চৈতন‍্য জীবনীকাব‍্য : চৈতন‍্যচরিতামৃত

বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের উপর ভিত্তি করে অনেক কবিরাই তাঁদের রচনার পারদর্শী কে পাঠক সমাজে তুলে ধরেছেন, সেইসকল চৈতন্যজীবনীর মধ্যে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি সবচেয়ে বিস্তৃত আর সবচেয়ে প্রমাণিক। ষোড়শ শতাব্দীর শেষপর্বে বা সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে উক্ত কাব্যটি রচিত হয়।

সুকুমার সেন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্য সম্পর্কে বলেছেন – “গ্রন্থটির রচনায় লেখকের যে বিচক্ষণতা মর্মজ্ঞতা ও ইতিহাসচেতনা প্রকটিত তা সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্যের উদ্ভবের কিছুকাল পরেও অপরিকল্পিত।”

কৃষ্ণদাস কবিরাজ সম্পর্কে যা জানা যায় তা সম্পূর্ণ কৃষ্ণদাস কবিরাজের নিজের কথা। আদিলীলার ‘পঞ্চম পরিচ্ছেদ’-এ নিত্যানন্দ মাহাত্ম্য বর্ণনার ভিতর কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিজের সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। সেখান থেকে জানা যায় তার নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে নৈহাটির নিকটে ঝামাটপুর গ্রামে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের পিতার নাম ভগীরথ এবং মাতার নাম সুনন্দা দেবী। কবি নিত্যানন্দ প্রভুর শিষ্য ছিলেন। এছাড়া জানা যায় কবি সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। তাঁদের গৃহদেবতার নিত্যপূজার জন্য ব্রহ্মণ পূজারী নিযুক্ত ছিল। তাঁদের বাড়িতে কীর্তন মহোৎসবের আয়োজন করা হত, সেখানে আবার কোন কোন বৈষ্ণব প্রধান মহান্তের আগমন ঘটত। এই রকম এক উৎসবের শেষেই একদিন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর মাহাত্ম্য নিয়ে কবির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মনান্তর হয়। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্য থেকে জানা যায় কবিকে সেই রাতেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভু স্বপ্নাদেশ দেন বৃন্দাবনে চলে যেতে। সেই নির্দেশ মেনে কবি জলপথে বৃন্দাবনের চলে যান। কবি বিবাহিতা ছিলেন কি না তার সঠিক কোনো তথ্য তিনি দেননি। অনেকের অনুমান কবি ঘরসংসার ছেড়ে বৃন্দাবনে গেলেও সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি। নরহরি চক্রবর্তীর লেখা কৃষ্ণদাস কবিরাজের বন্দনাপদের শেষ অংশে দেখা যায় –
“সুখময় সরস রাধিকাসরসি সেবন সদা অধিক উল্লাস কৃতবাসনিয়ম প্রবল
গৌরগোবিন্দপ্রিয় – মোদকরণা
নিশি দিবস রসভোগ নাহি তব ওর করুণা বিদিত দীনজনবন্ধ ধনবান –
নিপুণাতিশয় দাস নরহরি – হৃদয়ত্রাস – হরণা॥”
অর্থাৎ, সুখময় সরস রাধাকুণ্ডে সেবার অধিক উল্লাস, গৌরগোবিন্দের প্রিয় সেই ব্যক্তির তুষ্টি করা তোমার কাজ। দিবানিশি রসমগ্ন তুমি। তোমার করুণার সীমা নেই। সকলকেই জানে তুমি দীন জনের বন্ধু, ধনবান অতিশয় নিপুণ। তুমি নরহরিদাসের হৃদয় ভয় – নাশন ।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের রচিত ‘ চৈতন্যচরিতামৃত ’ গ্রন্থটি দর্শন কাব্য ও ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হিসেবে এক উজ্জ্বল রত্নবিশেষ। ধরা হয়ে থাকে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ১৫৬৫ থেকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ আদিলীলার বিষয়বস্তু নিয়েছিলেন মুরারি গুপ্তের কড়চা ও তদানুসারে বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ থেকে । আর মধ্যলীলার বর্ণনা, বিশেষত চৈতন্যদেবের ভারত ভ্রমণের বিবরণ অনেকটা কৃষ্ণদাসের গবেষণার ফল বলা যায় এবং ‘অন্তলীলার’ বিষয়বস্তু নিয়েছিলেন স্বরূপদামোদরের কড়চা এবং রঘুনাথ দাসের কবিতা ও তাঁর কাছে শোনা বিবরণ থেকে।
“আদিলীলা মধ্যে প্রভুর যতেক চরিত।
সূত্ররূপে মুরারি গুপ্ত করিলা গ্রন্থিত॥
প্রভুর যে শেষলীলা স্বরূপদামোদর।
সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর॥
এই দুইজনের সূত্র দেখিয়া শুনিয়া।
বর্ণনা করেন বৈষ্ণব ক্রম যে করিয়া॥”
কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ চৈতন্যজীবনী কাব্য বলা যায় । অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য সহ জীবন ইতিহাস উক্ত কাব্যে তুলে ধরেছেন এবং চৈতন্যজীবনের প্রেক্ষাপটে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের ব্যাখ্যা ও বিচার বিশ্লেষণও তুলে ধরেছেন। ব্যক্তি চৈতন্যের আদর্শ ও তাঁর প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের স্বরূপও উদঘাটিত হয়েছে আলোচ্য কাব্যে। মধ্যযুগের অন্য কোনো কাব্য বিষয় মাহাত্ম্যে, অকৃত্রিমতায়, তথ্যনিষ্ঠায়, সরল প্রাঞ্জল বাক্যগুণে, দর্শন, ইতিহাস ও কাব্যের অভূতপূর্ব সমন্বয়ে এমন গৌরব অর্জন করতে পারেনি যা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্য পেরেছে। বৈষ্ণব ধর্মের একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ -এর মূল্য অনস্বীকার্য। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ – মূল প্রতিপাদ্য চৈতন্য দেবের জীবনচরিত নয় বরং প্রেম ও ভক্তিরসের যে বিগ্রহরূপে চৈতন্যদেব আরাধ্য সেই চরিতামৃতের এবং সেই প্রেম ও ভক্তিবাদের ব্যাখ্যান। চৈতন্যদেবের জীবনী অপেক্ষা যুক্তিতর্ক দিয়ে বৈষ্ণব দর্শনের প্রতিষ্ঠাই ছিল কৃষ্ণদাসের লক্ষ।

