তি কারো নেই – বিদ্রোহী নবীন বীর স্থবিরের শাসন – নাশন যুগসত্যরূপে অনিবার্যতায় আসন্ন হবে। তারাশঙ্কর হয়তো সজ্ঞানে এই যুগপ্রবাহের বিরোধিতা করতে চাননি, কিন্তু তার মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া খানিকটা অবচেতনভাবে নতুনের নির্মমতাকেই যেন প্রধানত অভিব্যক্ত করতে চেয়েছে।”
‘গণদেবতা’ গ্রামসমাজে পরিবর্তন কি ভাবে ধীরে ধীরে ঘটে চলে গ্রামবাসীর অবর্তমানে তা ‘গণদেবতা’ উপন্যাসটি লক্ষ করলে জানা যায়। লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্যাপারটি সুনিপুণ ভাবে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা, আধুনিক ইনড্রাসটি কি ভাবে সংরক্ষিত গ্রামীণ সমাজের শাসন ও অবরোধ ভেঙে দেয়, কি ভাবে আধুনিক নাগরিক জীবনের আধুনিক জীবনের সুগসাচ্ছন্দ্য মুক্তি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গ্রামের অবহেলিত মানুষদের সমাজ ভেঙে আসতে প্রলুব্ধ করছে, কি ভাবে জীবনের গভীর প্রোথিত শতাব্দী – সঞ্চিত সংস্কার ও ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিমূল আলগা হচ্ছে তা এখানে লেখক দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক দুর্বার সামাজিক – অর্থনৈতিক পরিবর্তনের তরঙ্গাঘাতে গ্রামীণ সমাজ ধীরে অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপ যে বদলে যায়, তার বিশ্বস্ত চিত্র এখানে পাওয়া যায় ।