‘চৈতন্যচরিতামৃত ’ কাব্যটি আদি, মধ্য, অন্ত – এই তিনটি লীলাপর্বে বিভক্ত। প্রতিটি লীলা আবার কয়েকটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত –
৹ আদিলীলায় – চৈতন্যমহাপ্রভুর গার্হস্থ্য জীবনের প্রথম চব্বিশ বছরের কথা জানা যায়, এই ভাগে পরিচ্ছেদের সংখ্যা সতেরো।
৹ মধ্যলীলায় – চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে শেষ তীর্থ ভ্রমণ পর্যন্ত ছয়বছরের কথা পাওয়া যায় উক্ত লীলায় পঁচিশ সংখ্যক পরিচ্ছেদ।
৹ অন্তলীলায় – চৈতন্যদেবের শেষ আঠারো বছরের বৃত্তান্ত জানা যায় উক্ত লীলার পরিচ্ছেদের সংখ্যা কুড়ি।
সবকটি লীলার পরিচ্ছেদ মিলিয়ে বাষট্টিটি পরিচ্ছেদ পাওয়া যায়। প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শীর্ষে একটি করে স্বরচিত শ্লোক পাওয়া যায়। তত্ত্বকথা সব লীলার মধ্যেই লক্ষ করা যায় বিশেষ করে আদিলীলা ও মধ্যলীলায়। এক কথায় ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ – গীতা, গীতগোবিন্দ, অমরকোষ, পাণিনিসূত্র প্রমুখ গ্রন্থের প্রভাবে পুষ্ট একটি কাব্য।
আদিলীলাই চৈতন্যচরিতামৃতের প্রধান অংশ বলা যায়।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে বৃন্দাবন দাসকে অনুসরণ করেছিলেন নবদ্বীপ লীলা বর্ণনায় –
“নবদ্বীপলীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস।”
কবি শ্রীমদ্ভাগবত, গীতা, ব্রহ্মসংহিতা প্রভৃতি নানা শাস্ত্রসমুদ্রে ডুব দিয়ে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সহ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাভূমি নির্মাণ করেছেন আলোচ্য কাব্যে –
“কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার।”
মধ্যলীলায় আছে সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভুর নীলাচলে অবস্থান পর্যন্ত ছয় বছরের কথা। এই অংশ কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিয়েছিলেন বৃন্দাবন দাস, মুরারি গুপ্ত ও কবইকর্ণ পুরের সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে।
অন্তলীলায় চৈতন্যদেবের নীলাচলের শেষ সতেরো – আঠারো বছরের লীলা বর্ণিত করা হয়েছে। এই সময়ে মহাপ্রভুর দিব্যোন্মাদ অবস্থা। এই লীলাবর্ণনায় কি তত্ত্ববিশ্লেষণে, কি তথ্যনিষ্ঠায়, কি আপনার ভাবমাহাত্ম্যে – কৃষ্ণদাস অভাবনীয় সার্থকতা লাভ করেছিলেন। তাঁর কাব্য বৈষ্ণব দর্শনকে উপলব্ধি করার দর্পন বলা যায়। পরিমিত কাব্য বিন্যাস, ভক্তিতন্মায়তা ও অলংকারের সমন্বয়ে ‘চৈতন্যচরিতামৃত ’ দর্শন ও কাব্যের মুক্তবেণী বলা যায় ।
‘ চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যে কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ সবরকম ‘রচনাছাঁদ’ – এই রচনা করেছেন, কঠিন ছাঁদ এর উদাহরণ যেমন –
“ভ্রম প্রমাদ বিপ্রলিপসা করণাপাটব।
ঈশ্বরের বাক্যে নাহি দোষ এই সব॥
উপনিষৎ সহিত সূত্র কহে যেই তত্ত্ব।
মুখ্যবৃত্তি সেই অর্থ পরমমহত্ত্ব॥
গৌণবৃত্ত্যে যেবা ভাষ্য করিল আচার্য্য ।
তাহার শ্রবণে নাশ হয় সর্ব্ব কার্য্য॥
ঈশ্বরের তত্ত্ব যেন জ্বলিত জ্বলন ।
জীবের স্বরূপ যেছে স্ফুলিঙ্গের কণা॥
পরিণামবাদে ঈশ্বর হয়েন বিকারী।
এত বলি বিবর্তবাদ স্থান যে করি॥
বস্ত্তত পরিণামবাদ সেইত প্রমাণ।
দেহে আত্মবুদ্বি বিবর্তের স্থান॥”
নরম ছাঁদের উদাহরণ –
“কহিবার কথা নহে           কহিলে কেহ না বুঝয়ে
ঐছে   চিত্র চৈতন্যের রঙ্গ।
সেই সে বুঝিতে পারে         চৈতন্যের কৃপা যারে
হয় তাঁর দাসানুদাস – সঙ্গ ॥”
অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব , সাধ্যসাধন তত্ত্ব , রাগানুগা ভক্তি সখিসাধনা ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক জটিল ধর্মতত্ত্বকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর উপমা, সুভাষিত ও ছন্দের ব্যবহার সহজবোধ্য করে তুলেছেন।
রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বের এমন সরল ও নিপূণ ব্যাখ্যা যেভাবে কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ করেছেন, সেই ভাবে অন্য কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায়নি-
“সচ্চিৎ আনন্দময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
এতএব স্বরূপ শক্তি হয় তিন রূপ॥
আনন্দাংশে হ্লাদিনী সদংশে সন্ধিনী।
চিদংশে সম্বিৎ যারে জ্ঞান করি মানী॥”
বৈষ্ণব মতে, এই সম্বিৎ, আনন্দ এবং সৎ একত্র ‘মহাভাব’ রূপে উদগত হলে কৃষ্ণপ্রেমের উদ্ভব ঘটে। রাধা হলেন সেই মহাভাব স্বরূপিনী,  কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাই লিখেছেন – “সেই মহাভাবরূপা রাধা ঠাকুরানী।”
কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ বলতে গিয়ে কবি বলেছেন –
“কৃষ্ণপ্রেম সুখ সিন্ধু           পাই তার এক বিন্দু
সেই বিন্দু জগৎ  ডুবায় ।।”
কৃষ্ণপ্রেমের গঙ্গাজল বিধৌত ভক্তকবি কৃষ্ণদাসের নির্মল, স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র ও মহৎ হৃদয়ের স্বরূপটি সুপরিস্ফুট উক্ত কাব্য।
ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের ভেদাভেদ কি, সেই সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে কবি ‘ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যের আদিলীলার সপ্তম পরিচ্ছেদে বলেছেন –
“ঈশ্বরের তত্ত্ব যেন জ্বলিত জ্বলন। / জীবের স্বরূপ যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ॥”
চৈতন্যদেবের ধর্মের মিস্টিসিজমের অন্ত:প্রবাহ সবচেয়ে নির্ভুলভাবে এবং সর্বপ্রথম ‘ চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যেই গ্রন্থিত হয়েছে। ‘মহাবাউলের’ উল্লেখ সর্বপ্রথম এই কাব্যেই পাওয়া যায় –
“দশেন্দ্রিয় শিষ্য করি     মহা – বাউল নাম ধরি
শিষ্য লঞা করিল গমন ।
মোর দেহ স্বসদন      বিষয়ভোগ মহা – ধন
সব ছাড়ি গেলা বৃন্দাবন॥”
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ সহজপন্থী সাধকদের পরম বেদ বলে ধরা হয়। পুরোনো তান্ত্রিকযোগীদের পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজই প্রথম পরমতত্ত্বকে ‘সহজ বস্তু’ বলে গণ্য করেছেন।

‘চৈতন্যচরিতামৃত’ -এর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ –
১/ চৈতন্যজীবনী বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থটির মধ্যে বিষয়, বৈচিত্র্য, সংকলন, কবিত্বময় ভাষার অপূর্ব নিদর্শন লক্ষ করা যায়।
২/ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটিতে চৈতন্য তত্ত্ব ও চৈতন্যপ্রচারিত ধর্মের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।
৩/ উক্ত গ্রন্থটি দার্শনিক তত্ত্বে সমৃদ্ধ। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে রাধার প্রেমকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়েছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ -এর উক্তি থেকে তাই পাওয়া যায় –
“ প্রেমের পরম রস ‘মহাভাব’ জানি । সেই মহাভাবরূপা রাধা ঠাকুরানী।। ”
৪/ মহাপ্রভুর অবতারতত্ত্ব ও লীলারহস্য রচনায় উক্ত কাব্যটির তুলনা নেই।
৫/ কবিত্বের সঙ্গে ভক্তি নিষ্ঠার যথাযথ মেলবন্ধন ঘটেছে উক্ত কাব্যটিতে। আলোচ্য গ্রন্থটিতে এমন অনেক পংক্তি আছে, যা অনুভাবের প্রগাঢ়তায় অসামান্য –
“না সো রমণ না হাম রমণী।
দুঁহমন মনোভাব পেষনি জনি ।।”
চৈতন্য দেবকে অবলম্বন করে যে জীবনী গ্রন্থগুলি রচিত হয়েছে, সেইগুলির মধ্যে  ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটি যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আলোচ্য কাব্যটিতে চৈতন্যদেবের জীবনদর্শনের পাশাপাশি গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের মূল বিষয়গুলো যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তা এক কথায় বৈষ্ণব তত্ত্ব – সমুদ্রে ঝিনুকে মুক্ত দর্শনের ন্যায়।

জীবনী – কাব্যগ্রন্থ হিসেবে চৈতন্যচরিতামৃতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব:-
‘চৈতন্যচরিতামৃত ’ বাংলা ভাষা – সাহিত্য – ধর্ম – সংস্কৃতিচর্চার অভিনব সংযোজন বলা যায় । আলোচ্য গ্রন্থ টি চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবন – যাপন – দর্শন – তত্ত্ব – তথ্যকেন্দ্রিক আকর গ্রন্থ বলা চলে‌। কবি উক্ত কাব্যে ভাষা ব্যবহার যথেষ্ট নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। কবি কাব্যের মধ্যে এত সংখ্যক উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি অলংকার প্রয়োগ করেছেন যে গ্রন্থটি আধুনিক কাব্যচর্চার এবং গদ্যচর্চার নিদর্শন রূপে গন্য করার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা থাকে না।

অধ্যাপক রবিরঞ্জন চট্টপাধ্যায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য অনুভবে ওবিশ্লেষণে’ – গ্রন্থে জানিয়েছেন –“ এই গ্রন্থের গদ্যভাষার চালিকা শক্তি এতই বেশি যে, গদ্যভাষার উদ্ভবকে প্রায় আটকে দিয়েছিল।”

‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ও ‘চৈতন্যভাগবত’ – এর তুলনা মূলক আলোচনা:-
সৈকতভূমি ছাড়া যেমন সমুদ্র দর্শন করা সম্ভব নয় তেমনি ‘ চৈতন্যভাগবত’ ছাড়াও ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ অসম্পূর্ণ বলা হয়ে থাকে। ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রাক – সন্ন্যাস জীবন সম্পর্কে খুব ভালো করে বর্ণনা করা হয়েছে, এখানে চৈতন্যদেবের শৈশব, বাল্য, যৌবন, বিবাহ, অধ্যাপনা পণ্ডিতদের সঙ্গে বিতর্ক, নগর ভ্রমণ, জগাই – মাধাই উদ্ধার, কাজীদলন প্রমুখ ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘ চৈতন্যচরিতামৃত ’ গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবের অবতার লীলা,  বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষের দিকের কথা অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
‘চৈতন্যভাগবত’ যেখানে তথ্য সমৃদ্ধ ‘চৈতন্যচরিতামৃত ’ – এ তেমনি পাওয়া যায় তত্ত্বের সমাহার –
“কৃষ্ণতত্ত্ব রাধাতত্ত্ব প্রেমতত্ত্ব – সার।
রসতত্ত্ব, লীলাতত্ত্ব, বিবিধ প্রকার।।
তবে প্রভু হাসি তারে দেখাল স্বরূপ।
রসরাজ মহাভাব দুই একরূপ।।”
কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৈতন্যভাগবত’ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন, গ্রন্থের সম্পূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা দুই তাঁর জানা ছিল। তিনি জানতন ‘চৈতন্যভাগবত’ -এর প্রথমাংশ অতিকথনে বিস্তৃত, মধ্যাংশ নাতি বিস্তারিত এবং শেষাংশ অতি ক্ষীণতার সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে। সুতরাং, এই কথা মাথায় রেখেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর কাব্যে অন্তলীলা সবিস্তারে বলেছেন–
“বৃন্দাবনদাসের পাদপদ্ম করি ধ্যান।
তাঁর আজ্ঞা লঞা লিখি যাহাতে কল্যাণ।‌।
চৈতন্য লীলাতে ব্যাস বৃন্দাবন দাস।
তাঁর কৃপা বিনা অন্যে না হয় প্রকাশ।।”
‘ চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীচৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সময় নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, জগদানন্দ, মুকুন্দ প্রমুখ অনুচরেরা যেতে চাইলে কাউকে তিনি সঙ্গী করতে চাননি শুধুমাত্র কৃষ্ণদাসকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান – কোনো খাবার, বস্ত্রাদি, অনুষঙ্গিক কিছু নেওয়া যাবে না –
“ কৌপীন বহির্বাস আর জলপাত্র।
আর কিছু সঙ্গে নাহি যাবে এইমাত্র।।”
কিন্তু ‘চৈতন্যভাগবত’ -এ সকল তথ্য দেওয়া নেই।

সতুরাং, চৈতন্যমহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বের কাহিনী জানার জন্য যেমন  ‘চৈতন্যভাগবত’ পাঠ আবশ্যক তেমনি সন্ন্যাস গ্রহণের পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য  ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ পাঠ আবশ্যক। তাই বলাই যায় চরিতকাব্য হিসেবে এই দুটি কাব্য একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্য হল তত্ত্বের ভাণ্ডার। এই গ্রন্থটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্ববিশ্ব।